জঙ্গিবাদ কিংবা জঙ্গি হামলার সাথে প্রথম যে প্রশ্নটি আসে তাহলো; কারা এই জঙ্গি সংস্থার কিংবা এই হামলার অর্থ প্রদান করেছে। কারণ জঙ্গি সংস্থা পরিচালনা করার জন্যে অর্থের প্রয়োজন নয়। খালি পেটে জিহাদও করা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে জেএমবি আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী জিহাদির পরিবারকে একটি বড় অঙ্কের অর্থ প্রদান করতো, যেন তারা সন্তানহীন ভবিষ্যতে টিকে থাকতে পারে। এছাড়া প্রতিটি জঙ্গি-গোষ্ঠীর সদস্যের মাসিক বেতন রয়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে স্বনির্ভর জঙ্গি সংস্থা হল-আইএআআইস। যারা নিজেদের অর্থে নিজেদের জিহাদিদের বেতন প্রদান করে থাকে।

১ জুলাই, ২০০৬ (২৫শে রমজান) এর গুলশান হামলার পেছনেও বিদেশী কিছু মানুষের অর্থের যোগ রয়েছে। যে অর্থ দিয়ে এসব জিহাদিরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে এবং গুলশানে হামলা চালায়। পত্রিকার মাধ্যমে যানা যায়; খরচের ৩০ লাখ টাকা দেন দুবাই প্রবাসী পাকিস্তানি। হুন্ডি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে এ অর্থ পৌঁছে যায় জঙ্গিদের হাতে। টাকা গ্রহণ করেন সাব্বির ওরফে চকলেট নামে নতুন ধারার জামায়া’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) এক ক্যাডার। গুলশান হামলা মামলার তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটি) সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য। তদন্ত সংস্থার একাধিক সূত্র জানায়, রোজার মধ্যেই গুলশানে হামলাকারীদের কাছে ৩ দফায় টাকা পাঠানো হয় মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই থেকে। এর মধ্যে প্রথম দফায় পাঠানো হয় ৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় দফায় ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও তৃতীয় দফায় ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। দুবাই থেকে ‘হ্যান্ড পেমেন্ট’ পদ্ধতি অনুসরণ করে এ অর্থ চলে আসে সরাসরি রাজধানীর এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছে। ওই হুন্ডি ব্যবসায়ী ওই অর্থ গ্রহণ করেন। তার কাছ থেকে এই টাকা বুঝে নেন সাব্বির ওরফে চকলেট।

২০১১ সালে ২২শে জুলাই তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জঙ্গি অর্থায়ন বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, ইসলামী ব্যাংক বা বাণিজ্যিক ব্যাংকের ইসলামী শাখা যেসব এলাকায় নেই, সেখানে সেবা কার্যক্রম চালাতে গেলে মানি লন্ডারিং ও জঙ্গি অর্থায়ন হতে পারে। তাই সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং মোট ঋণ বা বিনিয়োগের ১৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ এখন ইসলামি ব্যাংকিং খাতের অন্তর্ভুক্ত। মোট ব্যাংকিং সম্পদের ক্ষেত্রে এই হার ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ। বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংব্যবস্থা পরিচালনা ও প্রসারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ সালে ইসলামি ব্যাংকিং-বিষয়ক দিকনির্দেশনা জারি করে।

