৩. ইসলাম ধর্ম সংস্কারের প্রস্তাবনা
ইসলামকে একটি একক ধর্মমত হিসাবে বিবেচনা করেছেন আয়ান হারসি। এই ধর্মমত গড়ে উঠেছে কোরান, হাদিসের উপর ভিত্তি করে। সামান্য কিছু সম্প্রদায়গত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এই ধর্মমত পৃথিবীর সকল মুসলমানকে একত্রিত করেছে, একটি ছাতার নিচে নিয়ে এসেছে।
ইসলামকে একক ধর্মমত হিসাবে রেখে দিয়ে মুসলমানদেরকে তিনটি বৃহৎ ভাগে ভাগ করেছেন তিনি।
ইসলামের শুরুর দিকে মুহাম্মদ মক্কাবাসীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতেন। তাদেরকে মূর্তি পূজা বাদ দিয়ে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকারের জন্য আকুল আবেদন জানাতেন। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই, এটা বোঝানোর আপ্রান চেষ্টা চালাতেন তিনি। তিনি যে সেই একক সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি, এটা বলতেও ভুলতেন না। মুহাম্মদের এই প্রচেষ্টা অনেকটা যীশুর মতোই ছিলো। যীশুও ইহুদিদের কাছে গিয়ে তিনি যে ঈশ্বরপুত্র, এটা মেনে নেবার জন্য আহবান জানাতেন। মুহাম্মদ তাঁর ধর্ম প্রচারের প্রথম দশ বছর এই রকম আকুতি-মিনতি করেছেন। কিন্তু, খুব একটা সফলতা দেখতে পান নি। শেষে এক সময় অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি এবং তাঁর ক্ষুদ্র একটা অনুসারী দল মদিনাতে হিজরত করেন। এখান থেকেই মুহাম্মদের ধর্ম প্রচার রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। অবিশ্বাসীদের তখনও আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য আহবান এবং আমন্ত্রণ জানানো হতো। তবে, মক্কার মতো তারা আস্থা ও বিশ্বাস না আনলে মুহাম্মদ এবং তাঁর অনুসারী যেরকম নীরবে প্রস্থান করতেন, সেটা পালটে যায় এখানে। কেউ বা কোনো গোষ্ঠী এরকম আমন্ত্রণে সাড়া না দিলে আর ছেড়ে দেওয়া হতো না। তাদেরকে আক্রমণ করা হতো। আক্রমণ করে পরাস্ত করতে পারলে দুটো অপশন তাদেরকে দেওয়া হতো। হয় ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া, নতুবা মৃত্যুকে বেছে নেওয়া। ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা নিজেদের ধর্ম রাখার সুযোগ পেতো, তবে সেই ক্ষেত্রে তাদেরকে জিজিয়া কর দিতে হতো।
ইসলাম ধর্মের দখলিসত্ত্ব নিয়ে এই দুই গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত রয়েছে। কোটি কোটি মুসলমান মুহাম্মদের মক্কা জীবনের শান্তিপূর্ণ ইসলামের প্রতি আনুগত্য দেখায়। অন্যদিকে আরেকদল মুসলমান প্রতিনিয়ত এদেরকে চ্যালেঞ্জ করে এবং মুহাম্মদের মদিনা জীবনের রাজনৈতিক ইসলামকে পুনর্জীবিত করতে চায়।
এর ভিত্তিতেই আয়ান হারসি আলি মুসলমানদের তিনভাগে বিভক্ত করেছেন।
প্রথম অংশ হচ্ছে মদিনা মুসলমান। এরাই সবচেয়ে মাথা ব্যথার কারণ। এরা পাক্কা মৌলবাদী, শারিয়া আইনের ভিত্তিতে সমাজ বা রাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে চায়। সপ্তম শতকে যে ইসলাম এসেছিলো, তাকে আদির সেই অবস্থাতে অপরিবর্তিত রাখার পক্ষে এরা সোচ্চার। নিজেদের বিশ্বাসকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়াটাকে বা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াটাকে এরা নিজেদের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করে।
