প্রথম পর্বের ব্লগটি পড়ুন এখানে

আগের পর্ব থেকে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরী। বর্তমান সময়ের ইসলামী গবেষকদের লেখা থেকেই জানা যায়, ইসলামে শিক্ষাদীক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় প্রধানত দুটি প্রয়োজন থেকে। এক, কোরআন কে মুখস্থ করে তাকে সংরক্ষণ করা আর দ্বিতীয়ত নও-মুসলিমদের এই নতুন ধর্মের নিয়ম কানুন জানানো। আগ্রহী পাঠকদের জন্যে উল্লেখ করা দরকার যে, এই দুটি প্রয়োজনই কিন্তু পার্থিব বা দুনিয়াবি প্রয়োজন। এর সাথে পরকালের কোনও সরাসরি সম্পর্ক নেই। এই বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার এইজন্যে যে আজকের কওমি মাদ্রাসা বা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হিসাবে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি ও পরকালের নেকি হাসিল কে প্রধান হিসাবে উল্লেখ করা হয় যা ইসলামের ইতিহাসে শিক্ষাদীক্ষার আলোচনায় পাওয়া যায়না, অন্তত প্রথম দিকের ইতিহাসে তা পাওয়া যায়না। অর্থাৎ ইসলামের প্রথম দিকের ইতিহাসে শিক্ষা-দীক্ষার উদ্দেশ্যটি ছিলো সব সময়ই পার্থিব প্রয়োজন মেটানো। এই লেখায় পরের কোনও অংশে আমরা দেখবো, কখন ইসলামে শিক্ষার উদ্দেশ্য পার্থিবতা থেকে সরে আসলো।

এই পর্বে আমরা আরো চারজন ইসলামী পন্ডিতের শিক্ষা বিষয়ক ধারণার উল্লেখ করছি। যদিও এটা খুব সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, তবুও এই আলেমদের চিন্তার স্বকীয়তা ও তাঁদের চিন্তার মাঝে পার্থক্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ। আজকের ইসলামী শিক্ষাকে বোঝার জন্যে ইসলামের এই আলেমদের মাঝে চিন্তার পারথক্যগুলো বোঝাটা জরুরী। কেননা, ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে নিশ্চিত ভাবেই কারো কারো চিন্তা অন্যদের চিন্তাকে পরাস্ত করেছে এবং জয়ী চিন্তাটি ইসলামের মূলধারার চর্চায় আত্তীকৃত হয়েছে। এই আত্তিকরন সঠিক বা বেঠিক তার চাইতেও জরুরী হচ্ছে এই ইতিহাসটি জানা ও তার প্রভাবটি বোঝা।

