খুব ছোট বেলায় দেখিছি , আমাদের ড্রইংরুমের বা পাশের দেয়ালটাতে রাশিরাশি বরফেমোড়া ধূসর পর্বতমালার বড়সর একখানা পেইন্টিং ঝুলতে । পর্বতমালার ঠিক মাঝ খানটায় একটুখানি সোনালী আলো এসে পরেছে। ঐ একটুখানি আলোর জন্যই ছবিটার প্রতি দুর্দান্ত আকর্ষণ ছিল আমার। অবাক হয়ে ভাবতাম,শুভ্র বরফ কি করে এত সুন্দর হয় !
আমার সেই শৈশবের মুগ্ধতা হয়ত জমা ছিল স্মৃতির কোন এক খুপরিতে। সুইডেনে এসে টের পেলাম স্মৃতির পাতায় জমানো ছবিটি মিথ্যে ছিল না ।
জুন জুলাই এবং আগস্টের কিছু সময় এখানে সামার চলে। খুব সহজ করে বললে , তীব্র শীতের প্রকোপ কমে খানিকটা উষ্ণ আবহাওয়ার আমেজ পাওয়া যায় । তাপমাত্রা অঞ্চল ভেদে ১০ থেকে ২০ এর ভেতর ওঠানামা করে । তখন পুরো সুইডেন রঙে রঙে ভরে ওঠে। অসংখ্য ফুলের পশরা সাজিয়ে হাজির হয় প্রকৃতি । স্থানীয় সুইডিসরা ছোট বড় উৎসব করে , কেউ ঘুরতে বেড় হয় , কেউ নতুন জীবন শুরু করে , মোট কথা বছরের এই সময়টা তারা বেশ উপভোগ করেই কাটায়। আর আমরা যারা গরমে অভ্যস্ত তারাও ভারী কাপড়ের ভারমুক্ত হয়ে তুলামূলক হালকা কাপড় পরার সুযোগ পাই। কফির মগ হাতে বারান্দায় দাড়িয়ে ভাবি,
আহা ! সময়টা বেশ কাটছে।
জুনের মাঝামাঝি সময়ে সুইডিশরা তাদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব মিডসামার পালন করে। আমাদের দেশের পহেলা বৈশাখের সাথে মিডসামারের উদ্ভূত মিল । তখন এখানেও মেলা হয় , আমাদের মাটির পুতুল, মুড়িমুড়কির বদলে এখানে দেখা মেলে তুলতুলে কাপড়ের পুতুল, পপকর্ণ আর সাদা গোলাপী ক্যান্ডীফ্লসের ।
পৃথিবীর সব দেশের বাচ্চারাই এক ।সুইডিশ বাচ্চারা যখন দলবেঁধে বালুতে গড়াগড়ির খায়, গাছ থেকে মাটিতে লাফ দেয়, লুকুচুরি খেলে, তখন মনে হয় আমি আমার শৈশব দেখছি।
বড় শহর থেকে ছোট শহরগুলতে তুলনামূলক মানুষের ভিড় কম। স্থায়ী বসবাসের জন্য এই শহরগুলো বেশ আরাম দায়ক। সুইডিশরা স্বভাবে মিষ্টিভাষী এবং আন্তরিক। পশুপাখির প্রতি তাদের সীমাহীন ভালবাসা। কুকুর বিড়াল পোষা তাদের জীবনেরই একটা অংশ।
সুইডিস সম্ভ্রান্ত নারীদের খুব চমৎকার একটা শখ আছে। তারা ঘোড়া পোষে এবং রীতিমত ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ায়। বিশেষ করে সামারে এই দৃশ্য খুবই পরিচিত।
একজন ষাটোর্ধ নারী ঘোড়ায় চেপে চলছে এই দৃশ্য আমার কাছে মোটেও স্বাভাবিক নয় , তাই প্রথম প্রথম অবাক হতাম। ধীরে ধীরে বুঝে নিয়েছি ঘোড়াটা শুধুই তাদের বাহন নয়, ঘোড়া এবং তার বাহকের সম্পর্কটি ভালবাসার, পারস্পারিক নির্ভরশীলতারো বটে।
আমার সুইডিশ বন্ধু নিনা । তার বয়স তেষট্টি হলেও সে এখনো চঞ্চলা তরুণী। নিনার একটা চমৎকার ঘোড়া আছে। সে বলে তার ঘোড়া তাকে বোঝে, সে তার ঘোড়া কে বোঝে, তাই তারা অনেক ভাল বন্ধু। নিনা যতটা বলে, ওদের সম্পর্কটা আসলে তার চেয়েও অনেক বেশি মধুর। আমার বারবার মনে হয়েছে, নিনার আবেগগুলো ঘোড়াটা ঠিকঠিক উপলব্ধি করতে পারে। নিনার যখন মন খারাপ হয় ঘোড়াটারও তখন মন খারাপ হয়। নিনার প্রতিটা আচরণের জবাবে ওর ঘোড়ার রেসপন্স আমাকে বিস্মিত করেছে ।
নিনার বয়স যাই হোক সে আসলেই স্বভাবে তরণী। সে তার এই বয়সে এমন অসংখ্য কাজ করে যা আমি করার সাহস হয়ত করব না ।ওর এই অদম্য জীবনশক্তিই নিনা কে একজন সফল এবং বিখ্যাত সাংবাদিক করেছে।
বাংলা প্রবাদে হাতী পোষা যেমন ব্যয়বহুল ঠিক তেমনি এখানে ঘোড়া পুষতে হলে প্রচুর আয় এবং ধৈর্য থাকা আবশ্যক। এই বিষয়ে সুইডিস নারীরা শতভাগ সর্বগুণ সম্পন্না। তারা মাইলের পর মাইল হাটে। সংসার অফিস সবই সামলায়। অনেক সময় সঙ্গী বিহীন জীবনের ভার একাই বহন করে। বিচিত্র এদের জীবন ।এই বৈচিত্র্যময় জীবন অসংখ্য বর্ণিল অভিজ্ঞাতায় ভর্তি। আমাদের মা খালা, কিংবা নানী দাদীদের সাথে তাদের জীবন তুলনা করলে আফসোস হয়। বাঙালী নারীরা তাদের সমস্ত জীবনে কত রঙ, রূপ, রস, গন্ধ, থেকে বঞ্চিত হয় তারা সে খবর জানেই না । এখানকার নারীরা বয়সের সাথে সাথে জীবনের নতুন নতুন সাধ গ্রহণ করে।
অন্য কোন সময় এ নিয়ে লিখব।
লেখার শুরুতেই বলেছিলাম বরফের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি। শীতের সময়টাতে পুরো সুইডেন জুড়েই বরফের দেখা মিলবে কিন্তু সামারে বরফ দেখতে হলে নর্থের দিকে যেতে হবে। নর্থে কখনো ই তাপমাত্রা তেমন উষ্ণ হয় না।সামারেও তাপমাত্রা ৭ থেকে ১৪ ভেতরেই ওঠানামা করে। তাই সেখানে সারা বছরই বরফ থাকে । দুর পাহাড় চুড়ায় কিংবা বনের ভেতরে হাটতে হাটতেই ছোট ছোট বরফগলা নদীর দেখা মিলবে , হাল্কা স্রোতের সাথে সেখানে টুকরো টুকরো বরফ ভাসতে দেখা যায়।
বরফেমোড়া পর্বত চুড়ায় যখন সূর্যের আলো এসে পরে , তখন রিফ্লেকশন হয়। সোনালী আলোতে চারদিক ঝলমল করে ওঠে। বিশেষ করে একপশলা বৃষ্টির পরে যখন মেঘের আড়াল থেকে সূর্য উঁকি দেয় তখন অর্ধবৃত্ত রংধনুর সৃষ্টি হয় , সেই আলোতে বরফরাশিও বর্ণিল দেখায়। ঠিক যেন রূপকথার গল্পের সেই পরীদের রাজ্য। এখানকার আবহওয়ার মেজাজ মর্জি ভারী অদ্ভুত। কখন সেই গোমড়ামুখো খিলখিলিয়ে হাসবে আঁচ করা কঠিন। এই ঝকঝকে আকাশ তো, এই টিপটিপ বৃষ্টি। কড়কড়া রোদেও হিমশীতল বাতাসের ঝাপটা মিললে অবাক হবার কিছু নেই। সুইডেনের এই পরিবর্তনশীল আবহওয়া নিয়ে স্থানীয় প্রবাদ আছে,
