(এই লেখাটাকে উপন্যাস টাইপ কিছু বলতে পারেন। ধারাবাহিক উপন্যাসের কাছাকাছি কিছু! ধরে নিন এটা ফিকশন! হ্যাঁ ফিকশনই তো! উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনার মতো। লোকটা ছিলো তাঁর সময়ের অন্যতম প্রথাবিরোধী মানুষ। ইতিহাস তাঁকে মনে রাখেনি নিজ পরিচয়ে। বরং রঙ চাপিয়ে মুছেই ফেলেছে আসল লোকটাকে! জশুয়ার জন্য ভালোবাসা।)

সূর্যের জন্ম

জুন মাস। রোমান সাম্রাজ্যের জুডায়া প্রদেশ তপ্ত কড়াই এর মতো ফুঁটছে। প্রচন্ড গরমে মানুষ, পশু সবারই নাভীশ্বাস উঠে গেছে! নাজারেথের পাথর কুঁচি বসানো রাস্তাটাতে একটা খচ্চর টানা গাড়ী মৃদু ক্যাচক্যাচ আওয়াজ তুলে বিষন্ন বিকেলে রাস্তায় ধুলা উড়িয়ে খুব ধীর গতিতে দক্ষিণ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। গাড়িটা পর্দা দিয়ে ঘেরা। ভেতরে দুইজন মানুষ বসে আছে। গাড়োয়ানের চেহারা দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। কিন্তু সে কিছুক্ষণ আগেই একটি বড় মিথ্যে ছড়িয়ে এসেছে। তাঁর বৃদ্ধা ফুফু অসুস্থ। তাঁকে নিয়ে সে যাচ্ছে জেরুজালেম মহামন্দিরে, শেষ প্রার্থণার জন্য। আসলে তাঁর গাড়ির পর্দার আড়ালে শুয়ে আছে একজন তরুণী। বয়স উনিশ-কুঁড়ি। সে যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছে! মৃত্যু যন্ত্রণা না। প্রসব বেদনা। তাঁর মাথার কাছে বসে আছে প্রায় তারই সমবয়সী এক তরুণ। এক কালো ফিলিস্তিনি। নাম জোসেফ। জোসেফ, প্রসব বেদনায় ভোগা মেয়েটার প্রেমিক। তাঁদের এখনও বিয়ে হয়নি। জোসেফের প্রেমিকার নাম মিরিয়াম। বিয়ে তাঁদের না করার মূল কারণ মিরিয়ামের বাবা একজন সম্ভ্রান্ত ইহুদী ব্যবসায়ী। বণী ইসরাইল হিসেবে তাঁর অহংকার, নিজ কণ্যার সাথে একজন ইয়ামেনী কালো ইহুদীর সম্পর্ক কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনা। ফলে দুজন পালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। এরমধ্যেই জোসেফ পিতাগৃহে বন্দিনী মিরিয়ামের অন্তঃস্বত্তা হবার খবর পায়! মিরিয়ামের বাবা এর মধ্যে নাজারেথের রোমান গভর্ণরের কাছে অভিযোগ তোলে, জোসেফ হেরোশিয়ান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত! জোসেফকে পালাতেই হবে। কিন্তু একা সে পালাবেনা! কোনমতে মিরিয়ামকে লুকিয়ে বের করেছে! কিন্তু এতো সব উত্তেজনায় তাঁর শুরু হয়েছে প্রসব বেদনা।

এদিকে গরমে শুধু এই ভাগারে যাত্রীদেরই কষ্ট হচ্ছে তা নয়। গাড়ী টানা খচ্চরগুলির অবস্থাও খারাপ! এই ছোট্ট দলটি যাচ্ছে জেরিকোতে। সেখান থেকে জাহাজে করে মিশর। সেখানে আশ্রয় মিলতে পারে। এদিকে সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। রাতের মতো আশ্রয় নেয়া ছাড়া গতি নেই। জর্ডান নদীর তীরে বেথেলহামের কাছে ছোট্ট কাফেলাটা পৌঁছে গেছে। সরাইখানায় থাকবার মতো পয়সাই বা পাবে কোথায়! রাতের মতো তাই আশ্রয় নেয়া হলো একটি গোয়াল ঘরে! আশ্রয় মিললো। কিন্তু মিরিয়ামের প্রসব বেদনা তখন চরমে! এদিকে ক্ষুধায় চোখে অন্ধকার দেখছে জোসেফ আর গাড়োয়ান গ্যাব্রিয়েল। টাকার তো সংকট আছেই, বাইরে উন্মুক্ত বের হলে রোমান সৈনিকদের কাছে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। গ্যাব্রিয়েল তবুও বের হয়ে খানিকটা শুকনো রুটি আর পানি নিয়ে আসলো। মিরিয়াম ব্যাথায় চিৎকার করছে। কোন ধাত্রীও নেই। জোসেফ মিরিয়ামের মুখে কয়েক ফোঁটা পানি ঢালার চেষ্টা করে ব্যার্থ হলো। পানি ঠোঁটের কশ বেয়ে পড়ে যাচ্ছে। মুখে আর যাচ্ছে না। জোসেফের মিরিয়ামের আর্ত চিৎকার আর সহ্য হচ্ছেনা। বাইরে খোলা আকাশের নিচে বসে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও জোসেফ বাইরে এসে আকাশ ভরা তারা দেখতে দেখতে মিরিয়ামের চিৎকার না শোনার ভান করতে লাগলো। এদিকে গ্যাব্রিয়েল ভয়ার্তভাবে পায়চারী করছে। মিরিয়ামের চিৎকার শুনে কোন রোমান সৈনিক চলে আসলে তাঁদের আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। নির্ঘাত নির্যাতিত হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে হবে। অথবা তাঁদের হতে হবে এম্ফিথিয়েটারের বাঘ-সিংহের খোরাক!

রাত ক্রমে গভীর হয়েছে। জোসেফ আবার বসেছে মিরিয়ামের মাথার কাছে। মিরিয়ামের চিৎকার একেবারে না কমলেও একটু কমেছে। আর কতোই বা চিৎকার করা যায়। একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে মেয়েটি। বাপের বাড়িতেও তাঁকে কম নির্যাতন সহ্য করতে হয়নি! দূর্বল শরীরে এতো ধকল সইবেই বা কেনো! মিরিয়ামের আশা ছেড়ে দিয়েছে জোসেফ। জিহোভার কাছে প্রার্থনা করছে, যাতে মেয়েটার অগ্যস্থ যাত্রা সস্থিদায়ক হয় আরেকটু! এরমধ্যে ক্লান্ত জোসেফ কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, বলতেই পারে না!

হঠাৎ কান্নার আওয়াজে ঘুম ভাঙলো জোসেফের। একটা শিশুর কান্নার আওয়াজ! নতুন কন্ঠের চিৎকার। তাকিয়ে দেখে মিরিয়ামের দুই পায়ের মাঝে একটি ছেলে শিশু সর্বশক্তিতে চিৎকার করছে। সারারাত ভয়াবহ কষ্টের পর মিরিয়াম এখন শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। বাচ্চাটাকে নিজের দুইহাতে তুলে নিলো জোসেফ। বেশ স্বাস্থ্যবান একটা বাচ্চা। জোসেফের পাশে গ্যাব্রিয়েলও এসে দাঁড়িয়েছে। দুইজনে এসে দাঁড়ালো জর্ডানের ধারে। আলতো করে জর্ডানের পানি আজলায় তুলে বাচ্চাটার গায়ের রক্ত পরিষ্কার করতে লাগলো জোসেফ। তখন পূর্বাকাশ লাল করে সূর্য উঠছে। সেই লালচে আভা জর্ডানকে লাল করে তুলেছে। সেই সাথে বাচ্চাটাকেও আলোকিত। বাচ্চাটার নাম ঠিক করে ফেলেছে জোসেফ! জশুয়া।

২ প্রাচীন শহর

১ খ্রিস্টাব্দ…

খচ্চরে টানা ছোট্ট কাফেলাটা গোধুলীবেলায় রাস্তার শুকনো ধুলো উঁড়িয়ে দামেস্কে এসে ঢুকলো। নাজারেথ থেকে পালানোর ৩ মাস হয়ে গেছে। শুরুতে জোসেফ পরিকল্পনা করেছিলেন, জেরিকো থেকে জাহাজে উঁঠে আলেকজান্দ্রিয়া যাবেন। কিন্তু আলেকজান্দ্রিয়ার অবস্থাও টালমাটাল। আলেকজান্দ্রিয়ায় যুদ্ধ চলছে। পথে যেখানে সেখানে দস্যুদলের উৎপাত! জোসেফ আর সাহস পেলেন না মিশরে যাবার। সিদ্ধান্ত নিলেন জেরিকোরই কাছের সেই ইতিহাসখ্যাত মহানগর দামেস্কে যাবার। পথে ঊষর মরু পারি দিতে হবে। মিরিয়াম দূর্বল। জশুয়া তো একেবারেই শিশু। কেবলই জন্মালো। বেথেলহাম আর জেরিকো মিলিয়ে দুই মাস কাটিয়ে দিয়ে গ্যাব্রিয়েল আর জোসেফ সিরিয়ার পথে রওনা দিলেন। পথিমধ্যে আলেপ্পোতে কিছুদিন ছিলেন। বালের বন্দির আর কেনানে যাবার পথে মজেজের প্রতিষ্ঠিত সিনাগগে দর্শন দেয়াও সারা হলো। মিরিয়ামের অবশ্য ধর্মকর্মে মতি নেই। জোসেফের নিজেরও যে খুব বেশী আছে তা নয়। কিন্তু গ্যাব্রিয়েলের আগ্রহের কারণে যেতে হয়।

এই গ্যাব্রিয়েল কিন্তু জোসেফের রক্তের কেউ নয়। গ্যাব্রিয়েল তাঁর মৃত বাবার বন্ধু। চুপচাপ এক মুদি দোকানদার। তলেতলে এই মধ্যবয়স্ক লোকটা জোসেফকে এতোটা স্নেহ করতো জোসেফ আগে বোঝেনি কখনো। মিরিয়ামের সাথে পালানোর আগে প্রায় বন্ধুহীন জোসেফ গ্যাব্রিয়েলের কাছে গিয়েছিলো কিছু টাকা ঋণ করতে! গ্যাব্রিয়েলের চাপাচাপিতে পুরোটা খুলে বলতেই হয় জোসেফকে। তিনকুলে গ্যাব্রিয়েলের কেউ নেই। তড়িঘড়ি করে দোকানটা বিক্রি করে সেও জোসেফের ব্যাক্তিগত অভিযানে সামিল হয়ে যায়! জোসেফের না করার সুযোগ ছিলোনা আসলে। তবে গ্যাব্রিয়েল প্রচন্ড অসুস্থ। তাই জোসেফ আরোও কিছুদিন আলেপ্পোতে থাকতে চেয়েছিলো। কিন্তু গ্যাব্রিয়েল রাজী হয়নি। গ্যাব্রিয়েলের ইচ্ছে ছিলো যতো দ্রুত সম্ভব জুডায়া থেকে দুরে চলে যাওয়া। যুক্তিটা যেহেতু ভুল ছিলোনা, জোসেফ তাই রওনা দিতে রাজী হয়।

অসম্ভব পরিশ্রান্ত হয়ে ঠিক শেষ বিকেলে ইতিহাস বিখ্যাত নগরে প্রবেশ করলো দলটি। এই শহর আব্রাহামের। এই শহরে পা ফেলেছিলেন মজেজ। অন্যরকম এক ভাবাবেগে আক্রান্ত হলো গ্যাব্রিয়েল। তবে জোসেফের মাথায় এসব চিন্তা নেই। তাঁর মাথায় ঘুরছে, এই বিশাল শহরে আশ্রয় মিলবে কোথায়! এখানে সে কাউকে চেনেনা! গ্যাব্রিয়েলরও সম্ভবত এমন কেউ নেই যে ৪ টা মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারে! প্যালেস্টাইন থেকে দুরে সামান্য নিরাপদ বোধ করলেও কিভাবে সামনের দিনগুলি কাটাবে ভাবতেই ভয় লাগছে! জোসেফকে প্রায় কপর্দকহীনই বলা যায়! গ্যাব্রিয়েলের সম্বল ৫০০ শেকেল! সরাইখানায় আপাদত আশ্রয় নিলেও খুব বেশীদিন চলার জো নেই! তবুও জোসেফ সস্তা দরের একটা সরাই ঠিক করে ফেললো। তবে খুব দ্রুত কাজ খুজতেই হবে। এতো বড় শহরে নিশ্চই কাজ পেতে অসুবিধা হবার কোন কারণ নেই!

