আমি, আমরা, হেফাজতে-ইসলামি বাংলাদেশের আমীর আল্লামা শফি হুজুর, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী থেকে শুরু করে রাজনীতির জ্ঞান সম্পন্ন প্রত্যেকটি মানুষই জানি যে- অধুনা বাংলাদেশে ইসলাম প্রেম, নবি মুহাম্মদের কথিত ‘অবমাননা’, ইসলাম ধর্ম রক্ষার যে জিগির উঠেছে তার সবকিছুই ‘বাখওয়াজ’। আসল কথা হল সাধারণ জনগণকে ধর্মরক্ষার মিথ্যে জিগির তুলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা নিজেদের ক্ষমতার মসনদে আসীন করবার পথকে সুগম করার হীন কৌশলমাত্র। বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের ‘গণতান্ত্রিক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বাংলাদেশের ৮৯% মুসলমানকে ‘জোটবদ্ধ’ করা চাই। এই জোটবদ্ধ করার সহজ উপায় ১১% লোকদের ধর্ম সন্দেহ, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো। ক্ষমতায় টিকে থাকতে কিংবা ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি হিসেবে ইসলাম ধর্ম হল তুরুপের তাস।
বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ ও সেক্যুলার হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। আওয়ামী লীগ বহির্বিশ্বে নিজেদের ‘ধর্মীয় মৌলবাদ বিরোধী’ একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে জাহির করার বহুমাত্রিক চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই সরকার ও এর প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্টরা আদৌ জানে না ধর্মীয় মৌলবাদ কী জিনিস।
আলোচনার প্রারম্ভে প্রাসঙ্গিকভাবেই জানা প্রয়োজন ধর্মীয় মৌলবাদ কী? সকল ধর্মীয় মৌলবাদ হল বাস্তব বর্জিত, যুক্তিহীন, বৈজ্ঞানিক ভাবনা-চিন্তাহীন, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, বিবর্তনের জ্ঞানহীন এক অসুস্থ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মতবাদ। ধর্মীয় মৌলবাদীরা বর্তমানকালে জীবনধারণ করে থাকে, বর্তমানকালের বিজ্ঞান ও সভ্যতার সকল সুযোগ সুবিধাদি ভোগ করে; অথচ সহস্রাব্দকাল আগের কথিত ধর্মীয় সামাজিক আচারাদি যা বর্তমানকালে পুরোপুরি অচল, সেই অচল সমাজ ব্যবস্থাই চালু করতে চায়। সহস্রাব্দকাল আগের প্রাচীন রীতি-নীতি ধর্মবিশ্বাস যে কোন প্রক্রিয়ায় (খুন করে হলেও) সকল মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চায়। এইসব ধর্মীয় মৌলবাদীরা মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত আচার আচরণের স্বাধীনতা কিংবা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কোনও মূল্য দিতে রাজি নয়। যতো গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন, যা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থে নেই, তার অস্তিত্বই এরা স্বীকার করে না। এদের মতে- ‘সবকিছুই ধর্মগ্রন্থে রয়েছে’। আর ধর্মগ্রন্থে যা নেই মানুষের জীবনে তার দরকারও নাই। মুসলিম ধর্মীয় মৌলবাদীদের উদ্দেশ্য বিশ্বব্যাপী খিলাফত শাসন প্রতিষ্ঠা করা।যেখানে শরিয়াহ আইনের অধীনে পুরো রাষ্ট্রকাঠামো চলবে। যা আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র বলে পরিচিত রাষ্ট্রকাঠামোর ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত ও সাংঘর্ষিক।
ধর্ম নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচয়দানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গত প্রায় ৭ বছর ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। অথচ এই সরকারের আমলেই বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসীদের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। কেবলমাত্র গত বছরেই প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে ৬ জন ব্লগারকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে সিরিয়ালি কাউকে খুন করার নজির গণতান্ত্রিক কোন দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ব্লাসফেমির অভিযোগে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে খুন করা একমাত্র ইসলামি রাষ্ট্রগুলোতেই সম্ভব। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশেই আজ এটা সম্ভব হচ্ছে কেবলমাত্র রাজনৈতিক আপসকামীতার কারণে। বর্তমানে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, ক্ষমতার বাইরে থাকা বিরোধী দল থেকে শুরু করে সংবাদ মিডিয়া, লেখক বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে অধিকাংশই অবিশ্বাসীদের সংস্রব এড়িয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকছেন। আর এই সুযোগটাই ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী কাজে লাগাচ্ছে। জঙ্গিরা একের পর এক মুক্তচিন্তার লেখকদের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে হত্যা করলেও তারা কেউ-ই কার্যকরী প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ করছেন না, সরকারও সত্যিকারভাবে তাদের দমনের ব্যাপারে আন্তরিক নয়। ফলে জঙ্গিরা দিন দিন আরও সাহসী হয়ে উঠছে। অবস্থা এখন এমনই দাঁড়িয়েছে যে, মৌলবাদী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যারাই মুখ খুলছেন তারাই ‘নাস্তিক’ উপাধি পাচ্ছেন। আর বাংলাদেশে ‘নাস্তিক’ উপাধি পাওয়াকে অধিকাংশ মানুষ ঘৃণার চোখে দেখেন। সমাজে মানুষের বড় একটি অংশ মনে করেন নাস্তিকদের হত্যা করা অন্যায় কিছু নয়। নাস্তিকদের সাথে সরকারের কোন সংশ্লেষ নেই প্রমাণ করার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ও স্বয়ং নাস্তিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স-এর নিকট বক্তব্য দিয়েছেন, “আমরা (আওয়ামী লীগ) নাস্তিক হিসেবে পরিচিত হতে চাই না।” (সূত্র- Dhaka Tribune.com) জনাব জয়ের উপরোক্ত বক্তব্যই বাংলাদেশ সরকারের সামগ্রিক চিত্র প্রতিভাত করে।
মুক্তচিন্তা, ধর্মীয় সমালোচনা ও স্বাধীন মত প্রকাশ সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির অসংখ্য সুস্পষ্ট প্রমাণ উল্লেখ করা যায়। পুলিসের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা মুক্তচিন্তার লেখকদের কঠোরভাষায় হুমকি দিয়ে সাবধান করে বলেন- “আমরা যেন সীমা লঙ্ঘন না করি। এমন কিছু লেখা উচিত নয়, যেখানে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে, বিশ্বাসে আঘাত আনে।” এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন- ” কোনও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে কেউ বক্তব্য দিলে তা সহ্য করা হবে না।”
বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই নাস্তিকতা চর্চা ছিল, কিন্তু তখন এই অপরাধে নাস্তিকদের খুন করার ট্রেন্ড ছিল না। এই ট্রেন্ড চালু হয়েছে বিশ্বব্যাপী ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থানের পর থেকেই। ১৯৭৪ সালে দাউদ হায়দারকে কবিতার জন্যে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এরপর ১৯৯১-১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমি বই মেলায় লেখক তসলিমা নাসরিনের বই উঠিয়ে নেওয়া হয়, বাংলা একাডেমি বইমেলায় তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল। এমনকী সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাঁকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত্ও করা হয় এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার ‘অপরাধে’ তাঁর বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি ও ফাঁসির দাবি তোলে ইসলামি রাজনৈতিক দলসমূহ। তাঁর ফাঁসির দাবিতে সমগ্র দেশে অসংখ্য মামলা রুজু হয়, সরকারও তাঁর বিচারেরও চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি গোপনে দেশত্যাগ করায় সরকারি মামলা-মোকদ্দমা, ঝামেলা থেকে রক্ষা পেয়ে প্রাণে বেঁচে যান। এরপর নাস্তিক ও মুরতাদ ঘোষণা দিয়ে সমগ্র দেশে ড. আহমদ শরীফের ফাঁসি দাবি করে আন্দোলন গড়ে তোলে ইসলামি রাজনৈতিক দল। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে ইসলামী জঙ্গি সংগঠন হরকাত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামি মুক্তমনা কবি শামসুর রাহমানকে হত্যার চেষ্টা চালালেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এর কয়েকবছর পরে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাংলা একাডেমি বই মেলায় অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের ওপরে নৃশংসভাবে হামলা চালানো হয়। এই হামলা ও আক্রমণের ফলে অল্প কিছুদিন পরই তাঁর মৃত্যু হয়। বাংলাদেশের সরকার এখনো পর্যন্ত ড. আজাদ হত্যাকাণ্ডের যথাযথ তদন্ত ও বিচার করেন নি। এরপর থেকেই মূলত বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার লেখকদের ওপর হামলার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। যা রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রশাসন ও রাজনীতিকদের প্রচ্ছন্ন সহায়তা কিংবা নীরবতার কারণেই ক্রমশ বিশাল আকার ধারণ করেছে।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বাংলাদেশে ইসলামবাদীদের দ্বারা এমন কিছু গুপ্ত হামলা ও হত্যা সংঘটিত হচ্ছে যেগুলোর ধরন এবং টার্গেট এবং প্রকাশ্যে তাদের ঘোষণা দেখে এর পিছনের ইসলামি উৎস ও সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। এবং এটাও পরিষ্কার হয় যে, খুনি বা হামলাকারীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু মুক্তচিন্তার লেখক, ব্লগার ও প্রকাশক এবং অতঃপর মূল ইসলামী ধারা বিচ্যুত মুসলমান এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইসলামি মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠী এইসব হত্যা, আক্রমণ ও হামলার পিছনে যুক্ত থাকলেও এযাবৎ সংঘটিত কোনও হত্যাকাণ্ডের বিচার এ দেশে হয় নি।
গত বছর (২০১৫) ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে ইসলামি মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর সবচেয়ে উর্বর সময়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালে নৃশংস হত্যার শিকার হন ‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা, বিজ্ঞান লেখক, ব্লগার ও গবেষক ড. অভিজিৎ রায়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত একুশে বইমেলায় তাঁর লেখা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে অভিজিৎ রায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে প্রকাশ্য জনসাধারণের সামনেই হত্যাকারীরা ধারালো চাপাতি দিয়ে তাঁর মাথা ও ঘাড়ে উপর্যুপরি আঘাত করে তাঁকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। পুরো ঘটনাটাই ঘটেছিল শত শত মানুষের উপস্থিতিতে, এবং ঘটনাস্থলের অনতিদূরে পুলিশ অবস্থান করলেও অভিজিতের প্রাণ রক্ষার্থে তারা কোন সহায়তা করেন নি। এই ঘটনার সময় তাঁর সাথে বিশিষ্ট বিজ্ঞান লেখক, মুক্তমনা ব্লগার, অভিজিতের স্ত্রী, রাফেদা আহমেদ বন্যাও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হন। বন্যা আহমেদকে সাধারণ লোকজন হসপিটালে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা করাতে উনি প্রাণে বেঁচে যান।
এরপর ধারাবাহিকভাবে এইসব ইসলামি জঙ্গিদের হাতে ২০১৫ সালের মার্চ মাসের ৩১ তারিখ অনলাইন একটিভিস্ট ও ব্লগার ওয়শিকুর রহমান বাবু তার নিজের বাসার সামনেই প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন। এরপর অফিসে যাবার পথে সকাল বেলা নিজ বাসার সামনেই বিজ্ঞান লেখক, ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসকে কুপিয়ে খুন করে মে মাসের ১২ তারিখে। এবং ৭ আগস্ট নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নীলয় নীল ওরফে এনসি নীল নিজ বাসভবনে খুন হন। গত বছরের সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিল মুক্তচিন্তার লেখককের বই প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা। ৩১ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে তাঁকে তাঁর প্রকাশনা সংস্থার অফিসেই জবাই করে খুন করে যায় ইসলামি জঙ্গিরা। একইদিন মুক্তচিন্তার লেখকদের বই প্রকাশক, লেখক ও কবি আহমেদুর রশিদ টুটুল, লেখক ও ব্লগার রণদীপম বসু এবং কবি তারেক রহিমের ওপরও ইসলামি জঙ্গিরা হত্যা করার উদ্দেশে চাপাতি ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হামলা করে। এঁরা ৩ জনকে দ্রুত হসপিটালে নিলে সৌভাগ্যক্রমে তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান। একইদিন এঁরা ৩ জন প্রাণে বেঁচে গেলেও জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপন প্রাণে বাঁচতে পারেন নি।
একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, ধারাবাহিকভাবে লেখক, ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের ওপর এই আক্রমণের সূচনা হয়েছে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দারকে হত্যার মধ্য দিয়ে। যিনি অনলাইন প্লাটফর্মে ‘থাবা বাবা’ নামে লেখালেখি করতেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি এবং ফাঁসীর দাবীতে শাহবাগ চত্বরে ঐতিহাসিক জনবিস্ফোরণের পরেই এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটা শুরু হয়েছে। এই যুদ্ধাপরাধীদের প্রায় সকলেই ইসলামি মৌলবাদী রাজনীতি ও সাধারণ মানুষ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। এই যুদ্ধাপরাধীরা ছিল প্রধানত জামায়াতে ইসলামি নামক সংগঠনের নেতা-কর্মী। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের জাতিদ্রোহী ও দেশদ্রোহী ভূমিকা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের কঠোর শাস্তির দাবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ শাহবাগে জমায়েত হন। এবং এই জমায়েত ও বিক্ষোভের পিছনে প্রকাশ্যে না এলেও পিছন থেকে ভূমিকা রেখেছিলেন মুক্তচিন্তার লেখক ও ব্লগারদের বড় একটি অংশ। বস্তুত এই আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল ব্লগ ও ফেসবুকে অনলাইন একটিভিস্টদের নিজেদের মধ্যে ইনবক্স ও পাবলিক পোস্টে যোগাযোগের মাধ্যমে। বাংলাদেশের আন্দোলনে যা সম্পূর্ণ নূতন ধারার সংযোজন ঘটায়। কারণ ব্লগ ও ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ সাইটের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সূচনা ঘটে। যা এই দেশে অতীতে কখনও ঘটে নি। এই আন্দোলনের শুরুটা হয় তখনই যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুরুতর যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে আদালত মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। যা ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টরা প্রত্যাখ্যান করে সে রায়কে ‘প্রহসনমূলক রায়’ হিসেবে অভিহিত করে সরকারের সাথে যুদ্ধাপরাধীদের আপসের অভিযোগ করে। পরবর্তীতে শাহবাগ আন্দোলনের চাপে কাদের মোল্লার রায় রিভিউ করে অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
ব্লগার ও অনলাইন একটিভিস্টদের শাহবাগ আন্দোলনের সময় জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি সভাপতি খালেদা জিয়াও ব্লগারদের আন্দোলনকে ‘নাস্তিকদের আন্দোলন’ হিসাবে আখ্যায়িত করে তার বিরোধিতা করেন, জাতীয় সংসদে নাস্তিক ব্লগারদের কঠোর শাস্তি দাবি করেন। এভাবে ব্লগাররা রাজনৈতিকভাবে সমগ্র দেশের প্রশাসন ও জনগণের নিকট ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলেন। উল্লেখ্য নেতিবাচক প্রচার-প্রপাগাণ্ডার কারণে ইসলামি দল ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ লোকদের নিকট ‘নাস্তিক’ শব্দটি খুবই ঘৃণিত ও অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হয়। তাছাড়াও ইসলামি গোষ্ঠী সবসময়ই নাস্তিকদের ব্লাসফেমি আইনে ফাঁসি দাবি করে আসছে। এমনকী তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বলেছে- ‘সরকার যদি নাস্তিকদের ফাঁসি না দেয় তাহলে তারা এইসব নাস্তিক ব্লগারদের জবাই করে খুন করবে’। এ লক্ষে ২০১৩ সালেই তারা ৮৪ জন নাস্তিক ব্লগারের একটি তালিকা সারাদেশে প্রকাশ করে। এই তালিকা ধরে একে একে সবাইকে খুন করা হবে বলেও এইসব ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী বারবার প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। খুন হওয়া ৫ জন ব্লগার-লেখকদের মধ্যে ৪ জনই ৮৪ তালিকাভুক্ত ব্লগার। গুরুতর আহতদের সংখ্যা বাদ দিলেও গত আড়াই বছরে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিদের হাতে খুন হওয়া মুক্তচিন্তার ব্লগার-লেখকদের সংখ্যা এখনো পর্যন্ত ৭ জন।
এটা পরিষ্কার যে, যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁরা বেশিরভাগই ধর্মে অবিশ্বাসী কিংবা নাস্তিক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। নিহতরা সকলেই নিজেদেরকে যুক্তিবাদী ও নিরীশ্বরবাদী হিসাবে দাবী করতেন এবং সকল প্রকার ধর্মীয় অন্ধ বিশ্বাস, গোঁড়ামি, মানবাতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাদের তীক্ষ্ণধার লেখালেখিই ছিল তাঁদের খুন হবার পিছনের কারণ। এ কারণেই জিহাদি তথা ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী কাপুরুষোচিতভাবে এইসব গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশে অাভ্যন্তরীণ জিহাদি বা ইসলামি জঙ্গি রাজনীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতিরও খুব শক্ত যোগসাজশ রয়েছে, যার আঁচ পাওয়া যায় ইসলামি দেশগুলোর কর্মকাণ্ডে। বিভিন্ন গবেষকও বিষয়গুলো নিয়ে তাদের দিকে বহুবার অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন। তা সত্বেও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকার, রাজনৈতিক দল ও নিরাপত্তা বাহিনীর কেউ-ই এটা দমন করার ব্যাপারে আন্তরিক নয়। জঙ্গিবাদ দমনের পরিবর্তে তারা সবাই মুক্তচিন্তার লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকদের দমনে অধিক মনোযোগী। আর এ কারণে কেবলমাত্র বিরোধী দলই নয়, সরকারি দল তথা খোদ সরকারের মধ্যেও কোন কোনও অংশের সঙ্গে এই ধরনের হত্যা-হামলার যোগসূত্র থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষত বিনা শাস্তিতে, বিনা বিচারে যেভাবে অপ্রতিরোধ্যভাবে খুন ও হামলাগুলি হয়ে চলেছে তাতে রাষ্ট্র এবং সরকারের ভিতরেও এগুলির পৃষ্ঠপোষকতা বা কৌশলী সমর্থন আছে, ব্লগাররা বার বার এমন অভিযোগ করে আসছেন। এইসব হত্যা ও হামলার ঘটনায় লক্ষণীয় ব্যাপার হল- সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, যারা বিভিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে জনমতকে প্রভাবিত করে, তাদেরকে হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু করা। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীদের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও মত-প্রকাশের স্বাধীনতার নামে ভণ্ডামির পরিবর্তে যারা এ দেশে প্রকৃত ধর্ম নিরপেক্ষতার চর্চাকে নূতন একটি মাত্রা দিয়েছিল, তাদেরকে বিনাশ করার মহাপরিকল্পনা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।
মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায় অনলাইন মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে ‘মুক্তমনা ব্লগ’ এর মাধ্যমে সমগ্র বাঙালি কমিউনিটিতে ধর্ম নিরপেক্ষতা, বিজ্ঞান চর্চা, সমাজবিজ্ঞানের চর্চার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অনলাইনে বাঙালিদের মুক্তচিন্তার রেনেসাঁর সূচনা অভিজিৎ-এর মুক্তমনার হাত ধরেই। মুক্তবুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্রে ‘মুক্তমনা’ ব্লগ একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এই ধারার অসংখ্য মানুষ এখন ব্লগ কিংবা ফেসবুককে অবলম্বন করে লেখালেখির মাধ্যমে মুক্তচিন্তা চর্চা করে যাচ্ছেন যা তরুণ প্রজন্মের ভিতর ব্যাপক যোগাযোগ ও প্রভাব বিস্তার করেছে। এই প্রভাবের কেন্দ্রস্থল হল ‘মুক্তমনা’ ব্লগ। স্বাভাবিকভাবেই সবার জানা যে, এই ব্লগের প্রাণপুরুষ ছিলেন অভিজিৎ রায়। আর মুক্তচিন্তার এই যাত্রাকে পথরোধ করা বা আটকে দেয়ার জন্য ইসলামি মৌলবাদী গোষ্ঠী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, ক্ষমতার বাইরে থাকা বিরোধী দল থেকে শুরু করে সমাজের স্বার্থান্বেষী সকল মহলই কম-বেশি জড়িত। এটা পরিষ্কার যে, ইসলামি জঙ্গিদের প্রধান টার্গেট ছিল অভিজিৎ রায় এবং সেই সাথে তাঁকে ও ‘মুক্তমনা’ ব্লগ কেন্দ্রিক গড়ে উঠা একদল প্রতিশ্রুতিশীল ও সম্ভাবনাময় লেখক। এখন দেখা যাচ্ছে, শুধু লেখক-ব্লগার কিংবা তাঁর ঘনিষ্ঠজনই নয়, তারা এখন অভিজিৎ-এর প্রকাশকদেরও হত্যার টার্গেট করেছে। অর্থাৎ এই গোষ্ঠীর কাছে অভিজিৎ-ই প্রধান টার্গেট ছিল। অভিজিৎ-এর কোনও ভিত্তি বা নাম-নিশানা তারা বাংলাদেশে রাখতে চায় না। অভিজিৎ যে লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে গিয়েছিলেন, সে লক্ষ্যকে তারা পুরোপুরি ধ্বংস করতে চায় বলেই এখনো হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশের মতো মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশে যে দেশে শতকরা ৮৯% লোক মুসলিম, সে দেশে নিরীশ্বরবাদী এবং মুক্তচিন্তার মানুষরা নিতান্তই ক্ষুদ্র একটি অংশ। যে অংশের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বা রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের কোন ক্ষমতাই নেই। তারপরও এই ক্ষুদ্র অংশটি কেন জিহাদিদের প্রধান টার্গেট হল সেটাই ভাবনার বিষয়। প্রকৃতপক্ষে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত, যুক্তিবাদী এবং মুক্তচিন্তার মানুষরা লোকবাদী বা প্রকৃত সেক্যুলার বাংলাদেশের আদর্শিক ভিত্তি নির্মাণে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আর সে কারণেই আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলো মুক্তমনা ব্লগার, লেখকদের খুনের পিছনে ছায়া হিসেবে ভূমিকা রাখছে। সেই ছায়ার ভিতরে অনেক বড় বড় শক্তির অস্তিত্বও বিদ্যমান।
