আশির দশকের প্রথম দিকে আমি যখন আমি মস্কোয় ছাত্র ছিলাম, তখন আমার সঙ্গে দ্বিজেন শর্মার পরিচয় হয়। উনি তখন প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদকের কাজ করছিলেন। আজকের এই আলোচনায় আমি তাঁকে দ্বিজেনদা বলে অভিহিত করব যেমনভাবে আমি তাঁকে এত বছর সম্বোধন করেছি। ঐ সময়ে আমার সঙ্গে দেবী শর্মা বা দেবীদিরও পরিচয় হয়। অন্য অনেক বাংলাদেশী ছাত্র ছাত্রীদের সাথে আমি তাঁদের মস্কোর কালোমেনস্কায়া অঞ্চলের আপ্যার্টমেন্টে যেতাম, সেখানে দেবীদি আমাদের রান্না করে খাওয়াতেন, আমরাও দেশের স্বাদ পেতাম। সেই সোভিয়েত আমলের আপ্যার্টমেন্টে দালানের নিচে দ্বিজেনদা বাগান করেছিলেন, সেখানে বুনেছিলেন বার্চ ও ম্যাপল গাছ, লাইলাক, পিওনি, লুপাইন আর হলিহক ফুলের গাছ। সেই বার্চ গাছ নাকি পরে এত বড় হয়েছিল যে সেটা তাদের দশ তলার আপ্যার্টমেন্ট ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

৭০ দশকের মাঝামাঝি আমি এক বছরের জন্য ঢাকায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র ছিলাম, দ্বিজেনদা সেখানে উদ্ভিদবিদ্যা পড়াতেন, কিন্তু আমি যখন ভর্তি হই তিনি ততদিনে মস্কো চলে গেছেন। কিন্তু কলেজ ক্যাম্পাসে তাঁর হাতের ছোঁয়া রয়ে গিয়েছিল তাঁর হাতে লাগানো গাছের মধ্যে দিয়ে। মস্কোতে আমরা গাছ নিয়ে কথা বলি নি। সেই সময় প্রকৃতি সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল অস্পষ্ট, তবে আমরা বিজ্ঞান ফিকশন নিয়ে কথা বলতাম। আমাদের একটি আলোচনা ছিল সোভিয়েত সায়েন্স ফিকশন নিয়ে। একটি বই নিয়ে আমরা আলোচনা করেছিলাম, বইটির নাম হল গ্রহান্তরের আগন্তুক। এটি ছিল রুশ ভাষায় লেখা কয়েকটি বিজ্ঞান কলবিজ্ঞান গল্পের সংকলন, ননী ভৌমিক সেটি অনুবাদ করেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী পড়ুয়া বাংলাদেশের কিশোরদের মধ্যে বইটি বেশ জনপ্রিয় ছিল।

