আমি ব্যাকরণবিদ নই। তবু ধারণা করি, জ্ঞাত হওয়া থেকে জ্ঞান শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। কোন কিছু জানাকে জ্ঞান বলে। সেটা ভাল হোক বা মন্দ হোক, সবই জ্ঞান। ব্যবহারিক পরিমণ্ডলে ভাল-মন্দের হিসাব নিকাশ আসে। জ্ঞান ভাল-মন্দ নিরপেক্ষ। কিভাবে এই জ্ঞানের জন্ম হয়? একজন দার্শনিক বা এপিষ্টেমোলজিস্ট তার জ্ঞানগর্ভ তত্ত্বালোচনার মাধ্যমে এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন। আমি দার্শনিকও নই। আমি এই প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করবো নিজস্ব পঠন, অধ্যয়ন, চিন্তন ও অভিজ্ঞতার আলোকে।

প্রকৃতি অসীম তথ্যের আধার। মানুষ যখন সেই তথ্যসমূহ নিজেদের জন্যে আহরণ করে কেবল তখনই তা জ্ঞানে পরিণত হয়। তারমানে সেই অর্থে প্রকৃতি জ্ঞানী নয়, শুধুমাত্র তথ্যের আধার। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসতে পারে, মানুষ কখন প্রকৃতির তথ্যভাণ্ডার থেকে তথ্য আহরণ করে বা জ্ঞান আহরণ করে? মানুষের মস্তিষ্কে প্রকৃতি এমন কিছু বৈশিষ্ট্যের সন্নিবেশ ঘটিয়েছে, যার ফলে তাকে জ্ঞান আহরণ করা লাগে। মানুষের কৌতূহল, প্রয়োজন ও প্যাশান বা প্রেমই হলো সেইসব প্রকৃতি প্রদত্ত গুণপনা, যার কারণে সে জ্ঞানার্জনে সক্রিয় হয়। শুধু জ্ঞান অর্জন করলে বা কাঁচা তথ্য সংগ্রহ করলেই তা কাজের উপযোগী বা পরিপক্ব জ্ঞান হয় না। সংগৃহীত জ্ঞানকে ব্যবহার উপযোগী করার জন্যে প্রথম যে উপাদানটা লাগে তার নাম সংশয় বা সন্দেহ। যখনই তথ্যপ্রবাহ সংশয়ের ভিতর দিয়ে এগোতে থাকে, তখনই দরকার হয় মানুষের মনোদেহের আরেকটা অঙ্গের, যার নাম সুপারইগো বা র‍্যাশনালিজম। প্রস্তুত হয় দার্শনিক যুক্তিবাদীতার, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পায় জ্ঞান। প্রায়োগিক জ্ঞানের জন্যে আরও একধাপ এগিয়ে বাস্তব ইন্দ্রীয়গ্রাহ্যতার ভিতর দিয়ে জ্ঞানকে ভ্রমণ করা লাগে। এই ধাপের নাম বিজ্ঞান, যা বাস্তব ও পার্থিব পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও নিরীক্ষার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। তাহলে একটা বিষয় পরিষ্কার হলো, পরিপক্ব জ্ঞান আসলে দুই রকমের- নান্দনিক, যার আপাততঃ ব্যবহার নেই, এবং প্রায়োগিক, যার ব্যবহার হবে বা হচ্ছে। তবে নান্দনিক জ্ঞানের ব্যবহার আজকে হচ্ছে না বলে আগামীতে হবে না সেটা হলফ করে বলা যায় না।

প্রায়োগিক ও নান্দনিক জ্ঞান যে উপায়ের মাধ্যমে নির্বাচিত ও প্রক্রিয়াজাত হয় তাকে ইণ্টিলিজেন্স বা বুদ্ধিমত্তা বলা যায়। এই বুদ্ধিমত্তাও শুধু শুধু কাজ করে না। এর জন্যেও দরকার হয় কিছু জ্বালানির। সেই জ্বালানি আসে কৌতূহল, প্রয়োজন ও প্যশান বা প্রেম থেকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানুষের জ্ঞানার্জনের মূলে রয়েছে তার স্বার্থ। সেটা ভাল হতে পারে, মন্দও হতে পারে। স্বার্থও জ্ঞানের মতন ভাল-মন্দ নিরপেক্ষ। ব্যবহারিক পরিমণ্ডলে তার বিচার। রিচার্ড ডকিন্সের ‘সেলফিশ জিন’ শব্দগুচ্ছ এক্ষেত্রে মানুষের বেলায় সঠিক অর্থ বহন করে। জ্ঞানার্জনে প্যশান বা প্রেম একটা পরোক্ষ বা সেকেন্ডারি উপাদান। সব মানুষের ক্ষেত্রে এটা ক্রিয়াশীল নয়। প্রেম বা নেশাগ্রস্থতার অনেকাংশ জুড়ে থাকে সহজাত প্রবৃত্তি বা ইন্সটিংক্ট। সুক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রায়োগিক জ্ঞানের চেয়ে নান্দনিক জ্ঞান আহরণের ক্ষত্রে প্রেম বা প্যশান প্রাইমারি উপাদান হিসাবে আবির্ভূত হয় বেশী। তারপরেও প্রায়োগিক জ্ঞান আহরণে প্যশান বা প্রেম থাকতে হয় নির্দিষ্ট অনুপানে, সঠিক ও সুন্দরভাবে কার্য সমাধার জন্যে।

