বাংলা অভিধানে ‘খোজকর’ শব্দের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়না।এমনকি বৃহত্তর সিলেটের বাইরে কোথাও এর অস্তিত্ব আছে কি না সে ব্যাপারেও সন্দেহ আছে।সিলেটেও বর্তমানে এটি একটি মৃত শব্দ। শ্রীযুত অচ্যুৎ চৌধুরী প্রণীত ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ নামক সুবিশাল গ্রন্থে কয়েক লাইনে খোজকর শব্দের উল্লেখ থাকলেও প্রথমেই সেখানে তার ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। গ্রন্থমতে ফালজোড়ের কালী সদনে এক সময় নরবলির প্রচলন ছিল। শারদীয় পূজার নবমী তিথীতে অথবা জয়ন্তিয়া রাজকুমারদের জন্মাদি অনুষ্টান উপলক্ষে নরবলি দেয়া হতো। চরগণ অন্যান্য রাজ্য থেকে বলির জন্য মনুষ্য সংগ্রহ করত আর এই চরদেরই বলা হতো খোজকর ১।বলিদানের তথ্য সঠিক হলেও খোজকর নামকরণের তথ্য সঠিক নয় কারণ নরবলির জন্য মনুষ্য সংগ্রহকারীদের নাম খোজকর হওয়ার কোনো কারণ নেই। খোছকর বা খোজকর শব্দটি গঠিত হয়েছে ফার্সী খোজা ও বাংলা কর প্রত্যয় যোগে।খোজা মানে নপুংশক এবং এর সাথে কর প্রত্যয়যোগে হয়েছে খোজাকর<খোজকর<খোছকর। তারমানে খোজকর শব্দের অর্থ দাঁড়ায় কৃত্রিম উপায়ে খোজা বা নপুংশক বানানো।সিলেটে কয়েক শতাব্দী ব্যাপী এই কুপ্রথাটি চালু ছিল।ছেলেধরা চক্র প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শিশুদের ধরে খোজা বানিয়ে বাইরে বিক্রি বা পাচার করে দিত।খোজাকরণের সাথে নরবলির সম্পর্ক হয় কী করে? অবশ্য মনুষ্য বেচাকেনা বা মনুষ্য পাচারের একটি প্রাচীন রুট ছিল সিলেট এলাকা।সুতরাং ছেলেধরা পেশাটিও সিলেটে সুপ্রচলিত ছিল।একারণে বলি, পাচার বা খোজা বানানোর জন্য সকল অপহরনকারীই এক খোজকর নামে অভিহিত হওয়া অস্বাভাবিক ছিলনা।অবশ্য ফুটনোটে ইতিবৃত্তের গ্রন্থকার ‘হয়তো’ শব্দ দিয়ে প্রায় সঠিক তথ্যই দিয়েছেন। ২

সিলেটে খোজকর প্রথার উৎপত্তি প্রসঙ্গে আলোচনার আগে খোজাদের ইতিহাস বিষয়ে কিঞ্চিত আলোকপাত প্রয়োজন। বাইবেলের ম্যাথু অধ্যায়ের বর্ণনা মতে “For there are some eunuchs, which were so born from their mother’s womb: and there are some eunuchs, which were made eunuchs of men: and there be eunuchs, which have made themselves eunuchs for the kingdom of heaven’s sake”৩ বাইবেলের এই উক্তি থেকেই প্রমানিত হয় নপুংশক বা খোজাকরণের ঘৃণ্য প্রথাটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন।শেষোক্ত ধর্মীয় কুসংস্কার বশতঃ স্বেচ্ছায় নপুংসক হওয়ার নজির একাদশ শতকের খৃষ্টান স্কপ্টসি (Skoptsy) সম্প্রয়াদায় যারা জাগতিক কামনা বাসনাকে বিসর্জন কল্পে স্বেচ্ছায় নিজেদের লিঙ্গচ্ছেদ করে খোজাতে পরিনত হতো।তৎকালীন সময়ে এদের সংখ্যাটিও উল্লেখ করার মতো।প্রায় লক্ষাধিক সদস্য এই দলভুক্ত ছিল। আর ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের বা নিজেদের হীন স্বার্থে কাউকে খোজা বানানোর প্রথম ঘটনা ঘটে প্রাচীন মেসিপ্টোমিয়ায়। আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের রানী সেমিরামিস (খৃঃপূর্ব ৮১১-৮০৮)প্রথমবারের মতো একটি বালকের লিঙ্গ ছেদন করে এই ঘৃণ্য প্রথার সূত্রপাত করেন।৪

খোজা করণের অমানবিক পদ্ধতি

একটি শিশু যে একটি বিশেষ লিঙ্গের অধিকারী হয়ে জন্ম গ্রহণ করে তাকে মানুষের বিকৃত মানসিকতার বা ক্ষুধার খোরাক বানাতে যে সার্জারির মাধ্যমে বদলে ফেলা হতো কেমন ছিল সেই পদ্ধতি? এ বিষয়ে বিস্তৃত বিবরণ আছে বিখ্যাত ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিক Barbara Chase-Riboud এর লেখা ‘Valide; novel of Harem উপন্যাসে।৫

বারবারার বর্ণনা মতে-প্রথমে বালক বা কিশোরকে হেলান অবস্থায় বসিয়ে তলপেঠ ও উরোর উপরি অংশে ফিতা দিয়ে শক্তভাবে বেঁধে দেয়া হতো যাতে অধিক রক্তক্ষরণ না হয়।তারপর লিঙ্গ এবং অন্ডকোষকে তিনবার ঝাল মরিচ গোলা পানি দিয়ে ধুয়া হতো।সম্ভবতঃ এনেস্থেসিয়ার বিকল্প হিসেবে এটি করা হতো।মরিচ গোলা পানিতে অঙ্গ ধৌতকরণের কারণে প্রচন্ড ঝালা হতো এবং এই যন্ত্রণাদায়ক অবস্থাতেই একটি বাঁকানো চাকু দিয়ে লিঙ্গ এবং অন্ডকোষকে যথা সম্ভব চামড়ার সাথে লাগিয়ে কেটে ফেলা হতো।প্রস্রাব নালীতে একটি ধাতব কাঠি ( আমাদের দেশে নিমের চিকন ডাল ) প্রবেশ করিয়ে কাটা অঙ্গকে ঠান্ডা পানিতে ভিজানো কাগজ দিয়ে ঢেকে সতর্কভাবে ব্যান্ডেজ করা হতো। ব্যান্ডেজের পর দুইজন হাজামের সাহায্যে আক্রান্তকে হাঁটিয়ে তার কক্ষে নেয়া হতো এবং দু’তিন ঘন্টা পর তাকে শুইয়ে দেয়া হতো। তিনদিন তাকে কিছুই পান করতে দেয়া হতোনা। একদিকে কাটা অঙ্গের যন্ত্রণা অপরদিকে বুক ফাঁটা তৃষ্ণা।এ ভাবেই তাকে তিল তিল করে দিনটি দিন অতিক্রম করতে হতো। তিনদিন পর ব্যান্ডেজ খুলে কাঠিটি বের করে আনার পর যদি ঝর্ণার মতো মূত্রধারা প্রবাহিত হতো তবেই অপারেশন সফল বলে গণ্য হতো আর মূত্র না বের হলে সেই হতভাগা শিশুটির অবধারিত পরিনাম ছিল মৃত্যু কারণ মূত্র বের না হওয়ার অর্থ তার কিডনী ডেমেজ হয়ে গেছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই শিশু কিশোরগণ কিডনী নষ্টের কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো।

