‘আমাদের লক্ষ সেনানী প্রস্তুত হচ্ছে ইসলামের পবিত্র এই ভূমির আনাচে কানাচে। আমাদের প্রস্তুতি শেষের প্রায় চূড়ান্ত। যে কোনো দিন খেলাফত কায়েমের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বো আমরা।’ সৌদি ওয়াহাবি পয়সা পুষ্ট, মুসলিম ব্রাদারহুড মগজ পুষ্ট বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামের জঙ্গি শাখা ‘আনসারুল্লাহ বাংলা’ টিমের লেখা চিঠির শেষাংশ। চিঠি জুড়ে অনেকগুলো নির্দেশনা, যেই নির্দেশনাগুলোকে আইন হিসেবে মানার দাবী, দাবী না মানলে পরিণতি- আনসার বাংলার ভাষ্যে, যারা মানবে না তাদের ‘শির লুটাবে ইসলামের সেনানিদের পদতলে’

অনেকগুলো কারণেই আজ বাংলাদেশে আপনার শির লুটাতে পারে ইসলামের সেনানিদের পদতলে। আপনি যদি একজন নিয়মিত সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা-রাতে গৃহত্যাগী চাকরিজীবী নারী হন তাহলে আপনাকে চাকরি দেবার জন্য আপনার অফিসের উঁচু, উঁচু সব ভবনকে ধুলো হয়ে যেতে হতে পারে, আপনাকে চাকরি দেবার অপরাধে অফিসের সবার শির লুটাতে পারে। আপনি যদি সাংবাদিক নারী হন তাহলে ঘর থেকে বের হয়ে চাকরি করার অপরাধের পাশাপাশি সাংবাদিকতা অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে এবং অপরাধ জেনেও চাকরি, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে ঘরে গিয়ে বসে না থেকে চতুর্থ অপরাধে অপরাধী হয়ে গেলে আপনার কপালে থুক্কু মাথার পেছনে কি কি খারপি আছে সেই ভাবনাটা আপনাকেই ভেবে নেবার উপদেশ দিয়েছে আনসার বাংলা। আবার আপনি যদি অঞ্জলি দেবীর মতো একজন শিক্ষক হন, যিনি একই সাথে ঘর থেকে বের হয়ে জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে হিজাব পরার শিবিরীয় আন্দোলনে চিন্থিত হয়ে পড়েছিলেন ‘হিজাববিদ্বেষী’ হিসেবে তাহলে আপনার সাথে আর কথা নেই। সকালে আপনি যখন বের হবেন তখন আপনাকে পেছন থেকে দেখে নেওয়া হবে। আপনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক একেএম শফিউল ইসলামের মতো মানবতাবাদী, সঙ্গীত, দর্শন, ইতিহাস প্রেমী হতে পারেন কিন্তু একই সাথে যদি হয়ে যান ‘হিজাববিদ্বেষী’ তাহলে ইসলামের সেনানিদের কাছে আপনার একটাই ফয়সালা- পেছন থেকে জবাই। আর সাধারণ মানুষের কাছে- দুষ্ট লোকটা লোকটা আস্ত একটা ‘ইসলাম বিদ্বেষী’।