বাহর আল-জাহিজ
ঈমাম আবু হানিফার পরে আরেকজন উল্লেখযোগ্য ইসলামী পণ্ডিত হচ্ছেন আমীর ইবনে বাহর আল জাহিজ। ইসলামের প্রথম পর্যায়ের এই ধর্মতাত্ত্বিক, শিক্ষাবিদ জন্মেছিলেন হিজরি ১৬০ সালে কিম্বা ৭৭৬ খিস্টাব্দে অর্থাৎ নবী মুহাম্মদের জন্মের ঠিক ২০৬ বছর পরে। ইথিওপিয়ান এই ধর্মতাত্ত্বিক, শিক্ষাবিদেরও প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিলো প্রাচীন গ্রীক দর্শন, বিশেষত এরিস্টটল এর দর্শন। সে সময় আরবী ভাষায় সুলভ গ্রীক দর্শনের পাঠ এবং অভিজাত মহলে সেসব নিয়ে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কে নিয়মিত অংশ নিতেন তিনি। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক রচনা ছিলো “কিতাব আল-মুয়াল্লিমিন” বা “শিক্ষকদের পুস্তক” (“The Book of the Teachers”)। এই পুস্তকটি লেখার দুইটি প্রধান কারণ জানা যায়। সেই সময়কার মুসলিম সমাজে শিক্ষকদের ভুমিকা খুব সম্মানজনক ছিলোনা, তিনি এই পুস্তকের মাঝে ব্যাখ্যা করেন কেনো শিক্ষকের মর্যাদা সমাজে উচ্চতর এবং কেনো সেই মর্যাদা রক্ষা করা দরকার। তিনি এই পুস্তকে আরো ব্যাখ্যা করেন শিক্ষকের শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে। যেহেতু আল জাহিজ নিজে ছিলেন গ্রীক দর্শন বিশেষত এরিস্টটলের দর্শনের ভক্ত, তাই শিক্ষাপদ্ধতির বিষয়ে তিনি মুখস্থবিদ্যার বদলে যৌক্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্তগ্রহন এই পদ্ধতির প্রতিই বেশী পক্ষপাতি ছিলেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম শিক্ষাদান পদ্ধতিতে মুখস্থবিদ্যার বদলে যৌক্তিক বিশ্লেষণের উপরে জোর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর পুস্তকে সরাসরি মুখস্থ করার বদলে ছাত্রদের সৃজনশীলতার চর্চাকে উদ্বুদ্ধ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। শিক্ষাদান পদ্ধতিতে জবরদস্তির বদলে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ককে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্নেহ – দয়াময়তার সম্পর্ক হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়জনীয়তা তুলে ধরেন তিনি। তিনি সেই সময়কার অন্যান্য ইসলামী পন্ডিতদের সাথে বিতর্ক করেন তাঁর মুখস্থবিদ্যা বিষয়ক ভিন্নমত নিয়ে। শিক্ষাপদ্ধতিতে মুখস্থ করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তিনি অন্যান্যদের সাথে সরাসরি দ্বিমত পোষণ। তাঁর মতামত ছিলো, মুখস্থ বিদ্যা ছাত্রদেরকে তাঁদের নিজেদের মতামত গড়ে উঠতে বাধা দেয়। তিনি মুখস্থ বিদ্যা ও সৃজনশীল চিন্তা, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা পর্যালোচনা এই সকল কিছুর মিশ্রন ঘটাতে চেয়ছিলেন শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহন পদ্ধতিতে। এই শিক্ষাবিদ ছাত্রদের সৃজনশীল লেখালেখির উপরেও জোর দিয়েছিলেন। তিনি ছাত্রদের জন্যে একটি কারিকুলাম বা পাঠ্যক্রমও প্রস্তাব করেছিলেন। এই পাঠ্যক্রম দুইভাগে বিভক্ত ছিলো। আবশ্যিক এবং ঐচ্ছিক। আবশ্যিক পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিলো সৃজনশীল লেখা, গণিত, আইনশাস্ত্র, ইসলামের মূল স্তম্ভগুলো সম্পর্কে জ্ঞান, কুরআন শরীফ, ব্যাকরণ, সাহিত্য ও কাব্য। ঐচ্ছিক বিষয় সমূহের মধ্যে খেলাধুলা, শরীর চর্চা ও সঙ্গীত অন্তর্ভুক্ত ছিলো। খানিকটা অবাক করা হলেও সত্যি হচ্ছে ইবনে শানুন এর ঐচ্ছিক পাঠ্যক্রমে খেলাধুলার মাঝে ঘোড়ার দৌড় এবং দাবা খেলা অন্তর্ভুক্ত ছিলো, যা আজকের সমকালীন ইসলামী শিক্ষার ছাত্রদের মাঝে নিষিদ্ধ মনে করা হয়ে থাকে।

আল-জাহিজ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে তিনিই সম্ভবত প্রথম ইসলামী পন্ডিত যিনি শিক্ষার ক্ষেত্রে “মুখস্থ” করার বিরোধিতা করেন। তিনি প্রস্তাব করেন, মুখস্থ করা ও সৃজনশীল আলোচনা – পর্যালোচনার সমন্বয়ে একটি শিক্ষাদান ও গ্রহন পদ্ধতি।

