শামসুর রাহমান বাংলাদেশের খ্যাতনামা কবি ও বুদ্ধিজীবী। শামসুর রাহমান তাঁর “আমাদের সমাজ ও লেখকের স্বাধীনতা” প্রবন্ধে মীর মশাররফ হোসেন-এর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারির ঘটনা, উগ্রবাদীদের হাতে আবুল হুসেনের অপমানিত এবং নিগৃহীত হওয়ার ইতিহাস বর্ণনা করেছেন।। কালের পরিক্রমায় শামসুর রাহমানকেও উগ্রবাদীদের হাতে আক্রান্ত হতে হয়েছেন। একটা অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে; যারা পূর্ববতী লেখকদের ধর্মবাদীদের হাতে লাঞ্ছনা-গঞ্জনার ইতিহাস লিখেছেন পরবর্তীতে তাদের প্রায় সবাইকে অগ্রজদের মতন ইতিহাসে ঠাঁই নিতে হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মবাদীদের হাতে আক্রান্ত ও নিহতদের তালিকা:‘হেলোউইন’ (HALLOWEEN) ইন বাংলাদেশ

দৈনিক জনকন্ঠ ও দৈনিক ইত্তেফাক (প্রথম পাতা), কবি পত্নি আহত।

১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি “হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী” (সংক্ষেপে হুজি) দলের সদস্যরা কবিতা সংগ্রহের নামে শামসুর রাহমানের বাড়িতে যাওয়া শুরু করে। প্রথমে তারা নিজেদের ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয় দেয়। সময়-সুযোগ বুঝে ঈদের আগে কবিকে হত্যা করার পূর্ব-পরিকল্পনা করে জঙ্গিরা। আটক হওয়া ৯ জন জবানবন্দিতে উল্লেখ করে; তথাকথিত ইসলাম বিরোধী কবি-বুদ্ধিজীবীদের হামলার মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান স্টাইলে বিপ্লবের পরিকল্পনা গ্রহণ করে তারা। ১৯৯২ সালে প্রাথমিকভাবে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করে তারা। তাদের জবানবন্দিতে-সংগঠনের অর্থ লেন-দেন ও সামরিক প্রশিক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। প্রমাণ হয় যে; সংগঠনটির সাথে আফগানিস্তানের আল-কায়দার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। পাকিস্তানের আইএস ও তালেবান থেকে সব রকম সাহায্য সহযোগিতা পেতে সংগঠনটি পেতে সক্ষম হয়। ইত্তেফাকের লিখছে; সদস্যরা জবানবন্দিতে বলছে সংগঠনটি বছর আলকায়দা থেকে এক কোটি টাকা অর্থ সহায়তা পেত। হামলাকারীদের সাথে ঢাকার তিনটি মাদ্রাসায় যোগাযোগ ছিল এবং হামলার প্রশিক্ষণও তারা মাদ্রাসা থেকে অর্জন করে। যদিও কওমি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ হুজির সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নাই বলে বিবৃতি দিয়েছে।জানুয়ারি মাসে বুদ্ধিজীবী হত্যার নির্দেশ দেয় ধর্মীয় নেতা শেখ ফরিদ। নীল নক্সায় শুধু কবিকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল না! পরবর্তীতে অধ্যাপক কবির চৌধুরী, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক আব্দুল আউয়াল, বেগম সুফিয়া কামাল, তসলিমা নাসরিন কে হত্যার দায়িত্ব ছিল আটক হওয়া হাসান, মাহতাব ও পলাতক আজাদের উপর ছিল। জানুয়ারিতে হামলার নির্দেশ দিয়ে শেখ ফরিদ দুবাই চলে যায়।

প্রকাশিত সংবাদ

হামলার দিন সৌভাগ্যবশত বাসার পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সহায়তায় কবি রক্ষা পান এবং ঘটনাস্থলে দুই জঙ্গি হাতেনাতে ধরা পরে। কবির উপর হামলায় বিভিন্ন মহল প্রতিবাদ ও নিন্দা জানায়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন-“দেশে মুক্তচিন্তার পরিবেশ সৃষ্টি হইয়াছে, তবে ষড়যন্ত্র থামিয়া নাই।“ এমনকি অনেক ইসলামিক সংগঠনও এই হামলার নিন্দা করে। প্রায় বিশ বছর আগের বাংলাদেশ ও বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের রয়েছে অনেক তফাৎ। বর্তমান বাংলাদেশ কোন লেখক ব্লগার জঙ্গিদের হাতে হামলা কিংবা নিহত হওয়ার পর রাজনৈতিক দল ও সরকার থেকে ভিকটিমকেই দায়ী করার একটা অপরাধ সংস্কৃতি চালু হয়েছে। অথচ শামসুর রাহমানের পর ২০০৪ সালে যখন জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হোন তখন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা দুই কিলোমিটার হেঁটে (আর্মি গাড়ি যেতে দেয়নি) হাসপাতালের লেখককে দেখতে যান। অন্যদিকে ২০১৫ অভিজিৎ রায় খুন হওয়ার পর ধর্মীয় দলগুলোর মন রক্ষায় ও ক্ষমতার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিতে পারেননি। যিনি মুক্তচিন্তার পক্ষের অবস্থান নিতেন তিনি আজ রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে শফি হুজুরদের ভাষায় ওয়াজ করছেন। ২০ বছর আগে বাংলাদেশের কোন ইসলামিক দল কোন ব্যক্তির কল্লা ফেলে দেব এমনটি বলার ক্ষমতা রাখতো না। অথচ আজকের বাংলাদেশে ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু বললে ঐ ব্যক্তির কল্লা ফেলে দেওয়া হবে এমন হুংকার ইসলামিক নেতারা তো দেনই, শামীম ওসমানের মতন আওয়ামী লীগের নেতারাও প্রকাশ্যে হুমকি দেন।

শামসুর রাহমানকে নিয়ে অপপ্রচার:
শামসুর রাহমানকে নিয়ে রাজনৈতিকভাবে ও ধর্মীয় ইস্যুতে অনেক অপ্রচার প্রচার হয়েছে। বিশেষ করে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করার পর যারা এই সংগঠনে যুক্ত ছিলেন সেসব বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় দলগুলো থেকে অপপ্রচারের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়; শামসুর রাহমান ও আহমদ শরীফের নাম। ধর্মীয় ইস্যুতে গুজব প্রচার করে ফায়দা হাসিলের জন্যে ধর্মীয় দলগুলো সবসময় তৎপর ছিল। কবি সম্পর্কে একটা অপপ্রচার আছে যে; কবি তাঁর “এই মাতোয়ালা রাইত” কবিতার মাধ্যমে আজানের ধ্বনিকে বেশ্যার হাসির সাথে তুলনা করেছেন! অথচ কবিতাটি পড়লে আমরা তেমন কিছুই দেখতে পাই না। পাঠকের সুবিধার্থে কবিতাখানি এখানে তুলে দিলাম। কবির উপর জঙ্গি হামলার পেছনে এসব গুজবের প্রভাব কোনভাবেই আমরা অস্বীকার করতে পারব না।

এই মাতোয়ালা রাইত-শামসুর রাহমান

হালকা আজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের
লগে দোস্তি আমার পুরানা, কান্দুপট্রির খানকি
মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা
রাইতের তামাম গতরে। পাও দুইটা কেমুন
আলগা আলগা লাগে, গাঢ়া আবরের সুনসান
আন্দরমহলে হাঁটে। মগর জমিনে বান্ধা পাও।

আবে, কোন্‌ মাম্‌দির পো সামনে খাড়ায়? যা কিনার,
দেহস্‌ না হপায় রাস্তায় আমি নামছি, লৌড় দে;
না অইলে হোগায় লাথ্‌থি খাবি, চটকানা গালে।
গতরের বিটায় চেরাগ জ্বলতাছে বেশুমার।

আমারে হগলে কয় মইফার পোলা, জুম্মনের
বাপ, হস্না বানুর খসম, কয় সুবরাতি মিস্ত্রি।
বেহায়া গলির চাম্পা চুমাচাট্রি দিয়া কয়, ‘তুমি
ব্যাপারী মনের মানুষ আমার, দিলের হকদার।

আমার গলায় কার গীতি হুনি ঠাণ্ডা আঁসুভরা?
আসলে কেউগা আমি? কোন্‌হানতে আইছ হালায়
দাগাবাজ দুনিয়ায়? কৈবা যামু আখেরে ওস্তাদ?
চুড়িহাট্রা, চান খাঁর পুল, চকবাজার; আশক
জমাদার লেইন; বংশাল; যেহানেই মকানের
ঠিকানা থাউক, আমি হেই একই মানু, গোলগাল
মাথায় বাবরি; থুতনিতে ফুদ্দি দাড়ি, গালে দাগ,
যেমুন আধলি একখান খুব দূর জামানার।
আমার হাতের তালু জবর বেগানা লাগে আর
আমার কইলিজাখান, মনে অয়, আরেক মানুর
গতরের বিতরে ফাল পাড়ে; একটুকু চৈন নাই
মনে দিল জিঞ্জিরার জংলা, বিরান দালান। জানে
হায়বৎ জহরিলা কেঁকড়ার মতন হাঁটা-ফিরা
করে আর রাইতে এমুনবি অয় নিজেরেও বড়
ডর লাগে, মনে অয় যেমুন আমিবি জমিনের
তলা থন উইঠা আইছি বহুম জমানা বাদ।

এ কার মৈয়ত যায় আন্ধার রাইতে? কোন্‌ ব্যাটা
বিবি-বাচ্চা ফালাইয়া বেহুদা চিত্তর অইয়া আছে
একলা কাঠের খাটে বেফিকির, নোওয়াব যেমুন?
বুঝছোনি হউরের পো, এলা আজরাইল আইলে
আমিবি হান্দামু হ্যাষে আন্ধার কব্বরে। তয় মিয়া,
আমার জেবের বিতরের লোটের মতই হাচা মৌত।

এহবি জিন্দা আছি, এহনবি এই নাকে আহে
গোলাব ফুলের বাস, মাঠার মতন চান্নি দিলে
নিরালা ঝিলিক মারে। খোওয়াবের খুব খোবসুরৎ
মাইয়া, গহীন সমুন্দর, হুন্দর পিনিস আর
আসমানী হুরীর বারাত; খিড়কির রৈদ, ঝুম
কাওয়ালীর তান, পৈখ সুনসান বানায় ইয়াদ।
এহনবি জিন্দা আছি, মৌতের হোগায় লাথ্‌থি দিয়া
মৌত তক সহি সালামত জিন্দা থাকবার চাই।

তামাম দালান কোঠা, রাস্তার কিনার, মজিদের
মিনার, কলের মুখ, বেগানা মৈয়ত, ফজরের
পৈখের আওয়াজ, আন্ধা ফকিরের লাঠির জিকির-
হগলই খোওয়াব লাগে আর এই বান্দাবি খোওয়াব!

