saka

জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত বৃথা যায়নি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছেন একটি স্বাধীন দেশ। আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কলঙ্ক হলো রাজাকার-আলবদর আর কিছু ছদ্মবেশী সুবিধাবাদী রাজনীতির বিষাক্ত কীট। স্বাধীনতার আগে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের খুন করে জাতিকে মেধাশূন্য করে দিতে চেয়েছে ওরা। পুরোপুরি সফল হতে না পারলেও স্বাধীনতার মাত্র তিন বছর আট মাসের মাথায় তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের চরম কলঙ্কজনক অধ্যায়। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দেয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। যে যুদ্ধাপরাধী জানোয়াররা গা-ঢাকা দিয়ে মিশে গিয়েছিল মানুষের ভীড়ে তারা সব পুনর্বাসিত হতে থাকে একে একে এবং সদলবলে। বন্দুকের নলের মুখে বাংলাদেশের সংবিধান ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের ফসল ভোগ করে মুক্তিযুদ্ধকে একেবারে অস্বীকার তো করা যায় না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হতে থাকে। এক পর্যায়ে সাধারণ মানুষের মনে হতে থাকে – রাজাকার আলবদররাই মনে হয় দেশ স্বাধীন করেছিল। নইলে বাংলাদেশের মন্ত্রী কীভাবে হন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরি, আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামীর মতো চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা?

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত এই বিশ বছরে বাংলাদেশকে যুদ্ধাপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছিল। ইতিহাস এমনভাবে বিকৃত করা হয়েছিল যে সেই সময়ে বেড়ে ওঠা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না যে বাংলাদেশে স্মরণকালের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণহত্যা ঘটেছে এবং সেটা ঘটিয়েছিল পাকিস্তানীরা এবং তাদের প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছে রাজাকার-আলবদর। যে জামায়াতে ইসলামী কখনোই বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি – তারা হয়ে ওঠে অনেক তরুণের আদর্শ রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের প্রতিটা সেক্টরে তারা এত বীজ বপণ করেছে যে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে পেরে ওঠা মুশকিল হয়ে পড়ে। তাদের ক্ষমতা এত বেশি ছিল যে তারা নিজেরাও চিন্তা করতে পারেনি যে এমন একদিন আসতে পারে বাংলাদেশে যেদিন তাদের কৃতকর্মের বিচার হবে। তাইতো সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরি প্রকাশ্যে নিজের বুক চাপড়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলতো, “আঁর বাপ রাজাকার, আঁই রাজাকার। হেডাম থাইলে আঁর বিচার গরিস।” অর্থাৎ – “আমার বাপ রাজাকার, আমি রাজাকার। সাধ্য থাকলে আমার বিচার করিস।”

