লিখেছেনঃ আবু জাহেদ
আপনি সমকামী নন, সমকামিতা আপনার কাছে গ্রহনীয়ও নয়; এখন দেখা গেল আপনার বাসার পাশে দুই জন সমকামী ঘর ভাড়া করে থাকে বলে আপনি জানেন। এখন আপনি কি করবেন? ওরা ওদের মত থাক, আমি আমার মত থাকি এই চিন্তা করবেন? নাকি একটা বন্দুক চাপাতি বা যে কোন একটি অস্ত্র জোগাড় করে ওদের মেরে দিয়ে আসবেন?
এবার মনে করুন আপনি মূর্তি পুজা করেন না, মূর্তি পূজাকে আপনি আপনার দৃষ্টিতে ভালো বলেও মনে করেন না, কিম্বা আপনি এ্যালকোহল পান করেন না অথবা শূয়োরের মাংসও খান না । কিন্তু যারা মূুর্তি পূজা করে, এ্যালকোহল পান করে আর শুয়োরের মাংস খায়; তাদের কে আপনি কি করবেন? তারা তাদের মত চলুক, আপনি আপনার মত চলুন এই চিন্তা? নাকি তাদের মেরে উচ্ছেদ করার চিন্তা? কোনটা করবেন আপনি?
আবার দেখা যায় মানুষ মারার মত ক্ষমতা সাহস আপনার নেই, কিন্তু কেউ যদি মারে তবে তাদের প্রতি কি আপনি সমর্থন জানাবেন নাকি তাদের ঘৃনা করবেন? এই প্রশ্নগুলি আজ সমস্ত মুসলিম সমাজের সামনে উত্থাপন হওয়া উচিত বলে মনে হয়। মুসলমানদের খুব পরিষ্কার ভাবে চিন্তা করার দরকার যে, এই পৃথীবিতে তারাই কেবল মাত্র একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়; রয়েছে হাজার বর্ণের, হাজার চিন্তার, হাজার সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের খাদ্যাভাস, রীতি নীতি, ধর্ম পালন প্রক্রিয়া, কিম্বা জীবন যাত্রা প্রণালী আপনাদের থেকে বিচিত্র এবং ভিন্ন ধরনের হতে পারে, এবং হবেও তাই।
এখন উপায় কি, সকলের সাথে মিলেমিলে এই পৃথীবিতে সহবস্থান করা? যুদ্ধ, মারামারি কিম্বা তাদের প্রতি সীমাহীন ঘৃনা পোষন করা কি এর সমাধান হতে পারে?
আপনি এখন হয়তো বলবেন শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানই এর সমাধান। কিন্তু এই সমস্ত কথা গুলি আপনারা মুসলিমরা ঠিক তখনই বলেন , যখন কোন মাইক্রোফোন কিম্বা কোন দেশী অথবা আন্তজাতিক সাংবাদিক ঠেঁসে যেয়ে আপনাদেরকে ধরে এই সংক্রান্ত প্রশ্ন করে। কার্যত এই সমস্ত কথাগুলি মুসলিম সমাজ বিশ্বাস করে বলে মনে হয়না। যদি করতো তাহলে মুসলিম দেশগুলি থেকে ক্রমাগত একের পর এক ইসলামী জঙ্গি সংগঠন সৃষ্টি হতে পারতো কি?
