পূর্ব প্রকাশ: WOMENCHAPTER
আমি ক’দিন আগে, ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ওয়াশিংটন ডি.সি. তে, সেন্টার ফর ইনকোয়েরি আয়োজিত চতুর্থ ‘উইমেন ইন সেক্যুলারিজম’ কনফারেন্সে সমাপনী বক্তব্য রেখেছিলাম। ওখানে বেশ কয়েকজন বিদেশী (ইরান, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশ থেকে) নারীবাদী এক্টিভিস্টরা বক্তব্য রাখলেও বেশীর ভাগ বক্তা এবং দর্শকই ছিলেন আমেরিকার প্রগতিশীল, সেক্যুলার নারীবাদী লেখক, এক্টিভিস্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। আমি এ বিষয়ে কোন বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু একজন সচেতন নারী হিসেবে এটা আমার পড়ালেখা, আগ্রহ এমনকি সমগ্র জীবনের কর্মকান্ড, চিন্তা এবং অস্তিত্বের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত একটা বিষয়।
পড়াশোনা, বন্ধুত্ব, কর্পোরেট চাকরি, লেখালিখি এবং এক্টিভিজমের সূত্রে গত আড়াই দশকে আমেরিকার বিভিন্ন সেক্যুলার এবং প্রগতিশীল সমাজের ঘনিষ্ট সংস্পর্শে এসেছি। আমার মনে হচ্ছিল, এদের সামনে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের নারীবাদের অবস্থা এবং পার্থক্যটা তুলে ধরা দরকার। একুশ শতকের সাম্রাজ্যবাদের শিখরে বসে থাকা আমেরিকার নারীদের পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত তৃতীয় বিশ্বের সমাজে নারীদের সংগ্রামের মিল এবং অমিলগুলো সম্পর্কে এরা অনেকেই ওয়াকিবহাল নয়। পাশ্চাত্যের প্রগতিশীলতা এবং সংগ্রামের নিরিখে বাকি বিশ্বের সংগ্রামগুলোকে একই পাল্লায় মাপার প্রবণতাটা কেন ঠিক নয় সেটিই ছিল আমার বক্তব্যের মূল বিষয়।
দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদ খুব ভয়ংকর জিনিস। ট্যাঁকের পয়সা খরচ করে টিকেট কেটে এসে মুখের উপর নিজের দেশের সমালোচনা শুনতে কারই বা ভালো লাগে! তাই একটু ভয়ে ছিলাম যে এনারা আমাকে এতদিন ভালবাসলেও হয়তো এবার গোস্বা করবেন। কিন্তু তারপর ভাবলাম, তাদের দাবীকৃত প্রগতিশীলতা এবং মানসিক উন্মুক্ততা আসলেই কতখানি উদার তার একটা পরীক্ষা না হয় করেই দেখি। যেমন ধরুন, আমার প্রায়ই পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছে করে যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উর্দ্ধে উঠে কয়জন প্রগতিশীল বাঙালি দেশে পাহাড়ি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম।
সে যাই হোক, শ্রোতাদের কাছ থেকে অভূতপূর্ণ সারা পেয়ে বুঝলাম এনারা পৃথিবীজুড়ে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার সমালোচনা করতে তেমন কুণ্ঠিত নন। বরং আমাকে বললেন এ কথাগুলো নাকি ওদের বারবার শোনা দরকার, ওদের মিডিয়া তো এগুলো বলে না। বক্তৃতাটার বেশ কিছু বিষয় আমেরিকার শ্রোতাদের জন্য প্রাসঙ্গিক ছিল যেটা হয়তো এখানে প্রাসঙ্গিক নাও হতে পারে। আবার উল্টোটাও সত্যি। আমি এধরণের টক দেওয়ার সময় স্ক্রিপ্টের বাইরে চলে যাই প্রায়শই। তাই এখানে থিমটার প্রতি সৎ থেকে বক্তৃতাটার সরাসরি অনুবাদ না দিয়ে ভাবানুবাদটা দিচ্ছি।
কী সাঙ্ঘাতিক কটা দিনই না কাটল এখানে! আপনারা একইভাবে অনুভব করেছেন কিনা জানি না তবে আমি করেছি। এই ঘর জুড়ে কী ক্ষমতা, কী শক্তির বন্যাই না বয়ে গেল! কী অপূর্ব এক বৈচিত্র্যময়, প্রতিভাবান, আর সাহসদৃপ্ত নারীদের সম্মিলন!