চট্টগ্রামের ত্রাস সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরির উত্থান হতে সময় লাগেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশে যখন রাজাকার-পূনর্বাসনের মহোৎসব চলছিলো তখন স্বরূপে আবির্ভাব সাকা চৌধুরির। তারপর এরশাদের হাত ধরে মন্ত্রী হওয়া। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। চট্টগ্রামের মানুষ এই সাকার কারণে যে কী পরিমাণ অসহায় ছিল তা সবাই জানে এবং জামায়াত-শিবির-বিএনপি ছাড়া আর সবাই বোঝে। বিশেষ করে হিন্দুরা। সাকা চৌধুরি হিন্দুদের তুলনা করতো তার নিজের পুকুরের মাছের সাথে। বলতো – হিন্দুরা তার পুকুরের মাছের মতোই। যখন খুশি যেটা খুশি যেভাবে খুশি ধরে খাওয়া যায়। সকল গণতান্ত্রিক নির্বাচনে যেখানে প্রার্থীরা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে অনুরোধ করে যেখানে হিন্দু ভোটারদের ব্যাপারে সাকার পদ্ধতি ছিল উল্টো। ভোটের আগে তার বাহিনীরা হিন্দুদের ঘরে ঘরে গিয়ে বলে আসতো – তারা ভোট দিতে না গেলেই সে ভাববে যে ভোটটা সাকাকে দিয়েছে। আর দিতে গেলে খবর আছে। হিন্দুরা যেখানে প্রতিনিয়ত খবর হচ্ছে সেখানে নতুন করে খবর হবার সাহস ক’জনের থাকে। সাকার বিচার হোক এটা মনে মনে চাইলেও তার হাতে নিগৃহীত কোন মানুষই আশা করতে পারেনি যে বাংলাদেশে সাকার বিচার হবে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ট্রাইবুনাল যখন গঠন করা হলো তখনো সন্দেহ যায় না ‘ঘরপোড়া গরু’ সাধারণ মানুষের। কাদের মোল্লাকে যখন সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হলো না – সবাই হতাশ হয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করলো যে জামায়াতের সাথে সরকারের আপোষ চলছে। কিন্তু তরুণদের বুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জ্বলে উঠেছে এরমধ্যে। এতদিনের নির্যাতন সওয়া মুক্তিযোদ্ধারা তো আছেনই। আর শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে গণ-প্রক্রিয়া শুরু করে গিয়েছিলেন তা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। তারুণ্যের গণজোয়ার রুখে – সাধ্য কার! শাহবাগ থেকে শুরু হলো ‘গণ জাগরণ মঞ্চ’। সারাদেশ মুক্তিযুদ্ধের নতুন চেতনায় জেগে উঠলো। এই চেতনা ধ্বংসের চেষ্টা করা হলো গুপ্ত হত্যা করে। আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে ‘ব্লগার’ খুনের জোয়ার বইয়ে দিলো যুদ্ধাপরাধীর দোসররা। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না তাদের। বিচারের সবগুলো আইনী ধাপ একে একে পেরিয়ে ফাঁসি হয়ে গেলো কাদের মোল্লার। তারপর কামরুজ্জামানের। তারপর পালা এলো সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরি ও আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের।

পুরো জাতির বহুল আকাঙ্খিত ক্ষণটি এলো ২০১৫ সালের নভেম্বরের ২২ তারিখ। বাংলাদেশের কলঙ্ক কিছুটা মুছলো সালাউদ্দিন আর মুজাহিদের ফাঁসি হবার পর। আমরা সাধারণ মানুষ রায়ের বাস্তবায়নে খুশি। এ ধরনের ঐতিহাসিক রায়ে ঠিক কী কী লেখা থাকে তা পড়ে দেখার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ খুব বেশি মানুষের থাকে না। সংবাদ-পত্রের পাতায় যেটুকু প্রকাশিত হয় সেটুকু পড়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। তার কারণ পূর্ণাঙ্গ রায়ের দুষ্প্রাপ্যতা এবং ভাষাগত সমস্যা। বর্তমান সরকারের তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রসর নীতির কারণে এখন আদালতের রায় সহজেই ডাউনলোড করা যায় আদালতের ওয়েবসাইট থেকে। কিন্তু তারপরও ভাষাগত সমস্যাটা রয়ে গেছে। আদালতের সব রায় এখনো ইংরেজিতেই লেখা হয়। আমি আইনের ছাত্র নই, তাই বাংলাদেশের আদালতের রায় কেন ইংরেজিতে লেখা হয় তা ঠিক জানি না। বিচার ব্যবস্থার কাছে নিশ্চয় এর কোন গ্রহণযোগ্য যুক্তি আছে।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরির যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় একটি ঐতিহাসিক দলিল। এর মধ্যে বর্ণিত আছে তার কৃতকর্মের প্রমাণ। সত্যকে প্রকাশ করার জন্য যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁদের কথাও যেমন আছে, সাকার পক্ষে যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের কথাও আছে। বিচার বাঞ্চাল করার আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের কথাও আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন এই রায়। সাধারণ মানুষ যেন এই রায় পড়তে পারেন সেই উদ্দেশ্যে নিজেদের উদ্যোগে এই মূল্যবান রায়ের বাংলা অনুবাদ করে ফেলেছেন দশ জন তরুণ-তরুণী। আরিফ রহমান, আহমদ রনি, সাব্বির হোসাইন, সুমিত রায়, সুবর্ণা সেঁজুতি, দেব প্রসাদ দেবু, কেশব কুমার অধিকারী, ফরিদ আহমেদ সবাই দেশের প্রতি নিজের মমত্ববোধের কারণে, দেশপ্রেমের দায়বদ্ধতার কারণে এই রায় বাংলায় অনুবাদ করে বই আকারে প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। পাললিক সৌরভ অতি দ্রুত বইটা প্রকাশ করে বইমেলায় নিয়ে এসেছে। এঁদের নিষ্ঠা দেখে শ্রদ্ধার পাশাপাশি আশাবাদীও হয়ে উঠি যে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীরা আর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পাবে না।

