প্রায় বছর দুয়েক আগে বিজ্ঞানযাত্রা‘র একটা অনলাইন লড়াইয়ের কথা মুক্তমনায় লিখেছিলাম। সেখানে শেষে লিখেছিলাম, “স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অনেকগুলো পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।” তারপর অল্প অল্প করে আমরা কিছু কাজ করেছি। কিছুদিন আগে সেইরকমই একটা কাজ করে খুব তৃপ্তি পেয়েছি। সেটার খবর আর বিস্তারিত আপনাদের জানাতেই এই লেখা।

গত ৮ মে, ২০১৮ মঙ্গলবার সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের ক্ষুদে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল একদিনের বিজ্ঞানমেলা। এই মেলার আয়োজনে ছিল বিজ্ঞানপ্রেমী আমরা একদল তরুণ, যারা সকলেই বিজ্ঞানযাত্রা নামের পত্রিকা ও অনলাইন ফোরামের সক্রিয় সদস্য। আপনারা জেনে খুশি হবেন যে এই মেলাটি ছিল আমাদের চতুর্থ উদ্যোগ, এর আগে গত এক বছরে আমরা আরো তিনটি অনুরূপ মেলা আয়োজন করেছিল শ্রীনগর, রাউজান, এবং লক্ষীপুরে। এবারের চতুর্থ আয়োজনে সিলেটে প্রথমবারের মতো ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে গিয়েছিলাম সবাই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের আগ্রহী ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে বিজ্ঞান চর্চার আনন্দ ছড়িয়ে দেয়াই আমাদের এই মেলাগুলোর মূল উদ্দেশ্য। বরাবরের মতোই এবারে ছিল নানারকম নতুন বিষয়ের ওপর দশ-পনেরো মিনিটের পরিবেশনা, ছিল মনোমুগ্ধকর একডজন পোস্টার প্রদর্শনী, এবং বাংলায় নির্মিত বিভিন্ন বিজ্ঞানবিষয়ক ভিডিওর আয়োজন। এছাড়াও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বানানো অনেকগুলো বিজ্ঞান প্রকল্পের প্রদর্শনীও হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক জিতেন্দ্র ভট্টাচার্য স্যার এবং অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ, আর বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশ

সকালে ঢিমেতালে চলতে থাকা বর্ষণ মাথায় নিয়েই দশটা থেকে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে জড়ো হতে থাকে। পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণীর প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী এসে পড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এরপর প্রথমে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা, এবং প্রধান শিক্ষক এবং অন্য শিক্ষকদের বক্তব্যের মাধ্যমে মূল পরিবেশনা শুরু হয়। মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসতি কি আসলেই সম্ভব, আর হলে তা কবে কীভাবে হবে? কিংবা পুষ্টির ব্যাপারে প্রচলিত কিছু ধারণাগুলো কি আসলে সঠিক না ভুল? এমন নানাবিধ পরিবেশনা আমরা একে একে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে থাকি। পড়ন্ত বস্তু আসলে কীভাবে মাটিতে পড়ে, তা হাতে-কলমে করে দেখালো আমাদের একজন। উৎসুক শিক্ষার্থীরা যখন দেখলো যে একটি মানিব্যাগ আর একটি দামি স্মার্টফোন একসাথে ফেলে দিলে একসাথেই স্টেজে পড়ে গেল, তখন তাদের প্রতিক্রিয়াও ছিল দেখার মতো!

ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের বানানো আধুনিক শহরের মডেল

এর পরে স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাদের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রকল্পগুলো প্রদর্শন করতে থাকে। ‘রকেট’ নামের গ্রুপ নিয়ে এসেছিল দুইটি প্রকল্প, যার একটি ছিল বন্যার পানির উচ্চতা সতর্কীকরণ ব্যবস্থা। এই প্রকল্পে বন্যার পানি একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার বেশি হলেই তীক্ষ্ণ এলার্ম বেজে ওঠে, যা তারা সেখানেই হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখালো। এছাড়াও তারা আধুনিক নগরায়নের আরেকটি প্রকল্প এনেছিল। চারজন মেয়ের একটি গ্রুপ বানিয়েছিল বিদ্যুৎবিহীন পানির পাম্পের একটি নমুনা। পানিভর্তি বোতলের মুখে একটি বেলুন লাগিয়ে তার পাশে পাইপ দিয়ে তারা আরেকটি খালি বোতলে পানি সরিয়ে নিতে পারলো।

সপ্রতিভ ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা

এই প্রকল্পগুলোর প্রদর্শনীর এক পর্যায়ে মেলার বিশেষ অতিথি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল উপস্থিত হন। বাকি প্রকল্পগুলো তিনি নিজেও খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন এবং শেষে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘এই আয়োজনে ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায় তিনি খুবই আনন্দিত। তাদেরকে বেশি বেশি প্রশ্ন করতে হবে, বুদ্ধি বাড়াতে হবে চিন্তা করে, কল্পনা করে, আর অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে তাদের মস্তিষ্কের চর্চাই বিজ্ঞানের পথে তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’ তার পুরো বক্তব্যটা ইউটিউবে আমাদের পেইজে আপলোড করা হয়েছে।

ড. জাফর ইকবালের বক্তব্যের পর মধ্যাহ্ন বিরতি দেয়া হয়। বিরতির পর আবার মেলায় বসে পোস্টারের প্রদর্শনী। cbdtop.club আমরা তাদের বোঝার উপযোগী করে একডজন পোস্টার বানিয়েছিলাম আগেই। সেগুলো দেখে দেখে তারা কতই না প্রশ্ন করলো। একজন তো তার ক্লাসের প্রজেক্টের জন্য একটা পোস্টার চেয়েই বসলো।

প্রশ্নে প্রশ্নে আমাদের নাজেহাল অবস্থা!

এরপরে বিকেলে আরেক দফা পরিবেশনার পালা, যেখানে আরো বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য জানতে পারে শিক্ষার্থীরা। ততক্ষণে শিক্ষার্থীরাও বেশ সহজ হয়ে এসেছে। আমাদের যে সদস্য স্টেজে উঠে পরিবেশনা দিচ্ছে তাকে সাবলীলভাবেই অনেক প্রশ্ন করলো তারা। একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে উৎসাহ পেলে তারা তাদের মনের সরল প্রশ্নগুলোও করতে পারে। উত্তর দিতেও মজা লাগে। আমাদের বয়স্ক মাথা হাজার ভাবলেও হয়তো এমন সরল প্রশ্ন করতে পারতো না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আগে আগে আমরা মেলার সমাপ্তি ঘোষণা করে দেই। মেলার আরো অনেক খুঁটিনাটি নিয়ে একটা চমৎকার লেখা আমাদের সাইটে আছে- লিংক

এবারের মেলাটি আগের তিনবারের চেয়ে আকারে ও পরিসরে অনেক বড় ছিল। আমাদের জন্যেও তা নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। আমাদের লক্ষ্য আগামী বছরে চারটার জায়গায় আটটা মেলা করার। বাংলাদেশের সকল স্কুলে আমরা যেতে চাই, সব জেলায়, সব গ্রামে গিয়ে এমন হাসি-আনন্দে ভরা একটি দিন ছোট ছোট শিশুদের উপহার দিতে চাই। জানি না এতে কতোজনের উপকার হবে, বা কতোজন বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে বেড়ে উঠবে। কিন্তু কিছু না করে হা-হুতাশের চেয়ে এটুকু চেষ্টা করতে তো দোষ নেই, তাই না?

আর সবার কথা জানি না, তবে দুই বছর আগে আমার চিন্তায় অনেক ক্ষোভ আর নেতিবাচকতার সৃষ্টি হয়েছিল। চারপাশের পরিস্থিতিই তেমনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছিল। বিজ্ঞানযাত্রার এই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর দলটাকে পেয়ে একটু একটু করে সেই নেতিবাচকতা কাটিয়ে উঠেছি। এখন চারপাশের পরিস্থিতি ভাবিত করে না। পরিস্থিতির কিছুই তো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, তাই ভেবে কী লাভ? বরং পরিস্থিতি বদলানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করার ইচ্ছা আছে। সেইটুকুই যতটা পারি করি। আমাদের সামনের মেলা আর প্রজেক্টগুলোতে যদি আপনারা কেউ যে কোনোভাবে অংশ নিতে চান, তাহলে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ আর পেইজ অনুসরণ করতে পারেন।

সবাইকে শুভেচ্ছা!