এই অনুষ্ঠানে আমাকে কথা বলার আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যারা আমার কাজে সহায়তা করেছেন গত ১৮ মাস ধরে তাদেরকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আমার পরিচয়টা সেরে ফেলি এই ফাঁকে, কী বলেন? (এখানে আমার পরিচয়, আমার এবং অভিজিতের লেখালিখি, আমাদের উপর গত বছরের আক্রমণ এবং তারপরে আমার কোর্পোরেট চাকরি ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে নিযুক্ত হওয়ার বিষয়টা খুব সংক্ষেপে তুলে ধরেছি। এগুলো এখানে আর বললাম না।)
যা হোক এবার এই সেমিনারের বিষয়বস্তুতে আসি।
নারীবাদ থেকে আমি ধর্মে সংশয় আর অবিশ্বাসটাকে ঠিক আলাদা করতে পারি না। এই দুই পথেই আমার যাত্রা খুব কম বয়েসে শুরু হয়। কত হবে তখন আমার বয়েস? এই ১৩ কি ১৪! কত কিছু নিয়েই যে কতশত প্রশ্ন ছিল তখন। ভাগ্যই বলতে হবে যে আমি এমন একটা উদার এবং শিক্ষিত মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলাম যেখানে সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করাটাকে উৎসাহিতই করা হতো।
যতই আমি আমার শিক্ষা আর আমার চারপাশের বিশ্বায়িত দুনিয়ার রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ব্যাপারগুলোকে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক অভিজ্ঞতাগুলোর সাথে মেলাই, ততই আমি আর বিষয়গুলোকে আলাদা করতে পারি না। যেমন আমি ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বাস থেকে নারীবাদকে আলাদা করতে পারি না ঠিক তেমনি পারি না বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, যুদ্ধ আর বৈশ্বিক কন্সিউমারিজমের বিরুদ্ধতার সাথে নারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে আলাদা করতে।
জানি আপনাদের অনেকেরই হয়তো মত মিলবে না ঠিক আমার সাথে। কিন্তু তারপরও চলুন কিছু ব্যক্তিগত আর সামাজিক অভিজ্ঞতার আলোকে কয়েকটা বিষয় বোঝার চেষ্টা করি।
উত্তরাধুনিক জগতে – না কি বলবো উত্তর-উত্তরাধুনিক জগতে – ‘টোটালাইজিং ডিসকোরস’ আর ‘মেটান্যারেটিভ’ খুব খারাপ জিনিষ। যুক্তিবাদ খারাপ, যুক্তি এবং বিজ্ঞান হচ্ছে স্রেফ মতাদর্শ। গণ-উৎপাদনব্যাবস্থা, সামগ্রিক কোন তত্ত্ব বা রাজনৈতিক দর্শন, ট্র্যাক্ট হাউজিং, জমি সবই খারাপ। উত্তরাধুনিকেরা স্বল্পমাত্রার উৎপাদন, স্থানীয় ব্যাখ্যা এবং বিবরণী, আর আপেক্ষিকতা নিয়েই আগ্রহী বেশি: খণ্ডায়িত কর্তাসত্তার (সাব্জেক্টিভিটির) আলোকে সামগ্রিকতার যে কোন তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করা বা যাচাই ও বিশ্লেষণ করার বেলায় সবকিছুই যেন আপেক্ষিক।
উত্তরাধুনিকদের সবকিছুর সাথেই আমি যে দ্বিমত পোষণ করি, তা কিন্তু নয়। তবে নারীমুক্তির ব্যপারটাকে আমি কিছুতেই খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঠিক দেখতে পারি না। সারা দুনিয়ার অর্ধেক জনগোষ্ঠী নিয়ে কথা বলছি এখানে আমরা! ধর্ম থেকে নারীবাদ আপনি আলাদা করবেন কিভাবে? আবার আজকের বিশ্বের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক গঠনপ্রণালী থেকে ধর্মকে কিভাবে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব? আর নারীর অধিকার – যেটাকে মূলত মৌলিক মানবাধিকার বলেই চিহ্নিত করা উচিত – কিভাবে আলাদা করে দেখবেন রাজনীতি, অর্থনীতি, আর সংস্কৃতি থেকে? আমরা সবাই একটি অতি জটিল এবং ওতোপ্রতোভাবে জড়িত বৈশ্বিক মাকড়সার জালে জড়িয়ে আছি, এখানে সব ক্রিয়ারই পারস্পরিক বিস্তৃত প্রতিক্রিয়া আছে।
আচ্ছা চলুন প্রথমে সহজ বিষয়টা নিয়েই কথা বলি – ধর্ম এবং নারী। বাংলাদেশ এবং আমেরিকা এই দুটো খুব ভিন্ন জগতে আমার থাকার সুযোগ হয়েছে বলে, আমি হয়তো আপনাদের সামনে এদের একটা তুলনামূলক চিত্র হাজির করতে পারবো।
যা বলছিলাম – কম বয়েস থেকেই আমি আমার অধিকার নিয়ে আমি প্রশ্ন করা শুরু করি। সেই সত্তরের দশকে মা বাবার জন্য শুধু কন্যা সন্তান থাকাটা খুব স্বস্তির কোনো ব্যাপার ছিল না। ব্যাপারটা এখনো উদ্বেগের, কারণ পুত্র সন্তানরাই আমাদের সমাজে সাধারণত বৃদ্ধ মা বাবার দেখভাল করার দায়িত্ব নিতে বাধ্য হয়।
তিন বোনের মধ্যে বড় আমি, আমরা তিনজনই যে মেয়ে সে নিয়ে আমার মা বাবা মনে হয় না খুব বেশী চিন্তিত ছিলেন। কারণ তারা জানতেন যে বুড়ো বয়সে তাদের ছেলেমেয়ের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন হবে না। একটু খেয়াল করে দেখুন, এখানে আমরা যে নারী অধিকারের কথা বলছি তা কিভাবে সমাজের আর্থসামাজিক শ্রেণিগত অবস্থানের সাথে ঘনিষ্ঠতভাবে যুক্ত।
যাই হোক, আমরা তিনবোন হওয়ায় মা বাবার বিশেষ মাথাব্যথা না থাকলেও, প্রতিবেশী আর দূর-আত্মীয়পরিজনেদের কাছে প্রায়ই শুনতে হত আমাদের মা বাবারা কত দুর্ভাগা। ছেলে না থাকলে তাদের এবং তাদের সম্পত্তির দেখভাল কে করবে?
