জীবনানন্দ দাশের “ঝরাপালক” কাব্যগ্রন্থে “অস্তচাঁদ” কবিতার দুটি পংক্তি এই রকমঃ

চুরি করে পিয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু!
সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির দর্প বিদ্রূপ ভুলিয়া

জীবনানন্দ দাশের কবিতা প’ড়ে আমাদের মনে হয়, তিনি অতি ছোট্ট ও তুচ্ছ একটি কীটের হৃদয়ের ব্যথাও উপলব্ধি করতে পারেন। অনুভব করতে পারেন একটি ছোট্ট পাতা, একটি ক্ষুদ্র সবুজ ঘাসের বেদনাও। একটি ইঁদুর, একটি প্যাঁচার মনও তিনি নিরীক্ষণ করেন। যোজন-যোজন দূরের সুবিশাল জ্বলন্ত নক্ষত্রদের মর্মজ্বালা পর্যন্ত তিনি অনুধাবন করেন। শংখচিল, শালিক, হিজলের ডাল পাতা ও পাতা নড়ার নিঃশ্বাসের সাথে একাকার হয়ে তিনি এদের মনোজগতের গভীরের খবর নিতে ব্যগ্র হয়ে ওঠেন।

কীটের হৃদয়ের ব্যথা অনুভব করার মতো হৃদয় যে কবি ধারণ করেন সে কবিও কি ক্রীতদাসীদের সম্ভোগের বস্তুই মনে করেন? আবার শুধু দাসীই নয় কিন্তু! তিনি বলেছেন, “ক্রীতদাসী”। তার মানে তিনি দাসপ্রথায় পুরোই সমর্থন করতেন! হতদরিদ্র অসহায় নর-নারীদের ক্ষমতাশালীরা ধরে ধরে লোহার শেকলে বেঁধে হাটে-বাজারে নিয়ে বিক্রি করবে। তাদের কিনে নেবে সামর্থবানেরা। তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করবে অকথ্য। তারপর ক্রীতদাসীদের ওপর যৌন নিপীড়ণ চালাবে ক্রেতা পুরুষ-মালিকপক্ষ। কীটের হৃদয়ের ব্যথা অনুভবকারী কবি জীবনানন্দ দাশের হৃদয়ের গভীরেও সেই একই কামনা বাসনা জেগে ওঠে – চুরি করে ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু পান করার!

ঘাস লতা পাতা পাখি ফুল চিল প্যাঁচা ইত্যাদির প্রতি তাঁর সমবেদনা সহমর্মিতা ও প্রেমের শেষ নেই। কিন্তু ক্রীতদাসীর প্রতি তাঁর কোনো সমবেদনা সহমর্মিতা নেই, নেই কোনো প্রেমও। তিনি যদি কোনো দাসীর প্রেম পড়তেন তাহলে তো কথাই ছিল না। কিন্তু আমরা খুঁজে পাই না তাঁর কোনো রচনায় এমন সংবাদ। ক্রীতদাসী বালিকার যৌনবের মধু পান করার কামনা-বাসনা জাগে তাঁর শরীরে। তাও আবার চুরি করে, সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির বিদ্রূপ উপেক্ষা করে। চুরি করে ক্রীতদাসী-সম্ভোগের মুহূর্তে সম্রাজ্ঞী দেখে ফেললে তাঁকে দৃষ্টি-কটাক্ষ করবেনই, এটাও তিনি জানেন। বেপরোয়া, ক্রীতদাসীর যৌবনের মধু-পিয়াসী কবি তা উপেক্ষা করেই ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু পান করার খায়েস ব্যক্ত করেন।

পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যৌন সম্পর্ক না হয়ে যদি শুধু একপক্ষের ইচ্ছায় হয় তাকে ধর্ষণ বলা হয়। কবি এখানে তা-ই করতে ব্যগ্র। ক্রীতদাসীটির যৌবনের মধু কবিকে পান করানোর ইচ্ছা আছে কিনা, তার সম্মতি আছে কিনা, এ ব্যাপারে কবির কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই।