০১.
খুনীরা ডানের রাস্তা ধরে চলে গেলো।
যাকে খুন করবে, সে গেলো বামের রাস্তায়। ঝোপের আড়ালে। খুনটা হলো না। অল্পের জন্য হলো না। এরকমই হয় সবসময়। কোথাও খুন করতে গেলে মানুষের বুদ্ধি কমে আসে। চাইলেই তাকে ফাঁকি দেয়া যায়। টানা দেড় ঘন্টা দৌড়ানোর পর এইমাত্র শফিক কয়েকজন খুনীদের ব্যর্থ বানিয়ে ডানের রাস্তা ধরে হাইওয়ের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছে। এর আগে আপ্রাণ দৌড়িয়েছে সে। জান হাতে নিয়ে।
পানি খেতে হবে। এখনই। না হয় গলা ফেটে যাবে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। কেউ খুন করার আগেই মরে যাবে। এভাবে মরে যাওয়া ঠিক নয়। তিন ভাগ পানি একভাগ মাটির পৃথিবীতে কারোরই উচিত না পানির অভাবে মরে যাওয়া। পানির খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে গভীর জঙ্গলের অনেক গভীরে চলে এসেছে শফিক। মনে মনে উপরওয়ালাকে ডাকছে। শব্দ করে ডাকতে পারছে না। গলা ফেটে যাবে।
গল্পে যেমন হয়, গভীর জঙ্গলে একটা পরিত্যক্ত ঘর থাকে। সেখানে ভুতপ্রেত বসবাস করে। অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়। রাতে ঘরের ভেতর বিনা কারণে আলো জ্বলে। সে রকমই একটি ঘরের দেখা পেয়ে পানি পানি বলে চিৎকার করে যারপরনাই দৌড়াচ্ছে। ঘরের সামনে।
: পানি আছে। দেয়া যাবে না।
: দেন না ভাই? একটু পানি দিলে কী এমন ক্ষতি হয়?
: ঠিক কী কারণে আমি আপনাকে পানি দিবো?
: পিপাসার্তকে পানি খাওয়ালে সওয়াব হয়, তাই।
: কারণ পছন্দ হয়নি, অন্য কোন কারণ বলেন।
: উপরওয়ালার এক বান্দার বিপদে আরেক বান্দা এগিয়ে আসবে, এটাইতো স্বাভাবিক। দেন না ভাই, এক গ্লাস পানি।
: এই কারণটাও পছন্দ হয়নি।
: ভাই, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। আপনি এত নির্দয় কেন ভাই?
: এই কারণটা পছন্দ হয়েছে। বসেন, পানি আনছি।
শফিক খুব অবাক হয়। এক গ্লাস পানির জন্য এই লোক এত নাটক করছে কেন! লোকটি ভেতর থেকে এক গ্লাস পানি এনে দেয়। শফিক সেই পানি রাক্ষসের মত নিমিষে শেষ করে। আরেক গ্লাস এনে দিলে সেই গ্লাসও দুই ঢোকে শেষ করে দেয়। জিজ্ঞাসা করে আর লাগবে কিনা, শফিক ডানে বামে মাথা নাড়ায়। লাগবে না।
: কিছু মনে করবেন না ভাই। আমাকে সবকিছু হিসাব করে চলতে হয়। সপ্তাহে একবার পানি আর খাবার আসে। সবকিছু মাপা মাপা। এই যে আপনি দুই গ্লাস পানি খেলেন, এখন আমাকে দুই গ্লাস পানি কম খেতে হবে।
পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে শফিক জিজ্ঞাসা করে, বাড়ি ঘর ফেলে জঙ্গলে কেন থাকেন?
: আমার দাদীর অসিয়ত।
জবাব শুনে শফিক অবাক হয়। এ কেমন অসিয়ত! কোন দাদী কি তার নাতিকে গভীর জঙ্গলে বসবাসের অসিয়ত করতে পারে?