বাংলাদেশে যদিও আমাদের একটা ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষ দেওয়ানি আর ফৌজদারি আইন আছে, আমাদের পারিবারিক আইন কিন্তু চলে ধর্মীয় মতে…। ইসলামি আইন মতে, যেহেতু আমি মেয়ে, তাই আমি আমার ‘ভাই’য়ের তুলনায় বাবা মার সম্পত্তির আদ্ধেকাংশ পাবো। আর আমাদের ভাই নেই বলে আমার বাবা মার মৃত্যুর পরে তাদের (যার নামে সম্পত্তি তার) ভাইয়েরা পাবেন সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ। সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারটাও ভারি বৈষম্যসূচক। ডিভোর্স হলে সন্তান ছেলে হলে ৭ বছরতক মায়ের কাছে থাকতে পারবে, আর মেয়ে থাকবে বয়ো:সন্ধি না-হওয়া পর্যন্ত। মা আবার বিয়ে করলে সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব চলে যাবে বাবার ওপর। পারিবারিক জীবন থেকে সামাজিক বলুন আর পেশাদারি জীবন বলুন, সবখানেই নারীরা বৈষম্য আর অবিচারের শিকার।
আমার মা একজন আইনজীবী, তিনি প্রায়শই নারীদের আইনি সমস্যা নিয়ে লড়তেন…আমাদের ঘরে এসব নিয়ে নিত্যনৈমিত্তিকভাবেই আলোচনা হতো। আমার উদারমনস্ক মা বাবা সবসময়েই আমাদের নানান কিছু পড়তে আর প্রশ্ন তুলতে উৎসাহ দিতেন। আমার মনে হয় রিজন র্যালিতে আমি আগেও এই গল্পটা বলেছিলাম -cতের বছর বয়েসেই আমি বাবাকে গিয়ে প্রশ্ন করি, এই যে সবকটা ধর্মই নিজেদের ‘ছহিহ’ ধর্ম হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চায় – ব্যাপারটা কী করে যৌক্তিক হতে পারে? ওই নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারীরা ছাড়া আর কেউই স্বর্গে যেতে পারবে না, এটা কেমনতর সুবুদ্ধির কথা, তাহলে অন্যরা কোথায় যাবে? বাবা হেসে বললেন, সব ধর্মের শাস্ত্রগুলো আগে পড়ে দেখো, তারপর আমরা এ নিয়ে আলোচনা করবো। যেমন কথা তেমন কাজ, আমিও বেড়িয়ে পরলাম, বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র এবং বাসার লাইব্রেরি থেকে নিয়ে ধুমায়া কোরান, বাইবেল, গীতা, আর তৌরাহ পড়তে শুরু করে দিলাম। ১৩ বছরের ছোট্ট মাথার বুদ্ধি নিয়েই যেন সব পড়ে উদ্ধার করে ফেলতে শুরু করলাম।
প্রায় বছরখানেক পর আমি বাবাকে গিয়ে বললাম যে সবকটা ধর্মগ্রন্থই তো রূপকথার মতন লাগলো। যৌক্তিক দিক থেকে কোনোটারই বিশেষ মূল্য নেই আর সবগুলোই তো নারীদের বিভিন্ন মাত্রায় অবদমিত করে রেখেছে। বাবা বললেন, ” ‘আচ্ছা, তুমি যদি তাই মনে করতে চাও তাহলে ঠিক আছে।” পারিবারিকভাবে আমার ধর্ম নিয়ে আলোচনার ওখানেই ইতি। এরপরে মনে হয় না কেউ আমাকে কখনো ধর্ম মানতে জোরাজুরি করেছে। এমনকি এদেশেও বোধ হয় খুব বেশী ছেলেমেয়ে আমার মত এতটা ভাগ্যবান হয় না এ ব্যাপারে।
তবে একটা হাসির কথা শেয়ার করি আপনাদের সাথে, এখন হাসি আসলেও তখন এটা কিন্তু খুব সিরিয়াস একটা ব্যাপার ছিল আমার জন্য। ১৫-১৬ বছর অবদি প্রায়শই ওই অবিশ্বাসটা একটু নড়বড়ে হয়ে উঠত, বিশেষ করে বড় সব পরীক্ষার আগেভাগে! আর যখনই আমার ‘নাস্তিকতা’র স্তম্ভটা একটু দুলে উঠতে শুরু করতো, আমি টুক করে কোরান থেকে সুরা নিসাটা পড়ে নিতাম, যেখানে ইসলামে নারী ও নারী অধিকার নিয়ে বলা হয়েছে। তারপরেই আবার সাই করে অবিশ্বাসের ছাতার তলে ফিরে চলে আসতাম। বিশ্বাস করুন, আমাকে এরকম একজন শক্তপোক্ত নাস্তিক বানানোর জন্য আমি কোরানের কাছে আমি নিরতিশয় কৃতজ্ঞ।
তবে ঠিকমত বলতে গেলে, পৃথিবীর রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় ইতিহাস এবং বিবর্তনের মত বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোই ছিল আমার জীবন দর্শনের একটা বড় অংশ। এসময়টা থেকেই আমি দেবীপ্রসাদের যে গল্পের শেষ নেই সহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বই, দার্শনিক এবং রাজনৈতিক বই পড়তে শুরু করি।