বস্তুত ইসলামি জঙ্গি বা জিহাদিদের পরিকল্পনায় ব্লগারদের ওপর সাম্প্রতিক হত্যা ও হামলা, একইসঙ্গে সরকার ও রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা এবং এমনকী এদের প্রতি প্রশ্রয়মূলক আচরণ, ব্লগার-লেখকদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার-নির্যাতনের হুমকি ও হয়রানিমূলক ভূমিকা সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের যে অবিশ্বাস, সন্দেহ ও অনাস্থার জন্ম দিয়েছে তার কারণে ইতোমধ্যেই অনেক মুক্তচিন্তার ব্লগার-লেখক বাংলাদেশ ত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে চলে গেছেন। কেউ কেউ পার্শ্ববর্তী দেশে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছেন; এবং এখনো অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যাবার চেষ্টা করছেন। এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এসকল ব্লগার-লেখকরা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চাকুরী বা উন্নত জীবন কিংবা স্রেফ জীবিকার সন্ধানে পাশ্চাত্যে যাবার সিদ্ধান্ত নেন নি। তাঁরা মূলত নিজেদের নীতি-আদর্শকে রক্ষা করে জীবন বাঁচাবার জন্যই দেশত্যাগ করছেন। তাই তাঁদের দেশ ছেড়ে এভাবে চলে যাওয়াটা অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।
যাই হোক, সংক্ষেপে এই আলোচনায় এটুকু অন্তত বোঝা যায় যে, যারা ধর্ম এবং বিশেষত ইসলাম ধর্মের সমালোচক; তারা এই খুনিদের প্রধান টার্গেট হয়েছে। এবং এই ধরনের খুনের পিছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ধরনের রাজনীতির সংমিশ্রণও বিদ্যমান। আর এ কারণে মুক্তমনা লেখক-ব্লগারদের কাছে বাংলাদেশ এখন এক শ্বাপদের নাম।
অভিজিৎ স্মরণে ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে NorrFika তে প্রকাশিত।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তথা মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপটি ভাল ভাবে উপলব্ধি করা যায়, লেখাটি পড়লে ।কিন্তু এই অমানিশা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? মুক্তমনামুক্তমনা মানুষরা যদি এইভাবে দেশত্যাগে বাধ্য হন, তাহলেইতো মৌলবাদীদের মিশন কার্যত সফল ।আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম !
ধন্যবাদ
সহমত পোষণ করছি
মন্তব্য ও সহমত পোষণের জন্য ধন্যবাদ।
গত বছর ২৭শে ফেব্রুয়ারী(২০১৫) কাগজে মুক্তচিন্তার লেখক অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু সংবাদ দেখে মুক্তমনা ব্লগের খোঁজ করে এই ব্লগে আমার ঢোকা। তখন থেকে আজও প্রয্যন্ত এই ব্লগ ফলো করে আসছি। এরপর ওয়শিকুর রহমান বাবু,অনন্ত বিজয় দাস ও ফয়সল আরেফিন দীপন কয়েকজনকে পরপর হত্যার কাহিনী শুনতে হয়। আমি লেখক নই, তবে মুক্তমনা কিনা তা ও সঠিক ভাবে বলতে পারবোনা। তবে এটা বুঝি যে, প্রত্যেক মানুষের বাক স্বাধীনতা থাকা উচিত এবং তার নিজস্ব মত থাকবে। কিন্তু তার মতবাদ কারো গ্রহণ যোগ্য না হলে, তাকে মেরে ফেলবে।, সেটা কি ঠিক? সুতরাং এরজন্য আরও বৃহৎ তর প্রতিবাদ হওয়া দড়কার।
এই লেখাতে একবারে শ্মত পোষণ করি।
মন্তব্য ও সহমত পোষণের জন্য ধন্যবাদ।
:good:
🙂
লেখকের উপলব্ধীর সাথে সহমত।
সহমত পোষণের জন্য ধন্যবাদ।
দারুন সূচালো তীক্ষ্ণ পর্যানোমূলক লেখাখানি।
সরকার বাহাদুরের কর্তা-ব্যক্তিরা যারা আসলে সরকার চালায় তারা যেন লেখাটি পড়ে।
হুস হবে না জানি।তারপরেও আশা করতে দোষ কি!!!
ধন্যবাদ।