শফিক আবার জিজ্ঞাসা করে। লোকটি আবার একই জবাব দেয়।
শফিক ভদ্রলোকের নাম জানতে চায়।
ভদ্রলোক বলে তার নাম শাওন।
শফিক তৃতীয়বারের মত অবাক হয়। লোকটির আক্কেল জ্ঞান নাই। কেউ কাউকে নাম জিজ্ঞাসা করলে পুরো নাম বলতে হয়। যেন বুঝা যায় লোকটি মুসলমান, হিন্দু নাকি অন্য কোন ধর্মের লোক।
: পুরো নাম বলেন। যেন বুঝতে পারি আপনি কোন ধর্মের মানুষ। যেমন আমার নাম মোহাম্মদ শফিকুর রহমান শফিক।
: নামে ছন্দ আছে। আচ্ছা, আপনি কোন ধর্মের?
চতুর্থবারের মত অবাক হয়। নাম শুনেও লোকটি বুঝতে পারেনি যে শফিক কোন ধর্মের মানুষ!
: আমি হিন্দুও না, মুসলমানও না। শাওন।
: আপনি পাগল।
: মিথ্যা কথা।
শাওনের কথায় ভরসা পায় না শফিক। লোকটি নিশ্চিত পাগল। কথাবার্তা কেমন যেন, আবোলতাবোল।
কিন্তু এখন সে কী করবে? এই পাগলের সাথে থাকবে, নাকি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যাবে? এখন সাত সকাল। জঙ্গল খুব একটা খারাপ লাগছে না। কিন্তু রাত নামলেই নিশ্চয় ভয়ংকর হয়ে উঠবে। আবার ফিরে গেলে ওরা খুঁজে পেয়ে মেরে ফেলবে। উভয় সংকট।
শাওন জানতে চায় শফিক জঙ্গলে কেন?
কিছু লোক শফিককে খুন করতে চায়। এই লোকগুলো তার নেতার লোক। নেতা পাঠিয়েছেন শফিককে খুন করার জন্য। কয়েকদিন ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আজ একেবারে সামনে পড়ে যায়। তারপর দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে জঙ্গলে চলে আসে।
শাওন ভাবে যে নেতা খুন করার জন্য লোক পাঠিয়েছে, সে কার নেতা?
শফিক বলে তিনি সবার নেতা। শফিকেরও নেতা, খুনীদেরও নেতা। নেতা সবাইকে সমানভাবে ভালোবাসেন। তিনি রেসিস্ট না। কারো সালামে তার আপত্তি নেই। সবার সালাম নেন, সবার ভোট নেন।
তাহলে সমস্যা কী?
সমস্যা গুরুতর। এক ঘরোয়া আড্ডায় নেতা নিজেকে দলের প্রধান নেতার সাথে তুলনা করেছেন। শফিক তার মোবাইলে আড্ডার কিছু অংশ ভিডিও করে, তার মাঝে ওই অংশটিও আছে। ভেবেছে এটা ফেসবুকে পোস্ট করলে নেতা খুশি হবেন। পোস্ট করেছে, নেতা খুশি হয়েছেন, লাভ রিএক্টও দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তিনিতো শুধু নেতা, প্রধান নেতা নন। প্রধান নেতার সাথে নিজেকে তুলনা করার বিষয়টা দলের বেশিরভাগ লোক ভালোভাবে নেয়নি। ঝামেলা শুরু হওয়ার পর নেতা তার লাভ রিএক্ট উইথড্র করে সমস্ত দোষ শফিকের ঘাড়ে চেপে দেন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি, পোলাপানের কাছে স্ক্রীণশট ছিলো। এখন বোধ হয় নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করবে। পরিস্থিতি তার অনুকূলে নেই। নেতার ঠিকাদারি ব্যবসার কোটি কোটি টাকার কাজ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এই কারণে তিনি শফিককে খুন করতে চান।
কাজ হারানোর ক্ষোভে?
না না। শফিককে খুন করার পর নেতা প্রমাণ করবেন যে, তিনি তার লক্ষ্যে অটুট। পথের যত বাধা বিপত্তি আছে, সব ধুয়ে মুছে এগিয়ে যাওয়ার হিম্মত রাখেন। দলতো এমন হিম্মতওয়ালা নেতাই চায়। তো, তিনি তার হিম্মত প্রমাণ করার পর সবকিছু ম্যানেজ হয়ে যাবে। প্রধান নেতা খুশি হবেন। এমনকি ভোটও বেড়ে যাবে।
: উপরওয়ালার মতন।
: মানে কী?