ইবনে শানুন
আবু হানিফা, মুকাতিল সমরখান্দি এবং আল-জাহিজ এর পরে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্যে যার নাম অবশ্যই আসবে তিনি হচ্ছেন, ইবনে শানুন। তিউনিসিয়ায় জন্মগ্রহন করা এই ইসলামী পন্ডিত (হিজরী ২০২ সাল বা ৮১৭ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন ইসলামের “মালিকি” মজহাবের একজন গুরুত্বপূর্ণ আইনজ্ঞ, হাদিস বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ এবং ইতিহাসবিদ। বস্তুত তিনিই প্রথম ইসলামের শিক্ষাদান পদ্ধতির উপরে একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন, যেখানে শিক্ষাদান পদ্ধতির সকল খুটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেন। বর্তমান তিউনিসিয়ার কাইরুয়ান শহর ছিলো সেই সময়ের ইসলামের “মালিকি” মজহাবের রীতিনিতি, আইন ও অন্যান্য তাত্ত্বিক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ইবনে শানুন এই শহরেই জন্ম নেন। পরবর্তীতে তাঁর পিতার মৃত্যুর পরে, মাঘরেব শহরে তিনি “মালিকি” মজহাবের প্রধান আইনজ্ঞ হিসাবে অধিষ্ঠিত হন। প্রচলিত অর্থে আমরা যে ধরনের পুস্তককে “গাইডবুক” বলে থাকি, ইবনে শানুন সর্ব প্রথম শিক্ষকদের জন্যে সেই রকমের একটি বিষদ ও গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক রচনা করেন। “আদাব – আল মুয়াল্লিমিন” (“Rules of Conduct for Teachers”) নামের এই পুস্তকটিতে তিনি শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষাদান পদ্ধতি, ছাত্রদের প্রতি শিক্ষকের আচরনবিধি, শিক্ষকের নিজের পড়াশুনার গুরুত্ব, ছাত্রদের শাস্তিদান পদ্ধতি সহ আরো অনেক খুটিনাটি বিষয়ে ব্যাখ্যা করেন। ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ের এই শিক্ষাবিদ শিশুদের সাথে কাজ করার জন্যে শিক্ষকদের কি কি গুনাবলী থাকা দরকার তার উল্লেখ করেছেন। শিক্ষকদের বিনয়, ধৈর্য, কঠোর পরিশ্রমের কথা উল্লেখ করেছেন। সাধারণ জীবনের পরিবেশ আর শ্রেনীকক্ষের পরিবেশের মাঝে যে পার্থক্য থাকা দরকার এবং সেই পরিবেশ বজায় রাখার দায়িত্ব যে প্রধানত শিক্ষকের সে বিষয়েও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। ছাত্রদের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং দলগত ভাবে শিক্ষালাভের উপরেও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। ইবনে শানুন সম্পর্কে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করাটা জরুরী তাহলো, তিনি তাঁর কাছে আশা খৃস্টান ছাত্রদের কুরআনের পাঠদানের ব্যাপারে কঠোর ভাবে নিষেধ করতেন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষাকেন্দ্রে আসা ছাত্রদের প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস নিয়ে শিক্ষাগ্রহণ করার। অন্য অনেক ইসলামী শিক্ষাবিদের সাথে তিনি ভিন্নমত পোষণ করতেন, তিনি মনে করতেন বিশ্বাস ব্যক্তিগত বিষয়, এখানে জবরদস্তির কোনও সুযোগ নেই, শিক্ষা নিতে আসা ছাত্রদের মাঝে শিক্ষকের ধর্মবিশ্বাস “কায়েম” করার সুযোগ নেই।

ইসলামের শিক্ষার ইতিহাস ইবনে শানুন এর সময় থেকে ক্রমশই একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা হিসাবে গড়ে উঠতে শুরু করে। জ্ঞানচর্চা ও লেখালেখির দিক থেকে ইবনে শানুন ছিলেন, আল ফারাবী, আল-গাজ্জালী বা ইবনে রুশদ এর মতো ইসলামী পন্ডিতদের সাথে তুলনীয়। তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র চুয়ান্ন বছর এবং এই হ্রস্ব জীবনের মাঝেই তিনি প্রায় দুইশো পুস্তক রচনা করেছিলেন। সেই তুলনায় ঈমাম আল-গাজ্জালীই তাঁর সমকক্ষ ছিলেন।