হয়তো রাজনৈতিক স্বার্থে কিংবা ব্যক্তিগত ইগো কিংবা ব্যক্তিগত অহংকার কিংবা ক্ষোভের কারণে অনেকেই শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন, চাকরি করেছেন এই ইতিহাসকে পুঁজি করে অনেকে কবিকে পাকিস্তানের অংশে দিকে ঠেলে দেওয়ার এক ব্যর্থ চেষ্টা করেন। অথচ এরা ভুলে যায় বাংলাদেশে শুধু শামসুর রাহমান একা যুদ্ধের ময়দানে বন্দি ছিলেন না তাঁর সাথে ছিলেন বাংলাদেশের ৬ কোটি মানুষ। এছাড়া সিরাজ সিকদারের মতন মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতর থেকেই যুদ্ধ করেছেন, কেউবা নিজের অবস্থান থেকে যতোটুকু পেরেছেন মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন। যারা ব্যর্থ হয়েছেন তারা লিখনির মাধ্যমে নিজের অক্ষমতা ও জীবন-যাপনের চিত্র তুলে ধরেছেন কিংবা লেখনীর মাধ্যমে যুদ্ধের সমর্থন দিয়েছে। শামসুর রাহমানের কবিতায় অধিকাংশ সময় পূর্ব বাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠীর চেতনার মর্মশাঁসকে ধারণ করে শিল্পিত হয়েছে। বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২) কাব্যের ক্ষেত্রে এ কথা একেবারে চোখ বুজে বলা যায়। এই কবিতার বইয়ে জাতীয়তাবাদের অ্যাসেন্স, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় চৈতন্য আর শিল্পিতার একেবারে মণিকাঞ্চন যোগ ঘটেছে। (সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ ও ‘বন্দী শিবির থেকে’-কুদরত-ই-হুদা)

৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর সহপরিবার নিহত হওয়ার ঘটনায় কবিকে আলোড়িত করেছিল। সামরিক জান্তার ভয়ে সবাই যখন চুপ তখন কবি লিখলেন ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’ কবিতাটি। যা তার একটি গ্রন্থেরও শিরোনাম।কবিতাটি সমকালে প্রকাশ করা হয়। কবিতাটিতে যে শেখ মুজিব এবং তার ঘাতকদের প্রতীকধর্মী বর্ণনা ছিল কোনও কোনও অংশ, একথা ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয়ের মুজিববিরোধী কতিপয় ছাত্র টের পেয়েছিল এবং কোনও কোনও অছাত্র পাণ্ডা তাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল। তারা সমকাল এর সেই সংখ্যার কিছু কপি পায়ে থেঁতলে, আগুনে পুড়িয়ে নিজেদের উষ্মা প্রকাশ করে (আত্মজীবনী) সূত্র: রাজনৈতিক কবি, উইকলি বাঙালি। ১৯৯২ সালে পনের আগষ্ট হত্যাকাণ্ডকে সামনে রেখে কবি লিখলেন ‘তোমরারই পদধ্বনি’।

কবির উপর হামলার ঘটনায় বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদ

প্রতিবাদী কবি: (উইকি থেকে)
শামসুর রাহমান স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রূপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল (পত্রিকা) পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ্য করে লেখেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস’ (১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সালে)। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান-এ কর্মরত থাকা অবস্থায় পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যাতে আরো স্বাক্ষর করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দীন। ১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান যার প্রতিবাদে আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতি-কর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন যাদের একজন ছিলেন শামসুর রাহমানও। কবি ক্ষুব্ধ হয়ে লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। ১৯৭০ সালের ২৮ নভেম্বর ঘূর্ণি-দুর্গত দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ও মৃত্যুতে কাতর কবি লেখেন ‘আসুন আমরা আজ ও একজন জেলে’ নামক কবিতা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। শামসুর রাহমান ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের তিনি প্রথম বছরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, দ্বিতীয় বছরে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’, তৃতীয় বছরে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং চতুর্থ বছরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ লেখেন। ১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর লেখেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁর চেতনায় প্রবাহিত ছিল। শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে বারবার বিতর্ক তুলেছে কূপমণ্ডূক মৌলবাদীরা। তাঁকে হত্যার জন্য বাসায় হামলা করেছে। এতকিছুর পরও কবি তাঁর বিশ্বাসের জায়াগায় ছিলেন অনড়।

প্রতিবাদী হুমায়ূন আহমেদ (১৯৯৯)

মামলার অগ্রগতি:

২০১৬ সালে সতের বছর আগে কবি শামসুর রাহমানকে হত্যা-চেষ্টায় ঘটনায় দায়ের করা একটি মামলা পুনরুজ্জীবিত করতে আদালতে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় সাক্ষীর অভাবে ২০০৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সাত আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার পর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই মামলার কার্যক্রম। যদিও পরবর্তীতে মামলার কার্যক্রম খুব বেশি গতি পায়নি। শুধু শামসুর রাহমানের মামলা নয় বাংলাদেশের বেশির ভাগ জঙ্গি হামলার মামলার কার্যক্রমের একই দশা। এর মধ্যে বানিয়াচর বোমা হামালার কথা উল্লেখ করা যায়। ১৬ বছরেও হুজির এই হামালার চার্জশীট ১৫ বছরেও যখন জমা পড়েনি সুতরাং বিষয়টি সবার কাছে স্পষ্ট কোন দলই এসব হামলার বিচার করতে আগ্রহী নয়। রাজনৈতিক স্বার্থ ও দলগুলোর জঙ্গিবাদ তোষণের কারণে অসংখ্য হামলার কোন বিচার হয়নি।

নিচে ১৯৯৬-২০০১ সাল-এর আওয়ামী শাসনামলে হুজির কর্তৃক জঙ্গি হামলার ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হল।

-৩ জুন, ২০০১: গোপালগঞ্জের বানিয়াচং গির্জায় প্রার্থনা চলাকালে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত, আহত অর্ধশত। হামলা চালায় হুজি।
-২০ জানুয়ারি, ২০০১: সিপিবি’র মিটিংয়ে বোমা হামলায় ৫ জন নিহত। হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন হুজি।
-১৪ এপ্রিল, ২০০১: রমনা বটমূলে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত। হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন হুজি।
-২০ জুলাই, ২০০০:গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভায় ৭৬ কেজি ওজনের পুঁতে রাখা বোমা উদ্ধার করা হয়। জনসভা শুরুর আগেই এই শক্তিশালী বোমাটি উদ্ধার হওয়ায় বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা থেকে বেঁচে যায় দেশ। জঙ্গি সংগঠন হুজি এতে জড়িত ছিল।
-১৮ জানুয়ারি, ১৯৯৯: কবি শামসুর রাহমানের উপর হামলা করে জঙ্গি সংগঠন হুজি।
-৬ মার্চ, ১৯৯৯: যশোরে উদীচী অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত। হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন হুজি।
-৮ অক্টোবর, ১৯৯৯: খুলনা শহরে আহমদিয়া মসজিদে বোম হামলায় ৮ জন নিহত। হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন হুজি।

বিএনপি সরকারের আমলে হুজির উল্লেখযোগ্য হামলাগুলো:

২১ মে, ২০০৪: ২১ মে ২০০৪ সিলেটে হজরত শাহজালালের মাজারে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর আর্জেস গ্রেনেড হামলা। নিহত ২, হাইকমিশনারসহ আহত হয় ৭০। হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন হুজি।
২০০৪ সালের ২১ জুন: সুনামগঞ্জে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উপর হুজির একটি দল বোমা হামলা করে।
২১ অগাস্ট, ২০০৪: বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলায় ২৩ জন নিহত আহত শতাধিক। হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন হুজি।
২৭ জানুয়ারি, ২০০৫: শাহব এএমএস কিবরিয়ার উপর হামলা চালায় ৫ জন নিহত। হামলা চালায় জংঙ্গি সংগঠন হুজি।
২৬ শে সেপ্টেম্বর ২০০৬: সুনামগঞ্জ জেলার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলায় ৪ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়। সমাবেশটির নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