: মানে উপরওয়ালা মানুষের উপর যত বেশি হিম্মত চর্চা করেন, মানুষ তার প্রতি তত বেশি অনুগত হয়, সমর্থন বেড়ে যায়।
: এটা কেমন কথা হলো!
: আপনার প্ল্যান কী শফিক ভাই? মানে এখন কী করবেন?
: উপরওয়ালাকে ডাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
: যারা আপনাকে খুন করার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে, তারাও উপরওয়ালাকে ডাকছে। কারণ আপনাকে খুঁজে না পেলে নেতার প্যাদানি খাবে। এখন উপরওয়ালা কার পক্ষে যাবেন? অযথা তাকে বিপদে না ফেলে অন্যকিছু ভাবুন।
: আপনার কথাবার্তা কেমন যেন!
: চাইলে এখানে দুইদিন থাকতে পারেন।
: থাকতে পারলে ভালোই হয়। কিন্তু আপনিতো পাগল। আপনার সাথে থাকা নিরাপদ না।
: না, আমি পাগল না। চাইলে থাকতে পারেন। মানুষ মানুষের জন্য।
: আপনি জঙ্গলে কেন থাকেন, এটা যদি সত্যি করে বলেন, তাহলে থাকবো।
: আমি নাস্তিক। জঙ্গীরা মেরে ফেলার হুমকী দিয়েছে। জানের ভয়ে পালিয়ে আছি।
: আহারে! কী সুন্দর চেহারা, কিন্তু নাস্তিক।
: থাকবেন নাকি দুইদিন?
শফিক রাজি হয়। রাজি না হয়েও উপায় নেই। কোথায় আর যাবে!
শাওন সবকিছু বুঝিয়ে বলে। তার এক বন্ধু প্রতি সপ্তাহে একবার পানি, কেরোসিন, চাল, ডাল, আলু, ডিম, নুন, মসলা, সিগারেট, মদ ইত্যাদি দিয়ে যায়। মদ অবৈধ নয়, দু’জনেরই মদ খাওয়ার লাইসেন্স আছে। যা হোক, কেরোসিনের স্টোভে রান্না করতে হয়। সবকিছু মেপে মেপে খরচ করতে হয়। এখানে প্রচুর সাপ। তাই ঘরের চার কোনায় চারটা কার্বলিক এসিডের বোতল রাখতে হয়। এসিড শেষ হয়েছে পরশু। গতকাল এসিডের গন্ধও শেষ হয়ে গেছে। তাই একটু সাপের ভয় আছে। একটু না, অনেকখানি ভয় আছে।
এরকম পাগল নাস্তিকের কাছে সাপের ভয় টয় কিছু না। এরা সাপের চেয়ে ভয়ংকর। শফিক সাপ নিয়ে ভাবছে না। সে ভাবছে অন্য কিছু। আচ্ছা, লোকটি নাস্তিক কেন?
কারণ উপরওয়ালা লোকটির কোন কাজে আসেন না।
: উপরওয়ালা কি আপনার কাজের লোক, যে তিনি কোন কাজে আসবেন? বরং আমরা তার কাজ করি। তিনি যেভাবে চালান, আমরা সেভাবে চলি।
: আপনি উপরওয়ালার কাজে বাধা দিয়েছেন। এটা ঠিক করেননি। তিনি কিছু লোককে পাঠিয়েছেন আপনাকে খুন করার জন্য, অথচ আপনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
: কী বলতে চান আপনি?
: দুপুরের রান্না করতে হবে। একটু হাত লাগাবেন?
: তা লাগাবো, কিন্তু উল্টাপাল্টা কথা বলা বন্ধ করুন।
: আপনি আমাকে পেয়াজ, রসুন আর কাঁচা মরিচ কেটে দিন। বাকি সবকিছু আমি দেখছি।
শফিক পেয়াজ কাটে, রসুন কাটে, মরিচ কাটে। দ্রুত। ছোরাটা বেশ ধারালো। তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে। শাওন চাল ধুয়ে ভাত বসিয়ে ডাল ভিজিয়ে রাখে। তারপর গামছা ভিজিয়ে গা মুছে ভেজা গামছাটি শফিককে দেয়। শফিকও গা মোছে। এভাবেই চলছে। শাওন গোসল করতে পারে না আজ দুই মাস হলো। তার আগের একমাস টুকটাক বৃষ্টি হতো। সমস্যা ছিলো না। তিন মাস ধরে সে এখানে লুকিয়ে আছে।
শফিককে জিজ্ঞাসা করে একটা বিয়ার খাবে কিনা?
