হাশেমের আনন্দদন্ড
তিনদিন ধরে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি। সব ভেসে গেছে। প্রতিদিন প্রায় এক হাত করে পানি বাড়ছে। খাল, পুকুর ভরাট হয়ে পানি ঢুকে পড়েছে রাস্তায়, বাগানে, উঠানে। ঘর দুয়ারে পানি, মনে হচ্ছে কেউ দরজা খুলে দিলেই ঘরে ঢুকে পড়বে।
বিগত কয়েক বছরে গ্রামের মানুষ এমন বৃষ্টি দেখেনি। একটু বয়স্করা স্মৃতি হাতড়ে মনে করার চেষ্টা করছে শেষ কবে এত বৃষ্টি হয়েছে। আর কম বয়সীরা ভাবছে, এইভাবেও বৃষ্টি হতে পারে! তিনদিন একটানা!
বৃষ্টির নিজস্ব শব্দ আছে, আর সেই শব্দের নিজস্ব সমস্যাও আছে। টানা কিছুক্ষণ বৃষ্টির শব্দ শোনার পর মনে হয় আমাদের আর কোন শব্দ নেই, সুর নেই, গান নেই। বৃষ্টি ছাড়া আমাদের আর কিছু নেই, কেউ নেই।
এখন মধ্যরাত। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশ নেই। থাকলেও দেখা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পরপর একটা দুইটা বিজলি জ্বলে। বরাবরের মত অদেখা আকাশ তার দুই হাত ভরে পানি ঢালছে। টিনের চালে ঘুমুর ঘুমুর শব্দ। সবাই যার যার মত করে তার তার ঘরে, শুধু হাশেম ছাড়া। হাশেম আছে পরের ঘরে। মারজাহানের ঘর। হারিকেনের মৃদু আলো। মারজাহান উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে। হাশেম অন্ডকোষ মুঠে চেপে ধরে বসে আছে। মুঠো বেয়ে টুপ টুপ রক্ত ঝরছে। মারজাহান হাশেমের আনন্দদন্ড কেটে দিয়েছে।
ঠিক এই মুহূর্তে হাশেমকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, মারজাহান কে? হাশেম বলবে মারজাহান একটি ডাইনি। কিন্তু আসলে তা নয়। মারজাহান হচ্ছে এই গ্রামেরই মন্নাসের বৌ। মন্নাস থাকে সৌদি আরব। আজ ঘরে মারজাহান একা থাকলেও সবসময় কিন্তু একা থাকে না। সাথে শাশুড়ি আর দেবর থাকে। টানা বৃষ্টি শুরুর দিন সকালে মারজাহানের শাশুড়ি আর দেবর গিয়েছে মারজাহানের ননদের বাড়ি। বৃষ্টিতে আটকা পড়েছে।
হাশেম সবসময় মারজাহানকে ইশারা ইঙ্গিতে উত্যক্ত করতো। এসব ইশারা ইঙ্গিতের আড়ালে প্রেম আছে কিনা মারজাহান জানে না। থাকলেও সেই প্রেম নোংরা, ইতরের প্রেম। মারজাহানের ফুলের বাগান আছে, সেই বাগানে প্রজাপতি আসে, ভ্রমর আসে। মারজাহান ফুল দেখে। প্রজাপতি আর ভ্রমর দেখে। আড়চোখে হাশেমের ইশারা দেখে। আবার ফুল দেখে। প্রজাপতি আর ভ্রমর দেখে।
গত দুইদিন হাশেমের মতিগতি খুব খারাপ ছিলো। এত বৃষ্টি, এত পানি উপেক্ষা করে হাশেম এসে মারজাহানের ঘরের চারপাশে ঘুরঘুর করে, ইশারা দেয়, ইঙ্গিত করে। হাশেম রাত্রি বেলা ভেসে যাওয়া আগানে বাগানে আন্ধা বড়শি পেতে রাখে, কারেন্ট জাল বসিয়ে রাখে মাছের জন্য। মাছ যেদিকেই থাকুক না কেন, হাশেমের বড়শি আর জাল থাকে মারজাহানের ঘরের আশপাশে। হাশেমের জিহ্বা বেয়ে ঝরে পড়া লালসার লালা বৃষ্টির জলে মিশে যায়। তবুও মারজাহান সেটা দেখে। মারজাহান মেয়েতো, জানে ইতরের লালা কখন কিভাবে ঝরে।
আজ বিকালে হাশেমের ইশারা চিরতরে বন্ধ করতে মারজাহান হাশেমকে পাল্টা ইশারা করে। ইঙ্গিত করে। মারজাহানের মাত্র একটি ইশারায় হাশেমের আনন্দদন্ডের কোরবানি হয়ে গেলো। মাত্র একটি ইশারায় হাশেমের জিহ্বা, গলা, খাদ্য নালী প্রস্রাবের নালী, সব শুকিয়ে গেছে। এই গ্রামের সবকিছু এখন ভেজা, শুধু হাশেমের ভেতরটা ছাড়া। এক ফোটা লালা নেই, ভয়-আতংক-ব্যাথা ছাড়া আর কিছু নেই।
পরিষ্কার সুতি কাপড়, স্যাভলন, ছোট বাটি আর পানির জগ নিয়ে আসে মারজাহান। মারজাহান বলে, রক্ত বন্ধ করেন, নইলেতো মরে যাবেন। আপনার জানের সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। শত্রুতা যেটার সাথে, সেটা কেটে ফেলেছি। কোনমতে ব্যথাটা সহ্য করেন, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
হাতে বড় সাইজের একটা দাও ধরে মারজাহান হাশেমকে জানায়, ইশারা দিয়েন জায়গামত, যেখানে যা মানায়।
এক টুকরো বড় পলিথিন আর কিছু টাকা দিয়ে মারজাহান হাশেমকে বলে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে। নইলে ঘরে গিয়ে বৌয়ের হাতে ধরা খাবে। মান সম্মান সব যাবে। শুধু কি নিজের বৌ? ঘরে পুত্রের বৌও আছে। মানে পুরা চুনকালি মাখামাখি হয়ে যাবে।
আসলে গ্রাম ছেড়ে যাওয়া ছাড়া হাশেমের আর কোন উপায় নেই। তাই আনন্দদন্ড হারিয়ে হতবিহ্বল হাশেম আগে পিছে কিছু চিন্তা না করে বেহায়ার মত মারজাহানের কাছ থেকে টাকাগুলো নিয়ে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ে। সবকিছু কেমন গোলমাল পাকানো। মনে মনে অনেক কিছুই ভাবছে, সব এলোমেলো। ক্ষণে ক্ষণে ভাবছে সে বোধহয় স্বপ্ন দেখছে, আসলে কেউ তার ওটা কেটে দেয়নি।
হাশেম চলে যাওয়ার পর ঘরের মেঝে থেকে দন্ডটুকরো তুলে নেয় মারজাহান। পলিথিন কেটে বানানো জামাটা পরে ঘর থেকে বেরিয়ে পানি ডিঙিয়ে খালপাড়ে যায়। মাংসপিন্ডটি খালের জলে ছুঁড়ে মারে। এত জোরালো স্রোতে ঢুবে যাওয়ার উপায় নেই। কে জানে আবুল হাশেমের আনন্দদন্ড ভাসতে ভাসতে কোথায় যায়, কার পেটে যায়। মাছে খাবে নাকি সাপে খাবে, নাকি পঁচে গলে পানিতে মিশে যাবে।
আহারে হাশেম! পুরো শরীর নিয়ে গ্রাম ছাড়লো, শুধু ইয়েটা জলে গেলো।
এক্টিভিস্ট হিম সাগর
সকাল বেলা বাবা কানের নিচে চটকোনা মেরে বলেছে, আর পদ্য লিখিসনা। এখন গদ্যের বাজার ভালো, দু’চার লাইন গদ্য লিখ।
মা বলেছে, একটু বাজারে যা, কিছু সবজি কিনে আন।
ছোট বোন বলেছে, ভাইয়া একটু এদিকে আয়, আমার অংকটা দেখে দে।
কিন্তু কবি হিম সাগর গদ্য লিখবে না, সবজি কিনতে বাজারে যাবে না, বোনের অংক দেখে দিবে না। হিম সাগর গাঁজা খাবে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পর গাঁজা খেতে হয়। তারপর টয়লেটটা ঠিকমত হয়। টয়লেট সেরে ভাবে আজ নয়, কাল থেকে গদ্য লিখবো। আজ নয়, কাল থেকে বাজারে যাবো। আজ নয়, কাল থেকে সোনিয়ার অংক দেখে দিবো। গত কয়েক মাস ধরে হিম সাগর এরকম করে যাচ্ছে। আজ নয় কাল।
আসলে তার নাম আবদুর রহিম সাগর। আবদুর পুরোটা ফেলে দিয়েছে, রহিম এর র। তারপর নাম হয়েছে হিম সাগর। একবার ভেবেছিলো নাম রাখবে মাইকেল সাগর। অনেকেইতো রাখে। যেমন আলফ্রেড খোকন, হেনরি স্বপন ইত্যাদি। পরে ভাবলো এটা ঠিক না। শুনতে ভালো শোনায় না। বেখাপ্পা লাগে। তারচে এত বড় নামটা একটু কাটছাঁট করে রাখতে পারলে ভালো। হিম সাগর। পুরোপুরি বাংলা নাম। মানানসই।
কিন্তু আজ ভিন্ন পরিস্থিতি। গাঁজা বানাতে গিয়েও বানায়নি। ছোট বোনের অংক দেখে দিয়ে বাজারের থলে হাতে বেরিয়ে পড়েছে। গদ্য নিয়ে ভাবছে। খুব ভাবছে। কিন্তু গদ্য আসে না। পদ্যের ঢং চলে আসে। তবু হাল ছাড়ছে না হিম সাগর। ভেবেই যাচ্ছে।
হিম সাগর ফেসবুকে কবিতা লিখে। পাঠক তেমন একটা নেই। প্রতি কবিতায় গড়ে দুই আড়াইশ করে লাইক পায়। কমেন্ট পায় খুব কম। যা দু’একটি পায়, তাতে ঘুরে ফিরে একটাই প্রশ্ন থাকে – ভাই কবিতাটার অর্থ কী?
এসব কমেন্ট দেখে হিম সাগরের রাগ হয়, মেজাজ গরম হয়। দুনিয়ায় মানুষ অনর্থক কত কিছু করে। কিন্তু কবিতার একটা অর্থ থাকতেই হবে। অর্থ ছাড়া কবিতা লেখা যেন অপরাধ। তাছাড়া অবশ্যই কবিতা অনর্থক নয়, কিন্তু পাঠক না বুঝলে কবির কী করার আছে।
সবজি কিনে ফেরার পথে হিম সাগর গদ্য নিয়ে ভেবে যাচ্ছে। জীবনটা আজ নতুন করে শুরু হবে। হার মানলে চলবে না। জিততে তাকে হবেই। অনেক ভেবে এক লাইন গদ্য পেয়েছে। – মানুষ বোধহয় সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সবজি কিনতে বাজারে যাওয়ার জন্যই বেঁচে থাকে।
কিন্তু ঠিক মন ভরছে না। বাক্যটিতে যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেলেও দর্শনের ঘাটতি আছে। এটি একটি সামাজিক বাক্য বটে, কিন্তু বাক্যে জীবনবোধের গভীরতায় কমতি আছে। নতুন করে আবার ভাবতে হবে।
ভাবতে ভাবতে এবার যা পেয়েছে, হিম সাগরের কাছে তা অসাধারণ মনে হয়েছে। – ঘুম থেকে উঠে সবজি কিনতে বাজারে যাওয়ার জন্য সারা জীবন বেঁচে থাকো। কিন্তু গাঁজা খাওয়ার জন্য অন্তত একটি দিন হলেও বাঁচো।
পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করে ফেসবুকে পোস্ট করে দিলো।
বাসায় এসে ফোন বের করে দেখে লাইক পড়েছে বিশটি। কমেন্ট ছয়টি। এর মধ্যে চারটিই গালিগালাজ। একটি কমেন্ট মনে দাগ কেটেছে। -শালার কবিদের এই একটাই সমস্যা, দেশ জাহান্নামে যাক, উনাদের কাব্যচর্চা বন্ধ হয় না।