মনসুর আল-ইয়ামান
জাফর ইবনে মনসুর আল-ইয়ামান খুব আহামরি পরিচিত না হলেও, তাঁর ধর্মীয় গোত্রের কারণে খানিকটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন। আল-ইয়ামান জন্মেছিলেন এক শিয়া পরিবারে, সম্ভবত হিজরী সাল ২১৮ বা ৮৮৩ খিস্টাব্দে। আল-ইয়ামানের পিতা ও পরিবার পরবর্তীতে শিয়া মুসলিম থেকে ইসমাইলিয়া মুসলিম হিসাবে পরিবর্তিত (ধর্মান্তরিত লিখছিনা কেননা শিয়া এবং ইসমালিয়া, উভয় গোত্রই নিজেদের ইসলামের অনুসারী মনে করে থাকে) হন এবং তাঁর পিতা ইয়েমেন ইসমাইলিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান হিসাবে অধিষ্ঠিত হন। মনসুর আল-ইয়ামান এর সময় থেকে ইসলামী শিক্ষায় খানিকটা পরিবর্তন আসতে শুরু করে। ধর্মীয় ও সেকুলার বা পার্থিব বিষয়ের মিশ্রনের বদলে শুধুমাত্র ধর্মীয় বা কুরআনভিত্তিক শিক্ষার উপরে জোর দেয়ার প্রবনতা শুরু হয়। এই পর্যায়ে ইসলামী শিক্ষার পূর্বশর্ত হিসাবে আল্লাহর উপরে বিশ্বাস, তাঁর একত্ববাদের উপরে বিশ্বাসের প্রসঙ্গগুলো বিবেচনায় আসে। মনসুর আল-ইয়ামান এর মূল আগ্রহের বিষয় ছিলো শিক্ষার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক সত্যের সন্ধান করা। তিনি মনে করতেন পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জনের অর্থ হচ্ছে খোদার সান্নিধ্য লাভ করা। তিনি মনে করতেন, সত্যিকারের শিক্ষা লাভের জন্যে আল্লাহ্‌ বা সৃষ্টিকর্তার প্রতি পূর্ণ নিবেদন জরুরী। এছাড়াও আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা তিনি সংযুক্ত করেন ইসলামী শিক্ষা বিষয়ক চিন্তার ভান্ডারে। মনসুর আল ইয়ামেন প্রথম ব্যাখ্যা জ্ঞানের অভাব কোনও দোষের কিছু নয়, কেননা মানুষের অজ্ঞতাও আল্লাহ্‌ প্রদত্ত এবং মানুষের জ্ঞান লাভের আকাংখাও আল্লাহ্‌ প্রদত্ত। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে শিক্ষা দান ও শিক্ষা গ্রহন দুটি বিষয়ই একটি পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতি, অর্থাৎ মানুষ স্বল্প থেকে অধিক জ্ঞান লাভের অভ্যাস করে এবং সরল থেকে জটিল জ্ঞানের দিকে অগ্রসর হয়। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ছাত্রদের শিক্ষকের উপরে আস্থা রাখতে হবে কিন্তু মনে রাখতে হবে যে সকল জ্ঞানই আসে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা বা সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে।

এটা লক্ষনীয় যে, মনসুর আল-ইয়ামান (২১৮ হিজরী সাল বা ৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ) এর সময় থেকে ইসলামের শিক্ষায় আধ্যাত্মিকতা একটি প্রধান অংশ হয়ে উঠতে শুরু করে। শিক্ষা ও জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্য হিসাবে সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাহর দিদার বা সান্নিধ্য লাভ করাটাই প্রধান হয়ে ওঠতে শুরু করে। ঈমাম আবু হানিফার পর থেকে ইসলামের শিক্ষাক্রম ও পাঠদান পদ্ধতিতে যে পার্থিবতার লক্ষণ সমূহ ছিলো সেসব চিন্তায় খানিকটা পরিবর্তনের সুচনা লক্ষ্য করা যায়।