ভুড়ির সাইজ অনেক বড় হয়ে যাওয়াতে শফিক বিয়ার খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। একটু হুইস্কি হলে ভালো হতো।
কিন্তু হুইস্কিতো নেই। তাছাড়া শফিকের উচিত না হুইস্কি খাওয়া। হুইস্কিতে এলকোহলের পরিমাণ বেশি, তার মানে গুনাহও বেশি।
ধর্ম নিয়ে টিটকারি না করতে হুশিয়ার করে দেয় শাওনকে।
শাওন হাসে। অযথা। একটা বিয়ার নেয়। শফিক নেয় না।
০২.
ভাত হয়, ভাতের ভেতর আলু সেদ্ধ হয়। ডাল হয়, ডালের ভেতর ডিম সেদ্ধ হয়। তারপর ভর্তা হয়। তাদের দুপুরের খাবার শেষ হয়। মাঝখানে আজান হয়। কিন্তু শফিকের নামাজ হয় না। এমনিতেও তার খুব একটা নামাজ হয় না। তবু আজ বিপদের দিনে একটু নামাজ হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু সে নাপাক। পানির অভাবে পাক হতে পারেনি।
আসর শেষে বিকাল হলো।
: আপনি কী এমন বলেছেন যে, জঙ্গীরা আপনাকে মারতে চায়?
: বলিনি, লিখেছি। লিখেছি উপরওয়ালার চরিত্র খারাপ এবং চরম অভাবী লোকের সন্তান।
: ছি, ছি! এটা কী বললেন! উপরওয়ালা উপরওয়ালাই। তিনিতো মানুষ নন, অন্যরকম। যেহেতু তিনি মানুষ নন, সেহেতু তার চরিত্র থাকবে কেন?
: সেটাইতো! তার চরিত্র নেই। চরিত্রহীন। নিজের মত করে বেহেশত সাজাতে গিয়ে বাহাত্তরটা হুরপরী রেখেছেন। একজন পুরুষ এতগুলো পরী দিয়ে কী করবে? তারপর বলেছেন যা খেতে চাইবে, চাওয়া মাত্র তাই পাবে। মানে তার মা বাবা খুব অভাবী ছিলেন, সন্তানকে ছোটবেলায় ঠিকমত খাওয়াতে পারেননি। এজন্য তিনি বেহেশবাসীকে সারাক্ষণ খাওয়ার উপর রাখতে চান। বিরক্তিকর।
: খুবই বিরক্তিকর। আপনার এসব কথা শুনে কারোরই মাথা ঠিক রাখতে পারার কথা নয়।
: কাঁচা মরিচ, পেয়াজ কুচি আর সর্ষের তেল দিয়ে মাখিয়ে মুড়ি চানাচুর খাবেন?
: কিভাবে খাবো বলেন, আপনি কীসব বিশ্রী বিশ্রী কথা বলে যাচ্ছেন। মেজাজ ঠান্ডা রাখা মুশকিল।
শফিককে মেজাজ ঠান্ডা করতে বসিয়ে রেখে পেয়াজ, মরিচ কাটতে যায় শাওন। পেয়াজ আছে, মরিচ আছে, কিন্তু ছোরা নেই। কিছুক্ষণ খুঁজলো, পায় না।
অবাক কান্ড! ছোরাটি গেলো কোথায়?
শফিক জানে না ছোরা কোথায়।
কী আর করা, হাত দিয়ে পেয়াজ মরিচ ছিঁড়ে ছিঁড়ে নেয় শাওন। সর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি চানাচুর মাখায়। শফিকের কাছে নিয়ে আসে। খাচ্ছে।
শফিকের চেহারা বলে জিনিসটা বেশ ভালো হয়েছে। খুব মনযোগ সহকারে খাচ্ছে।
শাওন কিছু বলছে না। শফিকও না। পাখিরা বলছে। দিনের শেষে জঙ্গলে ফিরে আসতে শুরু করেছে।
শাওনের মন পাখির গানে। শফিকের মন পাখির ঝিকিরে।
ঝিকিরের কথা শুনে শাওন হাসে। শফিকের মেজাজ খারাপ হয়।
শাওন যায় পানি আনতে। নিঃশব্দে তার পিছু পিছু শফিকও যায়। শাওনের হাতে পানির কন্টেইনার, মগে ঢালছে। শফিকের হাতে ছোরা, উপরওয়ালার নামে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। শাওন সরতে গিয়ে পড়ে যায়। শফিক মাটিতে পড়ে পাল্টি খায়।
: আপনি ছোরাটি লুকিয়ে রেখেছিলেন! কেন?