সে যাক, আসুন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করি। বাংলাদেশে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রিও নারী, যা কিন্তু ইসলামী প্রথার সাথে ঠিক যায় না। কিন্তু তারা, সেই ক্ষমতাশালী নারীরাই কিন্তু আমাদের এই মধ্যযুগীয় পারিবারিক আইনগুলোর ব্যাপারে – মারাত্মকভাবে নারীর সমানাধিকার ক্ষুণ্ণ করা আইনগুলো- তাদের পরিবর্তনের ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে নীরব থাকেন। কারন এটা ধর্ম সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে তারা এদেরকে ঘাঁটাতে নারাজ তারা। সরকার প্রধান কিংবা রাষ্ট্র প্রধানের জেন্ডার আসলে পৃথিবীতে কোন বিশেষ ভূমিকা রাখে না, তারা মূলত পুরুষ শাসিত রাজনৈতিক কাঠামোরই প্রতিনিধিত্ব করে ক্ষমতা বজায় রাখার স্বার্থে।
অন্যদিকে কিন্তু তারা তথ্য ও… আইন (আইসিটি অ্যাক্ট ৫৭) – এর মত সেমি-ব্লাসফেমি আইন জারি করে সেক্যুলার এবং প্রগতিশীল ব্লগার, লেখক, সাংবাদিক এবং প্রকাশকদের জেলে পুরতে দ্বিধা করেন না। ৫৭ ধারা খুব পুরোনো একটা ব্রিটিশ আইন, যেটাকে সম্প্রতি কিছু সংশোধন করে এর ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়ে আবার নতুন করে জারি করা হয়েছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও সত্যি যে, সংশোধিত এই নতুন আইন অনুসারে ইন্টারনেটে ধর্মের সমালোচনা অথবা তথাকথিত ধমীয় অনুভুতিতে আঘাত দেয়া দন্ডনীয় অপরাধ; অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল! বাংলাদেশ সরকার ধারাবাহিকভাবে ব্লগার, সাংবাদিক এবং অ্যাক্টিভিস্টদের হেনস্থা করে যাচ্ছে এই আইনের বলে। অথচ, ব্লগারেরা যখন ইসলামিক জঙ্গিদের চাপাতির কোপে একের পর এক খুন হয়ে চলেছিল তখন এই সরকারই সম্পূর্ণভাবে নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিল।
সত্য হচ্ছে, দেশের প্রগতিশীল এবং প্রান্তিক মানুষদের জন্য ইসলামি জঙ্গিবাদই একমাত্র ভয়ের বিষয় নয়; নিজেদের সরকারের ভয়েও আমাদের সিটিয়ে থাকতে হয়। অনেকটা ওই যাকে বলে ‘মাইনক্যা চিপায় পড়া’র মত অবস্থা আমাদের আর কি।
যাহোক, আমার কথা হল, আমি নারী হিসেবে যদি সম অধিকার চাই, তাহলে আমার জন্য ধর্মে বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু আমি নারীবাদের বিষয়টা বিচ্ছিন্নভাবে দেখতে পারিনা বরং পুরো রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। এবার আসা যাক, আমার দ্বিতীয় পয়েন্টে, নারীবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে।
আপনাদের অনেকেই হয়ত বাংলাদেশের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে ঘটমান প্রাণঘাতি ঘটনাগুলোর কথা জানেন– আজ গার্মেন্টস ফ্যাকটরির বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ছে, কাল গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগছে, পরশু শ্রমিকেরা পথে নেমেছেন — এমন খবর তো আমরা এখানে প্রায়ই পাচ্ছি। বাংলাদেশে একটা রপ্তানিমুখি তৈরি পোষাকশিল্প গড়ে উঠেছে, যেখানে আজ ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করছে, আর তাদের শতকরা ৯০ ভাগই নারী।
দেখেন, আমি বেড়ে উঠেছি বাংলাদেশে, এবং গার্মেন্টস শিল্পের কর্মীদের খুব কাছের থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে । তারাই আমাকে অংশত কলেজ জীবনে প্রগতিশীল বাম রাজনীতিতে যোগ দেয়ার উৎসাহ যুগিয়েছে। আমি দেড় বছর পড়ার পরেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ড্রপ আউট করে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। এর মধ্যে গার্মেন্টস শিল্পেও প্রায় এক বছর কাজ করি; প্রথমে হেল্পার এবং পরে মেশিন অপারেটর হিসেবে। এর পরে আমার মা বাবা আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং একরকম জোর করেই বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যাবস্থা করেন। প্রথম আমি কানাডায় আসি পড়তে, ১৯৯১ সালে, তার কিছু পরেই আমেরিকায় চলে আসি।
গার্মেন্টসের কর্মী হিসাবে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল, এই পুরো গার্মেন্টস শিল্পটাই অমানুষিক কর্ম পরিবেশ, দীর্ঘ শ্রমঘণ্টা, অত্যন্ত কম বেতন, অনিরাপদ রেগুলেশনবিহীন বিল্ডিং, শিশু শ্রম, নিপীড়ন, দুর্নীতিগ্রস্ত মালিক এবং সরকারি নীতি দ্বারা পরিচালিত। আপনাদের কী এগুলো শুনে উনবিংশ শতাব্দীর শেষে আমেরিকার ফ্যাক্টরিগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে?