গদ্যকার হিম সাগর ভাবলো দেশের কী হয়েছে দেখা দরকার। নিউজ ফিডে কিছুক্ষণ ঘুরলো। ফ্রেন্ডলিস্টে বেশিরভাগ কবি, তাই নিউজফিড জুড়ে প্রায় সব পোস্টেই কবিতা। এর মাঝে বন্ধুদের শেয়ার করা পোস্ট থেকে দেশের কিছু খবর পাওয়া গেলো। জয়পুরহাটে মা’কে বেঁধে মেয়েকে ধর্ষণ। ফেনীতে কিশোরীকে ধর্ষণ শেষে খুন করেছে পাষন্ডরা। কিশোরগঞ্জে পুরোহিতকে জবাই করে হত্যা। দিনাজপুরে বিএসএফ এর গুলিতে এক বাংলাদেশি নিহত।
দেশ জাহান্নামে যাচ্ছে ঠিক আছে, কিন্তু জাহান্নামে যাওয়ার আগে একইসাথে ধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুন, জবাই, তারপর আবার ভিনদেশি সেনার গুলি খেয়ে গেলেতো সমস্যা। এতকিছুর পর দেশের আর কীইবা থাকে, কী নিয়ে জাহান্নামে যাচ্ছে, খালি হাতে?
হিম সাগর ভাবলো পদ্য গদ্য বাদ। এক্টিভিজম করতে হবে। সমাজটাকে বদলাতে হবে। দেশের জন্য কিছু করতে হবে। আর কত চুপ করে থাকা যায়, এই দুর্বৃত্তায়নের খাঁচা ভাঙতেই হবে। মুখ খুলতে হবে। কিছু বলতে হবে, কিছু একটা করতে হবে।
এক্টিভিস্ট হিম সাগর কোনভাবেই দেশকে জাহান্নামে যেতে দিবে না। আজ থেকে ফেসবুকে সামাজিক অন্যায় অবিচার নিয়ে প্রতিবাদ করবে। সোচ্চার হবে। কিন্তু একসাথে এতকিছু নিয়েতো লেখা যাবে না। অনেকেই আছে প্রতিদিন ফেসবুকে দশ বারোটা করে পোস্ট দেয়। বন্ধুদের প্রতি এটা একটা অবিচার। একজন মানুষ তার নিউজফিডের কয়টা পোস্ট পড়তে পারে। বেশি বেশি পোস্ট দেয়া মানেই বন্ধুদের উপর নির্যাতন করা। হিম সাগর এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।
এখন ফেসবুক এক্টিভিজমের জন্য বিষয় নির্বাচন করতে হবে। একটা সেইরকম পোস্ট দিয়ে এক্টিভিজম শুরু করতে হবে। জয়পুরহাটের বিষয়টা খুবই জঘন্য হয়েছে। মায়ের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ। কত বড় জানোয়ার হলে এটা করতে পারে! কিন্তু ফেনীরটা আরো ভয়ংকর। কারণ শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, মেরেও ফেলেছে। ধর্ষণের পর হয়তো মেয়েটি আত্মহত্যা করতো না। সে বেঁচে থাকতো। পাষন্ডরা তাকে মেরে ফেলেছে। অবশ্য মেয়েটিকে তার মায়ের সামনে ধর্ষণ করেনি। এদিক দিয়ে ঘটনাটি গুরুত্ব হারিয়েছে। তারপর এই যে পুরোহিতকে জবাইয়ের ঘটনা। কিছুদিন আগে হিমসাগর শুনেছে জঙ্গীরা নাকি বলেছে জবাই করে মারলে সওয়াব বেশি। চিন্তা করা যায়, তারা খুনের পন্থা নির্বাচন করে সওয়াবের ভিত্তিতে! বেশ কিছুদিন ধরে এই বিশেষ ধরনের খুন হচ্ছে। এটা মাথা ব্যাথার। তাছাড়া সংখ্যালঘুদের উপর বেশি আক্রমণ হচ্ছে। এটা আমাদের জাতীয় পরিচয়কে সংকটে ফেলে দিচ্ছে। একটা দুইটা ধর্ষণের চেয়ে এটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সীমান্তের হত্যার বিষয়টা জাস্ট অসহ্য। সীমান্তে শুধু বাংলাদেশের নাগরিকরাই মরে। অথচ আমাদের সরকার কিছুই করছে না। অথবা করতে পারছে না। নিজ দেশের সরকারের এমন মেরুদন্ডহীনতার কথা চিন্তা করলে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। আমাদের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব আজ প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষীদের হাতে মানুষ মরেই যাচ্ছে, কোন থামাথামি নেই।
কিন্তু এক্টিভিস্ট হিম সাগর এখন কী করবে? সবগুলো বিষয় সমান গুরুত্বপূর্ণ। কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবে, ভেবে পাচ্ছে না। আবার সবগুলো বিষয় নিয়ে লেখা চাট্টিখানি কথা নয়। এক লাইন গদ্য মাথায় আনতে একবার বাজারে যেতে হয়েছে, আবার ফিরতে হয়েছে। আর এখন যদি এতগুলো ইস্যু নিয়ে লিখতে যায়, তাহলে হিম সাগরকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবুও ঠান্ডা মাথায় চোখ বন্ধ করে ভেবে যাচ্ছে হিম সাগর। উপায় একটা বের হবেই।
এক্টিভিস্ট হিম সাগর ভাবছে একটু গাঁজা টেনে নিলে মনে হয় বিষয়টা সহজ হবে। তার বিশ্বাস, গাঁজা ব্রেইন খুলে দেয়। উদারভাবে চিন্তা করা যায়। কিন্তু গাঁজা টানলে তার নতুন জীবন শুরু করা যাবে না। আবার না টানলে এই সংকটের সমাধান হবে না। মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করে গাঁজার চুরুট ধরিয়ে দিলো কয়েক টান। তারপর দৌড়ালো বাথরুমে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে হিম সাগর ভাবছে আজ নয়, কাল থেকে এক্টিভিজম শুরু করবো।
মেয়েটির নাম জাহান, মারজাহান
এই মারজাহান সেই মারজাহান নয়। এই মারজাহান হচ্ছে জাহান। এবং এই মারজাহানের কোন গল্প নেই। অন্যের গল্পে মারজাহান ঢুকে পড়ে। কারণ ওইসব গল্প মারজাহানকে ছাড়া হয় না। যেমন বাইশ বছর আগে তার বাবা মা, দাদা দাদী, খালা ফুফু সবাই খুব চিন্তা করছিলো এই নবজাতকের নাম কী রাখবে। পরে নবজাতকের বাবা বললেন, নাম হোক মারজাহান। বাবার দেয়া নাম সবাই পছন্দ করেছে। তারপর মারজাহান নামেই সে বেড়ে উঠেছে।
মারজাহান বড় হলো। বয়স হলো চার। মারজাহানকে স্কুলে দিবে। ইংলিশ মিডিয়ামে নাকি বাংলা মিডিয়ামে, এই নিয়ে বাবা মা’র টেনশন। মা বললো বাংলা মিডিয়ামেই দাও। ইংরেজি বিষয়ের জন্য আলাদা মাস্টার রেখে দিবো। সমস্যা নেই। তারপর মারজাহান বাংলা মিডিয়ামের স্কুলে গেলো।
প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষে মাধ্যমিকে ভর্তি করানোর সময় আবারো মারজাহানের বাবা মা’র অন্তহীন চিন্তা। কোন স্কুলে ভর্তি করাবে, কোন স্কুল ভালো, কোন স্কুলের শিক্ষকদের কোন বদনাম নেই। অনেক ভাবনা চিন্তার পর মারজাহানকে একটা স্কুলে ভর্তি করায়। তার বাবা মা দুশ্চিন্তামুক্ত হয়।