১৯৭০ ও ১৯৮০’র দশক দুটিতে পড়ুয়া বাঙ্গালী কিশোরী ও কিশোর সম্মোহিত হয়েছিল বাংলা অনুবাদে রুশ তথা সোভিয়েত সাহিত্যে। শঙ্কর রায়ের অনুবাদে আর্কাদি গাইদারের চুক আর গেক, রেখা চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে পাভেল বাঝোভের ম্যালাকাইটের ঝাপি, আলেক্জান্দার বেলায়েভের উভচর মানুষ। এরকম অনেক বই প্রচুর গুণী বাঙালী যত্ন করে, পরিশ্রম করে আমাদের উপহার দিয়েছেন। এর মধ্যে আছেন খালেদ চৌধুরি, হায়াৎ মামুদ, দ্বিজেন শর্মা। অনুবাদ একটি পরিশ্রমের কাজ, অনেক ক্ষেত্রে মূল রচনার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তবু দিনশেষে মনে হয় অনুবাদক তার যথাযোগ্য মর্যাদাটা পান না। অনুবাদ ও ভাষান্তর একটি ধন্যবাদহীন উপেক্ষিত আর্ট। ‘উভচর মানুষ’ বইটি অনুবাদ করেছিলেন ননী ভৌমিক। দ্বিজেন শর্মা তাঁর ‘ননীদা, একদিন’ প্রবন্ধে লিখেছেন যে মস্কোতে ননী ভৌমিকের সঙ্গে আরো অনেক সাহিত্যসেবী এসেছিলেন, কিন্তু তারা সবাই ফিরে গিয়েছিলেন। দ্বিজেনদার ভাষায়, “(তাঁরা) এখানে রক্তকরবীর রাজার উপস্থিতি টের পেয়ে থাকবেন হয়তো। শেষ পর্যন্ত কেবল ননীদাই ধরা দেন তার লৌহআলিঙ্গনে। তাঁকে সে গুঁড়িয়ে দিতে চাইল, কিছুটা সফল হল বৈকি, নইলে এখানে এতদিন কাটিয়ে সৃজনশীল কিছুই বেরোলো না তাঁর কলম থেকে, বিশ্বখ্যাত না হোন, ভারতখ্যাত কথাশিল্পী হওয়ার যার সম্ভাবনা ছিল ষোলআনা।” মস্কোতে প্রথম যে বইটি দ্বিজেনদা অনুবাদ করেন সেটি লিখেছিলেন নিকোলাই আমাসভ, একজন চিকিৎসক। ইংরেজীতে এই বইয়ের শিরোনাম ছিল Thoughts and the Heart. অনুবাদকেরা যে প্রায়শই উপেক্ষিত থাকেন সেটি আমরা এই বইটি সম্পর্কে কলকাতার এক পাঠকের রিভিউ থেকে জানতে পারি। পাঠক বইটি খুঁজে পেয়েছিলেন ফুটপাথে ছড়ানো বইয়ের মধ্যে, শিরোনাম দেখে ভেবেছিলেন কবিতার বই। পাঠক বইটি পড়ে উচ্ছসিত, আমাসভের ভক্ত হয়ে গেলেন, কিন্তু কোথাও অনুবাদকের নাম বা বইটিতে কী ধরণের বাংলা ব্যবহার করা হয়েছে সেটা উল্লেখ করলেন না। এই অনুল্লেখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কারণ দ্বিজেনদা বইটির নাম দিয়েছিলেন অন্বিষ্ট হৃদয়, অপচিত হৃদপিণ্ড, অর্থাৎ যে হৃদয়কে বা মনকে অন্বেষণ করা হচ্ছে এবং যে হৃদপিণ্ড ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। মনে পড়ে এমন কাব্যিক শিরোনাম তখন আমাদের ছাত্র সমাজে বেশ আলোচনার খোরাক হয়েছিল। দ্বিজেনদা নিজে লিখেছেন সেই সময়ে তাঁর লেখা সুধীন দত্ত দিয়ে প্রাভাবিত হয়েছিল। কবি সুধীন দত্ত তাঁর কবিতায় অব্যবহৃত কিন্তু মনোগ্রাহী শব্দ প্রয়োগ করতেন।

আমাদের ভাগ্যভাল দ্বিজেনদা রক্তকরবীর যক্ষপুরীর মকররাজের আলিঙ্গন এড়াতে পেরেছিলেন। বরিশাল, সিলেট, ঢাকা, মস্কো, লন্ডনের ভৌগলিক পরাবৃত্তে, পৃথিবীর ইতিহাসের পালাবদলের প্রেক্ষাপটে তিনি তাঁর সহজাত মনীষা ও ভাষাগুণকে হারিয়ে যেতে দেন নি, আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন মুগ্ধতায় মোড়া ঢাকার চাঁপাগাছের বৃত্তান্ত, মস্কোর বনবিথীর মমর্রধ্বনি, প্রকৃতির ক্রান্তিলগ্নের আকুতি, সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ধান, ডারউইনের কাহিনী। এই লেখা এবং তাঁর নানান ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রকৃতির মাঝে আমাদের অবস্থানকে বুঝতে সাহায্য করে। তিনি ১৯৮৭ সনে বাংলা একাডেমি এবং ২০১৫ সনে একুশে পদক অর্জন করেন। বলতে গেলে তিনি এক নতুন প্রজন্মকে বাস্তব্যচৈতন্যেকে (ecological consciousness) চিনতে শিখিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমাকে ফিকশন লেখায় উৎসাহিত করেন। আমার প্রথম বইটি – একটি ছোট কল্পকাহিনীর সমষ্টি – আমি ওনাকে উৎসর্গ করি।