ইবনে মিশকাওয়াইহ
হিজরি ৩২০ সালে (৯৩২ খ্রিস্টাব্দে) বর্তমান ইরানের রাজধানী তেহরানে জন্মেছিলেন আরেকজন উল্লেখযোগ্য ইসলামী চিন্তক ও শিক্ষাবিদ আবু আলী আহমাদ ইবনে মিশকাওয়াইহ। এই সময় থেকে ইসলামী পণ্ডিতদের মাঝে বিবিধ বিষয় নিয়ে পড়াশুনার আগ্রহ দেখা যায়। ইবনে মিশকাওয়াইহ একাধারে দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও রসায়ন নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। তবে তাঁর প্রধান কাজ হিসাবে গন্য করা হয় নীতিশাস্ত্র এবং দর্শনের উপরে তাঁর লেখালেখিকে। দর্শন ও নীতিশাস্ত্র বিষয়ে তাঁর প্রখ্যাত পুস্তক “তাহদিব আল-আখলাক ওয়া তাহতির আল-আরাক” এর জন্যে এখনও পশ্চিমা একাডেমিক চত্বরে তাঁকে একজন প্রধান ইসলামী নীতিশাস্ত্রবীদ হিসাবে গন্য করা হয়। খুব তরুন বয়স থেকেই ইবনে মিশকাওয়াইহ সেই সময়ের অগ্রসর শিক্ষার সুযোগ লাভ করেন। তিনি তেহরান ও বাগদাদে সেই সময়কার প্রধান ইসলামী, খৃস্টান ও ইহুদী চিন্তকদের কাছ থেকে সরাসরি শিক্ষালাভের সুযোগ পান। ততদিনে বাগদাদ কেন্দ্রিক ইসলামী স্বর্ণযুগের শুরু হয়ে গেছে। বাগদাদে তখন খৃস্টান ও ইহুদী অনুবাদকেরা একের পর এক অনুবাদ করে চলেছেন গ্রীক বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন ও যুক্তিবিদ্যার সব বিখ্যাত পুস্তক সমূহ। এই অনুবাদকদের কয়েকজনের সরাসরি সান্নিধ্য পাওয়ার কারণে ইবনে মিশকাওয়াইহ ব্যক্তিগত ভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, দর্শন, যুক্তিবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান সহ আরো অনেক বিষয়ে। বিশেষত প্লেটো ও এরিস্টটল এর লেখার আরবী অনুবাদ গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়েন। আরো একটি বিষয়ে তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন, সেই সময়ের অর্থনীতি বা অর্থনীতিক ব্যবস্থাপনা।

ইবনে মিশকাওয়াইহ সম্পর্কে এই ভুমিকাটির দরকার একজন্যে যে ইসলামী শিক্ষায় নীতিশাস্ত্র বিষয়ক গভীর চর্চার আলোচনার শুরুটা এখান থেকেই। অন্তত সুলভ তথ্য অনুযায়ী ইবনে মিশকাওয়াইহ প্রথম যিনি ব্যক্তি যেকোনো শিক্ষা অর্জনের গোড়াতেই মানুষের নৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব সহ উল্লেখ করেন। তাঁর তাত্ত্বিক পুস্তক “তাহদিব আল-আখলাক ওয়া তাহতির আল-আরাক” এ তিনি উল্লেখ করেন মানুষের ব্যক্তি নৈতিকতার উন্নয়ন শিক্ষার একটি বড় উদ্দেশ্য। তিনি উল্লেখ করেন, মানুষ কে সবার আগে মানুষ হিসাবেই উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হতে হবে এবং এই উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়ে ওঠাটি এক ধরনের চর্চা ও ধারাবাহিক প্রশিক্ষনের বিষয়। তিনি মনে করতেন – উদ্দেশ্য এবং চুড়ান্ত গন্তব্য যদি মহৎ হয়ে থাকে তাহলে তার শুরুটাও মহৎ হতে হবে, কর্মপদ্ধতিও মহৎ ও উন্নত নৈতিকতার উপরে ভিত্তি করে হতে হবে। ইবনে মিশকাওয়াইহর সাথে তার পূর্ববর্তী ইসলামী চিন্তকদের শিক্ষা বিষয়ক মতামতের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ইবনে মিশকাওয়াইহ শিক্ষার পদ্ধতি বা কারিকুলাম এর চাইতেও অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন মানুষ হিসাবে নৈতিক মানুষ হয়ে ওঠার উপরে। তিনি মনে করতেন উন্নত নৈতিকতা ব্যতীত শিক্ষা মানুষের জীবনে কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারেনা। যদিও তিনি এটাও মনে করতেন উন্নত নৈতিকতা অর্জনও একটি চর্চা ও শিক্ষার বিষয়। আমরা পরবর্তীতে দেখবো ইবনে মিশকাওয়াইহ কিভাবে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছেন ঈমাম আল-গাজ্জালী ও নাসির আল-দিন তুসীর উপরে।

(চলবে)