: তোকে মারার জন্য।
: মানুষ মানুষের জন্য।
: তুই মানুষ না। নাস্তিক। তোর সাহসতো কম না, আমার ধর্ম নিয়ে মশকরা করিস!
আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে। শাওন সরে যায়। সরতে গিয়ে এবারও পড়ে যায়। শফিকের হাতের ছোরা খানিক দূরে ছিটকে পড়ে। ঘরের মেঝেতে। দুজন দুই দিকে। মুখোমুখি হাঁপাচ্ছে। অন্ধকার নামছে। জানালায় শেষ বিকেলের অল্প কিছু আলো। শাওন তাকিয়ে আছে। শফিক দেখে দুটি সাপ জানালা দিয়ে নেমে এদিকে আসছে। সাপ দেখে ভয় পেয়েছে। আরেকটু পেছনে সরে বেড়ার সাথে পিঠ লাগিয়ে লেপ্টে থাকে। শাওনও। জঙ্গলের সাপ, বিষাক্ত। ঠোঁটের উপর আঙ্গুল চেপে শফিককে ইশারা করে শাওন।
সাপেরা সোজা চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু শফিক কথা রাখেনি। সে চুপ থাকেনি। মেলে রাখা পা দুটি গুটিয়ে নিতেই সাপেরা দুজন শফিকের দিকে ফনা তুলে দাঁড়িয়ে যায়। শফিক খুশি হওয়ার চেষ্টা করে। সে ভাবে এরা শাওনকে খাবে।
মিথ্যা কথা, এরা কাউকেই খাবে না।
একটি সাপ ঘুরে শাওনের দিকে পজিশন নেয়। শফিক ভাবে অন্য সাপটিও সেদিকে মুখ ঘোরাবে। কিন্তু না। ঘরের এক পাশের বেড়ায় হেলান দিয়ে শফিক, অন্য পাশে শাওন। মাঝখানে সাপেরা।
ব্যাপারটা এমন নয় যে, সাপ দু’টি শাওনকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে, অথবা শফিককে মারার চেষ্টা করছে। আসলে সাপতো এসব বুঝে না। কে কাকে খুন করতে চাইছে, এটা তাদের মাথাব্যথা নয়। সাপের চিন্তাজুড়ে আত্মরক্ষার ভাবনা।
ঘরটা জঙ্গলে। জঙ্গলে ঘর হোক আর ঝোপ হোক, মানুষের চেয়ে সাপের অধিকার বেশি। যদিও শাওন ও শফিক একাধিকবার পরিষ্কার বাংলায় বুঝানোর চেষ্টা করেছে তারা সাপের কোন ক্ষতি করতে আসেনি, দুজনই প্রাণ বাঁচাতে এখানে আত্মগোপন করেছে। কিন্তু এসব বলে কোন লাভ নেই। মানুষের পলিটিক্স বুঝতে সাপ বাধ্য নয়। তাছাড়া বিষাক্ত প্রাণীরা সবসময় নিজেরটাই বেশি বুঝে। যেমন শফিক। যে লোক তাকে হিসাবের পানি খেতে দিয়েছে, তার পিঠেই ছোরা বসাতে চাইছে।
শফিকের প্রতি শাওনের খুব রাগ হয়। ব্যাটা নাকি সাপ ভয় পায় না। ভয়ে পা গুটাতে গেলো কেন? চুপচাপ বসে থাকলে সাপেরা চলে যেতো। এখন মহাবিপদ। একটুও নড়াচড়া করা যাবে না। নড়লেই ছোবল!