এই নির্দয় সার্জারি আর পৌরষত্ব হারানোর যন্ত্রণা ভুক্তভোগীকে কী রকম হিংস্র এবং প্রতিশোধ পরায়ন করে তুলতো Valide উপন্যাসে সে রকম একটি ঘটনার উল্লেখ আছে।বারবারা ঐতিহাসিক হেরোডিটাসকে উদ্ধৃত করে উল্লেখ করেছেন খৃষ্টপূর্ব ৪৮০-৮১ অব্দের দিকে প্যানোনিয়াস নামক এক ব্যক্তি হার্মোডিটাস নামের একটি বালককে জোরপূর্বক খোজা বানিয়ে বিক্রি করে দেয়। নিজের পৌরষত্ব হারানোর ক্ষোভ হার্মোডিটাসকে এতটাই প্রতিশোধপরায়ন করে তুলে যে পরবর্তীকালে যখন অনুকূল সময় আসে তখন তিনি প্যানোনিয়াস ও তার পরিবারকে অবরুদ্ধ করে প্যানোনিয়াসকে দিয়ে তার চার সন্তানকে খোজা বানাতে বাধ্য করেন। কিন্তু এতেও তার পূর্ণ পরিতৃপ্তি না হওয়াতে সন্তানদের দিয়ে প্যানোন্যাসকেও নপুংশক বানিয়ে প্রতিশোধের ষোলকলা পূর্ণ করেন।৬

খোজাদের বাণিজ্যিক ব্যবহার

খোজাকরণের পর একেবারে প্রথম থেকেই এসেরিও সাম্রাজ্যে এদেরকে প্রহরীর কাজে নিয়োজিত করা হয়। ভাগ্যের পরিহাস, যে বিকৃত মানসিকতার কারণে রানী সেমিরামিস এই প্রথার সূত্রপাত করেছিলেন তার জীবনাবসান হয় তারই সৃষ্ট এক খোজার হাতে।রাজ অন্তঃপুরী প্রহরার কাজে খোজাদের বিশ্বস্ততার সুখ্যাতির কারণে দেশে দেশে এদের চাহিদা দ্রুত বেড়ে যেতে থাকে। পারস্য মিশরে ফিনেশিয়, কার্তাজিনিয়ান গ্রীক ও রোমান শাসকগণ এই কাজে খোজাদের নিয়োগ দেন। চিওস ও ডিলস দ্বীপপুঞ্জ এবং ইপেসাস শহর খোজাদের জন্য খ্যাত ছিল।ইহুদি নবি ইয়াকুব পুত্র ইউসুফ মিশরে ফারাও সম্রাটের কারাগারে বন্দি অবস্থায় যে দুজন কারারক্ষীর সাক্ষাৎ পান এ দুজনই ছিলেন খোজা।পুতিপার নামক যে ব্যক্তি ইউসূফকে ক্রয় করেন তিনিও খোজা ছিলেন।রোমান ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যেও খোজাদের ব্যবহার ছিল।রাশিয়ার রাজকুমারীদের হেরেম প্রহরায়ও খোজারা নিয়োজিত ছিল। বাইজেন্টাইনদের কাছ থেকে তুর্কি অটোমানরা খোজাপ্রথা ধার করে। অটোমান সম্রাটদের হেরেম ছিল নারীতে পরিপূর্ণ সেই বিশাল সংখ্যক জেনানাকে পাহারা দেয়ার জন্য প্রচুর খোজার প্রয়োজন পড়ে আর এর পুরোটাই সরবরাহ করে বাইজেন্টাইনরা। সাধারনতঃ হেরেম প্রহরায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ খোজা ব্যবহার করা হতো।শ্বেতাঙ্গ খোজাদের হেরেমের খুব নিকঠে ভিড়তে দেয়া হতোনা এর কারণ এদের অনেকের লিঙ্গচ্ছেদন অসম্পূর্ণ থাকত এবং এদের সৌন্দর্যে হেরেমবাসিনীদের প্রবলভাবে আকর্ষিতা হবারও আশঙ্কা থেকে যেত। এ কাজে বরং নিগ্রো খোজাদের চাহিদা ছিল বেশী কারণ এদের চেহারা দেখে নারীরা কাছে ভিড়ার সাহস পেতনা এবং তূলনামুলকভাবে এরা বেশী বিশ্বস্ত ছিল। তথাপিও কিছুদিন পর পর হেরেমের ডাক্তার প্রতিটি খোজা প্রহরীকে পরীক্ষা করে দেখতেন তাদের নিম্নভাগে কোনো অবাঞ্চিত অঙ্গ গজিয়ে উঠল কি না। খোজাকরণ প্রক্রিয়াটি মুসলমানদের আবিষ্কার না হলেও এবং তাদের ধর্মীয় মতে প্রথাটিকে নিষিদ্ধ গণ্য করা হলেও মুসলমান শাসকরা একে ব্যাপকভাবে আত্নস্থ করেন।৭ এক সময় এটা শুধু হেরেম পাহারা দেয়াই মুখ্য উদ্দেশ্য না থেকে বরং যৌনাচারের এক বিকৃত কলায় পরিনত হয় এবং এ কাজে মুসলমান শাসকদের নানা কীর্তি কাহিনী ইতিহাস হয়ে আছে। এরা অস্বভাবিক যৌনাচারকে প্রাতিষ্টানিক রূপ দেন।খলিফা হারুন আল রশিদের সময়ে বাগদাদে অস্বভাবিক যৌনাচারকলা শিক্ষা দেয়ার জন্য গোলমান বা গিলম্যান ইনষ্টিটিউট পর্যন্ত প্রতিষ্টিত হয়।খলিফা আল-মামুনের শাসনামলে এক বিচারকের চারশত গোলমান থাকার কথা জানা যায়। এই গোলমানগণ প্রায় সকলেই খোজা হতেন।৮ আরব ও পারস্য দেশের কবিদের কবিতায় উঠে আসে এই সুন্দর বালকদের কথা। আবু নোয়াসের মতো কবি তার কবিতায় আরবদের বিকৃত আবেগকে ধারণ করতে দ্বিধা করেননি। এরাই ফার্সি রুবাইয়াতে বহুল উল্লেখিত সাকি। আমাদের কবি নজরুলও ফার্সি কবিদের অনুকরণে সাকি নিয়ে গান রচনা করেছেন ‘করুণ কেন অরুণ আখিঁ,দাওগো সাকি দাও শরাব’ অথবা ‘এ কোন মধুর শরাব দিলে আল আরাবি সাকি’ ইত্যাদি। অবশ্য এ স্থলে মনে হয় শরাব বলতে ইসলাম আর সাকি বলতে এর প্রবর্তককে বুঝানো হয়েছে।

ভারতবর্ষে মুসলমান ও তাদের বিকৃত সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ

মুসলমান শাসকদের আগমনের সাথে সাথে ভারতবর্ষেও এই কুখ্যাত প্রথার আমদানী ঘটে।“Along with their faith Islamic rulers brought their homo sexual customs, and as a result homosexual loves figured in the lives of some of the most prominent of the Islamic rulers of India.৯ আর এই বিখ্যাতদের মাঝ থেকে সর্ব প্রথমেই যে নামটির কথা উল্লেখ করতে হয় তিনি গজনীর সুলতান মাহমুদ।নজরুল তাঁর বিখ্যাত সাম্যবাদী কবিতায় এই মাহমুদকেই আহবান জানিয়েছিলেন-“কোথা চেঙ্গিস,গজনী মামুদ,কোথায় কালা পাহাড়” বলে।এই সুলতান মাহমুদের গোলমান আসক্তি ছিল বিষ্ময়কর।খোদাভীরু পরম ধার্মিক এই শাসকের মনোরঞ্জনের জন্য নিয়োজিত ছিল চার হাজার সুদর্শন তুর্কি কিশোর।তিনি যখন সিংহাসনে বসতেন তার বাম পাশে দাঁড়াতো দুহাজার গোলমান যাদের মাথায় থাকতো চার পালকযুক্ত টুপি হাতে সোনালী দন্ড ডান পাশে দাঁড়াতো দুহাজার কিশোর যাদের মাথায় থাকতো দুই পালক বিশিষ্ট টুপি এবং হাতে রুপালী দন্ড।জর্জিয়ান কিশোর মালিক আয়াজ এবং সুলতান মাহমুদের প্রেম কাহিনীতো সুফি সাহিত্যে অবিনশ্বর হয়ে আছে। তাদের প্রেমগাঁথা সেখানে আদর্শ প্রেমের নিদর্শন হিসেবে নন্দিত এবং বন্দিত।ফারসী কবি শেখ শাদি’র ‘বোঁস্তা’য়’ও এই প্রেমকাহিনীর উল্লেখ করা হয়েছে। পরম পরাক্রমশালী সুলতান মাহমুদ একদিন কৌতুকছলে আয়াজকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তুমি কি আমার চেয়ে শক্তিশালী কোনো নৃপতির নাম জান ? আয়াজ বলেছিলেন আমিই আপনার চেয়ে শক্তিশালী সম্রাট। বিষ্মিত মাহমুদ জিগ্যেস করেছিলেন-কীভাবে? আয়াজ প্রতুত্তরের বলেছিলেন-আপনি পরক্রমশালী সম্রাট আপনার হৃদয় আপনাকে শাসন করে আর এই বান্দা আপনার হৃদয়ের শাসক।

ভারত বর্ষের ইতিহাসে খোজাদের প্রভাব বিষ্ময়কর।বিকৃত যৌনাচারে আসক্ত শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক খোজা রাষ্ট্রের শীর্ষপদে উঠে যান এমনকি শাসককে হত্যা করে শাসন ক্ষমতা দখলেরও দৃষ্টান্ত রয়েছে।আলাউদ্দিন খলজির গুজরাট অভিযানের সময় মালে গনিমত হিসেবে এক সুদর্শন বালক তার হাতে আসে যার রূপে খলজি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন।বালকটিকে তাৎক্ষণিক লিঙ্গকর্তনপূর্বক খোজা বানিয়ে তার যৌনসাথী বানানো হয়। মমতাজের প্রতি শাহজাহানের যেরকম ভালোবাসা ছিল সেই বালকের প্রতি আলাউদ্দিন খলজিরও সে রকম ভালোবাসা ছিল। বালকের প্রতি প্রেমের নিদর্শন হিসেবে তার নামাংকিত কবজ তিনি কোমরে বেঁধে রাখতেন। ধর্মান্তরিত করে এই বালকের নাম রাখা হয় মালিক কাফুর। তার প্রতি সুলতানের তূলনাবিহীন ভালোবাসার কারণে বালকের নাম হয় মালিক কাফুর হাজারদিনারী। মালিক কাফুর সারা জীবন সুলতানের পাশে থেকে তার মনোরঞ্জন করে গেছেন যদিও সুলতান অসুস্থ হয়ে প্রিয় দাসের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়লে কাফুর তাকে বিষপানে হত্যার চেষ্টা করেন।আলাউদ্দিন খলজির মৃত্যুর পর মুবারক খলজি ক্ষমতাসীন হয়ে পিতার পদাংক অনুসরণ করেই আরেক ধর্মান্তরিত সুদর্শন হিন্দু বালকের প্রেমে পড়েন। প্রথমে হাসান ও পরে খসরুখান নামে পরিচিত এই তরুণ তাকে এতই মোহাবিষ্ট করে ফেলে যে মোবারক সকল সুহৃদ আমির ওমরাহকে দূরে ঠেলে দিয়ে খসরুখানকে নিয়েই মেতে ওঠেন এমনকি খসরুখান দ্বারা প্ররোচিত হয়ে রাজ প্রাসাদের ফটকের চাবি পর্যন্ত খসরুখানের লোকের কাছে হস্তান্তর করেন। প্রতিশোধপরায়ন ও ক্ষমতালোভী খসরুখান এই সুযোগ নিয়ে একরাতে সুলতানের যৌন উন্মাদনার দুর্বলতম মুহুর্তে মোবারক খলজিকে হত্যা করেন এবং উন্মুক্ত ফটক দিয়ে তার অনুগত বাহিনী প্রাসাদে প্রবেশ করে হেরেমের সকল নারীকে গণ ধর্ষনের পর হত্যা করে। এভাবেই খসরু খান দিল্লীর সুলতানাত অধিকার করেন।১০

ইমাম উদ্দিন রায়হান ছিলেন সুলতান বলবনের প্রধানমন্ত্রী। জাহান মালিক নামক এক কৃষ্ণাঙ্গ খোজা সুলতান মাহমুদের উজির নিযুক্ত হন। ১৩৯৪ সালে তিনি মালিক উস সারক উপাধি নিয়ে জৈনপুরের গভর্নর নিযুক্ত হন। মোগল আমলে অনেক খোজা মনসবদার,কমান্ডার ও বিভিন্ন সুবার গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। খাজা সারাস বা প্রধান নাজির ইতিমাদ খান বা ইতবার খান নামে খেতাবপ্রাপ্ত হন। জাহাঙ্গীরের প্রধান খোজা ইতবার খান আগ্রার গভর্নর নিযুক্ত হন। ফিরোজ খান নামক আরেকজন খোজা ১৫০০/৬০০ সৈনিকের মনসব ছিলেন। বাখতাওয়ার খান ছিলেন খোজাদের সুপারিন্টেন্ডেন্ট। তিনি পন্ডিত ও ঐতিহাসিক ছিলেন।তিনি তারিখই আলফি’ ও ‘আকবার উল আখিয়ার’ এর সংক্ষিপ্তকরণ করেন এবং’মিরাত উল আলম’ বা ‘মিরাতই জাহান নামা’ রচনা করেন। মিয়া খোশফাহান, মিয়া আর্জমান্দ , মিয়া মহব্বত এই তিন বিখ্যাত খোজা (১৭৫৪-১৭৫৬) মোগলানী বেগমের পক্ষে সাম্রাজ্য শাসন করেন।


ফুল মালিক ওরফে খোজা ফুল থেকে ইতবার খান হয়ে ওঠা এক প্রভাবশালী বাঙ্গালী খোজার কথা।

বিভিন্ন দেশ ও জাতীয়তার অধিকারী শক্তিমান ও প্রভাবশালী খোজাদের মাঝে বাঙ্গালী হিসেবে যে খোজার নাম পাওয়া যায় তিনি ইতিবার খান বা খোজা ফুল ওরফে ফুল মালিক।তিনি সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে আগ্রার গভর্নর নিযুক্ত হন। কিন্তু তিনি নিষ্টুরতার জন্যেই ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি তার পৌরুষত্ব হারানোর ক্ষোভ কোনোদিনও বিষ্মৃত হতে পারেননি। ফুল তৎকালীন বাংলার কোথাও এক দরীদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন হয়তো বা বৃহত্তর সিলেটেরই কোনো এক অঞ্চলের সন্তান তিনি।কারণ সিলেটেই এই কুপ্রথাটি কয়েক শতাব্দী ব্যাপী চালু ছিল।এছাড়া ফুল নামটিও সিলেটে খুব জনপ্রিয়।ফুলকে দরীদ্র এবং লোভী মা বাবা ‘মালে ওয়াজিরির কাছে বিক্রি করে দেন।ফুলের পৌরষত্ব হারানোর অনুভূতি তার জীবনে কী রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তা তার অপ্রকৃতস্থ জীবন চিত্র থেকেই প্রতিভাত হয়।ফুল যখন ইতিবার খান উপাধি নিয়ে আগ্রার গভর্নর তখন তার বৃদ্ধ বাবা মা ছেলের এই অসামান্য সফলতার খবর শুনে কিছুটা আর্থিক আনুকূল্যের প্রত্যাশায় বাংলা থেকে সুদূর আগ্রায় গিয়ে হাজির হন এবং অনেক চেষ্টা তদ্বির করে ইতিবার খানের সাক্ষাৎ লাভ করেন।কিন্তু ইতিবার খান মা বাবার পরিচয় পেয়ে আনন্দের বদলে ক্রুদ্ধ হয়ে এদেরকে পঞ্চাশটি করে বেত্রাঘাত করার জন্য দরবারের প্রহরীকে নির্দেশ দেন। তিনি দরবারে আবেগাপ্লুত ভাবে ঘোষণা করেন-যারা সামান্য কটি অর্থের বিনিময়ে তার জীবনের শ্রেষ্ট উপভোগের উপকরণকে বিক্রি করে দিতে পারেন তাদের জন্য এই হলো উত্তম পুরষ্কার। পরে দরবারে উপস্থিত ইটালিয়ান লেখক ও পর্যটক নিকোলাও মানোচির অনুরোধে তার এই আদেশ প্রত্যাহার করে তাদেরকে একশত টাকা দিয়ে বিদায় করে দেয়া হয় এবং ইতিবার খান তাদের এই বলে হুশিয়ার করে দেন ভবিষ্যতে যদি তাদেরকে আবার এখানে দেখা যায় তবে তিনি নিজ হাতে তাদেরকে হত্যা করবেন। নিষ্টুরতার জন্য ইতিবার খান এতটাই কুখ্যাত হয়ে ওঠেন যে সম্রাট আওরঙ্গজেব আগ্রার দুর্গে বন্দি পিতা শাহজাহানকে শারিরীক ও মানসিক শাস্থিদানের জন্য ইতিবার খানকে নিয়োগ দেন। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আমরা শৈশবে পাঠ্য বইয়ে পড়েছি তিনি ফকির বাদশাহ বলে খ্যাত ছিলেন। তিনি টুপি সেলাই করে ও কোরান নকল করে তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।এসব উপাখ্যান পড়ে যে এক মহানুভব সম্রাটের প্রতিচ্ছবি আমাদের মানসপটে স্থায়ী হয়ে আছে আসলে কি তিনি তাই? এই নিষ্টুর হৃদয় মানুষটি ক্ষমতার লোভে নিজ পিতা বাদশাহ শাহজাহানকে আগ্রা ফোর্টে বন্দি করে রেখে তাকে তিলে তিলে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দিতে ইতিবার খানের উপর দায়িত্ব দেন এবং ইতিবার খানও অতি বিশ্বস্ততার সাথে তার দায়িত্ব পালন করেন। আওরঙ্গজেব সহোদর অগ্রজ দার্শনিকতূল্য পন্ডিত দারা শিকোহকে ১৬৫৮ সালের ৩০ মে সামুগড়ের যুদ্ধে পরাজিত করে তার মাথা কেটে বাক্সে ভরে ইতিবার খানের মাধ্যমে পিতা শাহজাহানকে উপঢৌকন পাঠান। শাহজাহান যখন রাতের ডিনার খাবার জন্য টেবিলে আসেন তখনই ইতিবার খান বাক্সটি খুলে টেবিলে রাখেন। প্রিয়তম পুত্রের কর্তিত মাথা দেখে শাহজাহান চিৎকার করে টেবিলের উপরই মূর্ছা যান।সম্রাটের জ্ঞান ফিরে আসলে ইতিবার খান দারা শিকোহর চূল ও দাড়ি টেনে টেনে তুলতে থাকলে চূলের গোড়া থেকে তাজা রক্ত বেরোতে শুরু করে এই নিষ্টুর দৃশ্য দেখে শাহজাহান চিৎকার করে আর্তনাদ করতে থাকেন।ইতিবার খানের মুখ থেকে শাহজাহানের এই প্রতিক্রিয়ার বিবরণ শুনে আওরঙ্গজেব ও তার বোন রোশেনারা বেগম অতি আনন্দের সাথে তা উপভোগ করেন এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন।আওরঙ্গজেব ও ইতিবার খান পরামর্শ করে খাদ্যে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে নির্মমভাবে তাজমহলের অমর নির্মাতাকে হত্যা করেন।১১ বন্দী এবং অসহায় শাহজাহানের প্রতি খোজা ফুল যে অমানবিক নিষ্টুরতা দেখিয়েছেন তা কোনো সুস্থ বিবেকবান মানুষের পক্ষে চিন্তা করাও অসম্ভব।

আওরঙ্গজেব এর শাসনামলে প্রভাবশালী বাঙ্গালী খোজা ফুল ওরফে ইতিবার খান।

কলকাতার খোজা বাণিজ্য।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে মুসলমান শাসকগন ভারতবর্ষে আগমনের সাথে এদেশে তাদের নিষ্টুর প্রথাটিরও আমদানী হয়। ভারতে মুসলমান শাসন বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে বিদেশী সাদা ও কালো খোজাদের পাশাপাশি ধীরে ধীরে দেশীয় খোজাদেরও চাহিদা বাড়তে থাকে। রাজ দরবার এবং আমীর ওমরাহদের ব্যাপক চাহিদা মেটাতে তৎকালীন বাংলা প্রদেশে খোজা দাস ক্রয় বিক্রয়ের একটি বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিনত হয়। ১২৯০ সালের দিকে বিশ্ব বিখ্যাত পর্যটক মার্কোপোলো তৎকালীন বাংলা প্রদেশ সফর করেন। তাঁর ভ্রমন কাহিনী থেকে জানা যায় বাংলা মোগল অধিকৃত হওয়ার আগেই এখানে খোজা ব্যবসায়ের রমরমা বাজার গড়ে ওঠে।প্রথম দিকে খোজাদের পুরোটাই আসতো যুদ্ধবন্দিদের থেকে।মার্কোপোলো উল্লেখ করেছেন “-to purchage which the merchants from varius parts of India resort thither. They likewise make purchases of eunuchs, of whom there are numbers in the country, as slaves; for all the prisoners taken in war are presently emasculated; and as every prince and person of rank is desirous of having them for the custody of their women,the merchants obtain a large profit by carrying them to their kingdom, and there disposing of them. ১২

কিন্তু যুদ্ধতো বছরের পর বছর বা যুগের পর যুগ চলমান থাকেনা সুতরাং যুদ্ধবন্দীও পণ্য হিসেবে প্রবাহমান থাকেনি এদিকে রাজা উজিরতো বটেই নতুন নতুন আমির ওমরাহ গজিয়ে ওঠার সাথে সাথে খোজা দাসদের চাহিদাও ব্যাপক ভাবে বাড়তে থাকে আর ক্রমাগত এই চাহিদার কারণেই বাংলায় খোজা বাণিজ্যের জনপ্রিয় বাজার গড়ে ওঠে। কলকাতার খোজা বাজারে আফ্রিকান হাবশি এবং দেশীয় খোজা বেচাকেনা হতো। দেশি এই খোজাদের প্রধান সরবরাহক ছিল সিলেট এবং ঘোড়াঘাট। প্রাচীন তথ্য উপাত্তে সিলেটের নামটিই বিশেষভাবে এসেছে। স্যার যদুনাথ সরকার সম্পাদিত The India of Aurangzib (topography, statistics and roads গ্রন্থে বলা হয়েছে “In this province (Sylhet) they make many Eunuchs” ১৩ পন্ডিত আবুল ফজলের বিখ্যাত ‘আইন-ই-আকবরীতে বলা হয়েছে ‘In the Sarkar of Sylhet there are nine ranges of hills.It furnishes many Eunuchs. ১৪ তুজুক ই জাহাঙ্গীরী তে বলা হয়েছে- In Hindustan specially in the province of Sylhet which is a dependency of Bengal it was the custom for the people of those part to make eunuchs of some of their sons and give them to the governor in place of revenue (Mal- Wajibi) this custom by degrees has been adopted other provinces and every year some children are thus ruined and cut off from procreation ১৫ স্যার এডওয়ার্ড এলভার্ট গেইট প্রনীত ‘A History of Assam’ গ্রন্থে বলা হয়েছে “ In the early times the Sylhet district supply India with eunuchs but Jahangir issued an edict forbidding it’s inhabitants to castrate boys.১৬

এ ছাড়া প্রাচীন অনেক সূত্রেই খোজা ব্যবসায় সিলেটের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সুতরাং এ বিষয়ে আরো উদ্ধৃতি বাহুল্য মনে করি। অতীতে সিলেটে খোজা সম্পৃক্ত খোজকর শব্দটির ব্যাপক প্রচলনও ঐতিহাসিক মতগুলোর যথার্থতা প্রমাণ করে। বৃহত্তর সিলেটের বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা বা স্থান নামের সাথেও খোজা শব্দের উপস্থিতি লক্ষণীয়। সিলেট শহরের উপকন্ঠে ‘খোজার খলা’ নামক স্থানটি ঐতিহাসিক গবেষণার দাবি রাখে। এই স্থানটি কি খোজা কেনাবেচার কোনো কেন্দ্র ছিল না কি শিশুদের ধরে এনে এখানে খোজা বানানো হতো অথবা জীবন সায়াহ্নে কোনো খোজা তার জন্মস্থানে ফিরে এসে এখানে একটি খলা (সিলেটে ধান মাড়াই ও প্রক্রিয়াজাতের জন্য যে খোলা উচ্চ সমতল ভূমি ব্যবহার করা হয় তাকে খলা বলা হয়) তৈরি করেছিলেন তা নিয়ে অনুসন্ধান প্রয়োজন।তুজুক ই জাহাঙ্গীরী থেকে জানা যায় মুসলমান আমলের বিস্তৃত সময়ে খোজাকরণ বা খোজা ব্যবসা বৈধ বলেই গণ্য ছিল।জাহাঙ্গীর প্রথমবারের মতো এর অমানবিক দিক বিবেচনা করে এ ঘৃণ্য প্রথা ফরমান জারি করে নিষিদ্ধ করে দেন। “At this time I issued an order thus hereafter no one should follow this abominable custom and that the traffic in young eunuch should be completely done away with. Islam khan and other governor of subah of Bengal received firman that whoever should commit such act should be capitally punished and they should seize eunuch of tender year who might be in anyone’s possession. No one of the former kings had obtained this success please almighty God ,in a short time this objectionable practice completely done away and the traffic in eunuchs being forbidden, no one shall venture on this unpleasant and unprofitable proceeding” ১৭ তুজুক থেকে জানা যায় সিলেটের অনেক দরীদ্র ও লোভী বাবা মা অর্থের লোভে তাদের পুত্র সন্তানকে সরকারের রাজস্ব বিভাগ ‘মাল ওয়াজিবি’তে বিক্রি করে দিতেন। সম্ভবতঃ ‘মাল ওয়াজিবি’ নিজস্ব তত্তাবধানে ক্রয়কৃত শিশুদের খোজা বানিয়ে রাজধানীতে প্রেরণ করত।এ ছিল খোজা করণের একটি সীমিত পরিসর কিন্তু বৈধ এ প্রথার বিপরীতে সিলেটে খোজকরদের অনেক অবৈধ সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে যাদের ছেলেধরা এজেন্টরা সারা জেলা এমনকি বাইরের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে ফলে খোজকর শব্দটি সিলেটে এক আতংকজনক শব্দে পরিনত হয়। এ প্রসঙ্গে শ্রী অচ্যুৎ চৌধুরী তৎ প্রণীত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে কোনো সূত্র উল্লেখ না করে পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদের একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন যেখানে বলা হয়েছে “শ্রীহট্ট হইতে খোজা ভারতের সর্বত্র রপ্তানি হইত।মোসলমানদের এই একটা ব্যবসায় দাঁড়াইয়াছিল যে উহারা ছেলেদের খোজা করিয়া বিক্রী করিত।কেবল নিজেদের বালকগণের যে এই দশা করিত, তাহা নহে,বলে ছলে অন্যান্য স্থল হইতে ছেলে সংগ্রহ করিয়া খোজা করিত।“ উক্তিটি মনে হয় অনেকটাই সাম্প্রদায়িক দোষে আচ্ছন্ন।সিলেটের সকল মুসলমানই যদি এই ঘৃণ্য পেশায় নিয়োজিত হয়ে যেত তবে এই এলাকায় মুসলমান জনসংখ্যায় বিপর্যয় দেখা দিত এবং ১৯৪৭ এর ঐতিহাসিক রেফারেন্ডামে সিলেট অনায়াসে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত কিন্তু তাতো আসলে হয়নি কাজেই মুসলমানগণ নয় এর একটি অংশ এই জঘন্য ব্যবসাকে অবলম্বন করেছিল বলে আমরা ধরে নিতে পারি। সিলেটে শ্রুত কাহিনী মতে খোজকরেরা কমলা বা লোভনীয় চকোলেট দেখিয়ে বাচ্চাদের প্রলুব্ধ করত এবং সুযোগ মতো হাত পা মুখ বেঁধে বস্তায় ভরে পালিয়ে যেত।অনেক সময় এরা ধরাও পড়ত আবার অনেক অচেনা অপরিচিত ব্যক্তিও খোজকর সন্দেহে গণ পিঠুনির শিকার হতো। এখনও কোনো অচেনা ব্যক্তির সন্দেহজনক চলাফেরাকে সিলেটের কোনো প্রাচীন ব্যক্তি বলে থাকেন-লোকটাকে খোজকরের মতো লাগছে।বাংলার অনেক অঞ্চলে মায়েরা বর্গীর ভয় দেখিয়ে যেমন বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতেন সিলেট অঞ্চলের মায়েরা দেখাতেন খোজকরের ভয়।

মৌলভীবাজার সদরের গয়গড় গ্রামে অবস্থিত খোজার মসজিদ

এই অবৈধ খোজকরগণ কীভাবে এসব মানব পণ্য বিক্রি বা পাচার করতো তা এখনও অজানা তবে সম্ভাব্য দু’টি পদ্ধতি অনুমান করা যেতে পারে, এক, ধরে আনা শিশুদেরকে নিজ সন্তান পরিচয়ে মালে ওয়াজিবিতে বিক্রি করতো, দুই, খোজকরগণ নিজস্ব তত্বাবধানে শিশুদের খোজা বানিয়ে নৌবন্দর দিয়ে পাচার করে দিত। সরকারী বা নিজস্ব উদ্যোগে খোজাকরণের পদ্ধতি বর্তমান সময়ে অকল্পনীয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই সফল সময়েও যেখানে আমাদের মতো অনুন্নত দেশে সার্জারি উত্তর নানা জটিলতায় অনেক রোগীর মৃত্যু ঘটে সেখানে আদিম পদ্মতিতে সার্জারি করার পর বেশিরভাগ শিশুই সংক্রমন বা কিডনি নষ্টজনিত কারণে মৃত্যু বরণ করত। কত অসহায় মানব-শিশু মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নিথর লাশ হয়ে সিলেট শহর আর এর উপকন্ঠে মাটির গভীরে ঘুমিয়ে রয়েছে তার পরিসংখ্যান আর কোনো ভাবেই জানা যাবেনা। হয়তো আজও এই এলাকার মাটি খুঁড়লে হাজারো শিশুর অস্থি কংকাল বেরিয়ে আসবে। একটি দুঃস্বপ্নের অধ্যায়ের পর ভাগ্যবান (?) শিশুরাই কেবল সুস্থ হয়ে একটি বাণিজ্যিক পণ্যে পরিনত হতো। প্রাচীন কাল থেকেই সিলেট একটি বাণিজ্য বন্দর হিসেবে সুপরিচিত ছিল। আরব দেশের সুবিখ্যাত আলিফ লায়লার কাহিনীতেও সিলেট বন্দরের উল্লেখ রয়েছে এবং সিন্দাবাদ নাবিক এখানে আগমন করেছিল। তবে মুন্সী আসরফ প্রনীত আলেফ লায়লার কেচ্ছা’ পুঁথিতে সিলেটের চন্দন কাঠের কথা উল্লেখ আছে খোজাদের নয়। ১৮ এ থেকে মনে হয় আলেফ লায়লা’ কাহিনীর সমসাময়িক কালে সিলেটে খোজা ব্যবসার প্রচলন হয়নি এবং আলিফ লায়লার কাহিনীও সৃষ্টি হয়েছে ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমনের পূর্বে। সিলেট বন্দর দিয়েই খোজা শিশুগণ কলিকাতা ভারত মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার নানা দেশে পাচার হয়ে যেত।

যে শিশুগণ খুব ছোট অবস্থায় সেই দুর্ভাগ্যের শিকার হতো তা্দের বিক্রি হওয়া স্থানেই আমৃত্যু থেকে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিলনা।কিন্তু বাড়ি ঘর জন্মমাটির স্মৃতি যাদের থাকতো তাদের অনেকেই জীবন সায়াহ্নে মাটির টানে সারা জীবনের সঞ্চিত টাকা পয়সা নিয়ে দেশে ফিরে এসে নানা জন হিতকর কাজে আত্মনিয়োগ করতেন।ঐতিহাসিক সৈয়দ মর্তুজা আলীও তাঁর ‘হযরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস’ গ্রন্থে এই মত প্রকাশ করেছেন। ১৯ হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার গুজাখাইর গ্রামে অবস্থিত ‘খোজার দীঘি’ নামক বিশাল জলাশয়টি তেমনি এক জন হিতৈষী অজ্ঞাতনামা খোজার স্মৃতিকেই বহন করছে।এই এলাকার অনেক প্রবীন ব্যক্তির মতে ‘গুজাখাইড়’ নামটি ও ‘খোজা খয়ের’ নামের অপভ্রংশ।এ ছাড়া মৌলভীবাজার সদরের গয়গড় গ্রামে অবস্থিত এবং সুলতানী আমলে নির্মিত খোজার মসজিদটি প্রতিষ্টার সাথেও কোনো এক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকারী খোজার নাম জড়িত থাকার সম্ভাবনা আছে। অবশ্য অনেকের মতে মোগলদের দ্বারা বিতাড়িত আফগান শাসক খাজা ওসমান এই মসজিদে রাত যাপন করেছিলেন এজন্য তার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতেই মসজিদটি খাজা রূপান্তরে খোজার মসজিদ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তবে এ মতটি খোজা শব্দটিকে আড়াল করার জন্যও প্রতিষ্টিত করা হয়ে থাকতে পারে কেননা সিলেটি ভাষার উচ্চারণগত কারণে অনেক শব্দের উচ্চারণ বিপর্যয় ঘটলেও ‘খাজা’ ‘খোজায় রূপান্তরের কোনো কারণ নেই নজীরও নেই তাছাড়া শব্দটি গৌরবাত্বক নয় বরং সামাজিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে এটি একটি ঘৃণাত্নক শব্দ।একটি মসজিদের নামের সাথে এরকম একটি নেতিবাচক শব্দ জড়িত থাক এটা অনেকেরই পছন্দ হবেনা এটাই স্বাভাবিক। শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে চুরখাইর সন্নিকটবর্তি আরেকটি খোজার দীঘির উল্লেখ করা হয়েছে।করিমগঞ্জ মহকুমার বিখ্যাত জায়গিরদার বংশ তাদের বংশের জনৈক খোজার সম্পদে প্রসিদ্ধি ও সমৃদ্ধি লাভ করে বলেও ইতিবৃত্তে উল্লেখ করা হয়েছে। বৃহত্তর সিলেটের অনেক জায়গায় ‘খোজার বন্দ’এর অস্তিত্ব রয়েছে। অনুসন্ধান করলে বৃহত্তর সিলেটের আরও অনেক স্থান এবং স্থাপনার সাথে খোজা সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যাবে।


পারিষদ সহ সুলতান মাহমুদ পেছনে আয়াজ

সিলেটে কী করে এই খোজকর প্রথার সূচনা হয়েছিল ?

বিশাল ভারতবর্ষের মাঝে একমাত্র সিলেট অঞ্চলেই কেন এবং কীভাবে এই ঘৃণ্য প্রথাটির প্রচলন হয়েছিল এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন। আমাদের একটা প্রবনতা আছে অধিকতর উজ্জ্বল দিকটিকে হাইলাইট করে অনুজ্জ্বল বা কালিমালিপ্ত দিকটিকে চেপে যাওয়া। সিলেটের এই খোজকর প্রথার ব্যাপারটিও ঐতিহাসিকরা বেমালুম চেপে গেছেন।হিন্দু লেখকদের রচনায় লক্ষ্য করা যায় গা বাঁচানোর প্রবনতা আর মুসলমান লেখকরা মনে হয় এজায়গাটিতে এসে অনেকটা চোখ কান বন্ধ করে লাফ দিয়ে পেরিয়ে গেছেন।ইতিহাসের অন্ধকার দিকগুলি না জানলে জাতি আলোকিত হবার শিক্ষা কী করে পাবে ? এই যে দেশের কিছু কিছু বিশেষ এলাকাতে শিশুহত্যা বা নির্যাতনের খবর শুনা যায় তা কোনো আকষ্মিক ঘটনা নয় গবেষণা করলে এর সাথেও আমাদের সেই কালো ইতিহাসের পরম্পরা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

