(প্রথম অংশের পর)
কিন্তু এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ দেখতে কেমন? দেখতে বলতে বোঝাচ্ছি এর গঠন কেমন? আমরা দু’ধরনের তরঙ্গের বিষয়ে পড়ে এসেছি, অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ আর অনুপ্রস্থ তরঙ্গ। অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের ক্ষেত্রে তরঙ্গ মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দনের দিকের সাথে একই দিকে অগ্রসর হয়, আর অনুপ্রস্থ তরঙ্গ মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দন দিকের সাথে সমকোণে অগ্রসর হয়। নিচের চিত্র দ্রষ্টব্য।
শব্দ তরঙ্গ অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ আর আলো বা পুকুরের পানিতে ঢিল ছোঁড়ার ফলে উৎপন্ন তরঙ্গ হলো অনুপ্রস্থ তরঙ্গ। কিন্তু মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এমন নয়। এই তরঙ্গ হল কোয়াড্রুপল তরঙ্গ। এই তরঙ্গের প্রস্থচ্ছেদ করলে তা দেখতে হবে নিচের চিত্রের মতো। এরা স্থানের পর্যায়ক্রমিক আনুভূমিক ও উলম্ব সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে এগিয়ে চলে।
আর সার্বিকভাবে চিন্তা করলে দেখাবে নিচের চিত্রের মতো।
এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আপনার শরীরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করলে আপনার শরীরও প্রথম চিত্রটির মতো একবার লম্বা হবে আবার চওড়া হবে, এভাবে কম্পাঙ্ক অনুযায়ী লম্বা-চওড়া হতে থাকবে যতক্ষণ অবধি সম্পূর্ণ তরঙ্গটি আপনার শরীর অতিক্রম করে যায়। কিন্তু এই লম্বা-চওড়া হওয়ার পরিমান কেমন হবে? আপনার শরীরের মধ্য দিয়ে যদি এধরনের তরঙ্গ বয়ে যায় তাহলে পাশ দিয়ে অতিক্রম করা একজন পথচারী কি দেখে বুঝতে পারবেন যে আপনি একবার লম্বা হচ্ছেন, আবার চওড়া হচ্ছেন? উত্তর হচ্ছে না। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এত এত এত দূর্বল যে এগুলো সনাক্ত করা অতিমাত্রায় কঠিন আর এই কারণেই আইনস্টাইনের বর্ণনা করার পরে ১০০ বছর লেগেছে এগুলো সনাক্ত করতে। এবং এই সনাক্তকরণের জন্য প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, প্রচুর সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে। বিপুল কর্মযজ্ঞ চালাতে হয়েছে। আগেই বলেছি আমাদের সূর্য আর পৃথিবীর জোড়ও পরস্পর আবর্তিত হতে হতে (হ্যাঁ, পৃথিবী যেমন সূর্যের চারদিকে ঘোরে, সূর্যও পৃথিবীর প্রভাবে খুব সামান্য আন্দোলিত হয়, শুধু পৃথিবীর জন্যই নয় সব গ্রহই সুর্যকে সামান্য পরিমান আন্দোলিত করে থাকে) মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। প্রতিনিয়ত স্থানের মধ্য দিয়ে নানাবিধ মহাকর্ষীয় হিল্লোল অতিক্রান্ত হয়ে চলে যাচ্ছে আমরা সেগুলো টের পাই না। কাজেই যত সহজে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বর্ণনা করা গেল তত সহজে এগুলো সনাক্ত করা যাবে না। এর জন্য আমাদের ভাল উৎসের দিকে নজর দিতে হবে।
ভালো উৎসের সন্ধান কিভাবে পাওয়া যেতে পারে? পুকুরে যদি ছোটখাট নুড়ি ছুঁড়ে দেওয়া হয় তাহলে তরঙ্গ তৈরি হবে দূর্বল, আর ভারী কোনো বস্তু ফেললে তরঙ্গও তৈরি হবে শক্তিশালী। একই কথা প্রয়োজ্য মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ক্ষেত্রে। একটি মহাকর্ষীয় ঘটনা যত বেশী বিধ্বংসী হবে, যতো বেশী ভর এতে যুক্ত হবে, যত প্রলয়ঙ্কারী হবে ততোই শক্তিশালী হবে তার নিঃসৃত তরঙ্গ। এই ধরনে সবচেয়ে প্রবল তরঙ্গগুলো উৎপন্ন হতে পারে যখন দুটি নিউট্রন স্টার বা দুটি ব্ল্যাক হোল পরস্পরের মাঝে বিলীন হওয়ার পূর্বে বিপদজনক গতিতে পরস্পরের চারদিকে আবর্তিত হতে থাকে, কিংবা যখন কোনো বিপুল ভরের তারকায় সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয় তখন। এমনকি এধরনের সবচেয়ে তীব্র উৎসগুলো থেকেও যেই তরঙ্গগুলো উৎপন্ন হয় সেগুলো স্থানের সংকোচন-প্রসারণ ঘটায় কেবল ১০^-২১ ভাগ। বিষয়টিকে কিভাবে অনুধাবণ করা যায়?
এধরণের একটি শক্তিশালী মহাকর্ষ যদি পৃথবীর মধ্য দিয়ে চলে যায় তাহলে পৃথিবীর ব্যাসের পরিবর্তন ঘটবে (সংকোচন-প্রসারণজনিত কারণে) এক ন্যানোমিটারের লক্ষ ভাগের একভাগ মাত্র, যা একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ব্যাসের সমান! বুঝতেই পারছেন পৃথিবীর ব্যাস এতো সামান্য পরিমান বাড়ে যেই তরঙ্গ থেকে তা সনাক্ত করা কত মুস্কিল হতে পারে। তবু বিজ্ঞানীরা এই তরঙ্গ সনাক্ত করেছেন খুব চমৎকার উপায়ে। সেটি এখন আলোচনা করব। কিন্তু এই সবচেয়ে শক্তিশালী তথাপি অত্যন্ত দুর্বল মহাকর্ষীয় তরঙ্গ উৎসরণের ঘটনাও সচরাচর ঘটে না। কোনো একটি গ্যালাক্সিতে এধরনের একেকটি ঘটনা ঘটার জন্য কয়েক হাজার বছর অপেক্ষা করে থাকতে হতে পারে। তাই বিভিন্ন দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আগত মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলোর দিকেও নজর রাখতে হবে।
তবে ১৯৯৩ সালে পরোক্ষভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছিলো এবং তার জন্য নোবেলও দেওয়া হয়েছে। যেহেতু তরঙ্গ শক্তি স্থানান্তর করে তাই একটি দ্বৈত নক্ষত্র ব্যবস্থায় এভাবে শক্তি বিকিরণ করতে করতে নক্ষত্রদুটি ক্রমাগত একে অপরের কাছাকাছি চলে আসে এবং তাদের পরিধি ছোট হতে হতে শেষ পর্যন্ত একে অপরের মাঝে বিলীন হয়। যে হারে শক্তি বিকিরণ ঘটে তা হুবহু আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে অনুমিত মহাকর্ষীয় তরঙ্গের শক্তি বিকিরণ হারের সমান, তাই বলা যেতে পারে এই ক্ষেত্রে মহাকর্ষীয় তরঙ্গই উৎসরিত হয়েছে। যদিও এই পদ্ধতিতে তরঙ্গ সনাক্ত হয় না কিন্তু এই ঘটনা মহাকর্ষ তরঙ্গ উৎক্ষেপনের একটি সূচক। অবশ্য এই ফলাফল নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার অবকাশ নেই। আমরা যদি সরাসরি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করতে পারি তাহলে তা নানাবিধ গবেষনা এগিয়ে নিয়ে যাবে। এর মাধ্যমে ব্ল্যাকহোল, নিউট্রন তারকা এমনকি মহাবিশ্বের আদি অবস্থার বিষয়েও অনেক অজানা কাহিনী জানা যাবে।
কিন্তু একটি বস্তুর বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন ভাগের একভাগের কাছাকাছি দৈর্ঘ্যের প্রসারণ বা সংকোচন মাপা খুব সহজ কাজ নয় তাই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্তকরণ অধরা থেকে গেছে দীর্ঘদিন। তবে কিভাবে এই তরঙ্গ সনাক্ত করা যেতে পারে সেই বিষয়ে বিজ্ঞানীদের ধারনা ছিলো বেশ কয়েক বছর ধরেই। এবং এই আইডিয়া থেকেই স্থাপন করা হয়েছে Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory (LIGO)। নাম থেকেই কিছুটা অনুমান করা যায় কিভাবে এখানে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথমতঃ এখানে একটি মাইকেলসন ইনটারফেরোমিটার ব্যবহার করা হয়েছে এবং আলোর উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে লেজার।
LIGO পরীক্ষায় প্রায় সহস্রাধিক বিজ্ঞানী কাজ করেছেন এবং এতে ১ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। স্থানের সংকোচন-প্রসারণ সনাক্তকরার জন্য এই প্রকল্পে দুটি ডিটেক্টর ব্যবহার করা হয়েছে, যার একটি ওয়াশিংটনে এবং অপরটি লুইজিয়ানায় স্থাপিত। প্রতিটি ডিটেক্টর দেখতে L আকৃতির যার একেকটি বাহু চার কিলোমিটার লম্বা। এই দুটি বাহুর সংযোগস্থলে একটি অর্ধভেদ্য দর্পন রাখা হয় যা লেজার বিমকে দুই ভাগে ভাগ করে দুই বাহু বরাবর প্রেরণ করে। চিত্র দ্রষ্টব্য।
প্রতিটি বাহুর প্রান্তে নিক্ষিপ্ত লেজার প্রতিফলিত হয় এবং অত্যন্ত অণুপুঙ্খ পারমাণবিক ঘড়ির মাধ্যমে লেজারের পথ পাড়ি দেওয়ার সময় নির্ধারণ করা হয়। যদি কোনো শক্তিশালী মহাকর্ষ তরঙ্গ এর মধ্য দিয়ে যায় তাহলে L এর দুই বাহুর মধ্যে দৈর্ঘ্যের তারতম্য ঘটতে অতিঅতি অতি সামান্য এবং দুই বাহুর লেজারের আগমনের সময়ে সেকেন্ডের ক্ষুদ্রাংশ তারতম্য ঘটবে। তবে এই তারতম্য এতোই সূক্ষ হবে যে এই ডিটেক্টরকে তাই প্রায় অসম্ভব রকমের সূক্ষতা পরিমাপে সক্ষম হতে হবে। এই তারতম্য হবে একটি প্রোটনের ব্যসের লক্ষ্যভাগের একভাগ। যদি আমরা বাহুর দৈর্ঘ্যকে ছায়াপথ গ্যালাক্সির ব্যসের সাথে তুলনা করি তাহলে দৈর্ঘ্য সংকোচন-প্রসারণের পরিমান হবে একটি ফুটবল মাঠের ব্যসের সমান। তার উপর এই ধরনের সেনসেটিভ স্থাপনায় বাইরে থেকে নয়েজ ঢুকে যেতে পারে খুব সহজে। যেমন: নিয়ন্ত্রন কক্ষে বসে কেউ একটি তালি দিলেও তা যন্ত্রের সিগন্যালে একটি বিক্ষেপ তৈরি করে ফেলতে পারে। এই ক্ষেত্রে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক স্থানে স্থাপিত দু’টি ডিটেক্টর এই সমস্যার সমাধান করবে। ঠিক একই নয়েজ একই সময়ে দুটি ডিটেক্টরে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। একই সময়ে দুটি ডিটেক্টরেরই নিয়ন্ত্রন কক্ষে তালি দেওয়ার সম্ভাবনা বেশ কমই বলা চলে!
দৈর্ঘ্য বিচ্যুতি নির্ণয়ের পদ্ধতিটিও বেশ চমৎকার। বাহুর মধ্যে লেজারের বীমের দৈর্ঘ্য এমনভাবে নির্ধারণ করা হয় যেন স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিফলনের পরে আলোক তরঙ্গগুলো একে অপরের বিপরীত দশায় মিলিত হয়। আমরা জানি বিপরীত দশায় মিলিত দুটি তরঙ্গ একে অপরকে নাকচ করে দেয়। ফলে সার্বিকভাবে ডিটেক্টরে কোন সংকেত পাওয়া যায় না (নিচের চিত্র দেখুন)। কিন্তু যদি বিমের দৈর্ঘ্যে খুব সামান্য বিচ্যুতি ঘটে তাহলে দর্পনে প্রতিফলনের পরে এরা আর পুরোপুরি একটি বিপরীত দশায় মিলিত হবে না। ফলে একে অপরকে নাকচ করতে পারবে না বরং মিলত তরঙ্গের কোনো কোনো স্থানে সংকেতের তীব্রতা তৈরি হবে।
যন্ত্রের কার্যপ্রনালী তাহলে স্পষ্ট হয়ে গেল: স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো সংকেত পাওয়া যাবে না, এবং দৈর্ঘ্য বিচ্যুতি ঘটলে সংকেত পাওয়া যাবে। এই পদ্ধতিতে একটি প্রোটনের ব্যসের ১ সহস্রাংশ দৈর্ঘ্য পার্থক্য পরিমাপ করা সম্ভব। তবে আগেই যেমন বলা হয়েছে বাইরে থেকে খুব সামান্য নয়েজ এই যন্ত্রে বিশাল প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে একটা সুবিধা আছে। আমরা এর প্রস্থচ্ছেদ থেকে জানি এটি যখন একদিকে সংকোচন ঘটাবে তখন তার ৯০ ডিগ্রি কোণে প্রসারণ ঘটাবে। ফলে যখন আমরা একটি বাহুতে সংকোচন পাব অপর বাহুতে প্রসারণ পাব সুনির্দিষ্ট ভাবে। বাইরের গোলমাল এইরকম যথাযথ সংকেত তৈরি করতে পারবে না। তারউপর আগেই বলা হয়েছে দুটি ভিন্ন স্থানে দুটি ডিটেক্টর বসানোয় উভয়ের গোলমাল একই হবে না ফলে কোনগুলো গোলমাল আর কোনগুলো আসল সংকেত তা সহজেই পৃথক করা যাবে। এর বাইরেও ইতালীর ভার্গোতে আরেকটি স্থাপনা রয়েছে যা প্রকৃত মহাকর্ষীয় সংকেত সনাক্তকরণ আরো সহজতর করবে।
এই ধরনের ব্যবস্থাপনা নিয়ে ২০০১ সালে LIGO প্রকল্প যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ২০১০ সাল পর্যন্ত এটি একটি মহকর্ষীয় তরঙ্গও শনাক্ত করতে পারে নি। কারণ এত ব্যবস্থা আর সেনসেটিভিটি সত্ত্বেও মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করার জন্য যে পরিমান সেনসিটিভি প্রয়োজন এর তা ছিলো না। তার উপর এই ধরনের তরঙ্গ উৎসরিত হওয়ার সম্ভাবনাও প্রতিকূল। মহাজাগতিক গবেষণা হতে দেখা যায় এ ধরনের তরঙ্গ উৎসরিত হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক বছরে ১ টি, আর সর্বনিন্ম ১০,০০০ বছরে ১ টি! বোঝাই যাচ্ছে খুবই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে হচ্ছে। ২০১০ সালের মধ্যে কিছু সনাক্ত না হওয়ায় এই প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ২০৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করে এর যন্ত্রপাতি আপগ্রেড করে সেনসিটিভিটি ১০ গুন বাড়ানো হয়। এর অর্থ হলো এটি এখন মহাবিশ্বের ১০০০ গুণ বেশী আয়তনের সংকেত গ্রহণ করতে পারবে। তার মানে হলো রাতারাতি সংকেত পাওয়ার সম্ভাবনা ১০০০ গুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব ঠিকঠাক করে এটিকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে পুনরায় চালু করা হয়। এবং বিভিন্ন সময় এতে সিগন্যাল গ্রহণ করা হয়!