সোশ্যাল মিডিয়া, ওয়াজ মিডিয়া ইত্যাদি নানা মিডিয়ার কল্যাণে আমরা জানি, ইসলামের সেনানীরা সবাই নুনূর্ষু। নুনূর্ষদের কর্মজীবী নারীদের ভালো লাগার প্রশ্নই আসে না, তাই তাদের খেলাফতে নারীদের জন্য একটাই ফয়সালা। মতিকণ্ঠের ভাষায়, তারা থাকবে রুটি বেলার কাঠে, কাপড় কাচার ঘাটে, রাইতের বেলা খাটে। অর্ধেক জনগোষ্ঠীর ফয়সালা শেষে এবার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দৃষ্টি দিলো আনসারুল্লাহর চিঠি। ব্লগারদের ফয়সালা। ব্লগ নানা ধরণের হতে পারে আমরা জানি। শব্দটির উৎপত্তি (web log) থেকে, সেখান থেকে We Blog, সেখান থেকে Blog, ব্লগ থেকে ব্লগার, সেই ব্লগার সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে যখন আসলো বৃহত্তর জামায়াত ইসলামের চাপাতি শাখার কাছে ততদিনে তার সংজ্ঞা পালটে গেছে। আপনি অনেক কিছুই নিয়ে ইন্টারনেটে লিখতে পারেন, আপনি চটি লিখতে পারেন, জুতা নিয়ে লিখতে পারেন, ধর্ম নিয়ে লিখতে পারেন, আপনি সকাল বেলার প্রাকৃতিক কর্মের রঙ নিয়ে লিখতে পারেন, ফুল-ফল-লতা-পাতা নিয়ে লিখতে পারেন, রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে লিখতে পারেন, লিখতে পারেন বিজ্ঞান, দর্শন কিংবা সাহিত্য নিয়ে। তবে আনসার বাংলা সার্টিফাইয়েড ব্লগার আপনি তখনই হবেন যখন আপনি লিখবেন বিজ্ঞান নিয়ে, কুসংস্কার নিয়ে, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার নিয়ে, আপনি লিখবেন সামাজিক অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে। এইসব নিয়ে লিখলে অবধারিত ভাবেই আপনার লেখায় চলে আসতে পারে জামায়াত ইসলামের কথা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে আপনার অবস্থানের কথা, বাংলাদেশকে ছিনতাই করে পাকিস্তান বানানোর অপচেষ্টার কথা। ব্যাস! আপনি হয়ে যাবেন একজন আনসার বাংলা সার্টিফাইয়েড ব্লগার। হজ করলে যেমন হাজি হয়, উপরে উল্লেখিত সার্টিফিকেট পেলে আপনি হবেন একজন, আনসার বাংলার নতুন চিঠির ভাষায়- ফেসবুক, ব্লগসহ যে কোনো মাধ্যমে যে আল্লাহ, নবী, রাসুল, সাহাবি, ওলামায়ে কেরাম, মাদ্রাসার শিক্ষক, ধর্মপ্রাণ মুসলমান, উম্মুল মোমেনিনদের চরিত্র দিয়ে প্রশ্ন তোলা, বাজে কথা বলা ব্লগার। আপনার কল্লা তখন আল্লাহর সম্পত্তি, আল্লাহর সম্পত্তি মানে আজরাইলের সম্পত্তি, আর যেহেতু আজরাইল একা সারাবিশ্বের নাস্তিকদের কল্লা গ্রহণে সময় করে উঠতে পারছে না তাই আনসার বাংলা ভাষায়- ‘আপনার আজরাইল হিসেবে রাব্বুল আলামিন তাদের প্রেরণ করবেন। সুযোগ পাওয়া মাত্র ইসলামের বীর সেনানিরা তাদের কতল করবে।’ হুমকি পড়ার সময় মনে হলো, ফেসবুক, টুইটার, ইমেইল বা বোলগ যেই মাধ্যমেই হোক না কেনো আল্লাহর সাথে আনসারুল্লাহর সরাসরি যোগাযোগ আছে। আল্লাহই তাদের চাপাতি, লাল পাঞ্জাবি পরিয়ে, বাসার ঠিকানা দিয়ে কতল করতে প্রেরণ করেন। ঠিক যেমন ইসলামের হেফাজতকারী হিসেবে আল্লাহর থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে তিনি নিয়োগ করেছেন, মাওলানা শফিকে, দিয়েছেন বাংলাদেশের ইসলামের হেফাজতের দায়িত্ব। জানি না, আপনারও একই কথা মনে হলো কিনা।

Bangladesh-Atheist-Blogger-Killed-as-Fears-of-Radical-Islamism-Grow

তা তেল, গেস, বিদ্যুতের অভাবময় বাংলাদেশে ব্লগাররা কেনো আজ আজরাইলের রাডারে? শাহবাগ আন্দোলনের জন্য? ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির পাঁচ তারিখে জামায়াত ইসলামের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বর্তমানে মরহুম আবদুল কাদের মোল্লাকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা, ধর্ষণ ও ঢাকার মিরপুর এলাকায় গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার আলবদর বাহিনীর সদস্য হিসেবে ৩৪৪ জন নিরীহ মানুষকে হত্যার অভিযোগ আমলে নিয়ে, ১৯৭৩ এর ২০(৩) ধারা অনুযায়ী প্রমাণসাপেক্ষে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। রায় শোনার পর প্রতিবাদী গুটিকয়েক মানুষ শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবীতে দাঁড়িয়ে যান, এইরকম হরেক রকম বিষয় নিয়ে প্রতিদিনই জাদুঘরের সামনে কেউ কেউ কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু ফেব্রুয়ারির সেই পাঁচ তারিখ বিকেলটার এই ক্ষুদ্র প্রতিবাদ সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে। ফেসবুকে, সকল মিডিয়ায় খবর রটে গেলো- ব্লগাররা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবীতে শাহবাগে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন, চলো সবাই। ‘ব্লগাররা’? কাদের মোল্লার ফাঁসির পরে আমি অবশ্য কোনো ব্লগেই কোনো আন্দোলনের ডাক শুনি নি, সব ডাক ফেসবুকে শুনলাম, কিন্তু বাংলাদেশের স্মরণ কালের সবচেয়ে বড় স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণের ডাক দিয়েছেন ফেসবুকরা শুনতে খারাপ লাগে, তারচেয়ে ব্লগাররাই সই। কার্জন হল থেকে বেরিয়ে, বইমেলা হয়ে যখন শাহবাগে এলাম ততক্ষণে হাজার মানুষের ঢল শাহবাগে, ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই। যেহেতু ততদিনে আমিও প্রায় ছয় বছর বয়স্ক ব্লগার, যুদ্ধাপরাধীদের দাবীতে সোচ্চার লেখালেখি, কর্মকাণ্ডে তাই উঁকি দিয়ে দেখতে গেলাম এমন স্বপ্নের এক জাগরণের ডাক দেওয়া ব্লগারদের দেখতে। কয়েকজন পরিচিতকে দেখলাম। তবে দেখলাম হাজার মানুষের স্রোত, যারা ব্লগিং কি, ব্লগার কি কিছুই জানেন না, শাহবাগের মোড়ে প্রতিবাদ জানাতে ছুটে এসেছেন এক ঘৃণ্য অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে।