এটা যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অনুবাদ সেহেতু এটা আক্ষরিক অনুবাদ। রায়ের বিশ্লেষণ বা বোধগম্যতার বিঘ্ন মাঝে মাঝে ঘটলেও তা কাটানোর সুযোগ অনুবাদক বা সম্পাদক কারোরই ছিল না। সম্পাদনা পরিষদ বইয়ের ভূমিকায় তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ব্যাখ্যা করেছেন তাঁদের উদ্দেশ্য এবং দায়বদ্ধতা। আমি অনুবাদ পড়ার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইট থেকে মূল রায়টিও পড়ে নিয়েছি। পড়তে গিয়ে বুঝতে পেরেছি ২১৭ পৃষ্ঠার এই রায়টি অনুবাদ করতে কী কঠোর পরিশ্রমই না করতে হয়েছে এই বইয়ের সংশ্লিষ্টদের। মূল রায়টি কোথায় পাওয়া যাবে তা বইতে উল্লেখ করা থাকলে উৎসাহী পাঠকের আরো সুবিধা হতো। আমি মূল রায়টি পেয়েছি এখানে:
http://www.supremecourt.gov.bd/resources/documents/700203_Criminal_Appeal_No.122_of_2013.pdf

রায়ের শুরুর দিকেই বর্ণিত হয়েছে ১৯৭১ সালে সাকা চৌধুরির ভূমিকা:
তদন্তকারী সংস্থা অনুসন্ধান কালে যে সব কার্যক্রমের সাথে এ অপরাধীর যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন, তার মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং দেশত্যাগে বাধ্য করা, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে স্বাধীনতার পক্ষাবলম্বনকারী নাগরিক ও হিন্দু সম্প্রদায়কে নির্যাতন, মধ্য গহিরা হিন্দু পাড়া, গহিরা, জগৎ-মোল্লাপাড়া, বণিক পাড়া, সুলতানপুর, রাউজান থানাধীন ঊনসত্তরপাড়া, রাউজান পৌরসভা এলাকা, খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি সংযোগস্থলের তিনরাস্তার মোড়, হাজারী গলি, মোহরা গ্রাম, গুডস হিল, চট্টগ্রাম শহর এবং বৃহত্তর চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকায় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে করা গণহত্যা, অত্যাচার ও বসত-ভিটা, সহায় সম্পদ লুট-পাট ও জ্বালিয়ে দেওয়া সহ অন্যান্য অমানবিক সহিংসতায় সংশ্লিষ্টতার স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছেন।

বিজ্ঞ বিচারকরা জানেন এবং রায়ে স্পষ্ট করেই লিখেছেন: “এই মামলার বিচার ঘটনার ৪২ বছর পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বেশিরভাগ সূত্র এবং আলামত হারিয়ে গেছে সাক্ষীদের মৃত্যুর কারণে। কিছু সাক্ষী দেশ ছেড়েছেন একই ধরনের পরিণতি এড়াতে। অনেক বেঁচে যাওয়া সাক্ষী আসল ঘটনার বর্ণনা থেকে পিছু হটেছেন ভয়ে, কারণ তাদের স্থানীয় এলাকায় নিরস্ত্র লোকদের উপর জঘন্য নৃশংসতার ঘটনা রয়েছে। এছাড়াও অভিযুক্ত ব্যক্তি বর্তমানে একজন ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতা। এজন্য অনেক বেঁচে থাকা সাক্ষীরাও তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার সাহস দেখায় নি।”