জোসেফ একটা কাজ খুব ভালো জানে। সেটা ছুতোরের কাজ। দামেস্কে পৌঁছাবার ৩য় দিনেই কাঠ খোদাই করে ভাষ্কর্য তৈরীর একটি কারখানার সন্ধান পেলো জোসেফ। জোসেফ নিজেও সিরিয়ান বংশোদ্ভূত। যদিও তাঁর জন্ম প্যালেস্টাইনে। কিন্তু তাঁর দাদা ছিলেন সিরিয়ান ইহুদী। ফলে কাজ পেতে খুব বেশী অসুবিধা হলোনা জোসেফের। তাঁর হাতের কাজ দেখে বেশ মুগ্ধই মনে হলো কারখানার মালিককে। কারখানার মালিকের নাম সিরিল। সে একজন বয়ষ্ক ইহুদী। মাসিক ৪৫ শেকেল বেতনে জোসেফ কাজ পেয়ে গেলো। অথচ নাজারেথে মাসে কখনও ১০ শেকেলও কামাই করা হয়নি তাঁর! যাই হোক, জোসেফ মন দিয়ে কাজ করতে লাগলো। কাজ জটিল কিছুনা। কাঠ কুঁদে মানুষের চেহারার প্রতিমূর্তি বানানো। সিরিলের অধিকাংশ খদ্দের ধনী। তাঁরা জোসেফের সামনে এসে বসে থাকে, জোসেফ তাঁদের মূর্তি বানায়। একটা মূর্তি বানাতে লাগে দিন তিনেক। জোসেফ মাসে ৫-৬ জন খদ্দেরের মূর্তি বানায়।

জোসেফ বেশ ভালো আয় করছে। আগের জমানো টাকার সাথে আরো কিছু টাকা যোগ করে সে এখন একটা বাড়ি কিনতে পারে। দামেস্কে আসার ১ হপ্তার মধ্যেই তাঁর খচ্চরটা মারা গেছে। গাড়িটাও তাই বিক্রি করে দিয়েছে। তবে জোসেফের খুব বেশীদিন সিরিয়ায় থাকার ইচ্ছে নেই। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলেই সে মিশরে চলে যেতে চায়। তাই কোন বাড়ি কেনেনি সে। একটি ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়েছে দামেস্কের মাঝামাঝি একটি এলাকায়। জশুয়া বড় হচ্ছে। তাঁর বয়স এখন এক বছর। সুযোগ পেলেই মিরিয়ামের চোখকে ফাঁকি দিয়ে উঠানময় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায় সে। জোসেফ হাত বাড়ালেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আর মুখ দিয়ে নানারূপ শব্দ করতে থাকে! জোসেফ বাচ্চাটার দিকে গর্ব নিয়ে তাকায়। এ তাঁর সন্তান। বহু শখ করে জোসেফ যার নাম নিজের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছিলো জশুয়া। জশুয়া মানে রক্ষাকর্তা। জোসেফের মনে হয়েছিলো, এই বাচ্চাটা তাঁদের সামনের ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা করতে এসেছে। আপাত দৃষ্টিতে অবশ্য বিপদ দূর হয়েছে। জোসেফের আশ্চর্য লাগে এটা ভাবতে, যে মানুষটাকে সে সবসময় কাছে পাবার স্বপ্ন দেখতো, সে এখন তাঁর পাশেই আছে। ধনী বাবার একমাত্র কন্যা মিরিয়াম দরিদ্র জোসেফের সংসারে প্রচন্ডভাবে মানিয়ে চলছে। অথচ তাঁর চেহারায় অভিযোগের ছিটেফোটাও নেই। মনেমনে জিহোভাকে ধন্যবাদ জানায় জোসেফ। তাঁর ইদানিং এমন হচ্ছে। ধর্মের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। এই জোসেফই কৈশরের শেষে রোমান মন্দিরগুলোতে যাওয়া শুরু করেছিলো। অবশ্য ঠিক ধর্মের টানে নয়। ভেনাসের টানে। ভেনাসের সুগৌল স্তন, চওড়া উরু আর ভরাট নিতম্ব তাঁকে আকর্ষণ করতো। অবশ্য ভেনাসের মন্দিরে অনেক রক্তমাংসের ভেনাসেরও দেখা মিলতো! তবে ধীরে ধীরে ভেনাসের প্রতি তাঁর আকর্ষণ কমে যায়। কারণ তাঁর আকর্ষণের জায়গা বললে গেছে। এখন পাথরের মূর্তির চেয়ে রক্ত মাংসের এক মানবী তাঁকে টাকে। প্রতি শনিবার সেই মানবী সিনাগগে যায়। তাঁর আকর্ষণে জোসেফও যায়। মেয়েটার বয়স্কা আত্বীয়াদের আঁড়াল আর রাবাইদের বিরক্তিকর কন্ঠস্বর উপেক্ষা করে জোসেফ, মেয়েটার দিকে আঁড়চোখে তাকায় বারবার। একদিন মেয়েটাও তাঁকে দেখতে গিয়ে চোরা চোখের চাহনিতে ধরা পরে। এরপর বাজারের কোনায় দেখা। বাড়ির চাকরকে ঘুষ দিয়ে মোলাকাত। রাতের বেলা বাগানের অভিসার। সেই অসাধারণ মূহুর্ত, যার কারণে তাঁর উঠান জুড়ে জশুয়া খেলে বেড়াচ্ছে। মিরিয়ামকে পেয়েছে জোসেফ। তাঁর আর কিছুই চায়না।