ততক্ষণে সব টেলিভিশন চ্যানেল তাদের সকল অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে চলে এসেছে। মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত শাহবাগ। অনলাইনে ছাগু পেটানোর দিন শেষ। আজ আমরা রাস্তায়। মিটিং, মিছিল, স্লোগানে আমি কখনই ঠিকমতো অংশ নিতে পারি না। শুধু দেখতে ভালো লাগে। তাছাড়া কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় না হওয়ায় প্রচণ্ড হতাশা লাগা সত্ত্বেও, যে ট্রাইব্যুনাল নিয়ে তিন বছর ধরে উঁচু গলায় কথা বলে এসেছি এখন মনমতো রায় না পাওয়ায় ‘খেলবো না’ বলতেও মন সায় দিচ্ছিল না। তবুও শাহবাগে ছিলাম। শাহবাগ থেকে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবী না মানা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো। মহা সমাবেশের ডাক দেওয়া হলো সাত তারিখে। সাত তারিখ সারাদিন আমাদের কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের গাজীপুরের একটি রিসোর্ট ভোজন। ছয় তারিখ রাতে বন্ধুবান্ধবদের সাথে রওনা দিলাম গাজীপুরে। রাতভর আড্ডা-বাজি শেষে পরের দিনের প্রোগ্রামকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। কারণ বিকালের মহা-সমাবেশে যোগদান। ভোর রাতেই শাহবাগ চলে আসার কারণ রিসোর্ট ভোজনের সকালের খাবার যাবে ঢাকা থেকে, সেই খাবার গ্রহণ করতে মাইক্রোবাস ঢাকা আসবে। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে শাহবাগ পৌঁছলাম। এবং শাহবাগে ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই স্লোগানে কিছুটা বিব্রত আমার সব বিব্রতভাব কেটে গেলো সাত তারিখ ভোরে শাহবাগে পা দিয়ে। তখনও হাজার খানেক মানুষ রাস্তায় অবস্থান করছে, সেই ভোর রাতেও মাইকে স্লোগান বাজছে। শুধু ফাঁসি চাই, আর ফাঁসি চাই না, স্লোগান হচ্ছে- ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ চাই, জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ চাই, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই। মাইক্রোবাস থেকে আমি যেনো এক স্বপ্নপুরীতে পা দিলাম, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যে বাংলাদেশ গড়তে চাই, আজ সেই বাংলাদেশ আমার সামনে। এতো সহজে!

আমরা বাংলাদেশিরা আবেগ তাড়িত, তাই সবকিছু সহজে হয়ে যাবে মনে করে ফেলি। কিন্তু সহজে তো হয় না। শাহবাগের কন্ট্রোল থেকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হলো এবং পরে বাধ্য করা হলো শুধুমাত্র কাদের মোল্লার ফাঁসি চাওয়ার দাবীতে একাত্ম থাকতে, তবে অল্প অল্প করে জামায়াত শিবির নিষিদ্ধের স্লোগানও দেওয়া যাবে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ চাই- এই স্লোগান- কখনই না। পাঁচ দিন যেতে না যেতেই প্রথম পাঁচদিন যেই ব্লগাররা গণজাগরণের ঘোষক হিসেবে পেপার পত্রিকায়, টিভি মিডিয়ায় জায়গা পাচ্ছিলেন তাদের অনেককেই কন্ট্রোল থেকে বের করে দেওয়া হলো। প্রথমআলোর সিনিয়র একজন সাংবাদিক যিনি আবার একজন নামকরা ব্লগারও তাকে মঞ্চেই উঠতে দেওয়া হলো না। কতো বড় অপমান দেখো দেখি! শাহবাগের প্রথম পাঁচদিনের জোয়ারে সারা বাংলাদেশ ভেসে গেলেও জামাতি ফান্ডিং এ জন্ম নিলো বাঁশের কেল্লা। হিংস্র হয়ে উঠলো ‘আমার দেশ’। শাহবাগে জড়ো হওয়া সবাইকে ফ্যাসিবাদী আখ্যা দেওয়া হলো এবং কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে প্রচারিত হতে থাকলো ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগাররা ইসলাম ধ্বংসের জন্য শাহবাগে জড়ো হয়েছে, তারা নাস্তিক! জামায়াত ইসলাম হয়ে গেলো শুধু ইসলাম, জামায়াত ইসলাম বিদ্বেষীরা হয়ে গেলো ইসলাম বিদ্বেষী।

