কালিয়াচকের দাঙ্গার এত ছবি-এত আস্ফালন চারিদিকে-এই প্রবন্ধটা লিখতে বাধ্য হলাম।

মালদহের ওই দাঙ্গা নিয়ে লিখছি না। লিখছি-কিশোর বয়সে নদীয়া মুর্শিদাবাদ বর্ডারে দাঙ্গার অভিজ্ঞতা নিয়ে। কারন এই পরজীবি কোলকাতাবাসীদের ন্যাকামো আর সহ্য করা যাচ্ছে না।
সেটা বোধ হয় ১৯৮৬ বা ৮৭। আমি ক্লাস সেভেন এইটে পড়ি।

আমার বাড়ি ছিল করিমপুরে। এটা বর্ডার এরিয়ার স্মাগলিং টাউন। তুলো চিনি প্রতিদিন পাচার হত বাংলাদেশে। মুসলমানরা বাংলাদেশ-ভারত বর্ডারে মাল-এপার -ওপার করে । হিন্দুরা তাদের বিজনেসে টাকা খাটায়। এমনিতে স্মাগলাররা ভাই ভাই। কিন্ত বাটোয়ারা নিয়ে বাওয়াল হলে দুচার পিস লাশ থানায় ঢোকে।

এইভাবে এক হিন্দু ব্যবসায়ীর লাশ ফেলল একদিন। মোস্ট লাইকলি লোকটা স্মাগলিং এ টাকা খাটাত-আমাদের করিমপুরের খরে নদী পেরিয়েই মুর্শিদাবাদ। সেখানে ১০০% মুসলিমদের বাস। লোকটার বোধ হয় টাকা মার গেছিল-সে আদায় করতে গিয়ে ঝগড়া বা কিছু একটা গন্ডোগল হয়-এবং কিছুদিন বাদে বক্সীপুরের গ্রামগুলো থেকে তার গলাকাটা লাশ উদ্ধার । ফলে প্রাথমিক ভাবে একটা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কিছুদিন ধরে শহরে চলছিল। এদিকে করিমপুর শহরে যারা দিন মজুর, বিজনেসে ডেইলি লেবার-তারা সবাই মুসলমান এবং আসে ওপার থেকেই। করিমপুর শহরে আবার একটাও মুসলিম নেই। আমাদের সময় তিন হাজার দোকান ছিল-একটা মুসলমানের দোকান ও দেখি নি। ফলে শহরের মধ্যে মুসলিম লেবাররা ছিল ভালনারেবল। এই উত্তেজনা চলার তিন দিনের মাথায়-করিমপুর শহরে কোথাও জনাচারেক মুসলিম লেবারকে পেটানো হয়-ওই খুনের প্রতিশোধ হিসাবে। ওই সময় ওখানে আর এস এস বা হিন্দুদের কোন সংগঠন ছিল না।

সেই চারটে লোক কোন রকমে নদী পেরিয়ে পালিয়ে যায় প্রাণে বেঁচে। বাকী লেবারাও সেদিন পালিয়েছিল। কিন্ত পরের দিন পুরো উত্তেজনা হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার রূপ নেয়।

এদিকে আমাদের বাড়ি হচ্ছে নদীর ধারে। যেদিন প্রচুর গন্ডোগল হচ্ছে-বাড়ির তিনতালার ছাদের উঠে দেখি-যদ্দুর চোখ যায় নদী পেরিয়ে পাটক্ষেত্রে শুধু লোক আর লোক -লাঠি, হেঁসো নিয়ে নদীর ওপারে দাঁড়িয়। আমার ধারনা অন্তত দশ হাজার লোক লাঠি আর হেঁসো নিয়ে ওপারে আস্ফালন করছে। এপারে দুই জীপ পুলিশ। বলা বাহুল্য লোকগুলো নদী পার করা শুরু করলে-ওই কটা পুলিশে কিছু হত না। আমাদের পালাতে হত। বাড়ি পুড়ত। না পালালে, আমাদের লাশ পড়ত। আমি সাধারনত ভয় পাওয়ার পাবলিক না। তবে সেদিন বেদম ভয় পেয়েছিলাম। কারন নদীর ধারে বাড়ি হওয়াতে প্রথম কোপটা আমাদের বাড়ির ওপরেই আসত।

তবে সেই দাঙ্গা থামে সিপিএমের হস্তক্ষেপে। ততক্ষনে এপার আর ওপারের বিধায়করা এসে গেছেন। ডোমকল আর করিমপুরের বিধায়ক সিপিএম হওয়াতে লাভ হয় এই যে উনারা পরিস্থিতি সামাল দেন। এরপরে অবশ্য এমন বাজে অবস্থা কোনদিন হয় নি। পার্টি ম্যানেজ করত দুই সাইড।

কিন্ত টেনশন ছিল পাক্কা একবছর । বাবার স্কুল ছিল মুর্শিদাবাদে-বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে । কিন্ত সাইকেলে যেতে হত মুসলিম অধ্যুশিত গ্রাম পেরিয়ে। এইপার থেকে তিনজন হিন্দু শিক্ষক যেতেন। তাদের লাশ হওয়ার সম্ভাবনা তখন প্রবল। সেই জন্যে বাবারা ১০ মাইল ঘুরে যেতেন স্কুলে। প্রায় একবছর । সব থেকে দুর্ভাগ্য-বাবা ওই জোনেই পার্টি করেছেন সিপিএমের জন্মদিন থেকে। কিন্ত বাবার সিপিএম বন্ধুরাই পরামর্শ দিয়েছিল ঘুরে যেতে। কারন একজন বদলোকই লাশ ফেলার জন্য যথেষ্ঠ। আবার প্রায় একমাস ধরে ওপার থেকে মুসলিম লেবারদের এপারে আসা বন্ধ ছিল। যা আস্তে আস্তে খোলে।
না। এসব ঘটনা কোনদিন কোন পেপারে আসে নি। সেকালে ফেসবুকও ছিল না।

তবে ওই দশ হাজার লোক লাঠি আর দা নিয়ে কোপাতে আসছে-সেই দৃশ্য ভুলবো না। সেই জন্য আমার কাছে দাঙ্গা বাস্তব-ভীষন রকমের বাস্তব।

কোলকাতার বাবুরা বা বুদ্ধিজীবিরা চিরকাল পরজীবি। তারা বামপন্থী? এগুলো ভুল্ভাল ধারনা। বৃটিশ আমলে তারা ছিল বৃটিশ অনুগ্রহের দাস। ১৯৭৭ সালে সিপিএম যখন জেতে গোটা রাজ্যে-কোলকাতায় সিপিএমের ফল ভাল হয় নি। কোলকাতা আস্তে আস্তে বাম হয়েছে যখন বামেরা ক্ষমতায় গিয়ে, অনুগ্রহ বিতরন শুরু করেছে। কোলকাতার বুদ্ধিজীবিরা শ্রেফ পাওয়ার আশাতে বাম ছিল। এখন পাওয়ার আশাতে মমোপন্থী। যেদিন বিজেপি আসবে ক্ষমতায়-কোলকাতার সংখ্যাগরিষ্ঠ বুদ্ধিজীবির আলখাল্লার রঙ গেরুয়া হবে। এখন যারা ” এই ইসলামফোবিয়া ভালো নয়” বলছেন ( ওই শান্তিনিকেতনী স্টাইলে এই গরু সরে যা না )-বিজেপি ক্ষমতায় এলে, তারাই দেখবেন বলছে-বাট আপনারা কি দেখতে পারছেন না শান্তির ধর্মের লোকেদের উৎপাত?

তাই এইসব কলকাতাবাসী বুদ্ধিজীবি পরচুলাগুলোকে ফেলে দিতে হবে সামনের দিকে তাকাতে গেলে। মোদ্দা কথা হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে সমস্যা আছে স্বীকার করতে হবে। মুসলিম প্রধান এলাকাতে হিন্দুদের বাস করা অসম্ভব এবং হিন্দু প্রধান এলাকাতে মুসলিমদের ঘর ভাড়া দেওয়া হয় না-এগুলো করুন বাস্তব। সিপিএমের ৩৪ বছরে সাম্প্রদায়িকতা চাপা দেওয়া হয়েছিল । কমে নি। কারন ধর্মের ভিত্তিতে আঘাত হানতে ভয় পেতেন কমরেডরা । পাছে ভোটাটা হারন। এখন অবশ্য আম এবং ছালা-দুটোই হারিয়েছেন তারা।
ধর্মকে আঘাত না করতে পারলে কিছু হবে না। ইসলাম আরবদের ট্রাইবাল কালচার-আবার হিন্দু ধর্মের অতীত ও সেই ট্রাইবাল কালচার। ইসলাম ভাল মানলে, ইসলামের প্রফেটের লুঠতরাজ , ৮০ টি যুদ্ধ, যৌনদাসী রাখা-সব কিছুই ভাল হয়ে যায়। মানছি সেকালে ওগুলো ছিল আরবের প্রথা। কিন্ত একালের মুসলমানেরা যে সেই আদিম আরব সমাজের আইনে বিশ্বাস রাখে এটাও ত বাস্তব! যে ধর্মের নবীই ৮০টা যুদ্ধ করেছেন বিধর্মীদের বিরুদ্ধে, সেই ধর্মের লোকেরা অস্ত্র ধরবে না? ইয়ার্কি নাকি? ঠিক তেমন হিন্দু ধর্ম ভাল-এটা মানলে জাতপাতের অত্যাচার সহ আরো অনেক মনুবাদি সংস্কারকে ভাল বলে মানতে হয়। এবং এই যে লোকে এত বেদ বেদ করে। কোন হিন্দু ঋক বেদ পড়ে নি। ঋক বেদের অনেক ছত্রেই আর্য্যদের উস্কে দেওয়া হয়েছে অনার্য্যদের ওপরে লুঠপাট করার জন্য। দুই ধর্মের ভিত্তিতেই যেখানে দাঙ্গা, যুদ্ধ, হিংসা-সেখানে তারা পাশাপাশি থাকলে দাঙ্গাত হবেই। দুই ধর্মেই দাঙ্গা লাগানোতে এলাহি সমর্থন আছে। থামাবেন কি করে? এই ধরনের গোঁজামিল দিয়ে হিন্দু মুসলমানের ঐক্য হবে না।

বৈদিক হিন্দু ধর্ম এবং ইসলাম-এই দুটোই বাঙালীর জীবনে, বহিরাগত। বাঙালীরা যেদিন বুঝবে, তাদের পূর্বপুরুষদের একটা উন্নত ধর্ম ছিল-যা বৈদিক বা ইসলাম না। যা আউল বাউলে গানে মুখরিত করত বাংলার মাঠ, ঘাট, নদী-সেই সহজিয়া ধর্মের স্বাদ যেদিন প্রতিটা বাঙালী পাবে-অনুভব করবে, তারা হিন্দু বা মুসলমান না-গর্বিত বাঙালী-সেইদিন সাম্প্রদায়িকতার ভূত এই সমাজ থেকে নামবে। স্পেডকে স্পেড বলা শিখতে হবে। সিপিএমের ৩৪ বছরের ব্যর্থতা থেকে কবে শিখব আমরা? সাম্প্রদায়িকতা দূর করার একটাই রাস্তা-হিন্দুত্ব, ইসলামিৎ ছেড়ে শুধু ভাষাতে না-জীবন দর্শনেও বাঙালী হতে হবে।