গ্যাব্রিয়েল অসুস্থ। প্রচন্ড অসুস্থ। আলেপ্পো থেকে বয়ে বেড়ানো তাঁর অসুখ দামেস্কে আসার দেড় বছর পরেও সারেনি। ইদানিং সেই অসুস্থতা অনেক বেড়েছে। সবসময় জ্বর থাকে গ্যাব্রিয়েলের। মাঝেমাঝে রক্তবমি হয়। নিজেদের বিপদের সময়ের এই বন্ধুর অক্লান্ত সেবা করে চলেছে মিরিয়াম। হেকিমরা আসছে প্রতিদিন। মিরিয়াম নিজেও খানিকটা চিকিৎসা শাস্ত্রের জ্ঞান রাখে। কিন্তু কিছুতেই উন্নতি হচ্ছেনা গ্যাব্রিয়েলের। আজ অবস্থা আরো শোচনীয়। সকাল থেকে রক্তবমি হচ্ছে। একই সাথে প্রলাপ বকছে এই বয়স্ক মানুষটি। কাজে ছুটি নিয়ে জোসেফও চলে এসেছে। বসেছে নিজের অকৃত্তিম বন্ধুর শিওরে। কিছুক্ষণ পর চোখ মেললো গ্যাব্রিয়েল। জোসেফকে বললো, “জোসেফ আমার মাথার কাছে রাখা পুটুলিটা একটু দেবে আমায়?” জোসেফ না করলো না। পুটুলিটা নিয়ে এসে আবার গ্যাব্রিয়েলের পাশে বসলো।
“কিছু চাই তোমার? আমি খুঁজে দেই”? জোসেফ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুকে।
“আমার এই পুটলিতে আমার কিছু ভালো কাপড় আছে। সেটা দান করে দিও হতদরিদ্র মানুষদের”। কাশতে শুরু করলো গ্যাব্রিয়েল। সাথে উঠে এলো রক্ত। জোসেফ তাকে কথা বলতে বাঁধা দিতে গেলে হাত তুলে তাঁকে থামালো সে, আবার শুরু করলো, “একটা তাওরাত পাবে। আর পাবে দাউদের উপর জিহোভার নির্দেশাবলি, যাবুর। এই দুটা আমি জশুয়াকে দিয়ে যাচ্ছি। তুমি এটা ও বড় হলে ওকে দেবে। আর আমার পুটলিতে একটা বাক্স পাবে। সেখানে একটা রত্ন খচিত নেকলেস আছে। এটা আমার মা’র ছিলো। আমার তো তিনকুলে কেউ নেই। আমি এটা মিরিয়ামকে দিলাম। ওকে আমি কণ্যাসম স্নেহ করি। আর তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি জোসেফ। তুমি সিরিয়ান না। তুমি আসলে বণী ইসরাইল। প্যালেস্টাইনি। তোমার পূর্বপুরুষের কেউ একজন সিরিয়ায় চলে গিয়েছিলো। হ্যাঁ, তোমার শরীরে আলেপ্পান রক্তও মিশেছে। কিন্তু তুমি রাজা সলোমন আর রাজা ডেভিডের সরাসরি বংশধর। তোমার বাবা আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। সেই সূত্রে আমি তোমার পরিবারের অনেক অজানা গল্পই জানি। আমি যখন তোমার ছেলেকে বাঁচাতে প্যালেস্টাইন ছাড়ছিলাম, আমি আসলে তাঁকে বাচাচ্ছিলাম না। আমি বাচাচ্ছিলাম রাজ রক্তকে। ডেভিডের রক্তকে। সলোমনের সিলের প্রকৃত মালিককে। আমি জানি জোসেফ, আমার কথাগুলি তোমার অবিশ্বাস্য ঠেকছে, কিন্তু এই ছেলে একদিন বিদেশী রোমান শক্তির হাত থেকে ফিলিস্তিনকে বাঁচাতে লড়াই করবে। আমি জানি জোসেফ, এটাই হবে। তুমি ওকে প্রস্তুত করো জোসেফ। কেনানের জন্য ওকে প্রস্তুত করো। জিহোভা তোমার আর জশুয়ার সহায় হোক। আমেন”। আমেন বলেই থেমে গেলেন গ্যাব্রিয়েল। তাঁর চোখ আর ঠোঁট দুটাই স্থির হয়ে গেছে। শরীরও স্থির। গ্যাব্রিয়েলের খোলা চোখ শেষবারের মতো বন্ধ করে দিতে দিতে জোসেফ অস্ফুটে বললো, “আমেন”।