সাপকে সাপুড়েও ভয় পায়। শফিকের কথায় যুক্তি আছে। ভয় না পেয়ে উপায় কী? যদি মেলে রাখা পায়ের পাতায় ছোবল মেরে বসতো? তাই গুটিয়ে নিয়েছে। এদিকে সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাত নামতে শুরু করেছে। আকাশে চাঁদ আছে। কিন্তু চাঁদের খুব বেশি আলো নেই। ছোট চাঁদ। তবুও জানালা আর দুয়ার দিয়ে যতটুকু আলো আসছে, তাতে সাপ ও মানুষ উভয়ে উভয়কে দেখতে পাচ্ছে।
সাপেরা ভাবছে চাঁদের আলো না থাকলে ভালো হতো, চুপি চুপি ভেগে যেতে পারতাম।
মানুষ ভাবছে ভাগ্যিস চাঁদের আলো আছে, নইলে অন্ধকারে কামড়ে দিতো।
পরিস্থিতি খুব জটিল আকার ধারণ করছে। ভয়ে, আতংকে, গরমে পুরো গা ভিজে জুবুথুবু। শরীরের চিপায় চাপায় ঘামের অবাধ চলাচল। শফিকের মনে হচ্ছে একটি সরু চিকন সাপ তার উরুভাঁজ বেয়ে নেমে পড়ছে। এমন ভয়ংকর ঘামের মুখোমুখি এর আগে কখনো হয়নি।
মানুষ মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে। সাপ মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে।
শফিক কাজটি ঠিক করেনি। শাওন নাস্তিক। ধর্ম নিয়ে তার কোন কথায়ই শফিকের ভালো লাগবে না। তবুও শাওনের সাথে ধর্ম নিয়ে কথা বলতে গেলো। এখন নাস্তিক খোঁচাতে গিয়ে সাপ বেরিয়ে এলো।
শাওনের উচিত ছিলো উপরওয়ালাকে সম্মান দিয়ে কথা বলা। কিন্তু সে সম্মান দেয়নি। এটা তার ব্যর্থতা। ধার্মিকের কাছে উপরওয়ালাই সবার উপরে। শাওন এতটা উপরে না উঠলেও পারতো।
শফিক চাইলে জঙ্গলে শাওনের বিগত দিনগুলোর গল্প শুনতে পারতো। জঙ্গল নিয়ে শাওনের দর্শন শুনতে পারতো। শাওনের মা কী করেন, বাপ কী করেন, ভাই বোন কয়জন, শাওন বিয়ে করেছে কিনা, করলে বাচ্চা কাচ্চা আছে কিনা, থাকলে কয়জন আছে, শাওনের পেশা কী, এখানে কতদিন থাকবে, তারপর কোথায় যাবে, কী করবে, এসব নিয়ে কথা বলতে পারতো। কিন্তু তা না করে উপরওয়ালার সিংহাসনের পায়া রক্ষা করতে গেলো। অযথা।
আশ্চর্য! এটা শফিকের দায়িত্ব। উপরওয়ালা এই দায়িত্ব দিয়ে শফিককে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। শাওন বুঝেও না বুঝার ভান করছে। এটা ঠিক নয়। ধর্ম হচ্ছে একজন ধার্মিকের ইঞ্জিন, আর উপরওয়ালা হচ্ছেন সেই ইঞ্জিনের ফুয়েল। ফুয়েল ছাড়া শফিকরা চলতে পারে না। এটা তাদের অপরাধ নয়, বেঁচে থাকার অধিকার। এখানে দোষ যদি কিছু হয়ে থাকে, তবে শাওনের হয়েছে, শফিকের নয়।
শাওন কথা ঘুরিয়ে রান্না করতে গিয়েছে, শফিক ছোরা লুকিয়ে রেখেছে। শাওন কথা ঘুরিয়ে মুড়ি চানাচুর মাখাতে গিয়েছে, শফিক লুকিয়ে রাখা ছোরা শাওনের পিঠে বসানোর প্ল্যান করেছে। শাওন কথা ঘুরিয়ে পানি আনতে গিয়েছে, শফিক ছোরা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। শাওন ইশারায় চুপ থাকতে বলেছে, শফিক পা গুটাতে গিয়ে সাপের মুখে পড়েছে। শাওনকে সহ।