এরা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। সংস্কারের আগে মধ্য যুগে খ্রিস্টান ধর্মের যেরমক কিছু ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ছিলো, তাদের সাথে এরা তুলনীয়। এরা জোরপুর্বক শরিয়া আইন চালু করাটাকে নিজেদের ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করে। এরা শুধু মুহাম্মদের শিক্ষাকেই অনুকরণ এবং অনুসরণ করে না, বরং মদিনায় যাবার পরে মুহাম্মদের যে যুদ্ধংদেহী আচরণ ছিলো, সেটাকেও অনুসরণ করতে চায়। নিজেরা সহিংসতায় না জড়ালেও, সহিংসতার পক্ষে এদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে।
এদের মধ্যে বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা প্রবল। এরা ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের শুকর এবং বানর বলে গালি দেয়, এবং এই দুই ধর্মই যে মিথ্যা ধর্ম, সেটা অবিরত প্রচার করে। ইসলাম ধর্মে অবিশ্বাসী মুরতাদদের কল্লা কেটে নেওয়া, জ্বেনা করার অপরাধের শাস্তি পাথর ছুড়ে মারা, সমকামীদের ফাঁসি দেওয়া, এই সমস্ত বিষয়ে এদের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। এরা মহিলাদের জন্য কঠোর পর্দাপ্রথার পক্ষে। বোরকার অভ্যন্তরে মহিলাদের রাখাটা অবশ্য পালনীয় হিসাবে বিবেচনা করে। কোনো মহিলা ঘরের বাইরে একা চলাফেরা করলে, কিংবা পর্দাপ্রথায় সামান্য শৈথিল্য দেখালে তাকে পিটানোটাকে কর্তব্য বলে ভাবে। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননামূলক ছবি পোস্ট করার অপরাধে গত বছর এই মদিনা মুসলমানেরাই পাকিস্তানের গুজরানওয়ালাতে আটটি আহমদিয়া পরিবারের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। এই ঘটনা তিনজন নারী নিহত হয়েছিলো এই ধর্মান্ধদের হাতে।
মদিনা মুসলমানেরা বিশ্বাস করে যে, একজন অবিশ্বাসী যদি ইসলামের ছায়াতলে আসতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে তাকে হত্যা করাটা জায়েজ। এরা জিহাদের ডাক দেয় এবং ধর্মযুদ্ধে মৃত্যুর ফলে শহীদ হওয়াটাকে মহিমান্বিত করে। আল কায়েদা, আইএস, বোকো হারাম, আল শাহাব এর মতো জঙ্গী সংগঠনগুলোতে যারা যোগ দেয়, এরা সয়াবি এই মদিনা মুসলমানদেরই অংশ।
ভাগ্য ভালো যে এই মদিনা মুসলমানেরা সংখ্যায় লঘিষ্ঠ একটা অংশ। এড হোসেইন এর হিসাব অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বের মুসলমান জনসংখ্যার মাত্র তিন ভাগ, ইসলামকে এমন সহিংস হিসাবে বোঝে। কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে যে, এক দশমিক ছয় বিলিয়ন মুসলমানের তিন শতাংশও একটা বিশাল সংখ্যা। আরো আশংকার কথা হচ্ছে যে, এই সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছেই। বর্তমানে অনেক মুসলমান এবং ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত নব্য মুসলমানদের মধ্যে মদিনা মুসলমান হবার ঝোঁকটাই বেশি পরিলক্ষিত হয়।
দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে মক্কি মুসলমান। এরা মুসলিম বিশ্বে পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। ধর্মের মূল অংশের প্রতি এরা অনুগত, ধর্ম পালন করে গভীর ভক্তি এবং প্রগাঢ়তার সাথে। কিন্তু, সহিংস পথের প্রতি এদের কোনো আগ্রহ নেই। শান্তিপ্রাণ মুসলমান এরা। ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান বা ইহুদিদের মতো এরাও ধর্মের প্রচলিত কর্মকাণ্ডগুলো নিয়মিত পালন করে, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আশাকে ধর্মীয় আইন কানুনের বাধা নিষেধ মেনে চলে। গোবেচারাভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ধর্ম পালনই এদের মূখ্য উদ্দেশ্য।