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আজকেও, তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি মাস্যা ৭০ ডলারের মত। শ্রমিকেরা এটাকে বাড়িয়ে ১০০ ডলারে নেয়ার জন্য আন্দোলন করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ৭০ ডলারেই আপোষ করতে বাধ্য হয় তারা। এখানকার ওল্ড নেভি, ওয়ালমার্ট, এইচএন্ডএম, এবং গ্যাপ নামের ব্র্যান্ডগুলো আমাদের যে প্রতিযোগিতামূলক দামে কাপড় সরবরাহ করে, তা সম্ভব হচ্ছে কেবল ওই নারী শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা শোষণ করেই।
এখন যদি সেই নারীদের মুক্তির বিষয় কথা বলতে চাই, তাহলে সবচেয়ে প্রথমে কথা বলতে হয় দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় পরিসরের কাঠামোগত ইস্যুগুলো নিয়ে, সিস্টেম নিয়ে। তাদের বেসিক অধিকার নিশ্চিত করা নিয়ে কথা বলতে হয় প্রথমে। এখানে অবশ্যই আমাদের গ্লোবাল কন্সিউমারিজম আর শোষণমূলক গ্লোবাল অর্থনৈতিক নীতিসমূহের প্রভাবগুলোর কথা তুলে ধরতে হবে। সেদিনই কোথায় যেন দেখলাম, বিশ্বের ৬০ মিলিয়ন মেয়ে শিশুরা মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। মানুষ হিসেবে মৌলিক অধিকারগুলোই এখনো তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাহলে কী ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছেনা যে, আজকের এই চরম বৈষম্যমূলক পৃথিবীতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে শ্রম অধিকার, বৈশ্বিক রাজনীতি, এবং অর্থনৈতিক নীতি ইত্যাদির পর্যালোচনা করা ছাড়া নারীবাদ এবং নারী মুক্তির কথা বলা কঠিন?
চলুন আরেকটি ভিন্ন ধরণের উদাহরণ দেওয়া যাক। সৌদি আরবের কথাই ধরি। তাদের দেশে আজ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত, এই রাজতন্ত্র শরিয়া আইন মোতাবেক দেশ চালায়, যে আইনে নারীদের গাড়ি চাল্যাং কিংবা একা কোথাও ভ্রমণ করার পর্যন্ত অধিকার পর্যন্ত নাই। কিন্তু আমরা (আমেরিকার সরকার) সৌদি রাজতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছি যে কোন মূল্যে। আমাদের সরকার এত মানবাধিকারের কথা বলে এটা নিয়ে কিছু বলেনা কেন? আমার মনে হয় সবাই আমরা সেই উত্তর জানি। ওবামা কালকেই তো ভেটো দিল ৯/১১ এর পেছনে সৌদি আরবের ভূমিকার বিরুদ্ধে মামলা করার বিলটির বিরুদ্ধে।
প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বৃটিশ ঔপনিবেশিক যুগের সমাপ্তির পর, বেশীরভাগ সংঘাতের মূলেই রয়েছে গ্লোবাল সম্পদ আর বাজার দখলের জন্য সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। তিরিশের দশকে তেলের খনির আবিষ্কার পৃথিবীর ইতিহাসকে আরও রক্তাক্ত আর জটিল করে তুলেছে।
সাম্প্রতিক ইতিহাসেই দেখুন, রাশিয়া আফগানস্তানে হামলা করে, আমরা তৈরি করি বিন লাদেন। আমরা সাদ্দাম হোসেনের মত একনায়কের হাতকে আরও শক্তিশালি করি – তার নিজের দেশবাসীর উপর মানবতা বিরোধী দুষ্কর্মের প্রতি আমরা চোখ বুঝে থেকেই। তারপরই আবার আমরা ইরাক আক্রমণ করি মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে। ওদিকে প্যালেসটানই জনগণ তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লড়ে যাচ্ছে বহু দশক ধরে।
আমরা এখন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি যে, রাশিয়া আর আমেরিকার জন্য আইসিস ধ্বংস করার চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল সিরিয়ায় নিজেদের পক্ষের একটা সরকার প্রতিষ্ঠা করা। অথচ আইসিস হাজার হাজার মুসলমান মারছে, অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মারছে, জনপদের পর জনপদ ধ্বংস করে দিচ্ছে, তাদের মেয়েদের যৌনদাসী করে নিয়ে যাচ্ছে। আবার অন্যদিকে সিরিয়ার সরকার প্রধান, রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট একনায়ক, নিজের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে গিয়ে দেশটাকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ওদিকে সৌদিরা আবার সব ছেড়ে এখন ব্যস্ত ইরান দ্বারা প্রভাবিত ইয়েমেনিদের ধ্বংসের কাজে।