অামেরিকায় যখন নাইট ক্লাবে জঙ্গি হামলায় পঞ্চাশের অধিক মানুষ মারা গেল, তারপর থেকে আমাদের দেশের মিডিয়াগুলি নাইট ক্লাবের আগে সমকামীদের নাইট ক্লাব শব্দটি কোথাও যোগ করতে ভুলেনি। ওই ঘটনা বাংলাদেশে প্রচার হওয়ার পর এক চায়ের দোকানে উক্ত বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিলো। সেখানে আমি ছিলাম। মানুষের হাবভাব এমন যে, আপনি নিশ্চিত ভাবে ধারনা করতে বাধ্য হবেন এই সন্ত্রাস তারা নীরবে সমর্থন করে চলেছে। এটা কেবল আমার দেখা চায়ের দোকানের মানসিকতা না, বেশিরভাগ মানুষেরই এমন ভাব। সাধারণ মানুষদের মনোভাব একটু খেয়াল করে বোঝার চেষ্টা করলে আপনি নিজেই সেটা ধরতে পারবেন।
খুব পরিষ্কার ভাবে একটি কথা মুসলিমরা বুঝুন, পৃথীবি এখন পাঁচশো বা ছয়শো খ্রিষ্টাব্দে নেই, এখন চলছে ২০১৬ সাল। ঠিক এই অবস্থানে থেকে মধ্য যুগের ইসলামী খেলাফতের যুগে ফিরে যাওয়া কোন অবস্থাতেই সম্ভবপর নয়। সারা পৃথীবির, দেশের, সমাজের অন্য মানুষদের মতামত আচার ব্যবহার নিয়ে তাদের থাকতে দিতে হবে, যেমন তারা আপনাদের থাকতে দিচ্ছে, নতুবা সারা পৃথীবি থেকে বিছিন্ন হয়ে যেতে হবে।
জিহাদ এবং সারা পৃথীবী জুড়ে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করার দূরাশা; দয়া করে মাথা থেকে সরান।
দেখুন, মানুষের ব্যাক্তিগত যৌন জীবন একান্তই তার ব্যক্তিগত বিষয় । সময় হয়েছে এই বিষয়টিকে মানুষের ব্যক্তি অধিকারের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার। পৃথীবির বহু সমাজ এই বিষয়টিকে ব্যক্তির অধিকার হিসাবে মেনে নিলেও , আমাদের সমাজ সেই অধিকার মেনে নেওয়া দূরে থাক পাশবিক শক্তির মাধ্যমে তাদেরকে দমন করতে আগ্রহী । যার বিভিন্ন প্রমান নজির আমরা অনেক সময় রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকে পেয়েও থাকি।যদি সমকামীরা ঘরের মধ্যে গ্রেনেড বোমা বানাতো, এবং তা দিয়ে আপনার আমার জীবন কেড়ে নিতে চাইতো , তাহলে আমি নিজেও তাদের উচ্ছেদ করার বিষয়ে বদ্ধ পরিকর হতাম কেননা তাদের অস্তিত্ব আপনার আমার স্বাধারণ মানুষের জীবনকে বিপন্য করে তুলবে । যদি মানুষের যৌন জীবন কেবল মাত্র ব্যক্তিগত অধিকার হিসাবে মেনে নেন – তাহলে সমকামী সংক্রান্ত এই যুক্তিগুলি খাটেনা ।
অবশ্যই জঙ্গি আর সমকামী এক না এবং আমি সেই কথাও বলি না। আমার প্রশ্ন হলো আপনাদের মূলনীতি”যে যে রকম আছে সেই ভাবে থাকতে দেওয়া”নিয়ে। কারণ যদি এই মূলনীতির ভিত্তিতে সমাজে সমকামীদের গ্রহণ করা হয় তাহলে জঙ্গিদের বিরুদ্ধেও কথা বলার কোন অবকাশ থাকবে না। তাই এই মূলনীতির স্লোগান বন্ধ করুন। আর যদি বলেন সমকামীরা সমাজের জন্য ক্ষতিকর না তাহলে আমি বলব এটা আপনার মত কিন্তু সমাজে আরো অনেক ব্যক্তিকে পাবেন যারা এই মতের সমর্থক না,তাদের দৃষ্টিতে সমকামীরা সমাজের জন্য ক্ষতিকারক।
জঙ্গি আর সমকামী কি এক হলো?? জঙ্গি সমাজের শত্রু, দেশের শত্রু। আর সমকামী কি তেমন?? না,কখনো না।
ধরেন আপনি একটা বাসার মালিক আর আপনার বাসার নিচ তলায় কিছু আনসার উল ইসলামের অনুসারী বসবাস করে।তখন আপনি কি তার ক্ষেত্রেও “যে যেমন সেই ভাবে থাকতে দাও”এই মূলনীতি প্রয়োগ করবেন।যদি না করেন তাহলে আমার প্রশ্ন হলো সমকামীদের ক্ষেত্রে এই মুলনীতি প্রয়োগ করলেও জঙ্গিদের ক্ষেত্রে কেন এই মূলনীতি প্রয়োগ করবেন না?
আপনার কাছে কি সমকামিতা আর মানুষ হত্যা এক জিনিস? প্রাপ্ত বয়স্ক দুজন মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভালো লাগা ও সম্মতির মধ্য দিয়ে যদি প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক হয় সেটা কখনো অন্যায় নয়। বিষমকামিতা কি আপনার বিচারে অন্যায়? যদি তা অন্যায় না হয় তবে সমকামিতা কেন অন্যায় হবে? বিপরীত লিঙ্গের সাথেই কেন প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক হতে হবে বলে আপনার মনে হয়? বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না; আপনার এবং আরো অনেকেরই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রেম বা কামনা আসে বলে সবারই এরকম হতেই হবে কেন? একজনের পছন্দ-অপছন্দ অন্যের উপরে চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় নয় কি?
আমার বাসার নিচতলায় কেন, পৃথিবীর যেকোথাও যেকোনো মানুষ বাস করতে পারবে স্বাধীনভাবে। কিন্তু আমি যদি জানতে পারি, কোনো মানুষ কোনো প্রকারের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত আছে তবে আমি তার জন্য আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। আইন তার বিচার করবে। আনসার উল ইসলামের লোকেরা মানুষ খুন করে। আর সমকামীরা সমলিঙ্গের মানুষের সাথে প্রেম করে। প্রেম করা আর মানুষ খুন করা কি এক হলো?
এখনো পাকিস্তানসহ আরো কিছু মুসলিম দেশে বিপরীত লিঙ্গের সাথে প্রেম করার অপরাধেও মেয়েদের খুন করা হয়। এটাকে অনার কিলিং বলে। তাদের কাছে প্রেম করা জঘন্য অপরাধ। কিন্তু প্রেমিক-প্রেমিকাকে খুন করা খুব মর্যাদার। বলুন, এটা কি মানবিক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? ধর্ম সমকামিতাকে পাপ বলেছে বলে সমাজও এই প্রেমকে পাপ মনে করছে। সমাজ থেকে আমরা যে ধারণা পাই তা সব সময় সঠিক নয়। এক সময় মেয়েদের পড়াশোনা করা ও চাকরি করাকে সমাজ পাপ মনে করতো। আজ সেই ধারণা যে বিরাট ভুল ও অন্যায় তা অনেকেই বুঝতে পেরেছে। মেয়েরা এখন পড়ালেখা করছে, চাকরি করছে, খেলাধূলা করছে। মানুষের ধারণা, চিন্তাচেতনা ইত্যাদি অপরিবর্তনীয় নয়। এসব পালটায়। এভাবেই সমাজ পরিবর্তন হয়। বিভিন্ন মত ও চিন্তাচেতনার মানুষ রয়েছে এ পৃথিবীতে। সবাই সবার মতামত প্রকাশ করুক কাউকে শারীরিক আঘাত না করে, হত্যা না করে। মতের মিল না হলেই তাকে হত্যা করে ফেলতে হবে?
দু’জন মানুষ; ওরা যে লিঙ্গেরই হোক না কেন, পরস্পরকে ভালোবাসে- এর চেয়ে সুন্দর জিনিস আর কী আছে পৃথিবীতে? আনসার বাংলা – যাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য মানুষ খুন করা, তাদের সাথে প্রণয়ী মানুষের তুলনা করছেন? সমকামী মানুষ যদি অন্য কোনো অপরাধ করে, কোনো সন্ত্রাস করে তার বিচার আইনী প্রক্রিয়ায় অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু সমকামিতা কোনো অপরাধ নয়, যেমন অপরাধ নয় বিষমকামিতা।
ধন্যবাদ আবু জাহেদ।
অাপনাকেও অনেক ধন্যবাদ , ভালো থাকবেন ।