আপাত দৃষ্টিতে এদেরকে অক্ষতিকর দেখালেও, এদেরও একটা বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। এদের ধর্মীয় বিশ্বাস, যেটি চৌদ্দ শত বছরের চেয়েও বেশি পুরোনো, সেটি প্রতিনিয়ত ধাক্কা খায় আধুনিকতার সাথে। জটিল অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক উদ্ভাবন শুধুমাত্র পাশ্চাত্য বিশ্বকেই নতুন চেহারা দেয় নি, সাথে সাথে উন্নয়নশীল বিশ্বের সমাজেও নাটকীয় পরিবর্তন ডেকে এনেছে। আধুনিকায়নের যৌক্তিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের মূল্যবোধগুলো ঐতিহ্যবাহী সমাজগুলোর জন্য মরণঘণ্টা ডেকে এনেছে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ক্ষমতার সম্পর্কগুলোকে পরিবর্তন করার জন্য আধুনিকায়নের শক্তি সীমাবদ্ধ। এই সব সমাজের মুসলমানরা সেল ফোন, বা কম্পিউটারের মতো আধুনিক প্রযুক্তি ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সেকুলার মাইন্ডসেটের বিবাদকে না দেখেও ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু, পশ্চিমে, যেখানে ইসলাম সংখ্যালঘিষ্ঠ ধর্ম, সেখানে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এক ধরনের মানসিক অসংগতির মধ্যে বসবাস করে। এরা আটকা পড়েছে তাদের বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতার মাঝখানে। এই ধর্মনিরপেক্ষ এবং বহুমুখী সমাজ প্রতিনিয়ত তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করছে, আর এ থেকে মুক্তির জন্য তারা তাদের ইসলাম ধর্মবিশ্বাসকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরছে। কেউ কেউ এই টেনশন থেকে মুক্তি পেতে নিজেদের একটা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছে। একে বলে ককুনিং। মুসলমান অভিবাসীরা বাইরের প্রভাব থেকে নিজেদের বাঁচাতে শুধুমাত্র নিজেদের লোকজনের সাথেই মেশে, বাচ্চাদের শুধুমাত্র ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে।
এই সমস্ত মুসলমানদের মধ্যে কারো কারো শেষ পর্যন্ত মাত্র দুটি পছন্দ থাকে। ইসলামকে হয় পুরোপুরি ত্যাগ করা নতুবা অনমনীয় এবং আপোষহীন ইসলামের একঘেয়ে নিয়মগুলোকে বর্জন করা। হালকা-পাতলাভাবে ধর্মের সাথে লেপ্টে থাকা। এরাই হচ্ছে মুসলমানদের তৃতীয় অংশ, বিদ্রোহী গ্রুপ, পরিবর্তনকামী দল। এই গ্রুপের একটা বড় অংশ মনে করে যে, ইসলামের সংস্কার প্রয়োজন। বিশ্ব জুড়ে ইসলামের রাজনৈতিক সন্ত্রাসের কারণে এর যে দায় ইসলামের অনুসারীদের নিতে হচ্ছে, তা থেকে মুক্তির জন্যই ইসলামের সংস্কার আবশ্যক।