২০১৫ এর নভেম্বর মাসে জার্মানির ডি ডাব্লিউ ইসলামিক ব্যাংগুলো নিয়ে “ইসলামী ব্যাংকের পক্ষে জঙ্গি অর্থায়ন অসম্ভব না” নামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। সেখানে তারা বলছে, গত আগস্ট মাসে বাংলাদেশের তিনজন আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব৷ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, তাঁরা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেডকে ৷ তাঁরা ঐ সংগঠনটিকে ব্যাংকের মাধ্যমে মোট এক কোটি আট লাখ টাকা দিয়েছেন বলে অভিযোগ করে ব়্যাব৷ এই তিনজন আইনজীবী হলেন – ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা, লিটন এবং বাপন৷বাংলাদেশের তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান – ইসলামী ব্যাংক, এইচএসবিসি ব্যাংক এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড বা এসআইবিএল-এর বিরুদ্ধেও আছে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ৷ যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটির এক প্রতিবেদনেও এই তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে মুদ্রা পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে৷ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘‘ইসলামী ব্যাংকে এমন কিছু অ্যাকাউন্ট হোল্ডার পাওয়া গেছে, যাঁদের নাম ছিল জাতিসংঘের সন্দেহের তালিকায়৷ এ সব অ্যাকাউন্টের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ‘লুকিয়েছিল’ ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ৷” এছাড়া অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাতও তাঁর গবেষণায় বলেছেন, ‘‘ইসলামী ব্যাংক জামায়াত নিয়ন্ত্রিত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান৷ এই ব্যাংক নানা ধরণের অদৃশ্য খাতে অর্থ খরচ করে৷ তাই তাদের পক্ষে জঙ্গি অর্থায়ন অসম্ভব কিছু না৷ সরকার জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে ২০১২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ, সন্ত্রাস-বিরোধী আইন সংশোধন অধ্যাদেশ-২০১২ এবং অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা অধ্যাদেশ-২০১২ নামে তিনটি অধ্যাদেশ জারি করে৷

এছাড়াও ২০১২ সালের ১৮ জুলাই; বিবিসির রিপোর্টে জানা যায়-জঙ্গি অর্থায়ন নিয়ে দুটি ব্যাংকে তদন্ত শুরু হয়েছে। সেখানে তারা বলছে, বাংলাদেশের যে দুটো ব্যাংকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে অর্থের যোগান দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে তাদের লেনদেনেও সাহায্য করেছে এইচএসবিসি। কমিটির রিপোর্টে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নাম উল্লেখ করা হয়। মার্কিন সিনেটের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানাতে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন (আইআইআরও) সহ সৌদি আরব ভিত্তিক দুটো প্রতিষ্ঠান। এই দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।

সন্দেহজনক ১১ এনজিও নজরদারিতে:

দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের সন্দেহে নামকরা ১১টি এনজিওর ওপর নজরদারি শুরু করেছে সরকার। দেশের আইন-প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর শীর্ষ পর্যায় থেকে এই নজরদারি রাখা হচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। সূত্রমতে, ২০১২ সাল থেকে নজরদারিতে রাখার ফলে জঙ্গি অর্থায়নের সন্দেহে থাকা এনজিওগুলো চাপে আছে। তাদের অর্থ আয়-ব্যয়ের দিকগুলোতে বাড়তি সতর্কতা রেখে চলেছে এনজিওবিষয়ক ব্যুরো। জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েত, কাতার, সৌদি ও যুক্তরাজ্য থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ আসছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী সংশ্লিষ্টতায় পরিচালিত ১১টি এনজিওতে। এই এনজিওগুলো হলো— জামায়াতের কৃষক সংগঠন হিসেবে পরিচিত ‘বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতি’, মুসলিম এইড বাংলাদেশ, রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামি, কাতার চ্যারিটিবল সোসাইটি, ইসলামিক রিলিফ এজেন্সি, আল ফুরকান ফাউন্ডেশন, কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন (আইআইআরও), হায়াতুল ইগাছা, রিভাইবাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি (আরআইএইসএস), তাওহিদী নুর এবং আল মুনতাদা আল ইসলামি।

জঙ্গি অর্থায়নে বিভিন্ন এনজিও সংস্থা:

বাংলাদেশে ৫৭৭টি’র বেশি এনজিও জঙ্গিদের পেছনে বিপুল অর্থ ঢালছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন এবং নাশকতা সৃষ্টিতে সন্দেহভাজন ৫৭৭টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সরকার। জঙ্গি অর্থায়নে জড়িত বলে অভিযুক্ত এনজিওর বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্য-ভিত্তিক। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১৮টি ব্যাংক-বীমা ও সেবা খাতের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে কড়া নজরদারি করছে সরকার। সূত্রমতে, জঙ্গি সংগঠনগুলোকে অর্থ-দাতাদের একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। বেসরকারি একটি ব্যাংকসহ একাধিক এনজিও প্রতিষ্ঠান ও জামায়াত প্রভাবিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ তালিকায়। জঙ্গি বিস্তারে নেপথ্য ভূমিকায় থাকা অর্থ-দাতাদের রাজনৈতিক পরিচয় বের করতেও কাজ করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।