সেই কবে, ১৯৬৫ সনে, ঢাকার তেজকুণিপাড়ায় বসে দ্বিজেনদা তাঁর শ্যামলী নিসর্গ বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন। প্রকৃতিকে দোহন করে নয়, বরং প্রকৃতির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেই নগরে প্রকৃতিকে স্থাপন করার ব্যাপারে তিনি জোর দিয়েছেন। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রুশ দেশের বিভিন্ন নগর-উদ্যানের ‘কাব্যরূপ’ দেখে বিমোহিত হয়েছেন, আমাদেরকে সেটা জানিয়েছেন। প্রকৃতি, নগর ও এই দুই দেশের সীমানায় মানব বিচরণ–এই বিষয়গুলোর ওপর তাঁর লেখা আমাদের অভিভূত করে রাখে, কারণ এই ধরণের বিজ্ঞান-ঘেঁষা লেখা তাঁর শব্দচয়ন ও ভাষাশৈলীতে হয়ে ওঠে অপরূপ শিল্প। তাঁর শব্দগুলি একই সাথে যেন ভারি পাথর ও হাল্কা প্রজাপতি যা কিনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় তাঁর শৈশবের সিলেটের হারিয়ে যাওয়া বন-আচ্ছাদিত টিলা, তার মাঝে গেরুয়া পথ। তাঁর বাল্যকাল কেটেছে এরকমই প্রকৃতির মাঝে ১৯৩০এর দশকে যখন তাঁর বাড়ির কাছাকাছি জলপ্রপাতের নির্মলতা নষ্ট হয় নি উদাসীন পর্যটকের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিকের প্যাকেটে। পরবর্তী সময়ে আকৃষ্ট হয়েছিলেন বামপন্থী রাজনীতিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোটানিতে ডিগ্রি নিয়ে তিনি পড়িয়েছিলেন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে, ঢাকার নটর ডেম কলেজে। সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজে ক্যাম্পাসে লাগিয়েছিলেন চাঁপা গাছ। জীবনে সবাই বাগান গড়তে পারে না, বনকে রক্ষা করতে পারে না, সেটার জন্য চাই এক উদার নির্মল মানসিকতা।

তাঁর ভাষাটা যে প্রজাপতির মত সেটা কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন নামাঙ্কিত একটি রচনা থেকে দুটি লাইন উদ্ধৃতি দিলে বোঝা যাবে – “আমাদের গাঁ থেকে মাইলদুয়েক দূরে ছিল জমিদারের বাংলো। ওখানকার কিছু ফুলের প্রতি আমার আমাদের দারুণ দুর্বলতা জন্মায় – লালঘন্টা, রক্তকাঞ্চন, ক্যামেলিয়া। প্রতি বছর কাঞ্চনের নিষ্পত্র ডালগুলিতে বেগুনি-মভ রঙের ফুলের প্লাবন নামত। মনে হতো যেন অচেনা প্রজাপতিরা গাছটিকে ঢেকে দিয়েছে, তাদের পাখনার উদ্দাম বর্ণস্রোতে কী যেন কাঁপছে, হয়তো এখনই উড়ে যাবে গাছটিকে উদোম করে।”

তাঁর লেখায় তিনি বারে বারে ফিরে গেছেন নগরে একটি নিখুঁত পার্ক বা বাগানের কল্পনায়। ফিরে গেছেন কালিদাসের মেঘদূতে বর্ণীত ফুলে ও উদ্ভিদে, বাউল সঙ্গীতের আধ্যাত্মিক হৃদয়ে যা কিনা প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত, ভারতীয় উপমহাদেশে পারস্য সংস্কৃতির ছায়ায় গড়ে ওঠা মোঘল বাগানের সৌন্দর্যে। তাঁর লেখায় মূর্ত হয়েছে ভার্সাই বাগানের মালি আন্দ্রে ল নতরের কথা যিনি সপ্তদশ শতাব্দীতে ভার্সাই বাগানের নকশা করেছিলেন। রাজা লুই চৌদ্দর প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি, বৃদ্ধ বয়সে রাজা ল নতরের হুইলচেয়ার নিজ হাতে ঠেলে তাঁর বাগান দেখাতেন। হয়তো এই বর্ণনার মধ্যে দিয়ে দ্বিজেনদা এমন ধারণা দিতে চাইছিলেন যে রাষ্ট্রের কর্তব্য হল প্রকৃতির ধারকদের সামর্থ্য দেয়া।