মদিনা মুসলমানরা মক্কা মুসলমানদের পাশ্চাত্য সমাজে গণ্ডির মধ্যে আটকে থেকে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনকে নিন্দার চোখে দেখে এবং এটাকে ব্যহত করার চেষ্টা চালায়। তবে, বিদ্রোহী গ্রুপ, যারা ধর্ম ত্যাগ করেছে বা যারা ইসলামের সংস্কার চায়, তাদের প্রতি এদের আক্রোশ থাকে সবচেয়ে বেশি। এদেরকে প্রতি মুহুর্তে প্রত্যাখান করা হয়, সমাজচ্যুত করা হয়, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা দেওয়া হয়, কখনো কখনো মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হয়। শুধু হুমকি দিয়েই থেমে থাকা হয় না, কখনো কখনো সত্যি সত্যিই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশ। একের পর এক সেকুলার ব্লগারকে হত্যা করে এই বিদ্রোহী অংশের কণ্ঠ চেপে ধরার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের মদিনাপন্থী মুসলমানেরা।
ইসলামে সংস্কারের দাবি কিন্তু নতুন কিছু নয়। এই দাবি বহু আগে থেকেই বহুবার এসেছে, বিশেষ করে অটোম্যান সাম্রাজ্য পতনের পরে এবং খিলাফত বিলুপ্ত হবার পরে। ফলে, আয়ান হারসি আলি ইসলামের সংস্কারের যে বক্তব্য এনেছেন, সেটিতে নতুনত্ব কিছু নেই। এটি অনেক পুরোনো কনসেপ্ট। নতুনত্বের মধ্যে যা আছে, তা হচ্ছে আয়ান সুনির্দিষ্টভাবে ঠিক কোথায় কোথায় সংস্কার করতে হবে, সেটিকে চিহ্নিত করেছেন। ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসের পাঁচটা জায়গা, যেগুলো ঐতিহাসিক পরিবর্তনকে গ্রহণ করা এবং যুগের সাথে খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সেগুলোকে চিহ্নিত করেছেন তিনি। এই পাঁচটা বিষয়কে যখন ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমানদের জন্য মজ্জাগতভাবে ক্ষতিকর হিসাবে বিবেচনা করা হবে এবং যখন একারণে এগুলোকে বর্জন এবং বাতিল করা হবে, তখনই সত্যিকার ইসলাম সংস্কার সাধিত হবে। যে পাঁচটি বিষয়ে সংস্কার করতে হবে, সেগুলো হচ্ছেঃ
১। মুহাম্মদের আধা ঐশ্বরিক এবং ত্রুটিহীন মর্যাদা, সেই সাথে কোরানের আক্ষরিক পঠন-পাঠন, বিশেষ করে যে কোরানের যে অংশটা মদিনায় নাজিল হয়েছে।
২। ইহকালের চেয়ে পরকালকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। গোঁড়া মুসলমানরা যা কিছু করে, তার সবই এই পরকালের জন্য।
৩। কোরান, হাদিস এবং অন্যান্য ইসলামি ব্যবহারশাস্ত্র থেকে আসা শরিয়া আইন।
৪। ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায় প্রতিরোধের জন্য ব্যক্তি বিশেষকে ক্ষমতায়িত করা।
৫। জিহাদকে অপরিহার্য ভাবা।
আয়ানের মতে, এই পাঁচটা বিষয়কে, হয় সংশোধন করতে হবে নতুবা পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। সেক্ষেত্রেই শুধুমাত্র ইসলাম বা মুসলমানদের পক্ষে সম্ভব হবে পাশাচাত্যের ধর্মনিরপেক্ষ এবং আধুনিক সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলা। আজকের এই সহিংসতাপূর্ণ বিশ্বের জন্য ইসলাম এবং মুসল্মানদের যে দায় রয়েছে, সেটা থেকে মুক্ত হতে গেলে এর সংস্কারের মাধ্যমে এর বিষদাঁত উপড়ে ফেলে ঢোঁড়া সাপে পরিণত করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অন্যান্য প্রায় সব বড় ধর্মগুলোই নানা সময়ে সামাজিক চাপে সংস্কারের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, ধীরে ধীরে নখ, দাঁত খুইয়ে নির্বিষ এবং নিরীহ বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। ইসলাম এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম। সমস্ত সংস্কারকে প্রতিহত করে, এটি এখনো সেই প্রাচীন অবস্থাতেই নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে। এতে করে সমস্যা হচ্ছে আধুনিক