যাই হোক, সৌদি আরব প্রসঙ্গে আরও কিছু বলতে চাই। তারা বাংলাদেশের মত তৃতীয়বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে মৌলবাদী ওহাবিজম রপ্তানি করয়েছে বহু দশক ধরে, স্থানীয় সরকার এবং ধর্মীয় মৌলবাদী গ্রুপগুলোর সহায়তা নিয়ে। তারা সেসব মৌলবাদী গ্রুপগুলোকে ফান্ড যুগিয়েছে, আমাদের মত দেশগুলোতে হাজার হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করেছে সেকুলার শিক্ষাব্যবস্থার অভাবের সুযোগ নিয়ে। এখন তারা সবাই ধর্মীয় মৌলবাদ নিয়ে এত উচ্চকিত কারণ তাদের নিজেদের পলিসিগুলোই তাদের উপর ব্যাকফায়ার করেছে বলে। আমরা কিন্তু এখানে বসে এসবের বিরুদ্ধে কিছু শুনি না, কেননা বিশ্ব বাজারে সৌদি আরব আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র।
এখন সমস্যা হল, স্থানীয় এবং বিদেশি প্রবল ক্ষমতাশালী শক্তিগুলো যেখানে ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে, ব্যবহার করছে তাদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য– সেখানে সেই শক্তিগুলোকে প্রথমে দায়ী না করে, কি করে আমি কেবলমাত্র ধর্মকে দোষী বলতে পারি? আসলে কিন্তু পারি না। বাংলাদেশে আমরা দেখেছি দুর্নীতিপরায়ণ জাতীয়তাবাদী সরকারগুলো এবং তাদের সুবিধাবাদী রাজনীতি কিভাবে সংবিধানে, শিক্ষা ব্যবস্থায়, সামাজিক পরিসরে ক্রমাগতভাবে ধর্মকে ঢুকিয়েছে। এবং আগেই তো বলেছি ওই সব বিদেশি শক্তিগুলোর কথা যারা দেশীয় সরকারগুলোকে এই কাজে সহায়তা প্রদান করেছে।
আমি এই গল্পটাই করতে চেয়েছিলাম আজ আপনাদের সামনে। আমার অতীত আর বর্তমানের বোঝাপড়া দিয়ে এই অল্প সময়ের বক্তৃতার মাধ্যমে আমি আপনাদের সামনে একটা বৈশ্বিক ক্যানভাস আঁকতে চেয়েছিলাম। ইতিহাস, আমার জন্য, কেবল অতীতের ঘটনাবলি নয়, অথবা কোন শিক্ষামূলক প্রকল্প নয়। ইতিহাস আমার জন্য একটা সুযোগ যার মাধ্যমে আমি একাধারে অতীতের সাথে সংযুক্ত হতে পারি, বর্তমানকে অনুভব করতে পারি, এবং ভবিষ্যতের ছবি আঁকতে পারি অতীত এবং বর্তমান থেকে অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে পাওয়া রঙে।
আমাদের প্রজাতির ৭০০ বিলিয়ন সদস্যের বসতি এই ছোট্ট গ্রহটি বিচিত্র সব ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে আজ এখানে এসে পৌঁছেছে। এখানে, পশ্চিমে, মানবতাবাদ একটা লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে – প্রাচীন গ্রিসের সেই বীরোচিত দার্শনিক যুগ, মধ্যযুগের ফারসি, আরব আর মুরদের প্রভাব, রেনেসাঁসের মাধ্যমে ধ্রুপদী রচনাগুলোর পুনর্জাগরণ, রিফরমেশন, আলোকপর্ব, ফরাসি বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব — কত কিছুর ভেতর দিয়ে না গেছে সে।
কিন্তু বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু অংশই, ঔপনিবেশিকতার কারণেই হোক আর সাম্রাজ্যবাদের কারণেই হোক, ওইসব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক রূপান্তরের ভেতর দিয়ে যায়নি । ভেবে দেখুন, পশ্চিম যখন গত কয়েকটি শতাব্দী ধরে এসবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তখন বিশ্বের বাকি অনেক অংশের অভিজ্ঞতাগুলো কী ছিল? ভারতীয় উপমহাদেশ শোষিত হচ্ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ দ্বারা, ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো আফ্রিকাকে তখন তথাকথিতভাবে ‘সভ্য’ বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল, আমেরিকার আদিবাসীদের পরিকল্পিত ভাবে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছিল – আর সেইসাথে দাস ব্যবস্থা আর বর্ণবাদের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের পশ্চিমা দেশগুলোর ‘সভ্যতা’।
