জীবনের প্রথম আঠারো বছরে টেলিফোন করার সুযোগ হয়েছে সম্ভবত দুই থেকে তিন বার।
না অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেই ১৯৮০-৯০ সালে, স্যাম পিত্রোদার আগের জমানায় টেলিফোন মানে এলাহি ব্যপার। বড়লোক ব্যবসায়ীরাই রাখত। তখন একটা ফোন আসা মানে সারাদিনে বলার মতন ঘটনা- ট্রাঙ্ককল আসত।
ট্রাঙ্ককলটা কানেক্ট করে দিতেন টেলিফোন ওপারেটর। মানে ম্যানুয়াল সুইচিং। এই শহর থেকে অন্য শহরের এক কলের সাথে অন্যকল লাগিয়ে দিতেন টেলিকম অপারেটররা। আমার বড় মামা এবং বড় মাসী ছিলেন টেলিকম অপারেটর। উনাদের সাথে গেছি টেলিফোন অফসে মাঝে মাঝে । সারাক্ষন হ্যালে হ্যালে করছেন। আর এখান কার জ্যাক খুলে ওখানে লাগাচ্ছেন। একদম হাতে ধরে ক্রস কানেক্ট করা যাকে বলে।
রাজীব গান্ধী স্যাম পিদ্রোদাকে নিয়ে আসলেন। আস্তে আস্তে ম্যানুয়াল সুইচিং এর বদলে এল সিডটের তৈরী অটোমেটিক সুইচ বা ড্যাকস। পুরাতন কপার লাইনের বদলে মাইক্রোয়েভ লিংকে জোড়া হল শহর থেকে শহর।
রাজীব গান্ধী তদ্দিনে মারা গেছেন। কিন্ত তার আধুনিক চিন্তার সুফল পেতে শুরু করেছি আমরা। প্রথমে জেলা শহর এবং তারপরে করিমপুরের মতন প্রান্তিক শহরেও দ্রুত লাইন দেওয়া শুরু করে ডট বা ডিপার্ট্মেন্ট অব টেলিকম। তখনও ভিএসএনএল বিএসেনএল আসে নি। ফলে ১৯৯৩ সালের আগেও যেখান বাড়িতে নিয়মিত চিঠি লেখা অভ্যেস ছিল হোস্টেল থেকে- ১৯৯৪ এর পর থেকে সরাসরি এস টি ডি বুথে গিয়ে লাইন দাও। বাড়িতে ফোন কর।
অন্যদিকে পুরাতন ট্রাঙ্ককল লাইন গুলোকে তুলে দেওয়া হচ্ছে। তাই নিয়ে বড় মামা এবং মাসীর একটা চাপা টেনশন কি হয়- কি হয়। কারন অপারেটরের আর দরকার নেই। সেখানে এসে গেছে অটোমেটিক সুইচ। নেহাত সরকারি চাকরি। তবুও ভিয়ারেসের চাপ। সরকার চাপ দিচ্ছে টাকা নিয়ে অবসর নাও। ডটে প্রায় ধর্মঘট হত সেই সময়। কিন্ত ওই আদ্দিকালের ট্রাঙ্ককল ত চলার না। ফলে সামান্য রফা। টেলিফোন অপারেটেরদের কাউকে দেওয়া হল একাউন্টস দেখার কাজ-কেউ কেউ জেনারেটর তত্ত্ববধান শুরু করলেন। কম্প্রোমাইজড লাইফ। রিটারমেন্ট পর্যন্ত।
একটা সময় ছিল যখন শহরের ব্যবসায়ী মহলে বেশ খাতির পেতেন অপারেটররা। কারন ব্যবসায়ীদের ট্রাঙ্ককল তাদের হাত ঘুরেই আসত কি না! বড়মামার সাথে কালনার বাজারে গেলে টের পেতাম। কিন্ত হাইরে অটোমেশন! মেশিনের সাথে কি আর মানুষ পারে অসম প্রতি্যোগিতায়? একটা শহরে মাথা উঁচু করা চলা মানুষগুলো হঠাৎই হয়ে উঠলো প্রযুক্তির ঘোড়াতে লাথি খাওয়া কোনঠাসা বোরে।
সেই প্রথম কাছ থেকে দেখা কি করে প্রযুক্তি এবং অটোমেশন মানুষের চাকরি জীবন একদম বদলে দেয়-যে কাজ সারাজীবন ধরে তারা করতেন-পাঁচ বছরের মধ্যে ভ্যানিশ!
অটোমেশনের ফলে আমেরিকাতে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে গত ত্রিশ বছরে ৯০% শ্রমিক ভ্যানিশ। কিন্ত উৎপাদন বেড়েছে আড়াইগুন। একদম ছুমন্তর জাদু। ফলে লেবার ইউনিয়ানের সেই দাপট আর নেই আমেরিকাতে। তারা কোনঠাসা। বেশী ইউনিয়ানবাজি করলে কারখানা বন্ধ করে নতুন কারখানা খুলবে কোম্পানি-যা হবে সম্পূর্ন অটোমেটেড! ভারতেও এর ব্যতিক্রম হবে না। টাটা স্টিলে দেখেছি। ১৯৮৫ সালে ছিল ৭০,০০০ কর্মী। এখন উৎপাদন প্রায় তিনগুন, জামসেদপুর প্ল্যান্টে আছে মোটে ১১,০০০ কর্মী। তাও শুনলাম ৮০০০ উদবৃত্ত। তাদের ধরে ধরে সিকিউরিটির চাকরি দেওয়া হচ্ছে। কারন টাটারা দয়ালু। সচরাচর ছাঁটাই করেন না।
সুতরাং এইসব শ্রমিক আন্দোলন ইত্যাদি করে কিস্যু হবে না। শ্রমিকই ত উঠে যাচ্ছে। যারা টিকে যাবেন তারা স্কিল্ড, কর্মী। অনেক বেতন পান। তারা বেতন কম পেলে অন্যত্র ভাল কাজ নেবেন। তাদের ইউনিয়ানবাজি করার দরকার নেই।
সমস্যা আসলে অন্যত্র- একটা বিপুল আধা-বেকার শ্রেনী তৈরী হবে। স্কিল নেই বলে। এদের জন্য দরকার বিপুল বেকার ভাতা নইলে স্কিল ট্রেনিং। স্বাধীন ব্যবসা করার জন্য। কারন চাকরি ব্যপারটা বদলে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে সব চাকরিই প্রায় অনলাইন করা সম্ভব। ফলে ফ্রি ল্যান্সিং, কনসাল্টিং জনপ্রিয় হচ্ছে বেশী। পুরাতন মালিক শ্রমিক মডেল খুব অদক্ষ। আধুনিক মডেল হবে মালিক নিজেই পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে ফ্রি ল্যান্সার হায়ার করে ভার্চুয়াল টিম দিয়েই তার অধিকাংশ কাজ সারবে। বাকীটা রোবট, অটোমেশন।
আসলে আন্দোলনটা জরুরী দরকার স্কুল শিক্ষাটা আমূল বদলে দিতে। স্কুল থেকেই ছাত্রদের ব্যবসা ইঞ্জিনিয়ারিং আইন কোডিং ইত্যাদি শেখানো হোক। আল্টিমেটলি লাইফে অঙ্ক আর কমিউনিকেশন স্কিল ছাড়া আর কিছু লাগে না। এইসব মান্ধাতা আমলের ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান রেখে লাভ নেই। ওগুলো উইকি করলে বা একটা ইউটিউব ডকু চালালে বেটার শেখা যায়। বরং বেসিক ইঞ্জিনিয়ারিং শেখানোর মাধ্যমে ফিজিক্স শেখালে ছাত্ররা শিখবে অনেক ভাল। যেটা ফিনল্যান্ড করে। আমেরিকাও শুরু করেছে।
যারা শিক্ষা এবং স্কিল মিশন বাদ দিয়ে ভ্রান্ত শ্রমিক আন্দোলন এবং লাল সেলাম চালিয়ে যাচ্ছেন-তারা ইতিহাসের লিখন দেখতে পাচ্ছেন না। ৩৪ বছরের ব্যর্থতা থেকেও শেখেন নি। তাই জনগন তাদের আস্তেকুঁড়েতে ছুড়ে ফেলেছে।
আমি তৃণমূল সরকারের কাছ থেকে আশা করব বামফ্রন্ট সরকারের ভুলগুলো তারা করবেন না। ধর্মঘট বিরোধি পজিশন খুবই সদর্থক তৃনমূলের। এবার বাংলাকে উন্নত করতে স্টেপ টু দরকার- সেটা হচ্ছে স্কুল শিক্ষার বৈপ্লবিক পরিবর্তন করে তাকে কর্মমূখী এবং আধুনিক করা হোক।
কিছু কিছু যায়গায় সহমত হতে পরলামনা বিপ্লবদা !