কিন্তু এখানে মজার বিষয় আছে। পুনরায় চালু করার পর প্রকল্পে মাঝে মাঝে কৃত্রিমভাবে সংকেত প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। এর দুটি উদ্দেশ্য। প্রথমতঃ প্রকল্পের কর্মীরা সবাই যেন সতর্ক থাকে সংকেতের বিষয়ে এবং সতর্কতা চর্চা করে, আর দ্বিতীয়ত, কোনটি আসল সংকেত সেটি যেন সবাই বুঝে ফেলতে না পারে। কেবলমাত্র তিনজন ব্যক্তি জানেন একটি সংকেত আসল নাকি নকল। এর কারণ হলো, প্রকৃত সংকেত পাওয়া গেলেও প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিদের ইচ্ছে ছিলো না নতুন বছরের আগে তা প্রকাশ করা। এর কারণ সংকেত সনাক্তকরণে ভুল-ভ্রান্তিও থাকতে পারে। এই ভুল-ভ্রান্তি তদারকি করতে মাসাধিক কাল লেগে যেতে পারে তাই সবদিক নিশ্চিত না হয়ে ফলাফল প্রকাশ করে দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এতকিছুর পরেও সেপ্টেম্বরেই গুজব ছড়িয়ে যায় যে LIGO সত্যিকারের মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করেছে। সেই গুজব যে সত্যি ছিলো তা অবশেষে প্রমানীত হলো।
অসাধারণ বিশ্লেষণধর্মী লেখা..
Gravitarional force এর মাধ্যম কী? কীসের দ্বারা বাধা গ্রস্থ হয়?
Graviatational wave ও Gravitational force যা আমাদেরকৈ পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে টেনে রাখে, কী একই বস্তু ? বা পার্থক্য কী?
স্থান কালের হিল্লোলে G-wave এগিয়ে চলে। Gravitational force কে আমরা force না ধরে স্থান করের বক্রতার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে পারি। এই বিষয়ে প্রথম খন্ডে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা আছে। আরেকবার পড়লে হয়তো বিষয়টি আরো সহজ হয়ে আসবে।
দারুন লিখেছেন ,ধন্যবাদ 🙂 আমার একটি প্রশ্ন হচ্ছে ,গ্রহদের উপবৃত্তাকার কক্ষপথকে আমরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ দ্বারা কীভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি?? :scratch:
আপনাকেও ধন্যবাদ। গ্রহদের উপবৃত্তাকার কক্ষপথকে স্থান-কালের বক্রতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। এই এই বৃত্তাকার পথে ঘোরার সময় স্থান-কালের পর্দায় যে হিল্লোল তৈরি হয় তার ফলে উৎপন্ন তরঙ্গই হলো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। এই বিষয়ে প্রথম খন্ডে একটি ভিডিওসহ ব্যাখ্যা করা আছে। ভিডিওটি দেখবেন এবং তার পরের অংশটুকু ভালোভাবে পড়লে বোঝা যাবে আশা করি।
ভিডিও টি দেখার পর ব্যাপারটা মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে;ধন্যবাদ।আর ভাইয়া ,আপনার অনূদিত ‘পরমাণুর গহীন নিসর্গে’ বইটির সফটকপি কোথায় পাবো দয়া করে বলবেন…
মহাকর্ষ তরঙ্গ প্রমান এটি নিঃসন্দেহে মানব জাতির জুগান্তকারী অগ্রগতি। আইনষ্টাইনের তত্ত্বের ভিত আবারও এক পরীক্ষায় উত্তির্ন হলো। এটি এমন এক জটিল তরঙ্গ যা প্রমানের জন্য প্রযুক্তির ব্যপক উন্নতির প্রয়োজন ছিল। এমনকি আমার কাছে এই পরীক্ষা ত্রুটিমুক্ত ছিল কিনা এখনও সন্দেহ হচ্ছে! প্রতিটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ব্যপক বিশ্লেষন, যাচাই বাছাইয়ের পর স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাই আমার বিশ্বাস ছিল জটিল এই তরঙ্গকে প্রমান করার জন্য জটিল এমন কোন প্রযুক্তি আবিষ্কার করা হয়েছে। তাই এই পরীক্ষার পদ্ধতি জানতে আমি উদগ্রীব ছিলাম।
পরীক্ষাটির থিম ছিল এরকম- কোন বিশেষ লেজার বিম থেকে লেজার অর্ধ প্রতিফলকের মাধ্যমে দুটি পূর্ন প্রতিফলকে গিয়ে আবার একইভাবে ফিরে আসবে এবং পুনরায় ঐ প্রতিফলকের মাধ্যমে রিসিভারে পৌছাবে। প্রেরক প্রতিফলক এবং গ্রাহকের মধ্যকার নূন্যতম দূরত্ব কম বা বেশি হলে গ্রাহক যন্ত্র আলোর বিন্দুমাত্র উজ্জ্বলতা উঠা-নামা শনাক্ত করে বিচ্যুতির মান নির্নয় করতে পারে। সুতারাং গ্রাভিটেশনাল ওয়েভের কারনে যদি এটা হয় তবে নীশ্চিতভাবে গ্রাভিটেশনাল ওয়েভের অস্তিত্ব প্রমানিত হয়। এক্ষেত্রে একশ তিন কোটি আলোকবর্ষ দূরের দুটি ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষের ফলে আলোর গতিতে আগত মহাকর্ষ তরঙ্গকে পরিক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু সংঘর্ষের ঘটনার বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ এবং গ্রাভিটি তরঙ্গ একই সংগে পৃথিবীতে পৌছাবে তাই প্রত্যক্ষ করার সাথে সাথে বিন্দুমাত্র আলোড়ন পরীক্ষাটি প্রমানের জন্য আরো সহজ হয় যা এক্ষেত্রে তা প্রমানিত হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো পরীক্ষালব্ধ অবজেক্ট গুলোর মধ্যকার দূরত্বের তারতম্যের মাপ কিসের সাপেক্ষে করা হয়েছে? এটাতো বস্তুকম্পন বা ভূমিকম্প নয় যে স্থানের সাপেক্ষে তা নির্নয় করা যাবে। গ্রাভিটিশনাল ওয়েভ বলতে আক্ষরিক অর্থে স্থানেরই কম্পন যাতে স্থানের বিন্দুগুলোতে সংকোচন এবং প্রসারনের মাধ্যমে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এবং ঐ তরঙ্গায়িত বিন্দুগুলোর মধ্যে অবস্থানরত সমস্ত পদার্থ, পদার্থের গতি রেখা, আলো সবকিছুরই সমান সংকোচন-প্রসারন এবং বিচ্যুতি হবে। অর্থাৎ স্থানের যে কোন পরিবর্তন তার মধ্যে অবস্থিত সমস্ত কিছুরই পরিবর্তন সমান সময়ে ধ্রুব। আর তাই স্থানের মধ্যে থেকে এই বিচ্যুতির মান সবসময়ই শূন্য থাকে। সুতারাং এখানে স্থান এবং পরীক্ষালব্ধ অবজেক্ট গুলোর মধ্যকার বিচ্যুতির পরিমান ধ্রুব হওয়ায় বিচ্যুতির মানও জিরো। আবার আইনষ্টাইনের বস্তুর উপস্থিতিতে স্থান সংকোচনের তত্ত্বটিও প্রমানিত। আর এটি প্রমানিত হয়েছে আলোর বিচ্যুতি পরিমাপ করে। অর্থাৎ স্থান বক্রতা, সংকোচন-প্রসারনে স্থানের সম বিন্দুতে এবং সমান সময়ে আলোর সমান বিচ্যুতি হয়। এর ফলে স্থানের দৈর্ঘ্য বাড়লে বা কমলেও প্রতিফলিত লেজার একই সময়ে পৌছাবে, সুতারাং লেজারবিমের আলোর যেকোন বিচ্যুতিও এক্ষেত্রে অনির্নেয় থাকবে।
তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব? নাকি ভিন্ন কোন হিসাব নিকাশ রয়েছে অথবা কোন ভিন্ন নকশা? এটি কোন কাকতালীয় ঘটনার পরীক্ষা নয়তো, কেননা ঐ মুহুর্তের পরীক্ষাটি একইভাবে দ্বিতীয়বার সম্ভব নয়।
আপনার প্রশ্ন খুবই যুক্তিযুক্ত। তবে আপনার প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে আছে। যেহেতু গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ সরাসরি স্থানের উপর প্রভাব ফেলে অর্থাৎ স্থান নিজেই সংকোচিত প্রসারিত হয় তাই এটি আলো বা অন্যান্য তরঙ্গ হতে পৃথক। আর স্থানের মধ্য দিয়ে আলোর গতি সুনির্দিষ্ট। তাই স্থান প্রসারিত হলে টানেলের দৈর্ঘ্যই প্রসারিত হবে এর মধ্য দিয়ে যাওয়া লেজার নয়। এই কারণেই আমরা ইন্টারফেরেন্সে ভিন্ন দশা সনাক্ত করতে পারব।
এটি বোঝার জন্য আমরা আরেকটি তুলনামূলক চিত্র চিন্তা করতে পারি। আমরা জানি মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর হতে দূরে সরে যাচ্ছে। এমনকি সরে যাওয়ার গতি যদি পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখা যাবে অনেক ক্ষেত্রে এই গতি আলোর গতির চেয়ে বেশী। এটা কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? আসলে স্থান নিজে আলোর গতির চেয়ে বেশী গতিতে সম্প্রসারিত হতে পারে কিন্তু এর মধ্য দিয়ে চলাচলকারী কোনো কিছু তা পারে না। যেহেতু সময়ের সাথে স্থানের এই সম্প্রসারণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই একসময় আমাদের কাছাকাছি সকল বস্তুই আমাদের কাছ থেকে আলোর চেয়ে বেশী গতিতে সরে যাচ্ছে বলে মনে হবে (আসলে স্থান এই গতিতে প্রসারিত হবে) এবং কোনো বস্তু থেকে নির্গত আলোই আমাদের চোখে এসে পৌঁছবে না। কারণ আলো যেই গতিতে আমাদের নিকট আসতে থাকবে মধ্যবর্তী স্থান তার চেয়ে বেশী গতিতে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে (প্রসারিত হতে থাকবে) এবং নির্গত আলোকে আমাদের চোখ হতে দুরে সরিয়ে রাখতে থাকবে।
“মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ” এর ইংরেজী পরিভাষা কী?
এটাকে ইংরেজিতে Gravitational wave বা G-wave বলা হয়।
মহাকর্ষ তরঙ্গটার মাধ্যম কী? বা কোন পদার্থের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়? বায়ূ বা অন্য কোন গ্যাসীয় পদার্থ? নাকী শূণ্য স্থান? এটা বাধা গ্রস্থ হতে পারে কোন পদার্থের দ্বারা।
বলা যেতে পারে স্থান কাল নিজেই এর মাধ্যম। স্থান-কালকে যদি আমরা একটি কাপড়ের সাথে তুলনা করি স্থুল ভাবে, তাহলে স্থানকালে যেই ভাঁজ পড়ে (ripple বা হিল্লোল) বিভিন্ন বস্তুর গতির তথা ঘুর্ননের প্রভাবে সেটি তরঙ্গাকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এটি আমরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গাকারে উপলব্ধি করি।
অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ: ও অনুপ্রস্থ তরঙ্গ: এর ইংরেজী পরিভাষা কী?
সুন্দর বর্নণা হয়েছে। ধন্যবাদ।
পরে আরো পড়তে হবে।
লিংক রেখে দিলাম।
এই দুটি তরঙ্গের ইংরেজি যথাক্রমে logitudinal wave এবং transverse wave.
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।