অর্থাৎ প্রতিবেশ সারাবিশ্বে এক নয়, ইতিহাসও এক নয়, উন্নয়নের ধারা এক নয়। তাই আমি মনে করি, আমরা যখন মানবতাবাদ, নারীবাদ, আর নারীমুক্তির কথা বলি তখন আমদের আরও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। আমরা যেন ‘ওয়ান সাইজ ফিটস অল’ জাতীয় সমাধান সবার ওপর আরোপ করার চেষ্টা না করি। কারণ সেটা ঠিক হবে না। বিশেষ দেশের বিশেষ রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক বিবর্তন, তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং ওসবের ওপর গ্লোবাল রাজনীতি ও অর্থনীতির বিশেষ প্রভাব এবং সম্পর্ক — এই সব বিন্দুগুলোকে যোগ দিয়ে দিয়ে চিত্রটা এঁকে পুরো বিষয়টা আমাদের বুঝতে হবে।
পশ্চিমে আজকে যখন আমরা নারীর সমান অধিকারের জন্য আন্দোলন করছি , তখন বিশ্বের অনেক দেশেই নারীরা(এবং পুররুষেরাও) তাদের মৌলিক অধিকারের আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত। যেমন তাদের সংগ্রাম ন্যূনতম মজুরির জন্য, সম্পত্তির অধিকার অর্জনের জন্য, বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর অধিকারের জন্য, সন্তানের কাস্টডি অর্জনের জন্য, এমনকি নিজের পছন্দে প্রেম বা বিয়ে করা, শিক্ষা, গাড়ি চালানো, ভ্রমণ বা চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার অধিকারের জন্য।
গত কয়েক দিনে, এখানে যেসব বক্তারা কথা বলেছেন তাদের কাছ থেকে আমরা আমেরিকার স্থানীয় সমস্যাগুলো নিয়ে শুনেছি, শুনেছি ধর্ম, শ্রেণি, শিক্ষা, গর্ভপাত, বর্ণবাদ আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ইস্যুগুলো নিয়ে । গুলালাই আর মারিয়ামের মত বক্তাদের কাছে শুনেছি বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে কী হচ্ছে সে সম্পর্কে ।
আমি আজকে এটুকুই বলতে চাই যে, বিশ্ব যেমন বিচিত্র আমাদের সমস্যাগুলোও বিচিত্র, আবার তারা একে অপরের সাথে বিযুক্ত। একদিকে যেমন আমরা এগিয়েছি অচিন্ত্যকে জয় করেছি, অবিরাম অজানাকে জেনে চলেছি, আবিষ্কার করছি, উদ্ভাবন করছি, আবার অন্য দিকে তেমনি আমরাই এই পৃথিবীটাকে একটি জটিল এবং অন্যায্য জায়গা হিসাবে গড়ে তুলেছি। আমাদের মন উন্মুক্ত রাখা উচিত, আরও সচেতন হওয়া উচিত যখন আমরা মানবতার সমস্যা আর ইস্যুগুলি নিয়ে আলোচনা করি।
দেখুন, আমি কিরকম দিব্যি আলাদা আলাদা সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, আর সমাজের বৈচিত্র এবং স্থানীয় বয়ান বিষয়ক উত্তরাধুনিক ধরনাগুলো চুরি করে ফেললাম! তবে এরপরি উত্তরাধুনিকদের সাথে আমার পথ আলাদা হয়ে যায়। আমার মনে হয়, এরপরই সব আলাদা আলাদা বিন্দুগুলোকে যোগ করে বৈশ্বিক চিত্রের সাপেক্ষে ভাবতে হবে। কেননা এরা সবাই যুক্ত – আজকের পৃথিবীতে গ্লোবাল রাজনীতি আর অর্থনৈতিক কাঠামোর কঠিন জালে জড়িয়ে আছে সবকিছু।
আমি আজকে আমাদের সবার জন্য এই ছোট্ট ভাবনাগুলো রেখে যেতে চাই। আমি চাই এ নিয়ে আরও আলোচনা আর বিতর্ক হোক, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন অবস্থার নারীরা এতে অংশ নিক। আমার এই ভাবনাগুলো কোন শেষ কথা নয়, কোন জ্ঞানের প্রদর্শনীও নয়। তাছাড়া এগুলো কোন নতুন ভাবনাও নয়। আমি এগুলো বললাম, কথা ওঠানোর জন্য, কথা শোনার জন্য, ডায়ালগ শুরু করার জন্য যাতে আমরা একযোগে কাজ করতে পারি, নিজেদের ক্ষমতায়িত করতে পারি এবং এগিয়ে যেতে পারি — এই প্রতিকূল বিশ্বে আমরা যেন একদিন নিজের নিয়তি নিজেরাই তৈরি করতে পারি।
ধন্যবাদ সবাইকে।
নারী অধিকারের সাথে যে যেকোন ধর্ম সাংঘর্ষিক অবস্থানে কথাটি অনেক নারীরা স্বীকার তো করেই না আরও কোরাণ থেকে উদাহরণ দেয়। আমি এ নিয়ে কথা বলতে গেলে হিন্দু ধর্মের চেয়ে ইসলামে নারীরর জন্য কি কি সুবিধা বেশি তা বলা শুরু করেন। যদিও আমি আগেই হিন্দুধর্মের সাথে নারী অধিকার যে যায় না তা স্বীকার করেই নিয়েছি। যাহোক, এ ক্ষেত্রে আপনার সবল পদচারণা সফলতা বয়ে আনুক — এ প্রত্যাশা।
প্রিয এবং শ্রদ্ধেয় আপা, লেখাটা কি অনন্যার জন্য নিতে পারি? বা আপনি নিজে থেকে কি কোনো লেখা অনন্যা ঈদসংখ্যার জন্য দিতে পারেন?