জঙ্গি অর্থায়নে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রথমে ৫৬৩ এনজিও এবং পরে আরও ১৪টি এনজিওসহ মোট ৫৭৭ প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা-সংবলিত ২১৬ পাতার প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জেএমবির আর্থিক মদদদাতা হিসেবে অভিযুক্ত রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী সৌদি আরব সরকারের একটি সাহায্য সংস্থা, যা বিশ্বব্যাপী মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ (এমডবি্লউএম) নামে পরিচিত। এটির আরেকটি সহযোগী এনজিও ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন (আইআইআরও)। এ ছাড়া জামায়াত ও এর নেতাদের পরিচালিত বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক প্রতিষ্ঠান জঙ্গি অর্থায়নে জড়িত। নিচে কিছু সংস্থার নাম উল্লেখ করা হল।

রিভাইভাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি: Revival of Islamic Heritage Society (RIHS)
রাবেতা আল-আলম আল-ইসলাম: Rabita al-Alam al-Islami
সোসাইটি অব সোসিয়াল রিফ্রমস: Society of Social Reforms, Qatar Charitable Society
আল-মুনতাদা আল ইসলামি: Al-Muntada Al-Islami
ইসলামি রিলিফ এজেন্সি: Islamic Relief Agency
আল ফুরকান ফাইন্ডেশান: Al-Furqan Foundation
আন্তর্জাতিক রিলিফ সংস্থা: International Relief Organization
কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি- Kuwait Joint Relief Committee,
মুসলিম এইড বাংলাদেশ:Muslim Aid Bangladesh
দার আল খাইর- Dar Al-Khair
হায়াতুল লংঞ্চা এবং তৈহিদ-ই-নুর- Hayatul Igachha and Tawheed-e-Noor.
কাতার চ্যারিটেবল সোসাইটি-
তাওহিদী নূর-Towhidi Nur
সৌদিভিত্তিক হায়াতুল ইগাছা এবং দ্য গ্রিন ক্রিসেন্ট
ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন (আইআইআরও)

ইসলামিক ব্যাংকের জঙ্গি অর্থায়ন-প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, জিহাদি-করণ প্রক্রিয়াতে ধর্মীয় চ্যারেটির মাধ্যমে অর্থায়ন হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে অর্থ বেরিয়ে যাচ্ছে। এই ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করে সরকারি নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউর সর্বশেষ প্রকাশিত ‘বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৪’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এসব লেনদেনে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে এ ধরনের সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ৬১৯টি। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ৪২০টি। আর ২০১১-১২ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা ছিল ১৭৫টি। এর আগে ২০১৪ সালের আগস্টে ‘জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস অনুসন্ধান কার্যক্রম অধিকতর সমন্বয়ের লক্ষ্যে টাস্কফোর্স’ গঠন করে সরকার। সূত্রমতে, জঙ্গিগোষ্ঠীকে অর্থ-দাতাদের একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। বেসরকারি একটি ব্যাংকসহ একাধিক এনজিও ও জামায়াত প্রভাবিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ তালিকায়।

সন্দেহ হলেই নজরদারিতে রাখা যায় এন্টি মানি লন্ডারিং আইন অনুসারে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ডলার জমা হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকের একাউন্টে। কী কারণে? সোর্স কী? উদ্দেশ্য কী? একাউন্ট ওপেনের সময় কী ডিক্লারেশন ছিলো এইগুলা জরুরী বিষয়। IIRO বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ দুশ্চিন্তা আছে বুঝা যায়। তাই এটার শাখা বা সহযোগী দের খোঁজ ওরা নিচ্ছে। এরকম আরও হাজারো অর্গানাইজেশন আছে যারা আমেরিকার জন্য এখনো থ্রেট না কিন্তু আমাদের জন্য থ্রেট। সুতরাং আমেরিকা যাদের থ্রেট ভাবছে তাদের বাহিরেও হাজারো সংস্থা আছে যেগুলো আমাদের দেশের জন্যে মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।