গ্যাব্রিয়েলের মারা যাবার ৩ মাস পার হয়ে গেছে। দামেস্কেই তাঁকে কবর দিয়েছে জোসেফ। নিজের পিতার মর্যাদায়। এরমধ্যে এক ফিনিশিয় ব্যবসায়ীর মূর্তি তৈরী করছিলো জোসেফ। কাজ শেষ হলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই মুর্তিটা দেখছিলেন সেই ফিনিশিয় ব্যবসায়ী। এই দৃষ্টি নিজের প্রায় সকল খদ্দেরের চোখেই দেখেছে জোসেফ। সেই ব্যবসায়ী হঠাৎ জোসেফের কাছে জানতে চাইলো সে কতো আয় করে। একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললো জোসেফ। অবাক হয়ে সেই খদ্দের জোসেফকে বললেন, “তুমি এই কাজ করে মাসে ৫০ শেকেলও আয় করোনা! তোমার প্রতি মাসে কমপক্ষে ৩০০ শেকেল আয় করা উচিৎ! আসলে দামেস্কের মানুষ খুব কৃপণ এরা কাজের মূল্য দেয়না। তুমি বরং আলেকজান্দ্রিয়ায় চলো। সেখানে আর যাই হোক কাজের মূল্য পাবে। চাইলে তুমি মেমফিসেও যেতে পারো। আমি আগামী সপ্তাহেই আমার জাহাজ নিয়ে মিশর যাচ্ছি। তুমি ইচ্ছে করলেই আমার সাথে যেতে পারো। যাবে”? জোসেফ শুরু থেকেই আলেকজান্দ্রিয়া যেতে চেয়েছে। রোমান কেন্দ্র থেকে বহুদূরে। যেখানে জশুয়া একটি ভালো পরিবেশ পাবে। যেখানে জশুয়া লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। একজন জ্ঞাণী রাবাই হয়ে উঠবে! আর কোন সাতপাঁচ না ভেবে জোসেফ উত্তর দিলো, “আমরা যাবো”।

৩ আবার যাযাবর

জাহাজটা পাল তুলে দেবার পর প্রায় ৩ ঘন্টা হয়ে গেছে। মৃদুমন্দ বাতাসে খুব একটা খারাপ লাগছেনা জোসেফের। বরং নিজেকে প্রচন্ড সুখি মনে হচ্ছে। নিজের প্রিয়তমা সঙ্গিনী আর সন্তানকে নিয়ে নিরাপদে চলে যাচ্ছে অবশেষে। যদিও দামেস্ক খুব একটা অনিরাপদ কখনোই ছিলোনা। কিন্তু মনের ভেতর কোথায় যেনো একটা শঙ্কা কাজ করতো। গ্যাব্রিয়েল মারা যাবার পর থেকে এই বোধটা আরোও তীব্র হয়েছিলো। তাই আলেকজান্দ্রিয়ায় যাবার প্রস্তাবটা ফেলতে পারেনি। প্রস্তাব পাবার এক হপ্তার ভেতর রওনা দিতে হয়েছে। বাড়ি ছাড়া, সব গোছানো, চাকরি ছাড়া, অল্প সময়ে অনেক বেশী কাজ ছিলো। জোসেফের সেই সুহৃদ ফিনিশিয় বন্ধুটির নাম আস্তগার। বাকি ফিনিশিয়দের মতো নয় সে। জোসেফের কাছে আলেকজান্দ্রিয়া যাবার কোন পয়সা তো নিচ্ছেই না, বরং এই দীর্ঘ পথে তাঁদের জন্য একটা কামরার ব্যাবস্থা করেছে। যেকোন বানিজ্য জাহাজের মতোই কামরার অপ্রতুলতা সত্বেও!