পত্রিকা, মিডিয়ায় ব্লগারদের গণজাগরণের ঘোষক উপাধি দেওয়া হলো বটে কিন্তু শাহবাগের কন্ট্রোল পয়েন্ট ততদিনে ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের দখলে। কারণ একটা আন্দোলন চালাবার মতো সাংগঠিক শক্তি ব্লগারদের নেই, থাকার কথাও না, মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোরই আছে। তবে যতদিন বাহবা ছিলো ততদিন সব ভালোই ছিলো। বুঝি পাম তাও তো আরাম। একই সাথে বাঁশের কেল্লা, আমার দেশ থেকে পামের বদলে অনবরত প্রপাগান্ডা চলতে লাগলো ব্লগারদের নিয়ে। দুই একজন ব্লগার যারা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন ততদিনে তাদের মঞ্চে জায়গা শেষ, মিডিয়াতেও জায়গা শেষ। রথী মহারথী ব্লগাররা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ প্রাঙ্গণে এক গোপন সমাবেশ ডাকলেন করণীয় নিয়ে। যথারীতি সেখানে গেলাম, করনীয় সম্পর্কে নিজের গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করার জন্য অবশ্যই নয়, কয়েকজনের ফোন পেয়ে। রথী মহারথীদের অনেকেই তখন তাদের কথা না শোনার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, মঞ্চের ছিনতাই হয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বললেন, আমাদের আমার মঞ্চ দখল করতে হলে কী করতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করলেন, এবং বললেন- ব্লগারদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শাহবাগ হচ্ছে, এটা ব্লগারদের আন্দোলন নয়, সারা বাংলাদেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, সেখানে একটা নির্দিষ্ট গ্রুপকে চিন্থিত করার মাধ্যমে তাদের টার্গেট করে ফেলা হচ্ছে। শাহবাগের মূল্য ব্লগারদের দিতে হবে।

সামহোয়ারিন, সচলায়তন, মুক্তমনা, আমার ব্লগ সহ বাংলাদেশের প্রতিটি কমিউনিটি ব্লগের প্রতিনিধি সেখানে থাকলেও ছিলেন না ‘গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক’, ‘ব্লগার’ আহমেদ রাজীব হায়দার। কারণ রাজীব ভাইয়ের চাপাতির কোপ খেতে তখনও সাতদিন বাকি। তার সাথে আমার পাঁচ তারিখে পরে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়েছে শাহবাগে। চায়ের দোকানে বসে একা একা চা খাচ্ছেন। তখন রাজীব ভাইকে কেউ পাত্তা দিতো না, এমনকি নাস্তিকরাও না। রাজীব ভাই যেচে পড়ে বরঞ্চ কথা বলতে আসতেন সবার সাথে। এমনই একদিন কথা হচ্ছিলো। রাজীব ভাইয়ের উপস্থিতে কয়েকজন নাস্তিকরা বিরক্ত হলেও সেদিনের বিকালটায় আমি যেন চোখ বন্ধ করলেই চলে যেতে পারি। শাহবাগের এই তীব্র উত্তাল সময়ে একটা গ্রুপ তৈরি হলো যারা শাহবাগ আন্দোলনকে ‘নেক্সট লেভেলে’ নিয়ে যেতে আগ্রহী। তারা মগবাজারে জামায়াতের কার্যালয় আক্রমণ করবে। রাজীব ভাই তখন সেই গ্রুপের একজনকে বললেন- ওদের সাথে আমাদের সেক্ষেত্রে পার্থক্য থাকবে কোথায়!

তারপর আবার রাজীব ভাইয়ের দেখা হলো চারুকলার ছাদে। শহীদ রুমী স্কোয়াড শাহবাগের বুকে জাহানারা ইমামের ৩০ ফুট বাই ১৫ ফুটের একটা বিশাল পোট্রেট স্থাপন করার পরিকল্পনা নিলো। চারুকলার ছাদে এই পোট্রেট আঁকা হচ্ছিলো। পোট্রেট আঁকাতেই কাজ শেষ নয়, শাহবাগ চত্বরে সেটা বসাতে হলে কাঠামো তৈরি করতে হবে। সামিয়া সেই গ্রুপে কাজ করছিলো, আরও কাজ করছিলেন রাজীব ভাই। ১৩ই ফেব্রুয়ারি রাতে বেহালার করুন সুরে জাহানারা ইমামের সেই ছবি উন্মোচিত করা হলো শাহবাগের বুকে, লাখ মানুষের হৃদপিণ্ডে। শাহবাগের জোয়ার তখনও পূর্ণদ্যোমেই চলছে। আমরা বসে আছি এক কোণায়। সামিয়ার এক সহপাঠি এসেছে শাহবাগে ছবি তুলে ফেসবুকে জানান দিতে। প্রতিকৃতি উন্মোচনের সময় ও জিজ্ঞেস করলো, জাহানারা ইমাম কি এসেছেন?

সেরাতে জাহানারা ইমামকে শাহবাগের বুকে বসিয়ে রেখে শহীদ রুমী স্কোয়াডের সদস্যদের সাথে রওনা দিলাম সদরঘাট থেকে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে, লঞ্চে সুন্দরবনের ভেতর ঘুরে ঘুরে ক্লান্তি বিসর্জন দেবার পরিকল্পনা নিয়ে। চৌদ্দ তারিখ ভোরে খুলনা থেকে সুন্দরবনের কাছাকাছি কোনো এক জায়গায় আমাদের লঞ্চটা একটা নৌকা অতিক্রম ছিলো। সেই নৌকায় এক মাঝবয়সী মাঝি গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছে- ফাঁসি, ফাঁসি, ফাঁসি চাই, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই। আমরা সুন্দরবনে গেলাম। রাজীব ভাই গেলেন নিজের বাসায়। পনেরো তারিখ গভীর রাতে, আমরা মাঝ নদীতে, লঞ্চের ছাদের বসে যখন শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা গোনার সংগ্রাম করছিলাম তখন ঢাকা থেকে মোবাইলে ফোন এলো। রাজীব ভাইকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে বাসার সামনে। রাজীব ভাইকে হারাবার আগে আমি জীবনে অনেককেই হারিয়েছি, আমার দাদা-দাদুকে, নানীকে, আমার একমাত্র খালুকে কিন্তু রাজীব ভাইকে হারিয়ে আমি যেনো আমি যেনো আমার জীবনে প্রথম কাউকে হারাবার তীব্র বেদনায় আচ্ছন্ন হলাম। সামিয়া অনেক কাঁদলো, কাঁদলাম আমরা সবাই। রাজীব ভাই নেই আর।

