১৯২৩ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর মৃণাল কুমার দাশগুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সুকুমার দাশগুপ্ত এবং মা তরুবালা দাশগুপ্তের তৃতীয় পুত্র ছিলেন মৃণাল কুমার দাশগুপ্ত । সুকুমার দাশগুপ্ত ছিলেন একজন নামী স্কুলশিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে প্রতিটি শিক্ষার্থীর হৃদয়ে তিনি গভীর ছাপ ফেলতে সক্ষম ছিলেন। তার প্রাক্তন ছাত্র আরেকজন বিখ্যাত ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক অমলেন্দু বসুর স্মৃতিচারণে একজন শিক্ষক হিসেবে সুকুমার দাশগুপ্তের অসাধারণ মেধা, ধৈর্য ও নীতিগত আদর্শের কথা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করেন। সুতরাং এমন পিতার সন্তান হয়ে ছেলেবেলা থেকেই নিয়ম-নীতি আর আদর্শিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে মৃণাল ও যে জ্ঞান পিপাসু, অধ্যবসায়ী, স্থিতধী এবং মেধাবী হবেন এটাই স্বাভাবিক।
বরিশালেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথমে মৃণাল ভর্তি হন। পরে সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি ভর্তি হন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি উচ্চ বিদ্যালয়ে। গ্রেগরিতে নবম শ্রেণিতে (১৯৩৮ সাল) থাকার সময় জগন্নাথ কলেজের কনফারেন্স হলে বক্তৃতা দিতে আসেন সেই সময়ের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্র। এই শিশির কুমার মিত্রের বক্তৃতা তাকে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করে। বিজ্ঞানের প্রতি তার সীমাহীন ভালোলাগাটা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু তখনও কি তিনি জানতেন এই শিশির কুমার মিত্র ই তার পরবর্তী জীবনের স্বপ্নদ্রষ্টা হবেন! শিশির কুমার মিত্রকে নিয়ে তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন-
“ ১৯৩৮ সালে আমি সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠলাম। আমাদের প্রধান শিক্ষক রেভারেন্ড ব্রাদার ওয়াল্টার একদিন ঘোষণা দিলেন যে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্র জগন্নাথ হলের কনফারেন্স রুমে জনসাধারণের জন্যে একটি বক্তৃতা দিতে আসছেন। আমরা অনেকে সেই বক্তৃতা শুনতে গেলাম। প্রথম দেখাতেই অধ্যাপক মিত্রের অপূর্ব বাচনভঙ্গি আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছিলাম। খুব সহজ কথায় রেডিও, আয়ন-স্তর এবং এই সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়গুলি তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তার এই বক্তৃতা আমাকে বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। আমি তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম আমি ওনার মত যদি কখনও এত সুন্দর বক্তৃতা দিতে পারতাম ! ওনার মত বড় বিজ্ঞানী হতে পারতাম। কিন্তু তখনো ভাবি নি যে আমার ভবিষ্যৎ জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে উনিই থাকবেন। আমার ভবিষ্যৎ জীবনে বিজ্ঞানের পথে চলাটা ওনার হাত ধরেই আরও সুগম হবে।”
তিনি ঢাকা থেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সেই সময়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রীডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সান্নিধ্য ও মৃণালকে সামনের দিকে চলার অনুপ্রেরণা দেয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকের পর ১৯৪৬ সালে তিনি স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় বসলেও ১৯৪৭ সালের মাঝামাঝি এসে পরীক্ষার ফল বের হয়। কিন্তু ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ এর এই সময়টা ছিল ভীষণ উত্তাল। দেশভাগ, জিন্নাহ এর দ্বিজাতি তত্ত্ব নীতি এ সব মিলিয়ে যে গোষ্ঠীগত সংঘাত ও ধর্মীয় দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তাতে পূর্ববঙ্গের অনেক হিন্দু পরিবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। দাশগুপ্ত পরিবার ও এর ব্যতিক্রম ছিল না।স্নাতকের মতই স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই গবেষণা বৃত্তি নিয়ে সেখানে থাকতে চাইলেন। কিন্তু পরিবেশের চাপে ও সেই সময়ের ধর্ম ও দেশভাগ নিয়ে সৃষ্টি অরাজকতায় পরিবার ও তাকে কলকাতায় চলে যেতে বললেন।
১৯৪৭ সালে দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিনে পরিবারের সাথে তিনিও দেশত্যাগ করলেন। কলকাতায় পৌঁছানোর পড় বেশ কয়েকমাস কেটে গেল তার চাকরির খোঁজে। অবশেষে একদিন তিনি সকালের অমৃতবাজার পত্রিকায় অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্রের সাথে কাজ করার জন্যে একজন গবেষণা সহকারীর পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে সেখানে আবেদন করলেন।অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্র ছিলেন সেই সময়ের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের “ ঘোষ অধ্যাপক”। তিনি সেই সময়ে প্রধানত দুইটি বড় প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। একটি হচ্ছে তার বিখ্যাত বই “দ্য আপার এটমোস্ফিয়ার” – এইটির পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ। অন্যটি ছিল আরেক বিখ্যাত অধ্যাপক মেঘনাদ সাহার সাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে “রেডিও ফিজিক্স এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স” নামে সম্পূর্ণ একটি নতুন বিভাগ তৈরির কর্মযজ্ঞ।
মৃণাল এখানে এসে প্রথমে এস কে মিত্রের (শিশির কুমার মিত্র) অধীনে সক্রিয় নাইট্রোজেন নিয়ে গবেষণা করেন। অবশ্য অল্প কিছুদিন পরেই ভারত সরকারের ওভারসিজ স্কলারশিপ নিয়ে তিনি বিলেতে পাড়ি জমান রেডিও এস্ট্রোনমি-র উপর গবেষণা করতে। প্রথমে তিনি বিলেতে যাওয়া নিয়ে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু এস কে মিত্র ই তাকে এই বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা করতে উৎসাহ প্রদান করেন। তিনি বলেন,
” আমি চাই যে তুমি বিলেত থেকে নতুন কোন বিষয় শিখে আসো। রেডিও এস্ট্রোনমি একটি নতুন বিষয় আর তাই এখানে গবেষণা ও নতুন কিছু আবিষ্কারের সম্ভাবনা ও প্রবল।”
বেতারীয় জ্যোতির্বিদ্যা বা রেডিও এস্ট্রোনমি হচ্ছে জ্যোতির্বিদ্যার একটি উপশাখা যেখানে বেতার তরঙ্গের সাপেক্ষে মহাজাগতিক বস্তুকণা সম্পর্কে অধ্যয়ন করা হয়। বস্তুতঃ এর মাত্র বছর বিশেক আগে থেকে রেডিও এস্ট্রোনমি নিয়ে টুকটাক গবেষণা শুরু হয়। কার্ল জানস্কি বেল ল্যাবে বসে ট্রান্স আটলান্টিক টেলিফোন সংক্রান্ত গবেষণায় এই মহাজগতীয় রেডিও কলহের কথা বুঝতে পারেন। এরপরে ১৯৪০ সালে আমেরিকান বিজ্ঞানী গ্রোটে রেবার ও এই সম্বন্ধে জোরদার প্রশ্ন তুললেন। আস্তে আস্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর গবেষণার বিষয় হিসেবে এই রেডিও এস্ট্রোনমি ঠাই করে নিল। সেই সময়ে অধ্যাপক পি এম এস ব্ল্যাকেট ছিলেন ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। অধ্যাপক ব্ল্যাকেটের প্রচেষ্টায় সেই সময়ের সবচে আধুনিক রেডিও এস্ট্রোনমি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ম্যানচেস্টারে। অধ্যাপক এস কে মিত্রের সাথে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছিল অধ্যাপক ব্ল্যাকেটের। তাই বিলেতে আসার পর তার সহযোগিতায়ই ম্যানচেস্টারে “জডরেল ব্যাংক এক্সপেরমিনেটাল স্টেশন” নামের সেই বিখ্যাত গবেষণাগারের অধিকর্তা অধ্যাপক লোভেলের অধীনে মৃণাল তার গবেষণা শুরু করেন। এখানে আসার পর তার সহকর্মী ছিলেন আরেকজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার রোজার জেনিসন। দাশগুপ্ত ও জেনিসন এই দুজনের প্রচেষ্টাতে আবিষ্কৃত হল অজানা এক ডাবল রেডিও গ্যালাক্সি। তাদের গবেষণার মধ্য দিয়েই প্রথম কৃষ্ণগহ্বরের পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় যে সময়ে কৃষ্ণগহ্বরের ধারণাই অনেকের কাছে অধরা ছিল।