পুরো জাহাজ হেটে বেড়াতে আগ্রহ জেগেছে জোসেফের। সে হেটেও বেড়াচ্ছে। জোসেফ চেয়েছিলো তাঁদের যাতায়াতের কোন খরচ যেহেতু নেয়া হচ্ছেনা, সে জাহাজের নাবিকদের সাথে খেটে সেটা শোধ করে দেবে। আস্তুগার রাজী হয়নি। এর বদলে বলেছে তাঁর কণ্যার একটা মূর্তি গড়ে দিতে হবে। জোসেফের আপত্তির কোন কারণ ছিলোনা। আস্তগারের পরিবার আলেকজান্দ্রিয়াতেই থাকে। সে বলেছে যতদিন একটা ব্যাবস্থা না হয় সে মিরিয়াম আর জশুয়াকে নিয়ে তাঁর বাসাতেই থাকতে পারে। আস্তগারের এক বন্ধুর কাঠের মূর্তি তৈরীর স্টুডিও আছে। জোসেফ সেখানে কাজ শুরু করতে পারে। তবে আস্তুগারের ইচ্ছা জোসেফ নিজেই যাতে একটা স্টুডিও খোলে। যা খরচ লাগবে আস্তুগারই দিতে পারবে। জোসেফের কাজের যা হাত, দুই এক মাসেই টাকা শোধ হয়ে যাবার কথা!

রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে ছিলো জোসেফ। কাঁধে একটা হাতের আলতো স্পর্শ পেতেই ফিরে তাকালো। আস্তগার দাঁড়িয়ে আছে। আস্তগার জাতিতে ফিনিশিয় হলেও ভালো হিব্রু আর আরবী জানে। জোসেফের জন্য এটা সুবিধা।

“বন্ধু কোন অসুবিধে হচ্ছেনা তো”?, আস্তগারের কণ্ঠে আন্তরিকতার ছাঁপ স্পষ্ট।

“প্রশ্নই আসেনা। আপনি বদান্যতার কোন কমতি রাখেননি। আপনাকে দেবার মতো আমার কিছুই নেই। শুধু আন্তরিক ধন্যবাদ আর জিহোভার কাছে প্রার্থণা করা ছাড়া! অন্য ফিনিশিয়রা ইহুদীদের একেবারেই সহ্য করতে পারেনা! আপনি ব্যাতিক্রম”। জোসেফ যে সত্যই কৃতজ্ঞ তা তাঁর কন্ঠ শুনেই আঁচ করা যায়!

“আমিও ইহুদীদের ঘৃণা করি”। জোসেফের বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে থাকে আস্তগার। “কিন্তু তোমাকে আমি তো ইহুদী, রোমান কিংবা ফিনিশীয় হিসেবে সাহায্য করছিনা। একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত হিসেবে একজন অসাধারণ শিল্পীর সাহায্যে আসার চেষ্টা করছি মাত্র! এখানে তো আমি কোন ধর্মই খুঁজে পাচ্ছিনা। মনে রেখো জোসেফ, শিল্পীর হয়তোবা ধর্ম থাকে, শিল্পের কোন ধর্ম থাকেনা। ঈশ্বর যদি থেকে থাকেন, নিশ্চিতভাবেই তিনিও একজন শিল্পীই হবেন”।

“আস্তগার, আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাই। ক্রীতদাস ব্যাবসা আর মানুষ ছিনতাই করে ক্রীতদাস বানানোর কুখ্যাতির জন্য আমিও আগে ফিনিশিও ব্যবসায়ীদের ঘৃণাই করতাম। আপনাকে দেখে সেই ধারণা বদলে যাচ্ছে আমার”। জশুয়া খুব ধীরে ধীরে কঠাগুলি শেষ করে।

“এতো জলদি কোন সিদ্ধান্তে এসোনা জশুয়া”। আস্তগার বলতে থাকে। “কোন সিদ্ধান্তই একেবারে অমোচনীয় হয়না। কিন্তু সিদ্ধান্ত একেবারেই বদলানো উচিৎ নয়। হ্যাঁ ফিনিশিয়রা দাস ব্যবসায়ী। অনেক অনৈতিকতাও আছে এই ব্যবসায়। সেতো সব ব্যবসাতেই থাকে। ইহুদীরা অনায্য সুদের ব্যবসা করে কম টাকা কামায়নি। এমনকি নিজ সম্প্রদায়কে জাতের খাঁড়ায় নিজেরাই বহুধা বিভক্ত করেছে। আচ্ছা তোমার গল্পটা কি আমায় বলবে! তুমি যে সিরিয়ানদের মতো দেখতে হলেও সিরিয়ান নও তা বোঝা যায়। ইজরাইলে আমার যথেষ্ট যাতায়াত আছে। তিন মাস আগেও গাজা উপত্যকায় ব্যবসার কাজে গিয়েছিলাম। তোমার উচ্চারণে যদি আমার ভুল না হয় তুমি আরমায়িক জানলেও তুমি জুডায়ার মানুষ! আমি ভুল বলেছি? আপত্তি না থাকলে আমাকে তোমার গল্প বলতে পারো জোসেফ। আমার কাছে তোমার গল্প নিরাপদই থাকবে”।