লাশের রাজনীতিতে আমাদের জুড়ি নেই। রাজীব ভাইয়ের লাশের রাজনীতিও শুরু হয়ে গেলো তার মৃত্যুর সাথে সাথেই। তাকে যারা মেরেছে তারা অনেকদিন থেকেই রাজীব ভাইকে টার্গেট করে রেখেছে, তবে স্বীকারোক্তি অনুযায়ী রাজীব ভাইয়ের বাসা চেনার জন্য তারা তার পিছু নিয়েছিলো শাহবাগ থেকে। রাজীব ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুতে সারা বাংলাদেশ হতভম্ব হয়ে গেলো যদিও হতভম্বতা কাটতে বেশিক্ষণ লাগলো না। অনলাইনে বেরিয়ে গেলো তার লেখা! সেই লেখা গুলোয় রাজীব ভাই ধর্মকে নিয়ে কৌতুক করেছেন, তিনি অনেক ধর্ম নিয়েই কৌতুক করতেন কারণ তার কাছে ধর্ম ছিলো কৌতুকের উৎস। সব ধর্ম নিয়ে কৌতুকের পাশাপাশি রাজীব ভাই ইসলাম ধর্ম, ইসলাম ধর্মের আল্লাহ, ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদকে নিয়েও কৌতুক করেছেন। সবকিছু নিয়ে কৌতুক করা গেলেও ইসলাম ধর্ম কৌতুকে ভীত, তাই বাংলাদেশের মুসলমানরা যখন রাজীব ভাইয়ের লেখার সম্মুখীন হলেন ‘আমার দেশ’ সহ সকল জামায়াতি পত্রিকার বদান্যতায় তারা শোক ভুলে আনন্দিত হয়ে উঠলেন। নবীকে নিয়ে খারাপ কথা ক্যানো বলেছে রাজীব! বাকি অংশটা উহ্য। কান পাতলে সেই উহ্যতার মধ্যে থেকে ভেসে আসে ঠিকই একটা বাক্য- জবাই হওয়া ঠিকই আছে।

গণজাগরণ মঞ্চও তাই ভাবলও। তারাও মেনে নিলো, নবীকে নিয়ে কৌতুক করলে এমন পরিণতি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে করে লাশের রাজনীতিতে শাহবাগী ব্যাপারটা থাকে না আর। তাই রাজীব ভাইকে বানানো হলো গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক, বিখ্যাত ব্লগার ও সেরা অনলাইন একটিভিস্ট। একই সাথে বলে দেওয়া হলো রাজীব জীবনেও ধর্ম, ইসলাম, আল্লাহ, নবীকে নিয়ে কটাক্ষ ও দুরের কথা কোনোদিন টু শব্দও করেন নি। তাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ আখ্যা দেওয়া হলো। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ইসলামী শহীদ হবার যোগ্যতা অর্জন করলেন শাহবাগের এক কোণায় একা একা চা খাওয়া রাজীব ভাই।

কিন্তু রাজীব ভাই তো সত্যিই সেই লেখাগুলো লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন কিভাবে ধর্মের নামে মানুষকে জবাই করা হয় তা নিয়ে, লিখেছেন ধর্মের নামে কিভাবে নারীদের নির্যাতন করা হয়, লিখেছিলেন ধর্মের নামে কিভাবে অন্ধকার বাজারজাত করা হয়। সেই লেখা তিনি লিখেন নি বলে শাহবাগের নেতারা কী অর্জন করতে চেয়েছিলেন জানি না, তবে যাই চেয়ে থাকেন তারা এটা জানি যে কিছুই অর্জন করতে পারেন নি। আরিফ আর হোসেনের মতো ছাগুরা অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক আর শাহবাগে যেতে হবে না, শাহবাগ নিয়ে কথা বলতে হবে না, ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ‘চল্লিশ বছর’ আগের অপরাধের বিচার চাইতে হবে না, ফেসবুক কভার ফটো দিতে হবে না, শাহবাগের প্রোফাইল পিকচার দিতে হবে না। কারণ শাহবাগ ইসলাম বিদ্বেষীদের জায়গা। নিজের ফাঁদের শুধু পা নয় একেবারে ডাইভ দিলো শাহবাগ। আমিও যেনো সাত তারিখের ভোর বেলার স্বপ্ন ভেঙ্গে সম্বিত ফিরে পেলাম। বাংলাদেশ তার আগের জায়গাতেই আছে।