মারজাহান আরো বড় হলো। ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠলো। এখন বাবা মা’র দুশ্চিন্তা মেয়ে কোন লাইনে পড়াশোনা করবে। সায়েন্স, আর্টস নাকি কমার্স। সায়েন্স অনেক কঠিন। মেয়ে মানুষ কমার্সে গিয়ে কী করবে? আর্টসটাই মনে হয় ভালো। ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে পড়বে। অন্যদিকে খেয়াল কম যাবে। এসব ভেবে শেষে বাবা মা মিলে সিদ্ধান্ত নিলো মারজাহান আর্টসে পড়বে।
আরো বড় হলো। এসএসসি পাশ করেছে। কলেজে ভর্তি করাতে হবে। কিন্তু কোন কলেজে ভর্তি করাবে? কো এডুকেশন নাকি গার্লস কলেজ? গার্লস কলেজ হলে, সেটা কোন কলেজ? মারজাহানকে তার মা বলে –তোর চিন্তায় চিন্তায় তোর বাবার অবস্থা কাহিল। মারজাহান খেয়াল করে দেখে আসলেই তার চিন্তায় চিন্তায় বাবা মা দু’জনই শুকিয়ে যাচ্ছে। মারাজাহানের কোন চিন্তা নেই। বাবা বলে –তোর আবার কিসের চিন্তা, আমরাতো আছি।
এখন মারজাহানের বাবা মা চিন্তায় একেবারে জমে গেছে। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। ডাক্তার, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ল’ইয়ার নাকি প্রবাসী ছেলের হাতে তুলে দিবে? মারজাহানের মায়ের বোনের ছেলেটা মারজাহানকে পছন্দ করে। আবার বাবার বন্ধুর ছেলেও পছন্দ করে। কিন্তু বোনের ছেলেকে বাবার পছন্দ না, বন্ধুর ছেলেকে মায়ের পছন্দ না। তাই যে যার দায়িত্ব নিয়ে দুই পাত্রকে মানা করে দিয়েছে। কিন্তু মানা করে দিয়ে কী হবে, চিন্তাতো আর কমে না। এই সময় একটা ভালো পাত্র পাওয়া যে কত কঠিন, তা যাদের মেয়ে আছে শুধু তারাই জানে। মারজাহানের মা মারজাহানকে বলে – তুই কোন চিন্তা করিস না মা, একটা ভালো ছেলের হাতে তোকে তুলে দিবো। সুখে থাকবি।
এখন, ঠিক এই মুহূর্তে মারজাহান যাচ্ছে শপিংয়ে। দুই বছর হলো একা একা শপিংয়ে যাওয়ার অধিকার অর্জন করেছে। অর্জন বলা যাবে না, দয়া করে বাবা মা এই অধিকারটুকুন তাকে দিয়েছে। মারজাহান শপিং খুব পছন্দ করে। উপভোগ করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই শপিং মল থেকে ওই শপিং মল, এই শোরুম থেকে ওই শোরুম, এই ব্র্যান্ড থেকে ওই ব্র্যান্ড, ঘুরতে থাকে। একটার পর একটা জামা, কসমেটিক, জুতা দেখে। দেখতে দেখতে স্তুপ করে ফেলে। তারপর চেহারায় খুব অসন্তুষ্টি নিয়ে কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলে, একটাও পছন্দ হয়নি, পাশের দোকানে দেখি পছন্দ হয় কিনা।
শুধুমাত্র শপিং করতে আসলে ভালোমত দেখে, শুনে, বুঝে, চিন্তা করে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার, নিজের পছন্দ নিজে করার সুযোগ পায়। কেউ তাকে বলে না, তুই কোন চিন্তা করিস না, একটা ভালো জামা-জুতা আমরা কিনে দিবোই।
শপিং করতে আসলে মারজাহান অনেক চিন্তা করে। কারণ এখানে কেউ তার হয়ে চিন্তা করার সুযোগ পায় না।
রোদে পুড়তে থাকা যাত্রী ছাউনি