চিন্তাবিদগণ বুদ্ধিমত্তাকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন- গাণিতিক বুদ্ধিমত্তা (Mathematical Intelligence), সঙ্গীতীয় বুদ্ধিমত্তা (Musical Intelligence) ও ভাষিক বুদ্ধিমত্তা (Linguistic Intelligence)। বিজ্ঞান, ও গণিতের যত শাখা প্রশাখা আছে, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব, সবই গাণিতিক বুদ্ধিমত্তা সিদ্ধ জ্ঞান। সাহিত্য, কলার যত প্রকারভেদ আছে, সব পড়ে লিঙ্গুইষ্টিক ইণ্টিলিজেন্সের অধীনে। সঙ্গীতীয় বুদ্ধিমত্তার ভিতরে পড়ে যত রকমের সঙ্গীত আছে পৃথিবীতে সব। মানুষের বুদ্ধিমত্তাগত অস্তিত্ব সরাসরি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়- আবেগ আর যুক্তি। বিশুদ্ধ লজিকের উপরে ভর করে যেসব প্রায়োগিক ও নান্দনিক জ্ঞান প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তার মধ্যে গাণিতিক বুদ্ধিমত্তাজাত জ্ঞান সামনের সারিতে চলে আসে। আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে আমরা আবেগকে অকার্যকর একটা বিষয় হিসাবে বিবেচনা করি। আসলে বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। আবেগও এক ধরণের লজিক বা যুক্তি অনুসরণ করে, যাকে বলা হয় ইমোশনাল লজিক বা আবেগীয় যুক্তি। আর যে বুদ্ধিমত্তার উপরে এই লজিক ভর করে প্রতিষ্ঠা পায় তার নাম আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বা ইমোশনাল ইণ্টিলিজেন্স, সংক্ষেপে ই আই।

স্নায়ুবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও দার্শনিকগণের কাছে এই আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। ধরা যাক, কোন কোন লোকের অগুনিত বন্ধু, বন্ধুরা আঠার মত লেগে থাকে তার সাথে, বড় কোন বৈষয়িক স্বার্থ ছাড়াই। কেন এমন হয়? ঐ লোকের দেহভাষায়, মুখের ভাষায় এমন কিছু আছে, যা অবচেতনভাবে মানুষকে কাছে টানে। এটা হতে পারে তার প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদ অথবা সচেতনভাবে অর্জিত সম্পদ। একটা গান, একটা কবিতাও হতে পারে মানুষকে সাথে ধরে রাখার সার্থক উপাদান। চিন্তাবিদগণ তাই পুরা মিউজিকাল ইন্টেলিজেন্সকে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার শ্রেণিতে ফেলেছেন। উদাহরণ দেই, একটা সুপারহিট গানের লিরিক, তার ভিতরে এমন সব শব্দ, শব্দগুচ্ছ, ফ্রেজ রয়েছে যা মানুষের বিশেষ কোন আবেগের সর্বোচ্চ চুড়াকে স্পর্শ করেছে, যা শুনে শ্রোতা কেঁদেছে, হেসেছে, অথবা চেতনা হারিয়ে ফেলেছে। এই গানের স্রষ্টার আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাই এই গান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, যা ছুঁয়ে গেছে শ্রোতার আবেগের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার আরও বহু প্রায়োগিক সাফল্য রয়েছে। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা মানুষের সুখ, শান্তি ও আনন্দকে ম্যক্সিমাইজ বা সম্প্রসারিত করার ক্ষমতা রাখে, আবেগ বা ইমোশন যার কাঁচামাল। অনিয়ন্ত্রিত কাঁচা আবেগ ক্ষতিকর, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত ও সংগঠিত আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা সুখ, সমৃদ্ধি ও সভ্যতা বিনির্মাণের অন্যতম উপাদান।