একুশে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শাহবাগের অবস্থান কর্মসূচির সমাপ্তি টানা হলো। শুধু যদি কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবীতেই শাহবাগের গণজাগরণ হয়ে থাকে তাহলে সেই জাগরণ সম্পূর্ণ সফল অবশ্যই। কিন্তু আমার কাছে শাহবাগ ছিলো অনেক বড়, আমার কাছে শাহবাগ ছিলো অসাম্প্রদায়িক, পাকিস্তানি ভাইরাস জামায়াত মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলন, এক কাদের মোল্লার ফাঁসিতে সেই আন্দোলনের ফলাফল নির্ধারিত হয় না। তবে ফলাফলের দিকে যাত্রা অবশ্যই শুরু হয়। গণজাগরণ মঞ্চ স্তিমিত হবার পর পরেই এবং রাজীব ভাইয়ের লেখালেখি ছড়িয়ে এবার জামায়াত ব্লগারদের দিকে মনোযোগ দিলো। বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের মাধ্যমে ব্লগার এবং গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মীদের তালিকা করা হলো, তাদের ইসলাম বিদ্বেষী ট্যাগ দিয়ে, নবী কটুক্তিকারী উপাধি দিয়ে শুরু হলো গুপ্ত হত্যা। আল্লাহর পক্ষ থেকে মাওলানা শফির কাছে হটলাইনে ফোন এলো ইসলামের হেফাজত করার জন্য ব্লগারদের কি-বোর্ড থেকে। উত্থান হলো হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশের।

তারপর থেকে নাস্তিক ব্লগারদের কথা সরকারের আর মৌলবাদীদের মুখে মুখে। বাংলাদেশে একদল নাস্তিকদের উদ্ভব হয়েছে, যাদের একমাত্র কাজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইল, ল্যাপটপ খুলে ইসলাম ধর্মকে কি-বোর্ড দিয়ে আক্রমণ করা, দুপুরের খাবারের শেষে নবীকে কটাক্ষ করা, রাতে ঘুমানোর আগে ইসলাম বিদ্বেষের ঘুমের ওষুধ পোস্ট করা ব্লগে। তাদের কি-বোর্ডের আক্রমণে সারাদেশে আহত হওয়া শুরু হলো অসংখ্য ধর্মানুভূতির, অফিসের যাবার পথে মোবাইল খুলে ফেসবুকে ঢুকলেই ধর্মানুভূতি আহত হয়ে এমন অবস্থা হয়ে যেতে লাগলো যে সরকার থেকে আইন করে ধর্মানুভূতিকে আঘাতের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য শুরু হলো ব্লগারদের ইন্টারনেট মডেম, ল্যাপটপ সহ আটক করা, বড় বড় মন্ত্রীরা ধর্মানুভূতিতে যারা আহত হবে তাদের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানোর কথাও ভাবা শুরু করলেন, নিদেন পক্ষে চিন্তা করলেন বাংলাদেশ একটা চৌদ্দ কোটি সিট বিশিষ্ট ধর্মানুভূতি হাসপাতাল তৈরির কথা!

শাহবাগের থেকেই কী আনসার বাংলা নামে জামাতের প্রগতিশীল বাংলাদেশকে ধ্বংস করার যুদ্ধ শুরু হলো? রাজীব ভাইকে কি জামাত মেরেছে। অবশ্যই। তাকে কী শাহবাগ আন্দোলন বানচাল করার জন্য পরিকল্পনা করে মেরেছে? আমার মনে হয় না। ২০১২ সালে আমার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কেন্দ্রিক সেনা কর্মকর্তা/সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের সন্তানদের একটা উগ্র গ্রুপের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। যারা নিজেদের আল-কায়েদা বলে পরিচয় দিতো, আনওয়ার আল আওলাকি ভিডিও দেখতো সারাদিন, সেটা নিয়ে আলোচনা করতো, কিভাবে মায়ের রান্না ঘরের জিনিসপত্র দিয়ে বোমা তৈরি করা যায় সেটার ভিডিও বাংলায় অনুবাদ করতো, সৌদি আরবের সাথে মিলিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যেতো বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এক মসজিদে, শুক্রবারের নাম পড়তে যেতো মিরপুর দশের আরেক মসজিদে। সেখানে যেয়ে নাস্তিকদের মেরে ফেলা ওয়াজিব সেই বয়ান শুনতো, মসজিদে গিয়ে তারা ব্লগ পড়তো। ২০১২ সালে আমি এদের কথা জানলেও ২০১২ তেই তো তারা জন্ম নেয় নি, জঙ্গিবাদের চর্চাও ২০১২ সালে শুরু হয় নি। বন্যাপা তার ভলতেয়ার লেকচারে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কথার মধ্যে একটা কথা বলেছিলেন- ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে এক অভূতপূর্ব মুসলিম আত্মপরিচয়ের উদ্ভব হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাদ দিয়ে “আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা” এবং “গণতন্ত্র” বাদ দিয়ে সামরিক শাসন স্থাপিত হয়। এতকিছুর পরেও আমার মনে আছে, সেই আশির দশকে যখন আমরা কিশোর ছিলাম তখনকার বাঙালি মুসলিমরা বেশ উদারমনা ছিলো, অন্তত বর্তমানের তুলনায়। কিন্তু ধীরে ধীরে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলেছে, বাংলাদেশে উত্থান হয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদের।