তারপরেও সাহস করে সাক্ষ্য দিয়েছেন অনেকেই। প্রফেসর আনিসুজ্জামান সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্য দিয়েছেন অধ্যক্ষ নতুন চন্দ্র সিংহের ছেলে সহ আরো অনেক প্রত্যক্ষদর্শী। সাক্ষ্য প্রমাণে আদালতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল পাকিস্তানি আর্মি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ কুণ্ডেশ্বরীতে প্রবেশ করে। তারা নূতনচন্দ্র সিংহের সাথে কথা বলে ফিরে যাচ্ছিলো। কিন্তু সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকিস্তানি আর্মিদের ফিরিয়ে নিয়ে আসে নতুনচন্দ্রের বাড়িতে। নূতনচন্দ্র তখন প্রার্থনারত ছিলেন। তারা তাঁকে টেনে হিঁচড়ে মন্দির থেকে বের করে গুলি করে। এরপর মৃত্যুপথযাত্রী নূতন চন্দ্র সিংহের মৃত্যু নিশ্চিত করতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজ পিস্তল থেকে আরো দু’বার গুলি করে।

বিজ্ঞ আদালত জানেন যে যারা এই ধরনের অপরাধের সাথে যুক্ত থাকে, তারা তাদের অপরাধের প্রমাণ বিনষ্ট করতে অনেক কিছুই করে। তারা দলিল পোড়ানো থেকে শুরু করে এমনভাবে আলামত নষ্ট করে যাতে অপরাধের সাথে তাঁদের সম্পৃক্ততার অস্তিত্ব কোনোভাবেই প্রমাণ করা না যায়। তারা সাক্ষীদের ভয় দেখানো থেকে শুরু করে সাক্ষীদের খুন পর্যন্তও করে থাকে। তারা এমনকি অপরাধ সংঘটনের স্থান পর্যন্ত ধ্বংস করার চেষ্টা করে থাকে। সাকা চৌধুরি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। সাকা নিজে বিস্তারিতভাবে তার বংশানুক্রম, তার পারিবারিক ঐতিহ্য, তার পরিবারের সাথে বিখ্যাত ব্যক্তিদের, যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মতিলাল নেহেরু, স্যার জাফরুল্লাহ্ খান, এ কে ফজলুল হক, শহীদ হোসেন সোহ্রাওয়ার্দী এবং আরো অনেকের সাথেই সম্পর্কের বর্ণনা করেছে। প্রাণ বাঁচাতে সাকা বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হওয়ার ভানও করেছে। আদালতে দাঁড়িয়ে সে বঙ্গবন্ধু এবং অন্যান্য বাঙালি বুদ্ধিজীবী, যেমন এম এন রায়, চিত্ত রঞ্জন দাশ, জিতেন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসুধন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলামের ভূমিকার প্রশংসা করেছে। দম্ভের সাথে সাকা বলেছে, “আমি জন্মসূত্রে নয়, পছন্দের সূত্রে বাংলাদেশি।”