বেকার সমস্যা সারা পৃথিবীতে চরম আকার ধারণ করেছে । এর সমাধান কিভাবে হবে আপনার বিশ্লেষণী মতামত জানতে ইচ্ছে করে । তারপর লেখাযুদ্ধে লাগব ।
শিক্ষার উদ্দেশ্য আপনার মতে কি তা জানতে পারি? কারন আপনি যা বলেছেন তাতে মনে হচ্ছে শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য চাকরি পাওয়া। ইতিহাস, ভূগোল এসব পড়ানোর একটা কারন আছে। আর ইন্টারনেট বা ইউটিউব এ তো অনেক কিছুই আছে, কয়জন মানুষ তা নিজ ইচ্ছায় পড়ে ?
ক্রমাগত যন্ত্র ব্যবহার করার ফলে যে শ্রমিক উদ্বৃত্ত হবে তা যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য কাজে নিয়োগ করা যাচ্ছে ততখন সমস্যা নেই । যদিও এই transformation of job প্রক্রিয়াটা নিদারুন চোখের জলের বিনিময়েই হয়েছে । কিন্তু এমন একটা সময় আসবে যখন যন্ত্র মানুষের সমস্ত কাজ কেড়ে নেবে কিন্তু উৎপাদন কমবে না। তখন এই সমস্যা সমাধান কি হবে সেই সম্পর্কে অনেক মতবাদ শোনা যাচ্ছে । যেমন একজন মেক্সিকান বড় শিল্পপতি ইতিমধ্যে প্রস্থাব দিয়েছে সপ্তাহে কাজের দিন সাড়ে তিন দিন করা হোক। এর ফলে মানুষের যে অবসর আসবে সেই সময় সে বিনোদনে এবং সৃজনশীল কাজে নিয়জিত থাকবে । কম্পিউটার এবং অটোমেশন যে ভাবে উন্নত করছে তাতে মানুষের হাতে কাজ আর বিশেষ থাকবে না । যন্ত্রের ক্রমাগত উন্নতির ফলে মানুষের অবসর বাড়বে এটাই কিন্তু দার্শনিক দিক থেকে কাম্য ছিল । ফলে উপায় একটাই , মানুষের কাজের ঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া।
পুজিবাদের এই সমস্যা কি ভাবে সমাধান হয় এখন সেইটাই দেখা যাক।
আর একটা কথা এখানে হয়ত প্রাসঙ্গিক হবে । সম্প্রতি পূর্বতন সোভিয়েত দেশ গুলোতে সমীক্ষার ফলে দেখা গেছে যে সেখানকার প্রায় ৬৪% মানুষ মতামত দিয়েছে যে পূর্বতন সোভিয়েত সমাজেই তাদের জীবন অনেক সুন্দর ছিল। এই সম্পর্কে আপনার মতামত কি জানতে ইচ্ছা করছে।
আর আপনি বলেছেন ইতিহাস ভূগোল ইত্যাদি পড়ার দরকার নেই । তাও ভাগ্যিস বলেন নি যে সাহিত্য পড়ার কি দরকার । এই ব্যাপারে আমার বিস্ময় রয়েই গেল ।
আপনি জনসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যপারটা একদম এড়িয়ে গেছেন। পশ্চিমবংগে ২৭% মেয়ের বিয়ে হয় ১৮এর নীচে। পশ্চিমবংগ স্বাক্ষরতার হারে মিজোরাম ত্রিপুরার থেকেও পিছিয়ে। নারী শিক্ষার হার খুব কম।
এর পিছনে ধর্মের ভুনিকা প্রবল।
৩৪ বছরের বাম রাজত্ব পশ্চিমবংগকে শুধু শিল্পশুণ্যই করেনি, মানুষকে নিরক্ষর করেছে।