১৯৫৪ সালে পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভের পর তিনি কলকাতায় ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিও ফিজিক্স এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হলেন। এই বিভাগের উন্নতিতে তার অবদান অপরিসীম। এই বিভাগেই তিনি নানা সময় বিভিন্ন উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকেছেন। ১৯৯১ সালে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে অবসর নিলেও নানা সময় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বক্তৃতা দেয়ার মাধ্যমে তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি কলকাতা বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামের ” এস্ট্রোনমি এন্ড প্ল্যানেটোরিয়াম সায়েন্স” কোর্সের অধিকর্তা হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। তার অধীনে অভিসন্দর্ভ সম্পন্ন করা বিভিন্ন ছাত্র ছাত্রী নানা সময় বিভিন্ন বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানী এবং গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার বিশেষ করে তরঙ্গ সম্পর্কীয় গবেষণায় তার খ্যাতি ছিল প্রবাদপ্রতিম। নেচার বা ফিল ম্যাগের মত জার্নালগুলিতে তার বেশ কয়েকটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়। তার উল্লেখযোগ্য অবদানগুলি হলঃ
● The sudden enhancement of the integrated field intensity of atmospherics subsequent to nuclear bomb explosions of megaton range.
● The gradual enhancement of the integrated field intensity of atmospherics prior to the incidence of Nor’westers.
● The solar cycle dependence of the incidence of sporadic E (ES) – a global picture
● The variability of solar microwave radiations.
● The effect of a total solar eclipse on microwave line-of-sight propagation and also on ionosphere electron content.
● The effect of earth’s orbital eccentricity on incident solar flux at 10.7 cm.
● Studies on solar radio burst in relation to other solar optical features.
● Spectral studies on different types of solar microwave emission – basic component, slowly varying and burst components
রেডিও এস্ট্রোনমি নিয়ে গবেষণায় অধ্যাপক দাশগুপ্তের মৌলিক গবেষণার জন্যে ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমি তাকে ১৯৭৪ সালে একজন ফেলো নির্বাচন করে। বেনারসে ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত ৬৮ তম বিজ্ঞান কংগ্রেসে তিনি প্রকৌশল বিভাগে সভাপতিত্ব করেন। এছাড়া ও ১৯৮৮ সালে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে অনুষ্ঠিত কৃষ্ণগহ্বরের ওপর আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামে তাকে তার মৌলিক গবেষণার জন্যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। গবেষণাগারের বাইরে গিয়েও তিনি জনগণকে বিজ্ঞান সচেতন করতে অপরিসীম চেষ্টা চালাতেন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নানা সময়ে বিজ্ঞান বিষয়ে প্রচুর লিখেছেন। বাঙলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় তিনি ছিলেন একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