জোসেফ দ্বিধায় ভুগছে। বুঝতে পারছেনা আস্তগারের মতো একজন বিদেশীকে সব খুলে বলা উচিৎ হবে কিনা! অবশেষে সমস্থ দ্বিধা ঝেড়ে ফেললো জোসেফ। বলতে শুরু করলো তাঁর সমস্থ গল্প। মিরিয়ামের সাথে দেখা, প্রেমে পড়া, নাজারেথ ছেড়ে পলায়ন, জোশুয়ার জন্ম, দামেষ্কের জীবন সংগ্রাম কিছু বাদ দিলোনা।

গল্প শেষে চুপ করে বসে আছে আছে দুজন। আস্তগার আলতো করে জোসেফ এর হাত দুটো ধরলো। “আমি তোমার গল্প গাজাতে গিয়ে শুনেছি জোসেফ। তবে আমি জানতাম না তুমিই সেই। রোমান গভর্ণরের মাধ্যমে মিরিয়ামের বাবার নালিশ পৌঁছেছে রোমে সম্রাট অগাস্টাসের কাছে। তোমার বিরুদ্ধে রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ষরযন্ত্র, প্রজাদের উত্তেজিত করে তোলা আর মিরিয়ামকে নিয়ে পালাবার অভিযোগ উঠেছে। সিজার খুব গুরুত্বের সাথেই এই ব্যাপারটাকে নিয়েছেন। সকল রোমান চৌকিতে তোমাদের চেহারার বর্ণনা বলে দেয়া হয়েছে। তুমি এখনও কেনো ধরা পড়োনি সেটা ভাবতেই আমি অবাক হচ্ছি”! আস্তগার কথা চালিয়ে গেলো। “ঠিকমতো বাতাস পেলে আর এথেনা না ক্ষিপ্ত হলে ৩ দিনের মধ্যে আমরা সাইপ্রাস পৌঁছে যাবো। সাইপ্রাসে খুব শক্তিশালী রোমান ঘাঁটি। বানিজ্য কেন্দ্র হওয়ায় তোমার বর্ণনা অবশ্যই এখানে পৌঁছে গেছে। এখানে মাল খালাস করে নতুন মাল উঠাতে আমার দিন চারেক লাগবে। আমি যতোটা দ্রুত সম্ভব আমার কাজ শেষ করবো। তুমি এই সময়ে ভুল করেও জাহাজ থেকে নামবেনা। স্ত্রী সন্তানের সাথে কেবিনেই থাকবে। আর জাহাজ চলাকালে তোমার কেবিন থেকে অপ্রয়োজনে বের হবার প্রয়োজনও দেখছিনা। জাহাজে বিভিন্ন ধরণের নাবিক আছে। আমি সবাইকে বিশ্বাস করিনা। তুমি সাবধানে থেকো জোসেফ। বাকিটা জুপিটারের ইচ্ছা”।

বাকি সময়টা আসগারের পরামর্শে পুরোটা সময় কেবিনেই কাটিয়ে দিলো জোসেফ। বাতাস প্রায় পুরোটা সময়েই অনুকুলে থাকলো। পাল সবগুলি খুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে। মাস্তুলে লাল রঙের পালগুলো ফুলেফুলে জানান দিচ্ছে এটা একটা ফিনিশিয় বানিজ্য তরী। আর সামনের খোদাই করা গ্রীক অক্ষর বলছে এই সুন্দরী জাহাজটার নাম আফ্রোদিতি। বাতাস প্রচুর হওয়ায় এবারের মতো শেকলে পা বাঁধা ক্রীতদাসদের পিঠ চাবুকের চুমু থেকে রক্ষা পেলো। তৃতীয় দিন দুপুরের পর আফ্রোদিতি সাইপ্রাসের প্রধান বন্দরে এসে ভিড়লো।

চলবে…………………………