আবার ফিরে যাওয়া যাক আনসার বাংলার চিঠিতে। বিদেশে অবস্থানরত নয়জন এবং দেশে বসবাসরত ছয়জন ব্লগারের নাম তুলে দিয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘‘যারা বিদেশে আছেন তাদের দেশে ফেরার সাথে সাথে আর যারা দেশের অভ্যন্তরে গা ঢাকা দিয়ে আছেন তাদের সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথে হত্যা করা হবে।’

‘এই মর্মে হুঁশিয়ারি প্রদান করা যাচ্ছে যে, দেশ কিংবা বিদেশে পালিয়ে থাকা নাস্তিকদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে কেউ যেন নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকে না পড়েন। নইলে পরিণতি হবে নিলয় নীল কিংবা ওয়াশিকুর বাবু, অভিজিৎ রায়ের মত। একটি নাস্তিককেও বেঁচে থাকতে দেওয়া হবে না। এদের হত্যা করা আল্লাহ রাসুলের বিধান মতে ওয়াজিব।’

লেখালেখি করার জন্য নাস্তিকদের জবাই করা হবে এই মর্মে ঘোষণা দিয়ে গণমাধ্যমে সতর্ক করে বলা হয়েছে, যারা জবাই করবে তাদের কিছু বলা যাবে না, তাদের নিয়ে লেখালেখি করা যাবে না। ‘আপনারাও যদি নাস্তিক্যবাদীর সহায়তাকারী হন তবে কাউকে ছাড়া হবে না। আপনাদের বাক স্বাধীনতা যদি আমাদের বেঁধে দেয়া সীমা না মানে তবে আমাদের ক্রোধ প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রত্যেক সংবাদ মাধ্যম যেন প্রস্তুত থাকে।’

এই হুমকির আলোকে কয়েকটা জিনিস স্পষ্ট। প্রথমত, ইসলাম ধর্মের নাম নিয়ে যে কেউ আল্লাহর সাথ সরাসরি যোগাযোগের কথা বললে সেটাতে ইসলামের মূল নীতির কোনো বিরোধীতা হয় না। রাজীব ভাই, অভিজিৎ দা, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত দা, নীলকে জবাই করলে সেটা সহিহ ইসলামই থাকে, কারণ তাদের মৃত্যুর পর মৃত মানুষের ইসলাম বিদ্বেষ নিয়ে যে পরিমাণ আলোচনা হয়, যেভাবে ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলে প্রচারণা চালানো হয় সেভাবে একবারও বলা হয় না যেই ইসলামের যেই ইউটোপিয়ান শান্তির কথা বলা হচ্ছে সেটা শান্তি নয়, বরঞ্চ অশান্তি, সমৃদ্ধি নয় বরঞ্চ অবদমন, আলো নয় বরং অন্ধকার। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কোথাও মিছিল হয় না, কেউ বলে না, তাদের ইউটোপিয়ান শান্তির ধর্ম আজ অশান্তির হাতিয়ার। উলটো নীল হত্যার পর আমাদের পুলিশ প্রধান কথা বললেন- ধর্মানুভূতি নিয়ে। বললেন, যারা ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে তাদের নাম তার কাছ জমা দিতে। তিনি শায়েস্তা করবেন। আর তিনি না পারলে আনসারুল্লাহ তো আছেই।

আরও একটা ব্যাপার চিঠিতে উঠে আসলো সেটা হচ্ছে বাক-স্বাধীনতা। ইসলামি বাক-স্বাধীনতার সংজ্ঞা অনুযায়ী ইসলাম ধর্ম ছাড়া বাকি সব ধর্মকে প্রতি মুহূর্তে গালাগালি করা যাবে, অন্য ধর্ম পালন করলে শুধু গালাগালি নয়, গলাগুলিও কাটা যাবে, সকল দেব-দেবতাকে নিয়ে হাসি তামাশা করা যাবে, তাদের মিথ্যা বলা যাবে, কিন্তু আল্লাহকে নিয়ে কিছু বলা যাবে না, সকল ধর্মপ্রচারককে কটাক্ষ করা যাবে, শুধু যাবে না মুহাম্মদকে নিয়ে কিছু বলা। আনসার বাংলার এই চিঠিতে তারা লেখালেখির জন্য মানুষকে মেরে ফেলার হুমকি দিতে পারবে, নারীদের ঘরের মধ্যে বন্দি করার দাবী জানাতে পারবে এইটা ইসলামি বাক স্বাধীনতার সীমার মধ্যে। কিন্তু যেই আপনি বলবেন, কেনো মানুষকে মেরে ফেলা হবে, কেনো নারীদের গৃহবন্দি করা হবে তাহলেই আপনি বাক-স্বাধীনতার ইসলামি সীমা অতিক্রম করে ফেলবেন, আল্লাহ আনসার বাংলাকে বলে দিয়েছেন তিনি সীমা লংঘনকারীদের কল্লা চান, আর পুলিশ প্রধানকে বলেছেন জেল-হাজত।

বিডি নিউজের এই চিঠির খবরে প্রাসঙ্গিক ভাবেই বলা হয়েছে, সরকার বলেছে বাংলাদেশে আইএস বা এ ধরণের কোনো জঙ্গিদের তৎপরতা নেই। তা তো নেই! ২০১২ সালের যেই গ্রুপটার কথা বললাম সেই গ্রুপের একজন এখন সিরিয়াতে আইএস এর হয়ে জিহাদ করছে, এই বছর আমার কলেজের এক বড় ভাইকে ধরা হলো আইএস এর এজেন্ট হিসেবে, তিনি এক রাত ডিবিতে থেকেই তার সকল সাঙ্গ-পাঙ্গ সবার নাম ঠিকানা, তার টাকা পয়সার সোর্স, তার ইসলামিক স্টেটের জন্য জিহাদি সংগ্রহের সব তথ্য বলে দিলেন। কিন্তু তিনি বললে কী! বাংলাদেশের শুনতে হবে তো! বাংলাদেশ শুনবে না, কারণ বাংলাদেশে জঙ্গি নেই। বাংলাদেশে আনসার বাংলা নেই, আল-কায়েদা নেই, আইএস নেই। অভিজিৎ দা কিংবা জাপানি নাগরিক কুনিও হোসি ইহুদিদের পয়সা খেয়ে নিজেই নিজেকে হত্যা করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে চেয়েছেন।

আনসারুল্লাহ বাংলার চিঠিতে স্পষ্ট করেই তারা বাংলাদেশকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত। তাদের আক্রমণের বিষয়বস্তু পড়লেই বোঝা যায় তারা কেনো বাংলাদেশকে আক্রমণ করবে, করে বাংলাদেশকে তারা কি বানাতে চায়। শুধু চিঠি লিখেই তারা কাজ শেষ করে না, তারা কাজটাও করে দেখায়। একের পর এক ঘোষণা দিয়ে তারা প্রগতিশীল মানুষদের ইসলামের নামে হত্যা করছে, বোমা হামলা করা করছে, ব্যাংক ডাকাতি করছে অর্থ সংগ্রহের জন্য, বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করছে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে সরকারকে বিপদে ফেলতে তারপরও আমাদের সরকার ‘ভাবমূর্তি’ রক্ষার খাতিরে বলেই যাচ্ছে নেই দেশে কোনো জঙ্গি নেই। শুধু কী সরকারের দোষ? সরকার তো দেশের মানুষের প্রতিনিধি। সকল ক্ষেত্রে না হলেও অন্তত এই ক্ষেত্রে তারা সত্য প্রতিনিধি, কারণ দেশের আপামর মানুষ, বুদ্ধিজীবী বেশিরভাগের কাছেই তো জঙ্গিবাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। ব্লগাররা খুন হলে তারা তাদের লেখাকে দোষ দিয়ে আনসার বাংলার কর্মকাণ্ড হালাল করে দেন, শিক্ষক হত্যার পর পরকীয়ার অভিযোগ এনে তার খুনকে জায়েজ করে দেন, হেফাজত ইসলামের বিরোধিতা করে বুয়েট ছাত্র খুন হলে তাকে ছাত্রলীগ বলে সেই খুনকে হালাল করে দেন।

সরকার থেকে শুরু করে ৯০% মুসলমান এভাবে আসল শত্রুকে আড়াল করে ঝোপঝাড়ে কোপান কেনো তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ভয় এবং লোভ। সরকারের গদি টলার ভয়, সাধারণের বেহেশত লসের ভয়, নিদেনপক্ষে চাপাতির ভয়, মূল ধারার মিডিয়াগুলোকে আলাদা চিঠি পাঠিয়ে ভয় দেখার দরকার নেই, তারা আগে থেকেই ভীত। চোখ বন্ধ করে আমরা মনে করে যাচ্ছি কিছুই হচ্ছে না আমাদের চারপাশে। এমন চলতে থাকলে এই চোখ বন্ধ অবস্থাতেই প্রলয় আমাদের গ্রাস করবে, ইতিহাস তাই বলে। তাই চুপ করে না থেকে, ইসলামের দোহাই দিয়ে প্রতিবাদ না করে আমরা যদি আনসার বাংলা ওরফে জামাত ইসলামের ঘোষিত এই যুদ্ধকে এড়িয়ে চলি, যারা প্রতিবাদ করে তাদের নাস্তিক বা ইসলাম বিদ্বেষী ভেবে দায়িত্ব শেষ করি তাহলে আমরা তাদের পক্ষেই কাজ করলাম। বাংলাদেশে আনসার বাংলা, আল-কায়েদা, জামাত, আইএস সবই আছে, কিন্তু তাদের সংখ্যা সীমিত। যদিও অগণিত চুপ করে থাকা মানুষের সংখ্যা। এই মানুষেরা না জাগলে বাংলাদেশে আর সকাল হবে না। হয়তো তারা অন্ধকারেই থাকতে চান, কিন্তু তার আগে অন্ধকার দেখতে কেমন হয়, ইসলামি খেলাফত দেখতে কেমন হয়, সেটা দয়া করে গুগল করে দেখে নিবেন।

রায়হান আবীর
২২ অক্টোবর, ২০১৫