অধ্যাপক দাশগুপ্ত ১৯৫৫ সালে শ্রীমতী দিপালীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার মেয়ে বিয়ের পর বিলেতে চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ী হন। পুত্র অনিন্দ্য দাশগুপ্ত তড়িৎকৌশলে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হয়েছেন। অধ্যাপক দাশগুপ্তের কর্মযজ্ঞময় জীবনে স্ত্রী দীপালীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সদা ব্যস্ত এই মানুষটির গৃহের সকল দায়িত্ব নিপুণ হাতে দীপালী সামলাতেন।
২০০৩ সালে তার গুরুতর হার্ট এটাক হয়। কিন্তু এরপরেও তিনি বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামে তার কাজ চালিয়ে যান। পাশাপাশি বিভিন্ন দৈনিক , পাক্ষিক ও গবেষণাপত্র নিয়মিত পাঠ করতেন। কোন গবেষকের সাফল্য শুনলে তিনি তাকে ফোন দিয়ে বা চিঠি লিখে সাধুবাদ জানাতে কার্পণ্য বোধ করতেন না। মানুষটি সবমসয় ছিলেন এক নিরবিচ্ছিন্ন অনুপ্রেরণার আধার।
অধ্যাপক দাশগুপ্ত নিজে একজন ভীষণ ক্রীড়ামোদী ছিলেন। তিনি নিজেও খুব ভাল ব্যাডমিন্টন খেলতে পারতেন। ২০০৫ সালের নভেম্বরের ২৮ তারিখ সোমবার রাতে ভারত ও শ্রীলংকার একটি এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ হচ্ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ম্যাচটিতে শচিন টেন্ডুলকার প্যাভিলয়নে ফেরবার পর ভারতের জেতার আশা প্রায় শেষ হয়ে যায়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তিনি খানিকটা হতাশ ও অবসন্ন হয়ে পড়েন। দুর্বল হৃদযন্ত্রের পাশাপাশি এই মানসিক আঘাত কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে চিরদিনের জন্য নীরব করে দেয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বেতার তরঙ্গ নিয়ে মৌলিক গবেষণার পথিকৃৎ এই মানুষটিকে আজ ও সারা বিশ্ব নতশিরে স্মরণ করেন।
Biog.Mem. Fell. INSA, N. Delhi 30 209-220 (2006)
Professor Sisir Kumar Mitra – As I Remember Him by Mrinal Kumar Das Gupta, Resonance, July 2000
– লেখক
অতনু চক্রবর্ত্তী
অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, পুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
আমার শ্বশুরমশাই অধ্যাপক বিজ্ঞানী মৃণাল কুমার দাশগুপ্ত যখন মারা যান তখন এত ব্যাপকভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচলন ছিল না।তাই বড় নীরব ছিল তাঁর চলে যাওয়া..রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়েছিল একটি অনুষ্ঠান,ফোনে সংযোগ করা হয়েছিল আমাদের সঙ্গে।সেই শোক প্রকাশের ঝটিকা সফরে বিহ্বলতা ছাড়া আর কিছুই ব্যক্ত করা সম্ভব হয় নি।জ্ঞান-বিজ্ঞান পত্রিকা এবং আরো একটি বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা থেকে আমাকে মানুষ মৃণালকুমার সম্পর্কে কিছু লিখতে বলা হয়েছিল।মনে আছে লিখেছিলাম *ভরা থাক স্মৃতিসুধায়* …মহাকাশের রহস্যমোচনে ব্রতী বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁকে তুলে আমি ধরি নি,বরং অতি স্নেহপ্রবণ একজন ভীষণ সংসারী মানুষ হিসেবে তাঁকে প্রতিদিনের জীবনে যেমন পেয়েছিলাম তেমনটাই ব্যক্ত করেছিলাম।নিখুঁত হিসেবে পুরনো ডায়েরীর পাতায় ফুটিয়ে তুলতেন নিত্যদিনের বাজারদর,তারই পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য
স্লাইড আর ফুটনোটে সুন্দর হস্তাক্ষরে ফুটিয়ে তুলতেন রেডিও ফিজিক্সের নানান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।নাতিদের পাশে শুয়ে কখনো শোনাতেন পুরাতন ভৃত্য,মহেশ কখনো বা
তারা ভরা আকাশে ঈষৎ রক্তাভ মঙ্গলগ্রহ চেনাতেন।কোলকাতা সায়েন্স কলেজে রেডিও ফিজিক্স বিভাগের প্রধান হিসেবে অবসর গ্রহণ করার পরেও যুক্ত ছিলেন দীর্ঘকাল।ওঁনার নামের পাশে ছিল মস্তবড় লেজ–FSC FNA ইত্যাদি..