বিশ্বের। সামনে চলার পথে প্রগতিশীল মানুষকে এমন একদল লোককে নিয়ে এগোতে হচ্ছে, যারা শুধু ধীর বা পিছিয়ে পড়া বললে ভুল হবে, বরং উল্টোদিকেই হাঁটতে বেশি ইচ্ছুক। এই বিপরীতমুখী দ্বিমুখী যাত্রার ক্ষতিকর প্রভাব বর্তমান বিশ্বকে বইতে হচ্ছে, আগামী দিনের বিশ্বকে আরো বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে।। দেড় বিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই ধর্মটাকে গভীরভাবে ধারণ করে, কাজেই ইচ্ছা করলেই এই মুহুর্তে এই ধর্মটাকে বিলুপ্ত করে দেওয়া সম্ভব হবে না। তার চেয়ে বরং এর নানাবিধ সংস্কার করে একে কালসাপ থেকে ঢোঁড়া সাপে পরিণত করা এবং বর্তমান বিশ্বের যুগোপযোগী করাটাই আমাদের জন্য আশু প্রয়োজন।
আজকের এই সহিংসতাপূর্ণ বিশ্বের জন্য ইসলাম এবং মুসল্মানদের যে দায় রয়েছে, সেটা থেকে মুক্ত হতে গেলে এর সংস্কারের মাধ্যমে এর বিষদাঁত উপড়ে ফেলে ঢোঁড়া সাপে পরিণত করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অন্যান্য প্রায় সব বড় ধর্মগুলোই নানা সময়ে সামাজিক চাপে সংস্কারের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, ধীরে ধীরে নখ, দাঁত খুইয়ে নির্বিষ এবং নিরীহ বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। ইসলাম এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম। সমস্ত সংস্কারকে প্রতিহত করে, এটি এখনো সেই প্রাচীন অবস্থাতেই নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে। এতে করে সমস্যা হচ্ছে আধুনিক বিশ্বের। …………।
ফরিদ ভাই,
এটা একটা চমৎকার কাজ হয়েছে। তবে আয়ান হারসির ইন্টারভিউ দেখলে কেমন যেন রাগী নাস্তিক বলে মনে হয়। হয়তো জীবনে এত কিছুর মধ্যে দিয়ে গেছে বলেই।
প্রেসিডেন্সি কলেজের মঈদুল ইসলাম অক্সফোর্ডে তার পিএইচডি থিসিসের উপর ভিত্তি করে একটা চমৎকার বই লিখেছেন, ‘Limit of Islamism: Jamat-e-Islami in Contemporary India and Bangladesh’, বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতি এবং অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এই দুটি দেশে জামাত এবং ইসলামিজমের উত্থান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন -একটা মুসলিম মেজরিটি দেশ আরেকটা মুসলিম মাইনরি্টি দেশ। পড়তে বেশ কঠিন হলেও খুবই ভালো লাগছে। ইচ্ছা আছে একটা রিভিউ লেখার সময় পাইলে…
আমার মতে আয়ান হারসি এখনো ধর্মের অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসতে পারে নাই। তিনি দুদোল্য মনে আছে। তিনি মুহাম্মদকে তিন টুকরা করে ফেলেছেন। তিনি যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা কার্যকর করতে গেলে নিকসন দাদার মন্তব্যের মতই হবে। তার চেয়ে নিম্নে বর্নিত নিকসন কান্তি’দার সমাধান মন্তব্য অনেক গ্রহনযোগ্য। এবং বাস্তব সম্মত। ধন্যবাদ দাদা।
১। প্রথমেই ধর্মের নিয়মিত চর্চার অভ্যাসটা ছাড়াতে হবে। ‘উৎসব সবার’, ‘কালচারের মধ্যে ঢুকে গেছে’ এসব অযুহাতে ধর্মচর্চা উৎসাহিত করা বা চালিয়ে যাওয়া যাবে না। এর জন্য যত সময়ই লাগুক সে সময়টা দিতে হবে।
২। আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে হবে। দারিদ্র্য টিকিয়ে রেখে ধর্ম দূর করা যায় না।