// আবহাওয়া আর মেয়েদের মন কখনো বিশ্বাস করতে নেই//
যদিও এখানকার মেয়েরা এমন নয় তবুও নিছক কৌতুক করেই প্রবাদটা বলা হয়।
এখানকার আকাশ ঠিক আমাদের মত নয়। আকাশের রঙ নীলচে আকাশী আর মেঘেদের রঙ যান্ত্রিক সাদা। খুব পরিপাটী মেঘ দেখে কেমন যেন প্রাণহীন মনে হয়। হয়ত আমি অভ্যস্ত নই বলে এমন লাগছে কিন্তু খুব গোছালো আকাশ দেখতে কেমন নিষ্প্রাণ লাগে । মনে হয় কোন পাঁচ তারা হোটেলের দেয়ালে ঝোলান দামী চিত্রকর্ম।
সমুদ্রের পাশের শহরগুলতে প্রচুর সামদ্রিক গাংচিলের দেখা মেলে । এছাড়াও নানা ধরণের হাঁস তো রয়েছেই। এখানকার পাখিরা খানিকটা ডাকাত টাইপের। মালমো তে দেখেছি সাদা শৃগালের দল রীতিমত খাবার ছিনতাই করে। ওদের অধিকার এখানে মানুষের চেয়ে বেশি। ফাস্টফুডের দোকানগুলোতে এরা নির্ভয়ে ঢুকে যায়। বেশ রাগী ভঙ্গীতে খাবার চায়। কেউ ঝারি দিলে উল্টো তাকেই ঝাড়ি মারে । আদরে বাঁদর হয়েছে এখানকার পাখিগুলো।
তবুও ওরা সুন্দর। ওরা মানুষ কে ভয় পেতে শেখেনি। মানুষ আর পাখিদের এই মেলবন্ধনে এক ধরণের নির্মল আনন্দ আছে।
এখানে ঝোপেঝাড়ে প্রচুর খরগোশের দেখা মিলবে। এরা মানুষ দেখে একদম ভয় পায় না। মাঝে মাঝে ওরা দলবেঁধে রাস্তা পার হয়। তখন রাস্তার গারিগুলো চুপচাপ দাড়িয়ে ওদের পার হতে দেয়। কেউ হর্ন বাজালে ওরা মহা বিরক্ত হয়ে তাকায়। দৃশ্যটা খুবই মজার।
সামারের এই প্রকৃতি,উইন্টারে একদমই বদলে যায়। চারপাশে শ্বেতশুভ্র সৌন্দর্য। তখন জীবনের রঙ বদলায় । রোজকার রুটিং বদলায়। বদলে যায় দৈনন্দিন কাজগুলো।
এর পর একটু একটু করে শ্বেত সুন্দরীরা আসে তুষারের বেশে। নতুন সৌন্দর্যের ভাণ্ডার থাকে তাদের আঁচলে। সে এক ভিন্ন আমেজ।
আজকেই প্রথম আপনার লেখা পড়লাম। একসাথে ৫ টি লেখা পড়া হয়ে গেলো। চমৎকার লেখা সহজ বাংলা ভাষায়। সুইডেনে কিছু মানুষ আসে আজীবন শান্তিতে বসবাসের জন্য।আবার কেউ আসে বাধ্য হয়ে। বাধ্য হয়ে আসা লোকজনদের মধ্যে একটা প্রবনতা থাকে যে আমি বাধ্য হয়ে আছি, তো এই বিরুপ প্রকৃতি আমাকে আচ্ছন্ন করে আছে। কিন্তু এই প্রকৃতির মাঝেও আছে অপার সৌন্দর্য । যা আপনার লেখায় আলোকিত হয়েছে। সুইডিস নারীরা সাধারণত: স্বাধীনচেতা হয়। এজন্য এসব নারীদের সাথে দাম্পত্য জীবন দীর্ঘস্থায়ী হওয়া জটিল। তাই হয়ত: সুইডিস পুরুষরা অনেক বছর ধরে থাইল্যান্ডে যায় সংঙ্গীনি খুজঁতে। কাজের মেয়ে টাইপের ঘরণী প্রায় অধিকাংশ পুরুষের পছন্দ নয় কি!
সীগাল – গাংচিল। শৃগাল পাখী নয়। বানান বিভ্রাট! লেখাটি সুখপাঠ্য, ভাল লেগেছে্…।
ধন্যবাদ 🙂