এশিয়াটিক সোসাইটি,বিড়লা প্লানেটোরিয়াম,সঙ্গীত রিসার্চ একাডেমী(SRA),গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নানা রকম দায়িত্বপূর্ণ পদে.. বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনায় নিজে ব্যস্ত থাকতেন আর আমাকেও উৎসাহ দিতেন লেখার জন্য..কারণ সাহিত্য বিষয়েও তাঁর আগ্রহ কিছু কম ছিল না।তাই কিছু লিখলেই আমার অভ্যাস হয়ে উঠেছিল মা ও বাবাকে পড়ে শোনানো।গীতার শ্লোক লিখে তার ব্যাখ্যা লিখে রাখা,ভাল কবিতা টুকে রাখা,বিচ্ছিন্ন স্মৃতির টুকরো দিন ক্ষণ সাল ধরে টুকরো ছবির মত লিখে রাখতেন..এই সমস্ত টুকিটাকি অনেক কিছুই আমি ওঁনার কাছ থেকে শিখেছি।
খুব ভোরে উঠে নিজের হাতে চা বানিয়ে নিতেন,সঙ্গে খেতেন কুড়মুড়ে মাখন মাখানো কড়া টোস্ট,এই সুস্বাদু টোস্ট আর চা এর লোভে আমিও উঠে পড়তাম সকাল সকাল।বের হয়ে যেতেন প্রাতর্ভ্রমণে,মুঠো ভরে কুড়িয়ে আনতেন কোনদিন শিউলি কোনদিন বা চাঁপা–এসে হাসি মুখে আমার হাতে দিতেন।কাঁচের পাত্রে জল দিয়ে ফুল গুলো রেখে দিতাম..সারাদিন হালকা সৌরভে ঘরটা ভরে থাকতো।
বাবার মৃত্যুর পর কোলকাতা সায়েন্স কলেজে একটা সভার আয়োজন করা হয়েছিল–প্রথমে ছিল স্মৃতিচারণ পর্যায়,রেডিও ফিজিক্স বিভাগ আত্মীয় বন্ধু এবং বিশিষ্ট কিছু মানুষকে ব্যক্তি মৃণালকুমার সম্পর্কে বলতে অনুরোধ করেছিলেন।টুকরো টুকরো ছবিতে আমার চেনা মানুষটা অচেনা পরিসরে ছড়িয়ে যাচ্ছিলেন।স্নেহশীল অনুভূতিপ্রবণ ঘোরতর সংসারী মানুষটা একজন যে দক্ষ প্রশাসনিক এবং জনপ্রিয় ছাত্রদরদী শিক্ষক ছিলেন তা জানতে পেরেছিলাম।
ম্যাঞ্চেস্টারে গবেষণাকালে বাবার সহকর্মী ছিলেন রজার জেনিসন–প্রগাঢ় সৌহার্দ্য ছিল দুজনের মধ্যে।দেশ এবং কালের ব্যবধানেও সেই বন্ধুত্ব অটুট ছিল।জেনিসনের আঁকা বাবার একটি অবিকল প্রতিকৃতি আমাদের কাছে পৌঁছে দেন জেনিসনের স্ত্রী।বহু নামী ব্যক্তিত্ব আমাদের বাড়ীতে এসেছেন বাবার সঙ্গে মিলিত হতে ভাবলে অবাক হতে হয়।লোকেশ্বরানন্দজির সঙ্গে বাবার আমৃত্যু অনুরাগের সম্পর্ক ও সংযোগ ছিল..গোলপার্কে যেতেন মিশনের নানান আলোচনা সভাতে।ভরত মহারাজের কাছ থেকে পাওয়া (মহারাজ নিজে হাতে আশীর্বাদ করে লিখে দিয়েছিলেন) বিবেকানন্দ সমগ্র শোকেসে আজও শোভিত।
গম্ভীরানন্দ প্রণীত *শ্রীমা* গ্রন্থটিও স্মারক উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন বাবা।এসব বই শুধু পড়তেন না,লাইনের তলায় দাগ দিয়ে আত্মস্থ করতেন,লিখে রাখতেন পছন্দের অংশ।
ভয়ঙ্কর সুন্দর লেখনী আপনার। সকলের মাঝে বাংলা ও বাঙালির এই মহত্ত্ব ছড়িয়ে দিতে এটা facebook পেজ ‘ফিজিক্সান্বেষী’ তে পোস্ট করতে চাই। আপনার অনুমতি নিলাম ??
আপনি অনুমতি দিলে খুব ভালো হয়
স্বচ্ছন্দে !
স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করুন। আমি বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি বিজ্ঞানীদের জীবনী নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবত পড়াশুনো করবার চেষ্টা করছি। আশা করি সামনে আরও বেশ কিছু লেখা দিতে পারব।
মুক্তমনায় স্বাগতম! চলুক কল্ম, চলুক মুক্তচিন্তা!