আমার ইমেইল
[email protected]
প্রিয় বন্যা আহমেদ,
আপনার সুচিন্তিত বক্তবের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। অত্যন্ত সঠিকভাবেই আপনি উপস্থাপন করেছেন, নারী মুক্তির আন্দোলনকে সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক মুক্তির আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবা যাবে না। এ আন্দোলনে যেমন আছে একটি বৈশ্বিক প্রেক্ষিত, তেমনি তার আছে দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে ভিন্ন ভিন্ন স্বকীয় প্রেক্ষিত। সবগুলো প্রেক্ষিতকে বিবেচনায় নিয়ে রণকৌশলি নির্ধারণ করতে হবে। এ কথা আজ স্পটিক-স্বচ্ছ যে, কোন ধর্মেই নারীকে পুরুষের সমান অধিকার প্রদান করা হয় নি। তাই ধর্মীয় বিশ্বাস যেমন এখানে বড় বাঁধা, তার চেয়ে বড় বাঁধা, ধর্মকে ঠিকিয়ে রেখে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারকারী কায়েমী স্বার্থবাদী দেশীয় ও সাম্রজ্যবাদীশক্তি-যার কথা আপনার বক্তব্যে আছে । সংক্ষেপে হলেও সুন্দর ভাবে আপনার বক্তব্যে তা ওঠে এসেছে। তবে আপনার এ বক্তব্যকে আরো বিস্তৃত করতে হবে-যুক্তি-তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে। মাভৈ: চালিয়ে যান। আমরা যারা বাংলাদেশে বসবাস করি,তারা বস্তুত: সরকারী ও বেসরকারী উদ্ধত খড়গের নীচে মাথা রেখে আছি বিধায় অনেক কথা-বিশেষভাবে ধর্ম নিয়ে-বলতে পারছি না। আপনার জন্য অফুরন্ত শুভেচ্ছা।
আমার ইসলাম ত্যাগ ও নাস্তিক হওয়ার ব্যাপারে একমাত্র অবদান কোরানের। এজন্য কোরান লেখককে ধন্যবাদ, সে আল্লা কিংবা মোহাম্মদ যে-ই হোক।
সৌদি আরবের সাথে আমেরিকার এই প্রেম্র কারণ কি শুধু মাত্র তেল? তেল তো ইরাকেরও আছে। তবে দুই দেশের প্রতি সম্পূর্ণ ভিন্ন আচরণ কেন? সাদ্দাম স্বৈরাচারী ছিল, মানুষের হাত কেটে দিত, মাথা কেটে দিত ইত্যাদি প্রচার করে আমেরিকান জনগণকে ইরাক আক্রমণ সমর্থন করানোর দিনরাত প্রচেষ্টা চালানো হতো গণমাধ্যমে। মানুষের হাত কাটা, মাথা কাটা ইত্যাদি সৌদি আরবেও আছে। আমেরিকান সরকার এত জনদরদী হলে সৌদি আরবের ইসলামী আইনের প্রয়োগ নিয়ে কেন কথা বলে না? কেন কোনো ব্যবস্থা নেয় না মানুষকে এসব বর্বরতা থেকে উদ্ধার করার? সৌদি আরব টুইন টাওয়ার উড়িয়ে দিলেও কোনো আপত্তি নেই আমারিকান সরকারের। আর সাদ্দাম নিজের দেশে ইসলামী আইন চালু রাখলে পুরো ইরাক ধ্বংস করে দিতে হবে? নিরপরাধ মানুষদের বোমা মেরে কয়লা বানাতে হবে?
প্রবল ক্ষমতাশালী শক্তিগুলোকে পরাজিত করা সহজ নয়। প্রবল ক্ষমতাশালী শক্তিগুলোকে দায়ী করা হলো, ভালো কথা, কিন্তু সেটা করার পর তাদেরকেতো পরাজিত করা যাচ্ছেনা। তাই আগে তাদের হাতের অস্ত্রগুলোকে বিনাশ করা দরকার, আর সেটা করতে পারে একমাত্র জনগন।জনগনকেই বুঝতে হবে অস্ত্রগুলো কি (যেমন এখানে ধর্ম) এবং সেই অস্ত্রকে বিনাশ করেই শুধু ক্ষমতাশালী শক্তিগুলোর ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব।
আপনাকে ধন্যবাদ।
স্রেফ এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম। মাইন্ড ব্লোয়িং , ব্যাস। আর কিছু বলবার নেই।