মস্কোর প্রশস্ত গাছা-ঢাকা বুলেভার্ডে তিনি প্রশান্তি পেয়েছিলেন, ফরাসী অনুপ্রাণিত নিয়মানুগ রুশ পার্কের গঠনে চমৎকৃত হয়েছিলেন। ইংল্যান্ডে গিয়ে কিউ গার্ডেন্সে গেছেন বারংবার, চেলসি পুষ্পমেলায়। ইংল্যান্ডের বাগানের স্টাইল ১৭ শতকের প্রথম থেকে ইউরোপীয় ফরম্যাল বা নিয়মানুগ ধারা থেকে বের হয়ে স্বচ্ছন্দভাবে প্রকৃতিকে ধরে রাখতে চায়। ঐ শতকের বিখ্যাত ইংরেজ উদ্যানপালক উইলিয়াম কেন্ট এবং চার্লস ব্রিজম্যান এই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দৃশ্যপটে নিয়ে এলেন প্রাচীন গ্রীক বা রোমান মূর্তি বা ফোয়ারা বা বাড়ির ধ্বংসাবশেষ, সেটা সৃষ্টি করল এক ধরণের হারিয়ে যাওয়া রোমান্টিকতা।

প্রকৃতিকে বোঝার জন্য, তার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য ব্রিটিশদের প্রচেষ্টার ওপর দ্বিজেনদা লিখেছেন। এই প্রচেষ্টা শুধুমাত্র প্রকৃতিবিদ চার্লস ডারউইন বা ভূতাত্বিক চার্লস লায়েলের মত পৃথিবীখ্যাত মানুষ দিয়ে গঠিত হয় নি, এর মধ্যে ছিলেন জোসেফ ডালটন হুকারের মত উদ্ভিদবিদ ও পর্যটক। ১৮৪৭ থেকে ১৮৫১ পর্যন্ত হুকার ভ্রমণ করেন নেপাল, দার্জিলিং, সিকিম। হাতিতে চড়ে যান সিলেট ও গারো পাহাড়, সংগ্রহ করেন অসংখ্য উদ্ভিদের নমুনা, দেশে ফিরে কিউ গারডেন্সের পরিচালক হন, যেখানে শেষ করেন সাত খণ্ডের Flora of British India। কিউ গার্ডেন্স যে দ্বিজেনদার প্রিয় গন্তব্যস্থল ছিল তা আগেই উল্লেখ করেছি। সেই বাগানে রয়েছে নিভৃত নিকুঞ্জ, তৃণোদ্যান, শিলা-কানন, জাপানি নিসর্গোদ্যান, পদ্মপুকুর, প্রিন্সেস অফ ওয়েলস কনজারভেটরি – এদের অনেককটিকেই তিনি বর্ণনা করেছে তাঁর হৃদয়ছোঁয়া ভাষায়। দেখুন জাপানি বাগানটিকে তিনি কেমন করে বর্ণনা করেছেন, “বড় বড় পাথরের ফাঁকে ফাঁকে ছড়ানো সাদা নুড়ি, তাতে আঁকাবাঁকা রেখার তরঙ্গমালা। পাশে আর একট ডোবা, সেখানেও শুধুই সাদা নুড়ি, বক্রাকার রেখায় রেখায় স্পন্দনমান। পরে কয়েকটি ক্যামেলিয়ার গাছ। গোটা নির্মাণে জমাটবাঁধা এক অলৌকিক স্তব্ধতা।”


জাপানি নিসর্গোদ্যান, কিউ গার্ডেন্স, ইংল্যান্ড[/caption]

শব্দ ও বাক্য নির্মাণের এই যে কৌশল, তা আমাদের অভিভূত করে। এই কৌশল কারুকাজে ভূষিত নয়, বরং স্বচ্ছতার মাধুর্যে উজ্জ্বল। শুনুন সিলেটের হাওর অঞ্চল সম্পর্কে তিনি কী বলছেন, “এখানে সমতলের একঘেয়েমি নেই, এর উচ্চাবচ আন্দোলিত। হিজলের অরণ্যবলয় ছাড়াও এখানে তুলসীগন্ধী মটমটিয়া, প্রস্ফূটিত বনগোলাপ, উজ্জ্বল-বেগুনি হুড়হুড়ি ও শতমূলির ঝোপঝাড় অজস্র। এখানে ছায়া ঘুরে বেড়ায় নির্ভয় দোয়েল-শ্যামা-ঘুঘুর দল, আরো দূরে গরুর বাথান, বিলের কিনারায় বোরোধানের কচি সবুজ আর দিনরাত হাজারো হাঁসের মেলা।”

