অভিজিৎ রায় আর বাংলাদেশের জন্ম প্রায় সমসাময়িক। শিক্ষক পিতা অজয় রায় অস্ত্রহাতে লড়তে গিয়ে নবজাতকের জন্মের খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন আসামের শিবনগরের নাজিরা ম্যাটারনিটি সেন্টারে। তিনি যখন চাপাতির ধারালো আঘাতে লুটিয়ে পড়েছিলেন বাংলা একাডেমির পাশের রাস্তায়, সেটাও একার্থে রূপকই ছিল। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার, মুক্তমনের প্রতিভূ পরাভূত হলেন প্রতিক্রিয়শীলতার দীর্ঘ, অন্ধ কালো ছায়ার নিচেই। হুমায়ুন আজাদেরও পরিণতি ছিল একই। কাছাকাছি জায়গা থেকে তাঁরা কাছাকাছি কারণে কাছাকাছি হয়ে রইলেন জীবনে ও মৃত্যুতে। তফাৎটা হল, একজনের বেলায় তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় না-থাকলেও প্রকাশ্যে অধ্যাপক আজাদের হত্যার বিচার চেয়েছিল, কিন্তু তারাই এবার ক্ষমতায় থেকেও দিব্যি চাপা দিয়ে গেছে অভিজিৎ হত্যার বিচার।
অভিজিৎ রায়ের লেখনি বিচিত্র পথে গেছে, সর্বত্রগামী না-হলেও। এবং, আজাদের সীমার চাইতেও বেশি কোনো কোনো জায়গায়। ধর্মীয় তো বটেই, যৌনরুচির ও ভিন্নধারার সংখ্যালঘুদের নিয়েও তিনি বিচলিত ছিলেন, এবং লেখালেখি করে গেছেন কিবোর্ডে ঝড় তুলে। সমকামিতা যেখানে অনেক প্রগতিশীলদের কাছেও নাকসিঁটকানো নোংরামো, সেখানে তিনি সেটি নিয়ে বিরামহীন যুক্তিতর্ক করে গেছেন অনলাইনে, বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণসহ প্রচুর পড়াশুনো করে রচনা করে গেছেন একটি আকরগ্রন্থ। ধর্মের যুক্তিহীন অমানবিকতার দিকে আঙুল তুলে তিনি রচনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ। মৃত্যুও তাঁর এসেছে সেই পথ ধরেই, আদর্শিক থাকার মহোপরাধে।
তাঁর প্রজ্ঞা, মানবিকতা, পাঠাভ্যেসের প্রগাঢ়তা ইত্যাদি নিয়ে অনেকে জানেন, অনেকে লিখেছেন, অনেকেই লিখবেন। নিরন্তর হতাশা থাকবে বৈশ্বিক ও দেশিক রাজনৈতিক, সামাজিক, ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ে তাঁর বিশ্লেষণাত্মক লেখা পাওয়ার। সাথে থাকবে তাঁর নৃশংস হত্যার বিচারের দাবি।
কিন্তু আজ দুচারটে কথা বলব একটু ভিন্নতর বিষয় নিয়ে।
মুক্তমনা ছিল ড. রায়ের সন্তানবৎ। তিনি নিজে এতে প্রচুর সময় দিয়েছেন, লিখেছেন দুহাতে, আলোচনা সমালোচনায় কাটিয়েছেন প্রচুর সময়। কিন্তু তাঁর যে-দিকটি আমার নজর কেড়েছিল, সেটি হল, তিনি নতুন প্রচুর লেখককে ডেকে এনেছেন এখানে লেখার জন্যে। অন্যান্য ব্লগে হোক বা মুক্তমনাতে, তিনি যখনই কাউকে প্রতিশ্রুতিশীল ভেবেছেন, অনুরোধ জানিয়েছেন, আহ্বান জানিয়েছেন তিনি বা তাঁরা যেন মুক্তমনায় লেখা দেন। এমনকি ফেসবুক থেকেও তিনি পরিচিতদের ডেকে এনে লিখতে বলেছেন।
কেউ লেখালেখি বা পড়াশুনোয় আগ্রহী দেখলে জেগে উঠেছে তাঁর সম্পাদক সত্তা। শুধু আহ্বানই নয়, তিনি উৎসাহিত করে গেছেন নতুনদের লেখায় মন্তব্য করে। আমি নিজেই অন্য ব্লগে তাঁর আহ্বানে মুক্তমনায় লিখতে আসি। এবং, এই নবীনতর লেখকের দুটো ব্লগপোস্ট স্টিকি করে মুক্তমনা আমায় অনন্য সম্মান দান করে। এরকম একাধিকজনের কথা জানি, যাঁরা মুক্তমনা তথা অভিজিৎ রায়ের সৌজন্যবোধের সাক্ষি।
শুধু তাইই নয়, তিনি সবাইকে সর্বোচ্চ সম্মান দিতেন।
মফস্বলের কিশোরটি, যে কিছুদিন আগে মাত্র ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছে, সেও তাঁকে প্রশ্ন করে সুগঠিত উত্তর পেত। অনেক তুলনামূলক অপরিচিত মানুষও তাঁর কাছ থেকে ফেসবুকে বন্ধু হওয়ার আহ্বান পেয়ে বিহ্বল হয়েছে। মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধাবোধে হয়েছে আপ্লুত।
বস্তুত, তিনি মানুষটিই ছিলেন এমন। সুভদ্রতা, সুভাষিতা, ও সৌজন্যবোধের মূর্ত প্রতীক। তাঁর সাথে মুখোমুখি আলাপেও যেকেউ এই বৈশিষ্ট্যটি দেখতে পেতোই। বয়েস, যোগ্যতা, জ্ঞানগম্যি যার যাইই থাকুক, তিনি সর্বদা সম্মান ও সৌহার্দ্য দিয়েই আলাপে জড়িয়েছেন।
শুধু লেখক, বিশ্লেষক, বা আলোচক হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও তিনি অনেকের চাইতে এগিয়ে ছিলেন অনেকদিকেই।
জন্মদিনের শুভেচ্ছা রইল চিরতরুণ!
ভালোবাসা, অভিদা।
Leave A Comment