আনন্দদন্ড হারানো হাশেম ঢাকা এসে পোঁছেছে বেশিক্ষণ হয়নি। মতিঝিলে এক খাতিরের লোক থাকে। তার কাছে যাবে। ঢাকায় এসে বাস থেকে নেমে খাতিরের লোককে ফোন করেছে। খাতিরের লোক বলেছে বাসে করে সোজা শাপলা চত্বর এসে নেমে কোন দোকান থেকে আরেকটা কল করতে। তারপর তিনি এসে নিয়ে যাবেন। কিন্তু আবুল হাশেম ভুল বাসে উঠে এখন আগারগাঁও। প্রখর রোদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কোমরে অনেক ব্যাথা নিয়ে যাত্রী ছাউনিতে বসে আছে বাসের জন্য।
এদিকে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বাজারে গিয়ে সবাইকে অবাক করে দেয়া আবদুর রহিম সাগরের বাবা ভাবলেন ছেলে বোধহয় লাইনে চলে এসেছে। তাই ছেলেকে একটা কাজে কাওরান বাজার যেতে বললেন। গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকা হিম সাগর তার বাবাকে না করতে পারেনি। মনে মনে ভেবেছে আজ নয় কাল যাবে কাওরান বাজার। কিন্তু মনের বিরুদ্ধে গিয়ে শরীরটাকে নিয়ে আজই বেরিয়ে পড়েছে। যাত্রী ছাউনিতে বসে আছে বাসের অপেক্ষায়।
বাইরে ঠাডাভাঙ্গা রোদ। রোদ থেকে বাঁচতে ছাতা ব্যবহার করা একদম পছন্দ করে না মারজাহান। তারচে বরং ঘর থেকে বেরিয়ে পাঁচ টাকা দিয়ে একটা পত্রিকা কিনে নিলেই হয়। অন্তত মাথাটা রোদ থেকে বাঁচানো যায়। হাঁটতে হাঁটতে বাস স্টপিজে আসে মারজাহান। যাত্রী ছাউনিতে বসে।
আজ ছুটির দিন। তবুও রাস্তায় প্রচুর যানজট। বাস আসতে দেরি করছে। যাত্রী ছাউনিতে তিনজন মানুষ। আবুল হাশেম, আবদুর রহিম সাগর আর মারজাহান। এক কোনায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে হাশেম। মাঝখানে বসে পত্রিকা দিয়ে চেহারায় বাতাস করছে মারজাহান। আরেক পাশে বসে বসে উদাস দৃষ্টিতে কোথায় যেন তাকিয়ে আছে হিম সাগর।
অনেক সময় হলো, বাস আসছে না। অপেক্ষার বিরক্তি কাটাতে মারজাহান পত্রিকাটা মেলে পড়ার চেষ্টা করে। প্রথম পাতায় দুইটা ধর্ষণ আর তিনটা খুনের খবর। মানুষ কেন পত্রিকা পড়ে, এটা ভেবে অবাক হয় মারজাহান। টাকা দিয়ে পত্রিকা কিনে দুঃসংবাদ পড়ে কী লাভ! ধর্ষণের খবরে চোখ রেখে আপন মনে বলে, এদেরকে গুলি করে মারা উচিত।
এটা শুনে ডানপাশে উদাস হয়ে বসে থাকা হিম সাগর বলে, মেরে ফেললেতো বেঁচে যাবে। ওদের নুনু কেটে দেয়া উচিত। স্যরি, ফর ব্যাড ওয়ার্ড।
হিমসাগরের মুখে এটা শুনে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা আবুল হাশেম চমকে ওঠে। নুনু কাটার কথা শুনে তার গা কাঁপতে থাকে। কাঁপুনির তীব্রতা এত বেশি যে যাত্রী ছাউনির বেঞ্চটাও কেঁপে ওঠে। টের পায় মারজাহান ও হিম সাগর। দেখে একজন মোটামুটি বয়স্ক মানুষ জড়সড় হয়ে থর থর করে কাঁপছে। মারজাহান আবুল হাশেমের কাছে যায়। আবুল হাশেম ভয় পায়। মারজাহান আবুল হাশেমের কপালে হাত দেয়। আবুল হাশেম আরো ভয় পায়। মারজাহান বলে – আরে, আপনারতো অনেক জ্বর। আপনি কোথায় থাকেন, কোথায় যাচ্ছেন?
আবুল হাশেম কথা বলে না। মারাহান আবার জিজ্ঞাসা করে। আবুল হাশেম এবারও কিছু বলে না। ভয়ংকরভাবে কেঁপে যাচ্ছে। মারজাহান বলে, চলেন আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।
আবুল হাশেম নড়ে না। খেমটি মেরে বসে থাকে। হিম সাগর কিছু বলছে না, কৌতুহলী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মারজাহান আবুল হাশেমকে জোর করে। বলে, আপনি আমার বাবার বয়সী, ভয় পাচ্ছেন কেন? চলেন হাসপাতালে যাই। কাছেই একটা হাসপাতাল আছে।
প্রায় জোর করে আবুল হাশেমকে বসা থেকে উঠায় মারজাহান। এমন সময় মারজাহানের ফোনে কল আসে। কল রিসিভ করে। ওই প্রান্ত থেকে কী বলছে কে জানে, মারজাহান বলছে – আমি তিথি নই, মারজাহান।
ফোন রেখে দেয়। আবুল হাশেমের চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠে। কোথায় জ্বর আর কোথায় কাঁপুনি, গায়ে জানোয়ারের শক্তি ভর করে। সর্বশক্তি দিয়ে মারজাহানকে ধাক্কা মেরে বলে, দূর হ ডাইনি!
তারপন হন হন করে হেঁটে চলে যায়। ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় মারজাহান। বেঞ্চের সাথে আঘাত খেয়ে ভ্রুর উপরে কপালের খানিকটা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। এবার আর চুপ মেরে বসে থাকতে পারেনি হিম সাগর। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে মারজাহানকে তোলে।
হিম সাগর বলে, চলুন আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।
প্রতি অংশের জন্য পৃথক পৃথক মন্তব্য ভালো লেগেছে।
যাইহোক, গল্পটা যে বেশি কঠিন হয়ে গেছে, বুঝিনি।
ধন্যবাদ। 🙂
অনেক বছর আগেও দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ‘ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কর্তন’ টাইপ খবর ছাপা হতো। জানিনা এখনো এমন খবর গুরুত্ব পায় কি না। জানিনা এখনো দেশে ওই রকম দূঃসাহসী মারজাহান আছে কি না।
( হাশেমের আনন্দদন্ড) ।
জানিনা এখনো ফুল প্রজাপতি আর ভ্রমর দেখার মারজাহান’রা আছে কি’না। বহু বছর আগের মুক্ত মারজাহান’রা তো দেখি আজ শরিয়ার বস্তায় ঢুকে পড়তে ব্যস্ত। আহ।
হিম সাগর’রা কি এস্কেপিস্ট হয়ে যাচ্ছে?
(এক্টিভিস্ট হিম সাগর) ।
তবু জানি ওরা একটি দিনের জন্য হলেও, শুধু একটি বারের জন্য হলেও নিজের মত বাঁচে; টাকনুর জবাই বাজারে এই বা কম কিসের?
আর জাহান মারজাহান?
(মেয়েটির নাম জাহান, মারজাহান) ।
কেউ তাকে জিজ্ঞেস’ও করেনি সে কি চায়। চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সব। কিনতে পারুক বা না পারুক; জামা জুতো রঙ আর, তার পছন্দ নিয়ে কথা বলতে পারবার চর্চা; কম নয় মোটেও। অবশ্য লক্ষণীয়; পরিণত বয়সের অধিকারটুকুও চাপানো 🙂
রোদে পুড়তে থাকা যাত্রী ছাউনি’র সম্মেলন ও শেষটা হয়েছে কৌশলী এবং দারুনও বটে।
এইবার একটু অন্য কথা, পরের বার আমাদের মত আম জনতার জন্য সহজ গল্প পাবো তো?