আদালতে সাকার পক্ষে যেসব আলামত দাখিল করা হয়েছিল সেগুলো ছিল মিথ্যাচারের চূড়ান্ত প্রমাণ। বেশ কিছু হিন্দু মুসলমানের নামে কিছু হলফনামা আদালতে জমা দেয়া হয় সাকার পক্ষে। কার কার নামে হলফনামা জমা দেয়া হয় তা রায়ে উল্লেখ আছে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মৃদুল দে। এই ভদ্রলোক নিজেকে চট্টগ্রামের দানবীর নামে পরিচয় দিতেন। চোরাচালনী করে প্রচুর টাকা-পয়সার মালিক তিনি হয়েছিলেন সাকা সহ আরো অনেকের সাথে হাত মিলিয়ে। সে যাই হোক – হলফনামায় দাবি করা হয় যে তাঁরা অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই চিনতেন; তাঁদের অনেকেই জীবন রক্ষার তাগিদে গুডস হিলে আশ্রয় নিয়েছিলেন; ফজলুল কাদের চৌধুরীর কোনো সন্তানই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন না; গৌরাঙ্গ সিংহ, প্রফুল্ল সিংহ, গোপাল চন্দ্র দাস এবং নির্মল চন্দ্র দাস ভারতে চলে গিয়েছিলেন; মুক্তিযুদ্ধের সময় ডা. শচীন্দ্র লাল চৌধুরী, গোপাল চৌধুরী, হিমাংশু বিমল চৌধুরী, সাগর পাল, জানতি বালা পাল, চপলা রানী এবং প্রভা রানী ভারতে চলে যান; শেখ মোজাফফর এবং তাঁর পুত্রকে সেনাবাহিনীর লোকেরা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়েছিল এবং হাটহাজারি বা রাউজানে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেদের ওপর হত্যা এবং নির্যাতন চালানোর সাথে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জড়িত ছিলেন না। হলফনামায় যারা স্বাক্ষর করেছিলেন তারা সবাই কোন না কোনভাবে সাকার কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছে তা প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া আদালতে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে হলফনামাগুলো সব প্রায় একই সময়ে লেখা এবং একই রকমের বক্তব্যে ভরা। সবগুলো স্ট্যাম্পই কেনা হয়েছে তিন-চারদিন সময়ের মধ্যে এবং এই হলফনামাগুলো নোটারি পাবলিক এম আনোয়ার চৌধুরীর মাধ্যমে সত্যায়িত করা হয়েছে জুন মাসের ১৬ এবং ১৭ তারিখে। এডভোকেট জনাব মোঃ রিদুয়ানুল হক এবং জনাব তৌহিদুল ইসলাম পারভেজ এগুলোকে চিহ্নিত করেন। রায়ে স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে, “এই হলফনামাগুলো দৃশ্যত প্রমাণ করে যে, এগুলো একটা নির্দিষ্ট সময়ে একই লোকজনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিচার প্রক্রিয়ায় বিভ্রান্তি তৈরি করা। হলফনামাগুলোতে বিবৃত বিষয়বস্তু, স্ট্যাম্প, চিহ্নিতকারক, নোটারি পাবলিক, এগুলো বিবেচনা করলে সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, এই হলফনামাগুলো অশুভ উদ্দেশ্য প্রণোদিত।”

এই অশুভ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের চেষ্টার আরেকজন উল্লেখযোগ্য কুশীলব ছিলেন ব্রিটিশ অ্যাটর্নি টবি ক্যাডম্যান। এই লোকটাকে প্রচুর টাকাপয়সা দিয়ে নিয়োগ করেছিলো জামায়াতে ইসলাম। কিন্তু ব্যাটা এমন চোর বাংলাদেশে এসেছিল মিথ্যা তথ্য দিয়ে। ফলে তাকে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। তারপর সে বাংলাদেশের বাইরে থেকে ট্রাইবুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকে। আদালতে প্রমাণিত হয় যে , “জনাব কেডম্যান, মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আসামি পক্ষের একজন বিদেশি আইনজীবী হিসেবে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ চালাচ্ছেন। এই সব হলফনামা তিনিই তৈরি করেছেন তাঁর মক্কেল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে।”

১৯৭১ সালে সাকা দেশে ছিল না প্রমাণ করার জন্য অনেক রকমের জাল দলিলপত্র জমা দিয়েছে আদালতে। একেবারে শেষের দিকে হঠাৎ পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা জাল সার্টিফিকেট জমা দেয় যেটাতে দেখা যায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১৯৭১ সালের মে মাসে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগে স্নাতক (সম্মান) কোর্সে ভর্তি হয় এবং আগস্ট মাসে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করে!!

বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য জামায়াত-বিএনপি বাংলাদেশে মাসের পর মাস পেট্রোল বোমা মেরে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে। সাকার রায় ঘোষণার আগে আদালত থেকে রায়ের ড্রাফ্‌ট চুরি করে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরও বিচারের গতি অব্যাহত থেকেছে। সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী অত্যন্ত বর্বর উপায়ে এবং অত্যন্ত নির্মমতার সাথে অপরাধ সংঘটন করেছে, নিরস্ত্র অসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে, অত্যাচার-নির্যাতন করে নিরীহ লোকদের নিজে গুম করেছে এবং দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকেও সর্বোতভাবে সাহায্য করেছে লোকজনকে গুম করার জন্য। সে বেপরোয়াভাবে লুটতরাজ করেছে এবং অন্য মানুষের সম্পদ ধ্বংস করতে লুটেরাদের সহায়তা করেছে। বিশেষত সে এই ধরনের বর্বর কাজ করেছে হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে এবং তার রাজনৈতিক বিরোধী শক্তিকে ঐ এলাকা থেকে শেষ করার অভিপ্রায়ে।

এতকিছু প্রমাণিত হবার পরেও সাকার ঔদ্ধ্যত্য একটুকুও কমেনি। রায়ে বিচারকেরা উল্লেখ করেছেন, “বিচারের কোনো পর্যায়েই তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য অনুশোচনা এবং অনুতাপ প্রকাশ করেননি, বরং এই আদালতের বিচারকাজকে অবমাননা এবং উপেক্ষা করেছেন। তাঁর হাবভাবকে ট্রাইব্যুনাল দম্ভ হিসাবে দেখেছে এবং বার বার সতর্ক করার পরেও তিনি পুরো বিচার প্রক্রিয়া চলার সময়েই চিৎকার-চেঁচামেচি করে ট্রাইব্যুনালের সৌষ্ঠবকে নষ্ট করেছেন। ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তাদের প্রতি কোনো সম্মান তিনি প্রদর্শন করেননি এবং ট্রাইব্যুনালের কর্তৃত্বকে অমান্য করে গিয়েছেন প্রতিনিয়ত।”

সাকার আস্ফালন কিন্তু শেষপর্যন্ত টিকে থাকেনি। সে সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছে। কিন্তু এই জঘন্য যুদ্ধাপরাধী কি ক্ষমা পেতে পারে? অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য হলে সত্যি যে বাংলাদেশের জেলেই ফাঁসি হয়েছে ঘাতক সাকা চৌধুরির। আর তারই ঐতিহাসিক রায়ের সাবলিল অনুবাদ “যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরির বিচার: রায়ের পূর্ণবিবরণ”।

আমি যে পান্ডুলিপিটি পড়েছি তাতে বেশ কিছু বানান-বিভ্রাট রয়ে গেছে। আশাকরি বইতে সেগুলো সংশোধন করা হয়েছে। মূল রায়ে সাক্ষীদের prosecution witness (P-W) ও defence witness (D-W) হিসেবে উল্লেখ করা হলেও অনুবাদে শুধুমাত্র ‘সাক্ষী’ লেখাতে মাঝে মাঝে পাঠকের বুঝতে অসুবিধে হতে পারে। Exhibit এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘প্রদর্শনী’ লেখা হয়েছে। ওটা ‘আলামত’ হলেই যথোপযুক্ত হতো বলে মনে হয়।

অনুবাদটি উৎসর্গ করা হয়েছে ১৯৭১ সালে, নৃশংস ঘাতক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর হাতে নির্মমভাবে নিহত, নির্যাতিত এবং নিপীড়িত চট্টগ্রামের মানুষদের উদ্দেশ্যে। যে ক্ষতি তাঁদের হয়ে গেছে তা পূরণ হবার নয়। কিন্তু এই ঘাতকের বিচার হওয়াতে কিছুটা হলে সান্তনা পাবেন নির্যাতিতদের আত্মীয়-স্বজন।

একটা জাতির মুক্তির সংগ্রাম কখনো থেমে যায় না। আমি মনে করি এই নিরন্তর সংগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা এই বইয়ের অনুবাদক, সম্পাদক, প্রকাশক সবাই। নতুন যুগের মুক্তিযোদ্ধারা – তোমাদের অভিবাদন।