‌চলুন এবার দেখে নেওয়া যাক ৩ নভেম্বর ২০০৮ সালের মার্কিন গোপন তারবার্তাটি যেখানে জঙ্গিবাদে ইসলামিক ব্যাংকের বিষয়ে বিভিন্ন কথা বলে হয়েছে।

তারবার্তা নং ০৮ ঢাকা ১১৪৬
তারিখ: ৩ নভেম্বর ২০০৮; সময়:১১:০৬ পূর্বাহ্ণ
শ্রেণি: সিক্রেট
বিষয়: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংক হিসাবে রক্ষিত অর্থ লেনদেন করতে চায় ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন (আইআইআরও)

সারসংক্ষেপ:

১. সংবাদ পত্র সূত্রে জানা গেছে দীর্ঘ দুই বছর স্থগিত (Frozen) থাকার পর ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন (IIRO) এর ব্যাংক হিসাবের অর্থ ছাড় করেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। উল্লেখ্য, আইআইআরও এর সহযোগী সংগঠন (sister organization) আল-কায়দার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং জঙ্গি অর্থায়নে সংশ্লিষ্টতার কারণে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকা ভুক্ত। ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ভাবে আইআইআরও-এর বিষয়ে উদ্বেগের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিলো। সেই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকে থাকা আইআইআরও-এর একাউন্ট স্থগিত করেছিলো। সংবাদ পত্র সূত্রে প্রাপ্ত খবরের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা জানায় সংবাদটি অসত্য এবং আইআইআরও-এর হিসাবে লেনদেন এখনো স্থগিত রয়েছে। এই বিষয়ে আলোচনার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়- যদি কোন সংগঠনের সুনির্দিষ্ট সহযোগী সংগঠনকে জঙ্গি অর্থায়নের দায়ে কালো তালিকা ভুক্ত করা হয়, তবে সেই সংগঠনের অন্যান্য অ-তালিকা ভুক্ত সহযোগী সংগঠন বিষয়ে কী আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে?

ব্যাকগ্রাউন্ড ২০০৬-২০০৭

২. দ্যা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন হচ্ছে সৌদি আরব ভিত্তিক একটি ধর্তব্য (চ্যারিটি) সংগঠন, যার শাখা রয়েছে সারা বিশ্বে। আব্দুল হামিদ সোলাইমান আল মুজিল হচ্ছেন আইআইআরও-এর পূর্বাঞ্চলের নির্বাহী পরিচালক এবং তিনি সৌদি আরবেই অফিস করেন। আইআইআরও ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন শাখা আল-মুজিলের পূর্বাঞ্চলীয় অফিসের অধীনে তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এরাই জেমাহ্ ইসলামিয়া (জেআই) এবং আবু সায়ীফ গ্রুপ (এএসজি)-এর মূল অর্থ জোগান দাতা। এই দুটি সংগঠন (জেআই এবং এএসজি) UNSCR-1267 অনুসারে কালো তালিকা ভুক্ত সংগঠন।

৩. আল-কায়দা সংশ্লিষ্টতার কারণে ২০০৬ সালে জেআই , এএসজি সহ আল-মুজিল এবং আইআইআরও –এর ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন শাখাকে ইউএন-১২৬৭ এর আওতায় কালো তালিকা ভুক্ত সংগঠন হিসেবে শ্রেণিকৃত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টও আভ্যন্তরীণ ভাবে এঁদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউএস কাউন্টার টেররিজম অথরিটির মাধ্যমে (নির্বাহী আদেশ নং-১৩২২৪)। জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই সুনির্দিষ্ট ভাবে আইআইআরও-এর বাংলাদেশ শাখা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে কোন নির্দেশনা দেয়নি।