প্রায়োগিক বা নান্দনিক যে জ্ঞানই হোক, সেটা অর্জন করার পর জ্ঞানী মানুষটির ভিতরে একটা অস্থিরতা কাজ করে সেই জ্ঞান অন্যের মস্তিষ্কে ঢেলে দেবার জন্যে। এমনও অনেক জ্ঞানীকে দেখেছি, প্রচুর সময়, গবেষণা ও শ্রম দিয়ে লেখা বই আশানুরূপ সাড়া না ফেলায় চরম হতাশায় তলিয়ে যেতে। কেন এমন হয়? এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন বিশ্বখ্যাত বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী জেফরি মিলার। তিনি বলছেন, মানুষের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জনের পিছনে রয়েছে যৌন নির্বাচনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ও অনুপ্রেরণা। বাড়ির সামনে বড় একটা পাথর দাড়িয়ে থাকাটাই তো যথেষ্ট ছিল, কেন তাকে ঘষে মেজে একটা দর্শনীয় মূর্তিতে রূপ দেয়া হলো? এই কারণে তা করা হলো, যাতে এর মাধ্যমে মানুষ নিজেদের সুখ, আনন্দ, সমৃদ্ধি ও সভ্যতার উচ্চতাকে বাড়াতে পারে এবং সেই সাথে সাথে এর স্রষ্টার প্রতি আকৃষ্ট হয়, যে আকর্ষণের মূলে কাজ করে যৌনতা। পরিশেষে এই যৌনতাই যৌন নির্বাচনের মাধ্যমে উন্নত প্রজাতি সৃষ্টিতে অবদান রাখে। প্রকৃতির মূল উদ্দেশ্য উন্নত প্রজাতি সৃষ্টি, যার মৌলিক উপাদানের নাম জ্ঞান।

জ্ঞান অর্জন করে বা সেই জ্ঞানকে প্রকাশ করে আশানুরূপ সাফল্য না পেয়ে হতাশার কিছু নেই। প্রিন্টিং মিডিয়া হোক, বা ইলেকট্রনিক বিশাল মিডিয়া হোক, ছেড়ে দিন আপনার অর্জিত জ্ঞান। কেউ না কেউ তার প্রয়োজন মত খুটে নেবে। জ্ঞান দ্বারে দ্বারে ফেরি করে না বেড়িয়ে, এটা করা অনেক ভাল। কেউ যখন জ্ঞানের মুখাপেক্ষী না হয়, তাকে জ্ঞান দিতে নেই, এটা আমার ব্যক্তিগত মত। ডিজিটাল সাইবার জগত কত যথার্থভাবে আমার সেই আইডিয়াকে রূপ দিয়েছে ভেবে অবাক হই। এই ভাবে নিজের জ্ঞানকে ওপেন সোর্সের মাহফিজখানায় জমা দিয়ে আপনি নিজেও হতে পারেন পৃথিবীকে জ্ঞানদানকারী গর্বিত একজন। কি হবে অত নাম কাম দিয়ে? তারপরেও যদি কেউ আপনাকে খুঁজে পেয়ে কাছে আসে, প্রশংসা করে, বন্ধু হয়ে জেফরি মিলারের তত্ত্বকে বাস্তবে রূপ দেয় দিক, তাতে সেটা না হয় হবে উপরি পাওয়া। অনেকে বলেন, অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী। এই ধারণার সাথে আমি একমত নই। অল্পবিদ্যা যদি কাজের হয়, তবে তা অলস পড়ে থাকা বেশী বিদ্যার থেকে কল্যাণময়। অল্পবিদ্যার সমস্যাটা হলো, তা প্রকাশ হবার সময় বড্ড বিশ্রীভাবে প্রকাশ হয়। তার প্রকাশের শব্দটা বড় বেশী কানে বাজে। এছাড়া অল্পবিদ্যার আর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। কেউ যখন স্বাধীন চিন্তার জগতে উড়তে শিখে যায়, সে তখন কিছুটা আন্দাজ করতে পারে জ্ঞানের সীমানা প্রাচীর আসলে কতদূর বিস্তৃত। সেই সাথে সাথে সে নিজে কতটা জানে না, সে বিষয়েও একটা ধারণা নিতে পারে। তখন সে চুপ হয়ে যায়। খালি কলস হয়ে বেশী বেশী না বেজে ভরা কলস হয়ে যায়। মুক্ত চিন্তার জগতে প্রবেশ করতে হলে অনুশীলনের কোন বিকল্প নেই। যারা প্রকৃত জ্ঞানী তারা জ্ঞানার্জনের সাথে সাথে অন্যকেও এই মুক্ত চিন্তার আকাশে উড্ডয়নের পাঠ দেয় তাদের সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে। এটা তারা নিজেদের কর্তব্য বলে বিবেচনা করে।