আমি সমাজ বিজ্ঞানের গবেষক নই তবু সিলেটের খোজকর প্রথার উৎপত্তি সম্পর্কে আমার কিছু ব্যক্তিগত মুল্যায়ন এখানে উপস্থাপন করছি।মূল্যায়নটি শতভাগ সঠিক এ রকম দাবি আমি করবনা তবে এই মূল্যায়নের উপর আলোচনার সূত্রপাত হলে আসল সত্যটি বেরিয়ে আসতেও পারে। সিলেট প্রাচীন কাল থেকেই একটি দরীদ্র এলাকা ছিল। এর কারণ ভৌগলিক। সিলেটের বেশীরভাগ এলাকাই ছিল ছোটখাটো এক সাগরতলে নিমজ্জিত। চাষাবাদের ভূমি ছিল খুবই সীমিত। যেখানে দারীদ্রতার হার বেশী জাত বিজাতের ব্যাপারটিও সেখানে প্রকট থাকে। সিলেটে এটি ছিল ব্যাধির মতো। ব্রহ্মার পবিত্র মুখ থেকে সৃষ্ট ব্রাহ্মণ ছিল এ জনপদের শাসক বা কর্তা শ্রেণীয় আর এর আদি ভূমিপুত্ররা ছিল ব্রহ্মার নোংরা এবং ময়লাঘাটা পা থেকে সৃষ্ট শূদ্রবর্গীয়। সিলেটের নবদ্বীপ কেন্দ্রিক সংস্কৃত পন্ডিতদের মাঝে একটি কথা চালু ছিল ‘শ্রীহট্টে মধ্যমা নাস্তি’ প্রবাদাকারে চালু এই কথা থেকেই সিলেটে উচ্চ নিচের অলঙ্গনীয় ব্যবধানটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিম্নবর্গীয় শূদ্রদের জীবনমান এতটাই মানবেতর ছিল যে যুগের পর যুগ ধরে হাড়ভাঙ্গা মেহনত করেও নিজেকে মধ্যম পর্যায়ে উন্নীত করার কোনো সুযোগই সেসময় ছিলনা।১৯০৩ সালে এসেও শ্রীহট্টের ইতিহাস লিখতে গিয়ে শ্রী মোহিনী মোহন দাশগুপ্ত যখন লিখেন “অতি পুরা কালে ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানের ন্যায় শ্রীহট্টও অসভ্য জাতির বাসস্থান ছিল, তৎপর আর্যগণের আগমনে অসভ্যগণ পর্ব্বত ও গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে এবং আর্যগণ এস্থলে হিন্দুরাজ্য স্থাপন করেন।” ২০ তখন বুঝতে অসুবিধে হয়না বহিরাগত আর্য্য তথা বর্ণ হিন্দুদের কাছে স্থানীয় ভূমিপুত্রগণ কতটা ঘৃণ্য এবং ধিকৃত ছিলেন।ত্রিশ বছর আগেও সিলেটের প্রবীন মানুষের মুখে ‘আউয়া চাড়াল’এর কিচ্ছা শুনা যেত। আউয়া মানে বোকা অর্থাৎ চাড়াল বা চন্ডাল বলতেই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা এক সম্প্রদায়। বাঙ্গালীর সমূদয় নির্বুদ্ধিতার অপবাদ চাপানো হয়েছিল এই নীচ ব্রাত্য সম্প্রদায়টির উপর। এটি বিভিন্ন সম্প্রদায়কে হেয় করে রাখার পরম্পরাগত প্রচেষ্টার একটি দৃষ্টান্ত। ত্রয়োদশ শতকে যখন পশ্চিম থেকে ধেয়ে আসা মুসলমানগণ হিন্দু শাসকদের সীমান্তদূর্গ গুঁড়িয়ে বানের জলের মতো ঢুকতে শুরু করে তখন সমাজের দরীদ্র ও সামাজিকভাবে হেয় মানুষ তার সামাজিক ও আর্থিক উন্নয়নের স্বার্থেই তাদেরকে স্বাগত জানায় সে সাথে তাদের জীবন বিধানকে গ্রহণ করে। যদিও সামাজিক অবস্থাই তাদের নতুন ধর্মমতের দিকে ঠেলে দেয় তবুও চরিত্রগত দিক দিয়ে তারা সুবিধাবাদী শ্রেণী। কারণ সমান সামাজিক অবস্থান ও আর্থিক অবস্থা সম্পন্ন প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা এই সুবিধা গ্রহণে কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে নিজ ধর্মেই অবিচল থেকে যায় বা থাকতে পেরেছিল। সিলেটের গণ-ধর্মান্তরের আরেকটি বৈশিষ্ট ছিল তাতে একজন আধ্যাত্বিক ব্যক্তিত্বের ব্যক্তিগত প্রভাব।আধ্যাত্বিক বা অলৌকিকতায় আকর্ষিত হয়ে যারা ধর্মান্তরিত হন তাদের বেশীরভাগই শ্রমবিমুখ এবং স্বপ্নবিলাসী শ্রেণী। কোনো শ্রম ছাড়াই এরা কার্য সিদ্ধির পক্ষপাতি কি জাগতিক কি পরলৌকিক। সুবিধাবাদী এবং শ্রমবিমুখ শ্রেণী নিজেদের পৈত্রিক ধর্মত্যাগ করে বিজয়ী ভিনদেশী শক্তির ধর্ম গ্রহণের স্বল্প সময়ের মাঝেই এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলো।তারা হতবাক হয়ে দেখল রাজশক্তির প্রত্যক্ষ সহায়তায় তাদের দারীদ্রক্লিষ্ট জীবনকে আমুল পাল্টে ফেলার যে স্বপ্ন তারা দেখেছিল তা ভুল। যে শ্রম বিমুখ স্বপ্নবিলাসীর দল ভেবেছিল অলৌকিক ক্ষমতা বলে তার স্বপ্নকে ছুঁয়ে ফেলবে তা মরিচীকা। একসাথে খাওয়া আর একসাথে প্রার্থনা করা দেখেই যারা এক ইউটোপিয় সাম্যের স্বপ্ন দেখেছিল বাস্তবে তা বিভ্রম। তারা দেখল যে বহিরাগতকে তারা আপন ভেবে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল এদের সাথে তার আকাশ পাতাল ব্যবধান। ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকরা ইতোপূর্বে তাদের সাথে যে বৈষম্যমুলক আচরণ করতো এরাও সে রকমই আচরণ করছে। যে হিন্দু উচ্চবিত্তরা ইতোপূর্বে তাদের প্রভু ছিল তাদের অনেকেই প্রভাব প্রতিপত্তি ধরে রাখার স্বার্থে ধর্মান্তরিত হয়ে পূর্ববৎ প্রভুর আসনেই অধিষ্টিত আছে কিন্তু তাদের সামাজিক অবস্থান যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। তার আর্থিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি অধিকন্ত একদিন যাদের সাথে রক্ত এবং সামাজিক সূত্রে একই সংস্কৃতির বাঁধনে পাশাপাশি অবস্থান করে সুখ দুঃখকে সমানভাবে ভাগাভাগি করে নিচ্ছিল তারা পর এবং শত্রুভাবাপন্ন হয়ে গেছে।তারা এককালের স্বজনদের কাছে হয়ে গেছে অস্পৃষ্য যবন।ধর্মান্তরোত্তর সেই সময়টা দরিদ্র নও মুসলমানদের জন্য সত্যিকার অর্থেই একটি কঠিন সময় ছিল। তার স্বপ্ন বিপর্যস্ত তার চেনা সমাজ চেনা মানুষ এবং রক্ত সম্পর্কিয়রা হয়ে গেছে অচেনা তার দারীদ্রপীড়িত জীবনে অনটন পাথরের মতো ভারি হয়ে চেপে বসেছে। ১৮৭৯ সালে WW Hunter তার বিখ্যাত পরিসংখ্যান ভিত্তিক গ্রন্থ A Statistical Account of Assam গ্রন্থে উল্লেখ করেন ধর্মান্তর সিলেটের মুসলমানদের জীবন মানের খুব একটা উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি ২১ যদিও তাদের ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তখন সুরমা আর কুশিয়ারা দিয়ে পাঁচশত বছরের জল গড়িয়ে গেছে। এ থেকেই ধর্মান্তরের প্রারম্বিক সময়টাতে মুসলামানদের জীবন কতটা দুর্বিসহ ছিল তা কিছুটা অনুমান করা যায়। এমনি কঠিন সময়ে নিজ সন্তানকে সরকারের মালে ওয়াজিবিতে বিক্রি করে দেয়ার মতো নিষ্টুর সিদ্ধান্ত নেয়া তাদের অনেকের পক্ষেই অসম্ভব ছিলনা কেননা দারীদ্রের কারণে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে নিজ সন্তানকে বিক্রি করে দেয়া সিলেটে অভিনব কোনো ঘটনা ছিলনা বরং সেখানে পণ্যের মতো দাস দাসী কেনাবেচা হতো।‘শ্রীহট্টের ইতিহাস’ প্রনেতা অচ্যুত চৌধুরী ষোঢ়শ ও অষ্টাদশ শতকের দু’টি মনুষ্য ক্রয় বিক্রয়ের দলিল আবিষ্কার করে তাঁর গ্রন্থে সংযুক্ত করেন। দাসপ্রথা ও কেনা বেচা সম্পর্কে আমার পরবর্তি অনুসন্ধানমুলক রচনা ‘সিলেটের দাসপ্রথা’য় বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছা রইল। স্থানীয় নও মুসলমানরা এ ব্যাপারে বহিরাগত মুসলমানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন এটা নিশ্চিত। কারণ সিলেটে বাংলার অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক বেশী বহিরাগতের সমাবেশ ঘটেছিল।এই বহিরাগতদের মাঝে ছিল বিজয়ী বা তাড়া খাওয়া সিপাই লস্কর ভাগ্যান্বেষী উদ্বাস্ত ফেরারি আসামি পীর মুরিদ ইত্যাদি বিচিত্র পেশা ও চরিত্রের এবং আরবি ফার্সি তুর্কি মোগল পাঠান হিন্দি বা ফার্সি ভাষাভাষী বিভিন্ন অঞ্চলের ভারতীয় প্রভৃতি জাতীয়তার মানুষ। ৩৬০ আউলিয়ার দেশ হিসেবে সিলেট সুপরিচিত হলেও প্রশ্ন জাগে হজরত শাহজালালের সঙ্গি-সাথী সবাই কি পীর আউলিয়া ছিলেন ? সাধারনতঃ দুই তলোয়ারই যেখানে এক খাপে ধরেনা এখনও দুই পীরে মুখোমুখি হলে লাটালাটি বেঁধে যায় সেখানে ৩৬০ পীর এক পীরের ছত্রতলে একত্রিত হয়ে ভিন দেশে অভিযাত্রী হয়েছিলেন তা অবিশ্বাস্য। আসলে এদের অধিকাংশই ছিলেন লোটা-কম্বলসর্বস্ব সমাজের ভাসমান শ্রেণী। বর্তমান সময়ের রাজপথ কাঁপানো এবং রাজনীতিতে বহুল সমাদৃত বিবিধ তরিকার পীর ও তাদের মুরিদ বাহিনীর চরিত্র বিশ্লেষণ করলেই অতীতের পীর ও মুরিদদের হুবহু প্রতিকৃতি ফুটে উঠবে।এই বহু বিচিত্র শ্রেণী ও পেশার বহিরাগত দ্বারা স্থানীয় দরীদ্র নও মুসলমানদেরকে এই হীন পেশায় উদ্বুদ্ধ করার সম্ভাবনাটিই প্রবল কারণ সিলেটে দারীদ্রতার কারণে সন্তানকে বিক্রি করে দেয়ার প্রথা চালু থাকলেও খোজা করে দেয়ার বিকৃত মানসিকতা বহিরাগত মুসলমানদের কাছ থেকেই অর্জন করেছে কারণ এটি বহিরাগতদের সংস্কৃতি। দারীদ্রের যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট এই সব নও মুসলমানকে তারা এই লোভ দেখিয়েছে আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির সাথে সাথে তাদের সন্তান মুসলমান রাজা বাদশাহদের হেরেমের পাহারাদারিতে নিযুক্ত হবে এটাও তাদের জন্য এক ধরণের শ্লাঘার বিষয় হতে পারে। শুধু তাই নয় ভবিষ্যতে তাদের সন্তান অনেক অর্থকড়ি সঞ্চয় করে দেশে ফিরে এসে তাদের ভাগ্যের চাকাকে ঘুরিয়ে দেবে।এই লোভ সামলানো তাদের অনেকের পক্ষেই অসম্ভব ছিল।