৩। সমাজে বিজ্ঞানচেতনার ব্যাপক বিপুল প্রসার ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ অবশ্য এক্ষেত্রে অনেকটাই লাইনে আছে- গণিত অলিম্পিয়াড, প্রোগ্রামিং কনটেস্ট ইত্যাদির মাধ্যমে। এসবের আরো বিস্তার ঘটাতে হবে। বিজ্ঞানে উৎসাহ থাকাটা, সাম্প্রতিকতম তথ্যে আপডেটেড থাকাটা একটা মিনিমান সামাজিক যোগ্যতা কিংবা ফ্যাশানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
৪। সবাইকে কোরানের বাংলা অনুবাদ পড়াতে হবে। এই কথা শুনে অনেকের ভ্রু কুঁচকে উঠবে জানি। কিন্তু আমার ধারনা, কোরানের একটা সহজ বাংলা অনুবাদ (যেমন জাস্টিস হাবিবুর রহমানের করা অনুবাদ) কোন ন্যুনতম শিক্ষিত লোক গোড়া থেকে লাইন বাই লাইন পড়া শুরু করলে, থেকে থেকেই সেখানকার অদ্ভুত অদ্ভুত কথাগুলো পড়ে, গ্রন্থ শেষ হবার আগেই তার ধর্মবিশ্বাস অনেকখানি নড়বড়ে হয়ে যাবে।
যাক, এখানেই শেষ করি। মন্তব্য বেশি লম্বা গেলো। দুঃখিত।
এই সংস্কার প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? মদিনা মুসলমানদের মধ্যে যারা সবচে কম উগ্র তারা হেসে গড়িয়ে পড়বে এবং আয়ানের লেখাগুলো তাদের উগ্র বন্ধুদের কাছে পৌঁছে দেবে। মক্কি মুসলমানরা মুখ শক্ত করে বলবে, ‘ইসলামের সংস্কার চাচ্ছে! ইসলামের!! নাউজুবিল্লাহ!!!’ এই গ্রুপটা একটা অদ্ভুত হীনমন্যতায় ভোগে সবসময়। খাঁটি মাদানী ত্বরীকায় চলতে না পারার হীনমন্যতা। পূর্বোক্তদের সামনে তাই সবসময় একটু সংকুচিত হয়ে থাকতে হয় এদের। এখন এই সংস্কার প্রস্তাবের কথা জেনে ধর্মের পক্ষে ঝাঁঝালো কিছু কথাবার্তা বলে (মূলত ফেসবুকে) ওরকম ছোট হয়ে থাকা অবস্থা থেকে এরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবে। আর পরিবর্তনকামী দল? জানিনা কোন ভদ্রপল্লীতে এরা থাকে। আমার পোড়া স্বদেশে এদের কোন অস্তিত্ব আছে বলে তো মনে হয় না।
তাহলে কী দাঁড়ালো? প্রস্তাব যত সুন্দরই হোক, বাস্তবসম্মত নয়। বেড়ালের গলায়- একটা ঘন্টাই বাঁধা যায় না- পাঁচটা বাঁধবে কে! আয়ান হারসি নিশ্চয়ই তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ব্যাপক পড়াশুনা এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ওপর ভিত্তি করে মোটা দাগে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই প্রস্তাবগুলো করেছেন। আমার ভাবনা বাংলাদেশকে ঘিরে। বাংলাদেশের জন্য এ প্রস্তাবমালা পুরোপুরি অবাস্তব।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলাম সবচে কম পুরনো। উৎপত্তি এবং প্রাথমিক বিকাশ হয়েছে শিক্ষাদীক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতায় কম উন্নত সমাজে, যার অর্থ, বেশী ভাগ্যবিশ্বাসী বা দৈবনির্ভর সমাজে। তার ওপর ইসলামের মূল টেক্সটগুলোতে দার্শনিক ভাবালুতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বেশিরভাগ কথাই বেশ সোজাসুজি বলা হয়েছে। ফলে এর প্রসার হয়েছে অতি দ্রুত। পুন্য কিংবা পাপের ফল কী হবে তার প্রায় গ্রাফিক বর্ণনায় কথাগুলো মানুষের মাথায় গেঁথেও থাকে খুব পাকাপাকিভাবে। এসব কারনে সারা পৃথিবীতেই ইসলাম সবচে বেশী চর্চিত ধর্ম। সব সমাজেই নাস্তিকের সংখ্যা কম হলেও ধর্ম বিষয়ে উদাসীনের সংখ্যা প্রচুর; একমাত্র মুসলমান সমাজে উদাসীনের সংখ্যাও খুব কম। ফলে এখানে অবস্থার উন্নতির কোন সহজ রাস্তা নেই। কোন শর্টকাট নেই। সংস্কার প্রস্তাবের মতো সম্মুখযুদ্ধ এখানে কার্যকর নয়। এগোতে হবে অনেক ঘোরালো পথে। একটু একটু করে ডানা ছাঁটতে ছাঁটতে।
১। প্রথমেই ধর্মের নিয়মিত চর্চার অভ্যাসটা ছাড়াতে হবে। ‘উৎসব সবার’, ‘কালচারের মধ্যে ঢুকে গেছে’ এসব অযুহাতে ধর্মচর্চা উৎসাহিত করা বা চালিয়ে যাওয়া যাবে না। এর জন্য যত সময়ই লাগুক সে সময়টা দিতে হবে।
২। আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে হবে। দারিদ্র্য টিকিয়ে রেখে ধর্ম দূর করা যায় না।
৩। সমাজে বিজ্ঞানচেতনার ব্যাপক বিপুল প্রসার ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ অবশ্য এক্ষেত্রে অনেকটাই লাইনে আছে- গণিত অলিম্পিয়াড, প্রোগ্রামিং কনটেস্ট ইত্যাদির মাধ্যমে। এসবের আরো বিস্তার ঘটাতে হবে। বিজ্ঞানে উৎসাহ থাকাটা, সাম্প্রতিকতম তথ্যে আপডেটেড থাকাটা একটা মিনিমান সামাজিক যোগ্যতা কিংবা ফ্যাশানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
৪। সবাইকে কোরানের বাংলা অনুবাদ পড়াতে হবে। এই কথা শুনে অনেকের ভ্রু কুঁচকে উঠবে জানি। কিন্তু আমার ধারনা, কোরানের একটা সহজ বাংলা অনুবাদ (যেমন জাস্টিস হাবিবুর রহমানের করা অনুবাদ) কোন ন্যুনতম শিক্ষিত লোক গোড়া থেকে লাইন বাই লাইন পড়া শুরু করলে, থেকে থেকেই সেখানকার অদ্ভুত অদ্ভুত কথাগুলো পড়ে, গ্রন্থ শেষ হবার আগেই তার ধর্মবিশ্বাস অনেকখানি নড়বড়ে হয়ে যাবে।
যাক, এখানেই শেষ করি। মন্তব্য বেশি লম্বা গেলো। দুঃখিত।
যারা মক্কী তারা নিজেরা মদিনীয় কাজে অংশগ্রহন করে না তবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেটাকে প্রকশ্য বা মৌন সমর্থন দিয়ে যায়। সে কারণেই মদিনীয়রা তাদের ধর্ম নামীয় সন্ত্রাস চালিয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশে মদিনীয় জামাত যদি বৃহত্তর মদিনীয় গোষ্ঠীর সমর্থন না পেত তবে তাদের উগ্রবাদ প্রসারের সাহসই পেত না। ঘরে ঘরে তাদের মৌন সমর্থন আছে বলেই তারা সন্ত্রাসবাদ করার সাহস পায়।
একটি চমৎকার যুগোপযোগী লেখা। অনেক অজানাকে জেনেছি। লেখকের মতো আমারও ধারণা শঙ্খ্যাগত দিক থেকে মক্কিদের প্রাধান্য। তবে মক্কিদের আচরণগত শৈথিল্য এবং দুর্বলতা দেখে মনে হয় মদিনাদের জয় জয়কার। আমি আমার জীবনে প্রচুর মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি। এদের একটা বিরাট অংশই হয়ত তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত , নয়ত দ্বিতীয় । কানাডা এসে দুচারটি মদিনার পরিচয় হয়েছে। ইসলাম ধর্মের অন্যতম সমস্যা হোল ধর্মীয় আলোচনা অবারিত নয় । বিষয়টি বদ্ধ, সমালোচনাহীন, এবং কতল যোগ্য অপরাধ। ওখানে কখনো খোলা বাতাস বয় না। ফলে আমার জানার বিষয়টি সীমাবদ্ধ । আমার শহরে ধর্মের সামান্যতম সমালোচনা করার জন্য আমার চোখের সামনে একজন অগ্রজকে একজন অনুজ দ্বারা লাঞ্চিত হতে দেখেছি। ঐদিন আমি সামনে না দাঁড়ালে অগ্রজকে হয়তো আঘাত করা হতো। এটিই হোল ইসলামের অন্ধকার , কাল ও বিভীষিকাময় দিক। বিশ্বাসের যে লেলিহান আগুনে আজ এ ধর্মটি সব কিছুকে গ্রাস করতে চাচ্ছে – টা হয়তো একদিন নিজেই নিজেকে পুড়িয়ে মারবে । পাকিস্থান, ইরাক, সিরিয়া সহ দিকে দিকে তাই শুরু হচ্ছে। অনুজ ভাই ফরিদের লেখাটি আমার নিজের জ্ঞানের ভাণ্ডারকে আরও পুষ্ট করেছে। ধন্যবাদ।
মদিনা বেড়ে চলে মক্কা চাদরের আড়ালে।