ধন্যবাদ । নিয়মিত থাকার চেষ্টা করব।
বাঙালি জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী মৃণাল কুমার দাশগুপ্তকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। তবে আরেকটু যত্ন করে লেখা যেত। যেমনঃ “১৯২৩ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর মৃণাল কুমার দাশগুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন।” — কোথায়? তা পরে জানি যে বরিশালে । কারণ তিনি “বরিশালেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথমে মৃণাল ভর্তি হন।” এমন আরও কিছু বিষয় রয়েছে।
” অধ্যাপক দাশগুপ্ত ১৯৫৫ সালে শ্রীমতী দিপালীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার মেয়ে বিয়ের পর বিলেতে চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ী হন। পুত্র অনিন্দ্য দাশগুপ্ত তড়িৎকৌশলে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হয়েছেন। অধ্যাপক দাশগুপ্তের কর্মযজ্ঞময় জীবনে স্ত্রী দীপালীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সদা ব্যস্ত এই মানুষটির গৃহের সকল দায়িত্ব নিপুণ হাতে দীপালী সামলাতেন।” — পারিবারিক জীবন নিয়ে কেমন যেন দায়সারা কয়েকটী লাইন।।
“অধ্যাপক দাশগুপ্ত নিজে একজন ভীষণ ক্রীড়ামোদী ছিলেন। তিনি নিজেও খুব ভাল ব্যাডমিন্টন খেলতে পারতেন। ২০০৫ সালের নভেম্বরের ২৮ তারিখ সোমবার রাতে ভারত ও শ্রীলংকার একটি এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ হচ্ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ম্যাচটিতে শচিন টেন্ডুলকার প্যাভিলয়নে ফেরবার পর ভারতের জেতার আশা প্রায় শেষ হয়ে যায়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তিনি খানিকটা হতাশ ও অবসন্ন হয়ে পড়েন। দুর্বল হৃদযন্ত্রের পাশাপাশি এই মানসিক আঘাত কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে চিরদিনের জন্য নীরব করে দেয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বেতার তরঙ্গ নিয়ে মৌলিক গবেষণার পথিকৃৎ এই মানুষটিকে আজ ও সারা বিশ্ব নতশিরে স্মরণ করেন।”– –কেমন যেন আগোছালো। শচীনের নাম না থাকলে বুঝতামই না যে এটা ক্রিকেট খেলা। আর খেলা নিয়ে বৈজ্ঞানিকের মৃত্যু! মানতে কষ্ট হয় বৈ কি!
তাছাড়া, লেখকের পরিচয়টিও সম্পূর্ণ হতো যদি পুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া লেখা থাকতো।
অতনু চক্রবর্ত্তীর কাছে আরও লেখা চাই।
ত্রুটি গুলি ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। এরপর থেকে ব্যাপার গুলি লক্ষ রাখব। পাশে থাকবেন । মুক্তচিন্তা চলুক ।
লেখক ও মুক্তমনা ব্লগ কে ধন্যবাদ দেয়া যথেষ্ট নয়। লেখকের আরও লেখা চাই।। বিজ্ঞান বিষয়ে মুক্তমনার উচিৎ আর ও একটু বেশি মনোযোগী ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া । অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা বেশি চাই ।
অসংখ্য ধন্যবাদ ।
আমাদের মাটির সন্তান এই প্রতিভাধর মানুষটির বর্ণাঢ্য জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরনী পড়ে অনেক ভাল লাগল। যে কারণে তার জন্মভূমির মানুষ তার শিক্ষকতার ও বিজ্ঞান গবেষনার ফলে সরাসরি ঋদ্ধ হতে পারেনি সেই সাম্প্রদায়িক বিষ আরো উগ্রমূর্তি ধারণ করেছে। তাছাড়া জন্মভূমির মাটি তার প্রতিভার বিকাশে অনুকূল হতনা মোটেই! তাই তার দেশত্যাগ সঠিক ছিল।তার বিজ্ঞানী হিসেবে রেখে যাওয়া পদাঙ্ক
আজকের বিজ্ঞান প্রেমী প্রজন্মকে পথ দেখাবে ও প্রেরণা যোগাবে।
আমাদের অতীতে এক ঝাঁক তরুণ বুদ্ধিদীপ্ত বিজ্ঞানী রয়েছেন যারা আমাদের সতত অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাবেন । আস্তে আস্তে তাদের জীবন সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করছি ।