জঙ্গি সংগঠন হুজি ৩০ এপ্রিল ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকারের আমলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে দল তৈরির ঘোষণা দেয়। হুজির হামলাগুলো খেয়াল করলে একটা জিনিস স্পষ্ট যে; বাংলাদেশে হুজির মূল টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ, সংস্কৃতি সংগঠন ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা। উদীচীর অনুষ্ঠানকে উলঙ্গ নৃত্যের সাথে হুজি তুলনা করতো, যা তাদের চোখে ইসলাম বিরোধী। এটি ছিল উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মূল কারণ। হুজি সবচেয়ে বড় রেডিক্যাল গোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশে হাজির হয়। সংবাদ পত্রের প্রকাশিত খবরে বলা হয় হাজার খানেক কওমি মাদ্রাসায় হুজির কার্যক্রম চলছিল যাদের অনেক প্রশিক্ষক ও ধর্মীয় নেতা আফগান থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। হুজির সাথে বিএনপির একা পরোক্ষ সম্পর্ক ছিল, জামাতের সাথে ছিল প্রত্যক্ষ। ১৯৯৮ সালে জামায়াত থেকে পরে হুজিতে যোগ দেয় শায়খ আব্দুর রহমান, যিনি পরবর্তীতে জেএমবি প্রতিষ্ঠা করে। বিএনপির শরিক ইসলামিক দলের নেতা আজিজুল হকের সাথে হুজির হাইকমান্ডের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। যদিও পরবর্তী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে বিএনপি সরকার হুজিকে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়।

প্রতিটি দেশের মতন বাংলাদেশেও ডানপন্থী দল ও নাৎসিমনা মানুষ রয়েছে। তারপরও লেখক হত্যার সামাজিক ও ধর্মীয় বৈধতা এই দেশে অতীতে কায়েম হয়নি, যা আজকের বাংলাদেশে সাধারণ এক সাধারণ অপরাধ সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন আগে এক তরুণ জাফর ইকবালের উপর হামলা করেছে। হামলার কারণ আর কিছুই নয়; জাফর ইকবাল নাস্তিক এটি সে শুনেছে, এবং এও শুনেছে যে তিনি কোন এক বইতে নবী সোলায়মানকে অপমান করেছেন। কোন জঙ্গি গোষ্ঠী কিংবা দলের পক্ষ থেকে নয়, বরং ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ভাইরাস থেকে সে জাফর ইকবালকে আক্রমণ করেছে। আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদের মতন ঘোষিত নাস্তিকরা তাদের সময়ে সমাজে এতোটা অন্ধকার প্রত্যক্ষ করেননি। যা আজকের বাংলাদেশের জীবিত লেখক, সাহিত্যিকরা করছেন।

উগ্রবাদীদের হামলায় কবি দমে যাননি তাই তো মৃত্যু-পর্যন্ত কবির অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। স্বপ্নে ও দুঃস্বপ্নে বেচে আছি (১৯৯৯), নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে (২০০০), শুনি হৃদয়ের ধ্বনি (২০০০), হৃদপদ্মে জ্যোৎস্না দোলে (২০০১), ভগ্নস্তূপে গোলাপের হাসি (২০০২), ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছে (২০০৩), গন্তব্য নাই বা থাকুক (২০০৪), কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার দিকে (২০০৪), গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান (২০০৫), অন্ধকার থেকে আলোয় (২০০৬), না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন (২০০৬)।

এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন। কবি তার আত্মজীবনীতে (কালের ধুলোয় লেখা, পৃ,৩২৩) উল্লেখ করেছেন। কবিকে একবার সিলেটে সংবর্ধনা দেওয়ার কথা ছিল (সাল উল্লেখ নেই)। কবি সিলেটে আসবে বলে সিলেটের মৌলবাদী সমাজ এর বিরোধিতা শুরু করে। তারা আয়োজকদের কারও কারও বাড়িতে বোমা মারে এবং সংবর্ধনার অনুষ্ঠানের স্থানে অগ্নি সংযোগ করে। আর এই কারণে কবি আর সিলেটে যেতে পারেননি।

পত্রিকার কপির ঋণ স্বীকার: PID, Ministry of Information।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা ওমর শেহাব ভাইয়ের প্রতি।