কিন্তু পৃথিবীর পরিবেশ বদলে যাচ্ছে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে পৃথিবীর সম্পদকে – জল ও জমিকে – নষ্ট করছে। তাঁর জন্মস্থানের কাছাকাছি একটি বনের মৃত্যু তাকে বিশেষভাবে ব্যথিত করে। সেই বন নেই, নেই সেই বনের হরিণ, বনশুকর, আশ্চর্য প্রাণী বনরুই, বনবিড়াল, মেছোবাঘ, বাঘ, উল্লুক। প্রকৃতি সব জায়গায় আক্রান্ত। ভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের দ্বন্দ্ব সমস্ত ধরণের নীতিবাদের উর্ধে। হিংস্র নগরায়নে ঢাকা শহর পরিণত হয়েছে এক দুস্বপ্নের নগরীতে। তরুণ বয়সে দ্বিজেনদা মার্ক্সবাদে আস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি আবিষ্কার করেছিলেন প্রকৃতির দোহন সমস্ত ধরণের অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থায় বর্তমান। তিনি আরাল সাগরের মৃত্যুতে মর্মাহত হয়েছেন, কাজাখস্থান ও উজবেকিস্থানের সীমানায় এটি ছিল পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অন্তর্দেশীয় হ্রদ। সোভিয়েত সময়ে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে আরাল সাগরে যে সমস্ত নদী পড়ত সেগুলোর জল কৃষি ক্ষেতের জন্য সরিয়ে নেয়া হয়, ৫০ বছরে আরাল সাগর শুকিয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে এটা মানব-সৃষ্ট অন্যতম পরিবেশ বিধ্বংসী ঘটনা।

এ সব কিছুই দ্বিজেনদাকে ভাবিত করেছে, তিনি প্রশ্ন করছেন, মানুষ কী সত্যিই জ্ঞানী জীব? আমরা মনে করি মানুষ নিজেকে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত করতে পেরেছে, মানুষ সৃষ্টি করেছে হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু দ্বিজেনদা এক জায়গায় লিখছেন, “কিন্তু মানুষও প্রাকৃতিক নির্বাচনের উৎপাদ, তার বংশগতিতে রয়ে গেছে একক ও গোষ্ঠীগত আত্মরক্ষার কিছু প্রবণতা যেগুলো আজও তাকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত করে।” এটা হল সামাজিক ডারউইনবাদীদের মত, দ্বিজেনদা হয়তো খুব দ্বিধাভরে এই বক্তব্যে সায় দিয়েছেন যে মানবসমাজে এখন প্রাকৃতিক নির্বাচনের বড় ভূমিকা রয়েছে। এটা তাকে হতাশ করেছে, তিনি লিখছেন, “এ কথা বলা খুব অযৌক্তিক নয় যে, মানুষও প্রকৃতির মতোই এক অন্ধ ও নির্মুখ শক্তি, কেননা তার অগ্রযাত্রা উদ্দেশ্যহীন ও অনিশ্চিত।”

এই চিন্তাটি তাঁর মনকে যে খুব তরুণ বয়স থেকে অধিকার করে রাখত সেটা ১৯৫৯ সনে স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে লিসেঙ্কো মতবাদের প্রতিষ্ঠা ও চিরায়ত বংশগতিবিদ্যার পতনের ওপর তাঁর একটা লেখা থেকে বোঝা যায়। ত্রফিম লিসেঙ্কো, একজন কৃষি বিজ্ঞানী, ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন নাকচ করে দাবী করেছিল যে এক প্রজন্মে আহরিত দেহলক্ষণ বংশগতিতে সংক্রমিত হতে পারে এবং এর ফলে নতুন পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। স্টালিনের কাছে এই প্রস্তাবটি গ্রহণীয় ছিল কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের খাদ্যমজুত বাড়ানো দরকার ছিল। এর ফলে নিকোলাই ভাভিলভের মত প্রকৃত বিজ্ঞানী, যাঁরা কিনা বংশগতিবিদ্যার সম্মুখ সারিতে ছিলেন, তাঁরা চাকরিচ্যুত হলেন, অনেকেই গুলাগে প্রেরিত হলেন, ভাভিলভ কারাগারেই মারা গেলেন। ডারউইনবাদের তীক্ষ্ণ ছাত্র হিসাবে দ্বিজেনদা লিসেঙ্কোবাদের ছ্দ্মবিজ্ঞানকে নির্দিষ্ট করলেন, কিন্তু শুধুমাত্র বংশগতিতে প্রাপ্ত লক্ষণ সাফল্যের চাবিকাঠি হবে সেটা মানতে পারলেন না।