এখন শাওন ঘুমানোর ভান করে ঘাড় কাৎ করে রেখেছে। শাওনকে ঘুমাতে দেখে শফিকও ঘুমানোর চেষ্টা করছে। ঘুমাচ্ছে।
সাপ দেখতে পায় শফিক ঘুমাচ্ছে, শাওন ঘুমাচ্ছে। সুতরাং নিশ্চিন্ত। নিরাপদ। তারা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। চলে যায়।
শাওন ভান ভেঙে উঠে প্রথমে ছোরাটি কুড়িয়ে নেয়। বিকেলে কেটে রাখা পেয়াজ মরিচ আছে। দুপুরে সেদ্ধ করা একটি বড় আলু আছে। ভর্তা বানায়। ডাল দিয়ে ভাত খায়। হারিকেন জ্বালায়। বসে বসে শফিকের ঘুম দেখে। শফিকের শরীর পাশে রাখা জামা কাপড়ের বস্তার উপর গড়িয়ে পড়ে। খুব ভালো ঘুম হচ্ছে। শাওনের ঝিমানিও হচ্ছে না। জীবনে আরেকবার নিজের বোকামি ধরতে পেরেছে। খুনীর ধাওয়া খাওয়া একটি লোকের কাছে নিজের খুন হওয়ার ভয়ের কথা বলে এখন সেই লোকের হাতে খুন হতে নিয়েছে। বোকামি বুঝতে পেরে নিজের প্রতি খুব রাগ হয়। ভয়ের কথা কাউকে বলতে নেই, দাদির বলা এই উপদেশ তার ভুলে যাওয়া উচিত হয়নি।
শফিক ঘুমাচ্ছে। জঙ্গলের গাছগাছালি, পাখিরা ঘুমাচ্ছে। কিছু পশু, সাপ, শাওনরা জেগে আছে। নিজেদের পাহারা দিচ্ছে।
০৩.
শফিকের খুব ভালো ঘুম হয়। ভোর হয়। শাওনের অপেক্ষার শেষ হয়।
শফিক ঘুম ভেঙে দিনের আলো দেখেই বললো, ছোরাটি কোথায়?
শাওন ছোরা হাতে বসে আছে।
: তুই কি আমাকে খুন করবি?
: কেন?
: আমাকে খুন করে তোর কোন লাভ হবে না। একটা টাকাও পাবি না।
: হুম।
: কিন্তু তোকে খুন করলে আমার লাভ হবে। বুঝতেই পারছিস কী লাভ হবে, নতুন করে বলার কিছু নাই।
: হুম।
: জঙ্গিরা একদিন না একদিন তোকে মারবেই। মৃত্যুর অপেক্ষা না করে ছোরাটি আমার হাতে দে। মরে যা।
: হুম।
: আমাকেও হয়তো ওরা মেরে ফেলবে। কিন্তু তার আগে যদি তোকে মারতে পারি, তাহলে ওই বিষয়টা কনফার্ম হয়ে যাবে। বুঝতেই পারছিস কোন বিষয়টা কনফার্ম হবে, নতুন করে বলার কিছু নাই।
: আমার বন্ধু গত পরশুর আগেরদিন আসার কথা ছিলো। কিন্তু আসেনি। জানি না তার কোন বিপদ হয়েছে কিনা। জমানো রেশনের উপর টিকে ছিলাম। কিন্তু কার্বলিক এসিড শেষ হয়ে গেছে। এখানে আর থাকা যাবে না। এই জঙ্গলে প্রচুর সাপ। আমি এখান থেকে চলে যাবো।
কাল রাতে যা ঘটেছে, শফিকও নিশ্চয় আর এখানে থাকবে না। অন্য কোথাও চলে যাবে। কিন্তু শাওন কোথায় যাবে? নাস্তিকের জন্য দেশের এক ইঞ্চি জায়গাও নিরাপদ নয়। শাওন কেন নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে, এটা শফিকের বুঝে আসছে না। শফিকের কথা হচ্ছে, শাওন যদি জঙ্গিদের হাতে মরে, তাহলে কারোরই কোন উপকার হবে না। কারণ কোন ধর্মই জঙ্গিবাদ সমর্থন করে না। কিন্তু শাওন যদি একজন ধার্মিকের হাতে মরে, তাহলে সেই ধার্মিকের জন্য ওই বিষয়টি কনফার্ম হয়ে যাবে। সুতরাং শাওনের উচিত শফিককে সাহায্য করা। মানুষ হয়ে একজন মানুষের এই উপরকারটুকুন করতে না পারলে আর কীসের মানুষ!