৪. ২০০৬ সালে যখন উপরোক্ত তিন সংগঠনকেই যুক্তরাষ্ট্র কালো তালিকা ভুক্ত করে, তখন জাতিসংঘে শুধু মাত্র আইআইআরও ইন্দোনেশিয়া শাখা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়াটা অবশিষ্ট ছিলো। সেই সময় ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি চিঠি দিয়ে আইআইআরও-এর শাখা অফিস এবং এর ডিরেক্টরদের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলে অবহিত করে। দূতাবাসের পক্ষ বাংলাদেশ সরকারকে এই তাগাদা দেয়া হয়েছিলো যে, তাঁরা যেনো দ্রুত এদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে এবং ব্যাংক হিসাবে লেনদেন স্থগিত করে দেয় এবং অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা (আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও ভ্রমণ) আরোপেও ব্যবস্থা নেয়। আইআইআরও ইন্দোনেশিয়া বিষয়ে তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করা হয়, কেননা এদের সাথে জেআই এবং আল-কায়দার সংশ্লিষ্টতা আছে। এছাড়াও, দূতাবাসের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করা হয় তাঁরা যেনো সতর্ক ভাবে অনুসন্ধান করে দেখে এই সংগঠনের নামে বা আল মুজিল বা এর শাখার নামে কোন তহবিল বা আর্থিক সম্পদ অথবা ফাইন্যান্সিয়াল রিসোর্সেস সহ কোন নিজস্ব স্থায়ী সম্পদ বা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন কোন স্থায়ী সম্পদ আছে কিনা। দূতাবাসের পক্ষ থেকে এই অনুরোধও করা হয়েছিল যে, তাঁরা যদি এই সব সংগঠনের কোন কার্যক্রম বা ব্যাংক হিসাবের সন্ধান পায় তাহলে যেনো দূতাবাসের সাথে সেই তথ্য শেয়ার করে।

অক্টোবর ২০০৮ সালের বিভ্রান্তিকর মিডিয়া রিপোর্টস:

৫. অক্টোবরের শুরুতে দ্যা ডেইলি স্টার নামক বাংলাদেশী সংবাদ পত্রে “Bangladesh Bank wants to Dhaka 0000114 002 of 002 Activate IIRO Accounts Frozen for Alleged Terrorist Link” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যে প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, যাদের সাথে আইআইআরও-এর হিসাব আছে, তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আইআইআরও-এর হিসাব পুণঃসচল করার জন্য অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে। সংবাদ ভাষ্য অনুযায়ী ইসলামী ব্যাংক স্ব-প্রণোদিত হয়ে আইআইআরও-এর হিসাব স্থগিত করেছিলো এবং এই আইআইআরও বাংলাদেশে অনুমোদিত চ্যারিটি প্রজেক্টে ব্যয়ের জন্য ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করতে আগ্রহী।

৬. অক্টোবর মাসের শেষ দিকে প্রাসঙ্গিক আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক ইত্তেফাক নামক অন্য একটি কাগজে। যেটির শিরোনাম ছিলো “ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশনের জব্দ-কৃত হিসাব উন্মুক্ত করেছে ইসলামী ব্যাংক”। এই প্রতিবেদন অনুসারে ইসলামী ব্যাংক আইআইআরও-কে তাঁদের জব্দ-কৃত হিসাব থেকে ১০ কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের পর। এই প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায় যে, আইআইআর-এর সমস্ত হিসাব এখনো জব্দ-কৃত (Frozen) অবস্থায় আছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক-কে লেনদেন করার অনুমতি দেয়নি এবং বিষয়টি তদন্ত করার জন্য ইসলামী ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকও এই প্রতিবেদন ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে উল্লেখ করেছে বলেও সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