তথ্যসূত্র

১।শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (পূর্বাংশ)-অচ্যুৎ চরন চৌধুরী-কলিকাতা ১৩১৭ পৃঃ ৫৯০
২।প্রাগুক্ত শ্রীঃইঃ “খোজকর শব্দের ব্যবহার শ্রীহট্ট অঞ্চলে জয়ন্তিয়ার নরবলির পূর্ব হইতেই প্রচলিত ছিল বলিয়া বোধ হয়। আইন ই আকবরিতে লিখিত আছে যে,শ্রীহট্ট হইতে খোজা আমদানী হইত।খোজা ব্যবসায়ীগণ অপরের ছেলে চুরী করিয়া প্রক্রিয়া বিশেষে তাহাদিগকে নপুংসক করিয়া লইত।খোজকর শব্দের প্রচলন সম্ভবতঃ সেই সময় হইতেই হইয়া থাকিবে, পরে জয়ন্তিয়ার ছেলেধরাদের প্রতিও এই শব্দ প্রযোজ্য হইয়াছিল।“ পৃ ৩৪ ২য় ভাগ চতুর্থ খন্ড।
৩। Holly Bible, Mathew 19:12
৪।Valide ; a novel of the Harem- Barbara Chase-Riboud
৫।প্রাগুক্ত Valide
৬.প্রাগুক্ত Valide
৭।প্রাগুক্ত Valide
৮।History of the Arab- Philip Hitti. Page-341
৯। The Origins and Role of Same-Sex Relations in Human Societies
By James Neill page-308
১০। Same sex love in India-RuthVanita and Saleem kidwai.page-134
১১। Storia Do Mogor or Mogul India (1653-1708) part 1- by Niccolao Manucci. Translated with introd. and notes by William Irvine. আওরঙ্গজেব ও ইতিবার খানের পুরো কাহিনীটি তৎকালীন মোগল কোর্টে কাজ করা ইতালিয়ান লেখক ও পর্যটক নিকোলাও মানোচির লেখা উপরুক্ত গ্রন্থ থেকে নেয়া।
১২। The Travels of Marco Polo. The Orion Press, New York. Page 204
১৩। The India of Aurangzib (topography, statistics and roads ;- Edited by sir Jadu nath Sarkar, page-43
১৪। The Ain e Akbari-Abu al fazl ibn Mubarak-Translated by-Blochmann H (Henry) 1873 page-124
১৫। The Tuzuk-i-Jahangiri; or, Memoirs of Jahangir. Translated by Alexander Rogers. Edited by Henry Beveridge page-150-151
১৬। A History of Assam- Sir Edward Elbert Gait. Page-272 গেইট সাহেবের লেখা উক্ত গ্রন্থে সিলেটের খ্যাতির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে একমাত্র খোজা সরবরাহ বিষয়টি উল্লেখ করায় সিলেটে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় কারণ খোজা প্রসঙ্গটি সুখ্যাতি নয় কুখ্যাতি।এই গ্রন্থ সমালোচনায় শ্রীযুক্ত পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ লিখেন “ we are told only that in early time Sylhet district supplied India with eunuchs (page-272) and nothing more as to its product, human beings or other things.Sylhet claims its own the great Raghunath Siromoni, subtlest logician that Bengal has ever product ; the greater Sri Chaitanya who has possed as an avatar of Vishnu; Adwaita, one of the Vaishnavite trinity who represented God Siva,if Chaitanya was Vishnu; Maheswar Nyayalanker who , like Raghunandan (who wrote 28 books on new Sriti, calle Tattwas), wrote 28 books on old Sriti called Pradipas; Baninath Bidyasagar whose commentary is one of the best ever written on Sanskrit Grammar, and many other men of learning on religion+++But nothing counted so much with the author as the manufacture of eunuchs for insertion in his history.
১৭। প্রাগুক্ত T.j. page-151
১৮। কেচ্ছা আলিফ লায়লা-মুন্সী আসরফ বিরচিত
১৯।হযরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস-সৈয়দ মুর্তাজা আলী
২০। শ্রীহট্টের ইতিহাস-মোহিনী মোহন দাশগুপ্ত. ১৯০৩। পৃঃ১৯
২১। A Statistical account of Assam, voll.2 1879, page
“In point of social rank they take precedence of the Hindus, but Islam does not appear to be now much progress in the District. A convert however, is occasionally obtain from among the low castes of the Hindus community ,who change their faith from interested motive”.