ঘরের মেঝেতে ছোরা দিয়ে লাইন এঁকে দেয় শাওন। শফিক যেন লাইন না ডিঙায়। ডিঙালেই…! দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়। শফিক খুব হতাশ হয়ে শাওনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এখন এই ঘর ছেড়ে দুজন দুদিকে চলে যাবে। যেহেতু শাওনের হাতে ছোরা, সেহেতু সবকিছু শাওনের কথামত চলবে। সেই হুকুম দিবে। হুকুম অনুযায়ী আগে শফিককে যেতে হবে। শফিক যেদিকে যাবে, শাওন তার উল্টোদিকে যাবে। শফিক যদি জঙ্গলের ডান দিকে যায়, শাওন যাবে বাম দিকে। আর শফিক বামে গেলে শাওন ডানে যাবে।
: তুই কোথায় যাবি?
: অন্য কোথাও পালাবো। আপনি কী করবেন?
: তোকে খুঁজে বের করবো।
০৪.
জঙ্গলের ডান দিকের পথ ধরে শফিক চলে যায়।
খুনীরা ডানের রাস্তা ধরে চলে গেলো এই লাইনটি শেষে গিয়ে বুঝলাম।
বরাবরের মতই চমৎকার।
ধন্যবাদ চৌধুরী সাহেব 🙂
দারুন।
রূপকথার গল্পবিশ্বাসী অসুস্থ সমাজের নাগরিকে আজ ছেয়ে গেছে দশদিক। এরা খুন হলেও ডানে যায়; খুনি হলেও ডানে যায়। এরা মোহগ্রস্থ। শুধু একদিকেই যেতে থাকে; গড্ডালিকা প্রবাহের একেকজন হয়ে। মোহটা ধর্মের; এই মোহে জীবন রক্ষাকারীকে খুন করে ফেলাটাও হয় গায়েবী মহারাজের মহা তুষ্টির জন্য। আর যারা রূপকথার গল্পের মোহে না পড়ে সুস্থতা খোঁজে, শাওনের মত; তাদের থাকতে হয়, খেয়ে না খেয়ে, লোকালয় ছেড়ে দূর বনে। সত্যি কথা বলবার জন্য হতে হয় খুন, বিতাড়িত অথবা নির্যাতিত। কি বেদনাদায়ক। কি কষ্ট। অথচ শাওনরা না থাকলে, না চেনালে সূর্য্যটা, ওটা শোভা হয়েই থাকতো; কখনো সূর্য্যতারা হতোনা। আলোকিত হবার উৎস হতো না। ভেবোনা শাওন; ভেবোনা:
ওদের মনে হবে আমরা ভিনগ্রহের ভাষায় বলছি,
যেখানে বর্ণমালা ব্যাকরণ যেন অদ্ভুত এক দীর্ঘশ্বাস;
বিন্যাস শর্তহীন, একাকার কাঠামো, অনুভবটাই ভাষা,
হয়তো, একদিন, ওরা ইউরেকা চিৎকারে মেনে নেবে।
ভেবোনা। ভেবোনা একদম।
গ্রহান্তরের আগন্তকের মতো,
আবছা মতো;
আছে কিন্তু নেই এর মত,
অধরার মতো,
নাটোরের বনলতার মত,
জীবনের ভালবাসার মতো,
অন্যরকম একটা কিছুর মত,
দৃশ্যমান সত্যির মতো,
বন্ধুর মত,
একটু উষ্ণতার মত,
ওরা,
ওরা ঠিক একদিন একাকার হবে।
ভেবোনা।
বুঝতে শিখবে।
একটুও ভেবোনা।
ওরাও ভালবাসতে শিখবে।
অতি সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, কাজী দা।
শুভকামনা।
@সবাক, আপনার এইম ইন লাইফ কী? ছোটবেলায় রচনায় কী লিখতেন? ছোট গল্পকার হওয়া?
রচনায় একেক সময় একেক কিছু লিখতাম। ছোট গল্পকার হওয়া লিখিনি কখনো।
বরাবরের মতো ভালো লেগেছে ভাই। আরও বেশি পলিটিক্যাল গল্প চাই। আপনার এসব প্রতিকী পলিটিক্যাল গল্পের ভক্ত বনে গেছি।
আরও বেশি চাঁছাছোলা গল্পের অপেক্ষায়।
পাবি।