লিখেছেন: ফাহিম আহমেদ

সম্পদের অভিশাপ বা Resource Curse বলতে এমন একটি অবস্থাকে বোঝায় যেখানে একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য (বিশেষত অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন- খনিজ সম্পদ, জ্বালানি ইত্যাদি) থাকার ফলে সেখানে অর্থনীতির মন্থর গতি, স্বল্প গণতন্ত্র এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্ত-রাষ্ট্রীয় সংঘাত দেখা দেয়। এ অবস্থাকে Paradox of Plenty বা প্রাচুর্যের আপাতবৈপরীত্ব হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়। প্রাকৃতিক সম্পদ একটি রাষ্ট্রের জন্য অর্থনৈতিকভাবে সৌভাগ্যের না হয়ে দুর্ভাগ্যের হতে পারে এমন একটি ধারণা বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমস্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রথম ব্যবহৃত হয়। ১৯৯৩ সালে সর্বপ্রথম Resource Curse প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ Richard Auty । তিনি নিজ অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রমাণ করেন কীভাবে প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ একটি দেশ প্রায়ই ধীরগতিতে, দুর্নীতিতে, সহিংস ও কর্তৃত্ববাদী কায়দায় উন্নত হয়। নাইজেরিয়ার তেল, সিয়েরা লিওন ও অ্যাঙ্গোলার রক্তাক্ত হীরা, বলিভিয়ার টিনসহ পৃথিবীতে উপস্থিত সব খনিজ পদার্থের একটি বড় অংশ নিজ দেশের জন্য কোন না কোনোভাবে বয়ে এনেছে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা।

Photograph: Getty Images (Internet)

প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষত খনিজ তেল বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারগুলোকে বিগত দশকগুলোতে অধিক কর্তৃত্ববাদী হতে প্রভাবিত করেছে। এর মূল কারণ হলো নাগরিক কর্তৃক প্রদত্ত কর এর অনুপস্থিতি অথবা অপ্রতুলতা। যখন সরকারের আয়ের প্রধান উৎস জনগণের করের টাকা হয় তখন সরকার জনগণের ইচ্ছা ও গণতন্ত্রের প্রতি অধিক সংবেদনশীল থাকে। কিন্তু যদি বিপরীতটি হয়, অর্থাৎ সরকারের আয়ের প্রধান উৎস জনগণের কর না হয়ে প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে অর্জিত রাজস্ব হয়ে থাকে তখন সে সরকার নাগরিক অংশগ্রহণ ও গণতন্ত্রের প্রতি খুব বেশি মনোযোগ দিতে বাধ্য থাকে না। প্রাকৃতিক সম্পদ নানা ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি, প্ররোচিত ও প্রসারিত করে থাকে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে নাশকতার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক যোগান নিশ্চিত করছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, ১৯৯০ সাল থেকে খনিজ তেল সরবরাহকারী দেশগুলোতে গৃহযুদ্ধের আশংঙ্কা খনিজ তেলবিহীন দেশের তুলনায় দ্বিগুন হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রবণতার উদাহরণ হিসেবে কঙ্গো, নাইজার ডেল্টা, ইরাক, লিবিয়া ও অ্যাঙ্গোলার পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্য।

সম্পদের অভিশাপ ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে Dutch Disease একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। প্রাকৃতিক সম্পদের মাধ্যমে অর্জিত বড় অংকের রাজস্ব একটি রাষ্ট্রের অন্যান্য রপ্তানীভিত্তিক খাতকে বিপদগ্রস্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ বহির্ভুত অন্যান্য রপ্তানীভিত্তিক খাত থেকে শ্রম ও মূলধন প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে স্থানান্তর করা হয় যেন এ খাত থেকে অধিক রাজস্ব আয় করা সম্ভব হয়। এর মাধ্যমে শ্রম ও মূলধনের কেন্দ্রীকরণের দ্বারা যে অর্থনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় তাকেই Dutch Disease বলে । ১৯৫৯ সালে নেদারল্যান্ডসে একটি বৃহৎ গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের ফলে এ সমস্যাটি প্রথম চিহ্নিত করা হয়। ইরান, রাশিয়া, ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগো এবং ভেনেজুয়েলাতে Dutch Disease এর কারণে
প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ বহির্ভুত রপ্তানীখাতগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ব্যাপক নির্ভরশীলতা একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে লিঙ্গ বৈষম্য ও নারীর নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে। বিশ্বে খনিজ তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর কর্মক্ষেত্রে ও সরকারি প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ খুবই নগন্য। এসকল দেশে Dutch Disease এর কারণে অন্যান্য রপ্তানীমুখী শিল্পগুলোর বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয় যা নারীর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণকে সীমিত করে রাখে।

প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ বহু দেশের সরকারের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সেবা খাতে বরাদ্দের চেয়ে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ভাতা, খনিজ সম্পদের (বিশেষত জ্বালানি তেল) ওপর ভর্তুকি প্রদান, বিশাল আকৃতির স্থাপনা নির্মাণ প্রভৃতি খাতে রাজস্বের একটি বড় অংশ ব্যয় করা। এ ধরণের পরিকল্পনা সীমিত সময়ের জন্য সে দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে এলে এসকল দেশের সরকার নাগরিক সেবা পরিপন্থী তথাকথিত উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ঋণমুখী হতে দ্বিধা করে না। এরূপ আচরণের ফলে মেক্সিকো, নাইজেরিয়া ও ভেনেজুয়েলা ১৯৮০’র দশকে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে। একইভাবে এসব দেশের বেসরকারী খাত কিছুদিন সফলতার মুখ দেখলেও
দ্রুতই দেউলিয়া হয়ে পড়ে।

প্রাকৃতিক সম্পদ সকল ক্ষেত্রে অভিশাপ নয় এবং বহু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে উপরোক্ত যুক্তিগুলো অচল। বিগত ২৫ বছরে চিলি, ইন্দোনেশিয়া, নরওয়ে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত Dutch Disease ব্যাপকভাবে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। তবে প্রাকৃতিক সম্পদ একটি রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ হবে না আশির্বাদ তা নির্ভর করে সে রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতার মাত্রার ওপর। অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ তাই একটি রাষ্ট্রের জন্য একই সময় আকাঙ্খা ও আশাঙ্কার কারণ হতে পারে। সঠিক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন একটি রাষ্ট্রের বিদ্যমান ও ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য প্রগতি আনতে পারে ঠিক একইভাবে এ সম্পদের অপব্যবহার সে রাষ্টের জন্য সৃষ্টি করতে পারে দীর্ঘমেয়াদী সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা।