(সাক্ষাৎকারটি ১লা আগষ্ট ২০১৫ তারিখে নিউজনেক্সটবিডি ডটকম এ প্রকাশিত হয়। মুক্তমনার সম্পাদকের অনুমতিক্রমে এখানে পুনঃপ্রকাশিত হলো।)

সৈয়দ জামাল, ব্রাসেলস: বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার হত্যাকাণ্ডের বিচারের ক্ষেত্রে ‘প্রধানমন্ত্রীর আচরণ’ প্রশ্নবিদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন প্রবাসী ব্লগার ওমর ফারুক লুক্স।

খোদ জার্মানিতে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের প্রাণনাশের হুমকির মুখে থাকা এই স্যাকুলার ব্লগার নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’কে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। মুক্তমনা ব্লগার দম্পতি ওমর ফারুক লুক্স ও ফারজানা কবির স্নিগ্ধা এখন রয়েছেন সার্বক্ষণিক জার্মান পুলিশের পাহারায়।

ওমর ফারুক লুক্স বলেন, ‘বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার খুনের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং প্রশ্নবোধক। অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু এবং অনন্ত বিজয় দাশ খুন হবার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার সরকারের পক্ষ থেকে কোন বিবৃতি দেয়া হয়নি, নিহত ব্লগারদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো হয়নি, এমনকি খুনীদের গ্রেফতারের ব্যাপারেও সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা বা তৎপরতা দেখা যায়নি। উপরন্তু, অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী পুত্রের বক্তব্যে একের পর এক ব্লগার হত্যায় সরকারের সমর্থন এবং মৌলবাদীদেরকে উৎসাহ প্রদানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।’

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরো বলেন, ‘একের পর এক ব্লগার হত্যা, এবং খুনীদেরকে গ্রেফতারে সরকারের ব্যর্থতা বা বিচারহীনতার সংস্কৃতি অবশ্যই দেশের মানুষের মুক্তচিন্তা এবং জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ভয়ঙ্কর হুমকিতে ফেলেছে। তার ওপরে আইসিটির ৫৭ ধারার মতো একটি ব্লাসফেমি আইন জারি করে সরকার একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের চিন্তার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। অথচ আমরা জানি, জনগণের মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পূর্ব শর্ত।

তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামের প্রধান আল্লামা শফী দেশের নাস্তিকদেরকে হত্যা করা ওয়াজিব বা বৈধ বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করার পর সরকার তার বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তার সংগঠনকে ৩২ কোটি টাকা মূল্যের সরকারি জমি প্রদান করে পুরষ্কৃত করেন। যা দেশের মৌলবাদীদেরকে প্রকাশ্যে নাস্তিক হত্যায় বিরাট উৎসাহ প্রদান করেছে এবং দেশের মুক্তচিন্তার ও স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে কয়েকশত বছর পিছিয়ে দিয়েছে।’

মুক্তচিন্তা চর্চার কারণে বাংলাদেশের জঙ্গিরা এখন খোদ জার্মানিতে তাদের জন্য প্রাণনাশের হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জানিয়ে ব্লগার লুক্স বলেন, ‘আমার এবং আমার স্ত্রী স্নিগ্ধার নাম এবং আমাদের অবস্থান উল্ল্যেখ করে বাংলাদেশ থেকে মৌলবাদীরা ব্রিটেনের মৌলবাদীদের সঙ্গে জার্মানিতে এসে আমাদেরকে হত্যা করার সম্ভাবনা নিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আলোচনা করছিলো। এ লক্ষ্যে তারা জার্মান সালাফি মৌলবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার ব্যাপারে ব্রিটেনের মৌলবাদীদের সহযোগিতা চেয়েছিলো। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড বিষয়টি জানতে পেরে জার্মান পুলিশকে অবগত করে এবং আমাদের দুজনের নিরাপত্তার ব্যাপারে জার্মান পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে আমাদের শহরের জার্মান পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি আমাদের জানিয়ে সতর্ক করে, এবং আমাদের নিরাপত্তা সম্পর্কিত কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আমরা নিরাপদেই আছি এবং পুলিশের পরামর্শানুযায়ী অনলাইনে এবং অফলাইনে সব সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করছি।’

‘লেখালেখির কারণে ব্লগারদের খুন হতে হবে কেন? ব্লগাররা কী আসলেই ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানছে?’ এমন প্রশ্নের জবাবে ওমর ফারুক লুক্স বলেন, ‘যুক্তিবাদী এবং বিজ্ঞানমনস্ক ব্লগাররা ধর্মান্ধদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানছে, কথাটি মিথ্যে নয়। তবে কথাটি আমি এভাবে বলতে চাই, ঈশ্বরের অস্তিত্বের ভাবনা, মানুষের মধ্যযুগীয় পৌরাণিক বিশ্বাসকে ভুল বা মিথ্যে প্রমাণ করে- ব্লগারদের এ ধরনের যুক্তিবাদী এবং বিজ্ঞানভিক্তিক লেখা পড়ে ধর্মান্ধরা সব সময়ই আঘাত পায়। আর তা শুধু সাম্প্রতিক কালের ঘটনা নয়, বিজ্ঞানী, দার্শনিক আর যুক্তিবাদীদের লেখা পড়ে ধর্মান্ধদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগার ঘটনা হাজার বছরের ইতিহাসে লাখ লাখ উদাহরণ আছে।’

‘মহাবিশ্বের পৌরাণিক রূপ বদলে দিয়েছেন হাইপেশিয়া, কোপারনিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন। যাদের সবগুলো তত্ত্বের আবিস্কার বা উদ্ভাবনই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে। এই মহান জ্ঞানী বিজ্ঞানীরা যারা বিশ্বের সকল পৌরাণিক বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ অবাস্তব অবৈজ্ঞানিক বা ভুল বলে প্রমাণিত করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ উঠেছিল। শুধু তাই নয়, ধর্মনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে হত্যা করা হয়েছিল হাইপেশিয়া, জর্দানো ব্রুনোকে। এবার ভাবুন, এই মহান মানুষগুলো যদি তখন ধর্মানুভূতিতে আঘাত না হানতেন তাহলে আজ আমরা কোথায় থাকতাম? তাই আমি মনে করি, একটি সমাজের মানুষের মধ্যে ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার দূর করার জন্য ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার বিকল্প নেই। আঘাত ছাড়া বিশ্বের কোন সভ্য দেশ বা সমাজই কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তি পায়নি। বিজ্ঞান আর যুক্তির চর্চ্চা ছাড়া কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতা দূর করার আর কোন উপায় কি আপনাদের জানা আছে? এ প্রশ্নের জবাব চমৎকারভাবে দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আজাদ স্যার তার ”ধর্মানুভূতির উপকথা” প্রবন্ধে।’

বাংলাদেশে মুক্তমনা ব্লগারদের নিরাপত্তায় সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে উল্লেখ করে ওমর ফারুক লুক্স বলেন, ‘ব্লগারদের নিরাপত্তায় সরকারকে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন হতে বা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। বরং ব্লগারদেরকে হয়রানি, তাদের মুক্তচিন্তা বন্ধ করতে এমনকি ব্লগারদের নিরাপত্তাহীনতার জন্য ভয়ঙ্কর কিছু উদ্দ্যোগ নিতে সরকারকে দেখা যাচ্ছে।’

‘২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজীব হায়দার খুন হওয়ার পর সাতজন খুনীকে গ্রেফতার করা হলেও সে হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া এখন কোন অবস্থায় আছে- তা আমরা জানি না। এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করা খুনীদের কয়েকজনকে জামিনে মুক্তি দেয়া হলেও পরবর্তীতে তাদের অবস্থান ও বিচার প্রক্রিয়ার সর্বশেষ খবরও সরকার বা আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী কর্তৃক প্রকাশ করা হয়নি। ওয়াশিকুর বাবু হত্যাকান্ডে দুজন খুনীকে জনগণ হাতে নাতে পাকড়াও করে পুলিশের হাতে তুলে দিলেও সে বিচার প্রক্রিয়া এখন কি অবস্থায় আছে তা আমরা জানি না। খুনীরা খুনের পরিকল্পনাকারী জনৈক হুজুরের নাম প্রকাশ করলেও এ হত্যাকাণ্ডে আর কাউকে গ্রেফতার করার সংবাদ পাওয়া যায়নি।’

‘ড. অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি, বরং আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী বিভিন্ন সময় বিভ্রান্তকির তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্তির মধ্যে রেখেছেন। পুলিশের ভাষ্যমতে, অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে প্রধান সন্দেহভাজন রেদায়ুনুল আজাদ রানা এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছে, অথচ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডেই রানাকে গ্রেফতার করে আবার তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। রাজীব হায়দার খুন হবার পর তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী রাজীব হায়দারের পরিবারকে শান্তনা জানিয়েছিলেন এবং বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বাকি নিহত ব্লগারদের বেলায় প্রধানমন্ত্রীর আচরণ সম্পূর্ণ বিতর্কিত এবং প্রশ্নবোধক।’

ওমর ফারুক লুক্স বলেন, ‘এ অবস্থায় বাংলা ব্লগের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। আইসিটির ৫৭ ধারার মতো ব্লাসফেমি আইনের কারণে ব্লগাররা বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা ও যুক্তির চর্চায় অনুৎসাহিত হবে। স্বভাবতই উৎসাহ পাবে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে পুঁজি করে লেখাগুলো। ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের চর্চা বাড়বে, ধর্ম ব্যবসা, ধর্মীয় রাজনীতি উৎসাহিত হবে। দেশ অন্ধকার যুগের ইসলামী খেলাফতের দিকে এগিয়ে যাবে।’

‘পাকিস্তান, আফগানিস্তানের পরেই মৌলবাদের টার্গেট হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ’ এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে ব্লগার লুক্স বলেন, ‘এই আশঙ্কা খুবই যৌক্তিক। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, বাংলাদেশে এখন মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৯৫ শতাংশ। এই হার স্বাধীনতার আগে ছিল ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ। দেশে এখন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়েছে। আর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মাদ্রাসা শিক্ষার হার বেড়েছে ৭০০ শতাংশ। ভৌগলিক কারণেও পাকিস্তান, আফগানিস্তানের পরেই বাংলাদেশ মৌলবাদের ঝুঁকি বহন করে।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ এ একটি অসাম্প্রদায়িক- ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ গড়ার প্রত্যয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও পরবর্তীতে দেশের ক্ষমতা ও ভোটের রাজনীতিতে টিকে থাকার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সুবিধামত ধর্মকে ব্যবহার করেছে। দেশের বিশাল সংখ্যক অশিক্ষিত ও সহজ সরল ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠীকে খুশী করে তাদের ভোট নিশ্চিত করতে সংবিধানে “বিসমিল্লাহ” সংযোজন, ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্মের মর্যাদা, জামায়াতে ইসলাম ও যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার বৈধতা দিয়ে গণতন্ত্রকেই বিতর্কিত করেনি, বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়তে অসম্ভব করে তুলেছে।’

‘একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের সাম্প্রদায়িক মনোভাব আর ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্র ইসলামীকরণের ফল বা ভবিষ্যত আমরা বিশ্বের আর দশটা দরিদ্র, অশিক্ষিত আর দুর্নীতিগ্রস্থ ইসলামিক রাষ্ট্রের দিকে তাকালেই দেখতে পাই।’