বাংলাদেশে বিবর্তনবাদ পড়ানোর ব্যাপারে তিনি মন্তব্য করেছেন : “আমরা পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে বিবর্তন পড়েছি। শিক্ষকেরা ছিলেন ধর্মবিশ্বাসী, বিবর্তনবাদ সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য কোনোদিন আমি শুনিনি। তারপর অনেক বছর কলেজে বিবর্তনবাদ পড়িয়েছি, কোনো সমস্যা হয় নি। দশককাল হলো উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যক্রম থেকে বিষয়টি তুলে দিয়ে জীবপ্রযুক্তি পড়ানো হচ্ছে। কিন্তু তার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাই নি।…অবিজ্ঞানের কাছে নতিস্বীকার কিংবা জ্ঞান এড়িয়ে প্রয়োগ শিক্ষণ আখেরে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর হবে।” দ্বিজেন শর্মার এই সতর্কবাণী এখন পৃথিবীর অনেক দেশের জন্যই প্রযোজ্য। অবিজ্ঞানের সাথে সমঝোতা করে ডারউইনকে হয়তো ক্ষণকালের জন্য এড়ানো যাবে, কিন্তু সেটা ভবিষ্যৎ সমাজকে পশ্চাৎমুখীই করে রাখবে। শেষ কয়েকবার আমি যখন তাঁদের সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় যাই দেশে বর্ধমান সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় উন্মাদনা ও বিজ্ঞানের প্রতি অনীহা নিয়েই আমাদের কথা হয়।

বাংলাদেশে জীব বৈচিত্রের বিনাশ ও পরিবেশের অবক্ষয় নিয়ে দ্বিজেনদা গভীরভাবে ভেবেছেন। ২০১০ সনে আরজ আলী মাতুব্বর স্মারক বক্তৃতায় তিনি বলছেন, “বকপাখির ছদ্মবেশধারী ধর্ম জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবকে যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য বস্তু কী? উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন – মানুষ অহরহ মৃত্যু দেখে, কিন্তু আপন মৃত্যুর কথা ভুলে থাকে।”

জীব বৈচিত্রের বিনাশে মানুষ তার ভূমিকা সম্পর্কে খুব ভাল ভাবেই জানে, কিন্তু সেই ভূমিকা ত্যাগ করতে সে পারে না। ঐ বক্তৃতাটি তিনি সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ কবি জন ডানের বিখ্যাত কয়েকটি লাইন দিয়ে শেষ করেছিলেন। “No man is an island, entire of itself; every man is a piece of the continent; part of the main, … any man’s death diminishes me, because I am involved in mankind, and therefore never send to know for whom the bell tolls, it tolls for thee.”

বর্তমানে পৃথিবী জীববৈচিত্র বিনাশের মহাপ্রলয়ের মধ্য দিয়ে চলছে, পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে পাঁচবার এরকম মহাবিনাশ হয়েছে, কিন্তু এবারকার – ষষ্ঠতম – বিনাশের কারিগর মানুষই। কোনো ধরণের অর্থময় পদক্ষেপ ছাড়া প্রকৃতির বিনাশে ঘন্টাধ্বনি আমাদের জন্য বাজছে। সেই ঘন্টাধ্বনির কথা দ্বিজেনদার লেখা ও জীবনে ছড়িয়ে আছে। এ বছরের ১৫ই সেপ্টেম্বর দ্বিজেনদা মৃত্যুবরণ করেন।

[লেখাটি টরোন্টোতে PDI আয়োজিত দ্বিজেন শর্মার প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে ভাবনা অনুষ্ঠানে (অক্টোবর ২০১৭) পঠিত হয়]