৭. অক্টোবর ২০০৮ সালে এই সংক্রান্ত প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার পর দূতাবাসের পক্ষ থেকে সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হয় এবং আইআইআরও-এর হিসাব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। সেই যোগাযোগের চূড়ান্ত ধাপে এসে ২৮ অক্টোবর ২০০৮ সালে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাবৃন্দ একটি মিটিং এ মিলিত হন। কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুসারে আল-মুজিল এবং আইআইআরও-এর ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন শাখা সংক্রান্ত বিষয়ে জাতিসংঘের ২০০৬-২০০৭ সালের ১২০৭ নং পরিপত্র অনুযায়ী তাঁরা ইসলামী ব্যাংককে আইআইআর-এর হিসাব “সতর্কতার সাথে” লেনদেনের নির্দেশনা দিয়েছেন ২০০৬ সালে। অক্টোবর ২৮ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র আমাদের গোপনে জানায় যে, তাঁরা আইআইআরও-এর বাংলাদেশের হিসাব স্থগিত করার নির্দেশনা দেননি, কারণ জাতিসংঘের নির্দেশিত তালিকায় সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আইআইআরও-এর সহযোগী সংগঠন বা ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি যারা বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাই নিষেধাজ্ঞা পরিপত্র ১২৬৭ পরিপালন করা বেশ খানিকটা সমস্যাপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংক ধারণা করছে ইসলামী ব্যাংক স্ব-প্রণোদিত হয়ে হিসাবের লেনদেন স্থগিত করেছে।

৮. বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র অনুসারে এই বছরের শুরুতে ইসলামী ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইআইআরও-এর হিসাবে লেনদেন করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন চাওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার জন্য চিঠি লিখলে একটি এমন কোন স্পষ্ট জবাব পাওয়া যায় না, যেটি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথেও আলোচনা করে। বাংলাদেশ সরকারও এখনো পর্যন্ত এই বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি এবং পরবর্তী তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত রয়েছে। অক্টোবরের শুরুতে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের পর আমরা আমদের গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছি এবং অন্যদিকে আল-কায়দা সংশ্লিষ্ট আইআইআরও ইসলামী ব্যাংকে তাদের হিসাবে লেনদেন করার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে।

মন্তব্য

৯. বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ইতিবাচক আচরণ করেছে, যেটি উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আমদের ভাবনায় দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। ব্যাংক প্রমাণ করেছে স্পর্শকাতর এই ইস্যুতে উন্মুক্ত এবং আন্তরিক আলোচনায় তাদের আপত্তি নেই। দূতাবাস কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। আইনগত ভাবে যদিও বাধ্যবাধকতা নেই, তারপরও ইসলামী ব্যাংক সরকারের অনুমতি নিয়েই আইআইআরও-এর বিতর্কিত সম্পদের জব্দ-কৃত হিসাব অবমুক্ত করতে চাইছে ভবিষ্যৎ জটিলতা এড়াতে। দূতাবাস কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সরকারের এনজিও এফেয়ার্স ব্যুরোর সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে, যারা আইআইআরও এবং অপরাপর এনজিও’র কার্যক্রম দেখভাল করে থাকে। অ-তালিকা ভুক্ত আইআইআরও বাংলাদেশ শাখার এর পক্ষ থেকেও ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য রাস্তা নিয়েও ভাবা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে ই-মেইল চালাচালি হয়েছে। অ-তালিকা ভুক্ত সংগঠনের সাথে UNSCR-1267 ও যুক্তরাষ্ট্রের তালিকা ভুক্ত সংগঠন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য আমরা ওয়াশিংটনের চূড়ান্ত নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি।

-মরিয়ার্টি

সুতরাং বিষয়টি বেশ ওপেন সিক্রেট যে, বাংলাদেশে ইসলামের নামে যেসব ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্যান্য সংস্থা চালু আছে তারা অনেকেই জঙ্গিবাদে অর্থায়নে জড়িত। কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্য সরকার সরাসরি বলেছে যে, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন ইসলামিক সংস্থা ও দাতবসংস্থা সরাসরি জঙ্গিবাদে জড়িত। জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার কারণ যুক্তরাজ্যের ইসলামিক নেতা আঞ্জুমান চৌধুরীর কারাদণ্ডও হয়। সুতরাং বিষয়টি স্পষ্ট জঙ্গিবাদ ও জঙ্গি হামলার অর্থায়নে বিভিন্ন ইসলামিক ব্যাংক ও সংস্থা জড়িত। যারা বিভিন্ন দাতবসংস্থা কিংবা ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার নামে জঙ্গিবাদে অর্থায়ন করে যাচ্ছে।