র‍্যাডিকাল নারীবাদের সাথে মানবতাবাদ (মানবিকতা না, জাগতিক নিয়ম-কানুন ও কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হবে মানুষের কল্যাণ সাধন এই মতবাদ), মুক্তচিন্তা, নাস্তিকতাবাদ ও ইহজাগতিকতাবাদের সম্পর্ক ছিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক ছিলো । পশ্চিমে এটা ঘটে গেছে ৪ বছর আগে । আগে থেকেই একটু অস্বস্তিকর সম্পর্ক ছিলো । তবে ২০১১ সালের এলিভেটরগেইট ঘটনার মাধ্যমে চূড়ান্ত পর্যায়ে দুই আন্দোলনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ।

এলিভেটরগেইট ঘটনার মূল নায়িকা রেবেকা ওয়াটসন (Rebecca Watson) নামের একজন র‍্যাডিকাল নারীবাদী । সে বছরের ওয়ার্ল্ড এইথিয়েস্ট কনভেশনে যোগদানের সময় রাত্রে আড্ডা মেরে হোটেলে ফেরার সময় এলিভেটরে একজন পুরুষ তাকে প্রস্তাব করে যে, তোমার সাথে কথা বলে ভালো লেগেছে, যদি কিছু মনে না করো তাহলে আমার রুমে আসো । কফি খেতে খেতে তোমার সাথে আরো বিস্তারিত আলাপ করতে চাই । রেবেকা ওয়াটসনের নিজের কথা অনুযায়ীই সেই লোক কোনপ্রকার জোরজবরদস্তি বা মানা করে দেয়ার পর আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায় ।

কিন্তু কনভেশন থেকে ফিরে রেবেকা ওয়াটসন সেই ঘটনা নিয়ে একটা ভিডিও বানান যে এধরণের আচরণ থেকে পুরুষদের বিরত থাকা উচিৎ । পুরুষটির এই দাওয়াতে তিনি বিশাল অস্বস্তি বোধ করেছেন ও তাকে সেক্সুয়াল অবজেক্ট হিসাবে দেখা হয়েছে এর মাধ্যমে ।

মানবতাবাদী ও মুক্তচিন্তকদের বেশিরভাগই এই ঘটনায় রেবেকা ওয়াটসনকে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়ার দোষ দেন । কথা হচ্ছে ঐ লোক এমন কোন দাওয়াত দেয় নাই যে আসো আমার রুমে এসে সেক্স করো । হ্যাঁ ঐ ধরণের কনটেক্সটে এই কথার মানে ঐ ধরণের ইংগিত হওয়ার সম্ভাবণাই বেশি । কিন্তু সেটা কি স্বাভাবিক আচরণ না ? কোন নারীতে যদি কোন পুরুষ আগ্রহ বোধ করে , তাহলে তাকে প্রস্তাব দেয়ার এর চাইতে ভদ্রস্থ কি উপায় হতে পারে ! মানা করে দেয়ার পরেওতো সে আর কথা বাড়ায় নাই ।

ঝামেলা হয় যে , রেবেকা ওয়াটসনের ভিডিও পোস্টিং করার পরে একদল নাস্তিক ও মুক্তচিন্তক এ স্বাভাবিক যৌক্তিক চিন্তা না করে মার মার কাট কাট করে রেবেকা ওয়াটসনের পক্ষ নেয়া শুরু করেন । তার মধ্যে অন্যতম পি যি মায়ার্স (P Z Myers) । তিনিও রেবেকা ওয়াটসনের কথার সাথে শতভাগ একমত পোষণ করেন । এর মধ্যে রিচার্ড ডকিন্স (Richard Dawkins) আবার তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে হাউকাউ করার অভিযোগ করে রেবেকা ওয়াটসনকে ব্যঙ্গ করেন । ডকিন্স বলেন সোমালিয়া সহ আরো সব মুসলিম নরকে সত্যিকারের আক্রান্ত নারীরা যেখানে প্রতিনিয়ত ধর্মীয় পুরুষতন্ত্রের নির্যাতনে মারা যাচ্ছে সেখানে রেবেকা ওয়াটসনের এধরনের শৌখিন ও অতি-চুলকানীমূলক সমস্যা নিয়ে এইথিয়েস্টদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হাস্যকর । এটাকে আবার ওয়াটসনের বাহিনী ধরে নেয় বড় অপরাধের কথা বলে ছোট অপরাধকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা হিসাবে । এই র‍্যাডিকাল নারীবাদীর দল ভুলে যায় যে ডকিন্সসহ যারা এই ঘটনাতে রেবেকা ওয়াটসনকে অতি-প্রতিক্রিয়ার দোষ দিচ্ছেন তারা এলিভেটরে সেই পুরুষের আচরণকে অপরাধ বলেই মনে করছেন না । তুচ্ছ বা বড় এখানে কথা নয় । ডকিন্সের কথার সারমর্ম ছিলো সত্যিকারের অপরাধ ও নির্যাতনের স্বীকার যারা হচ্ছে তাদের দিকে মনোযোগ না দিয়ে রেবেকা ওয়াটসনের নিজের মানসিক সমস্যার জন্য কাল্পণিক অপরাধের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করানোটা হাস্যকর ।

ডকিন্স এর মন্তব্যের পরে রেবেকা ওয়াটসন ও তার সমমনারা ডকিন্সকে ত্যাজ্য করার ঘোষণা দেয় পুরোপুরি । তারা রীতিমত ডকিন্স এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তার বই কিনবেনা ও সবাইকে না কেনার অনুরোধ জানায় । তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো বিভিন্ন ধরণের কনভেশনে ডকিন্স ও তার সমমনাদের আমন্ত্রণ জানাবেনা বলে স্বিদ্ধান্ত নেয় । অপরপক্ষ থেকেও একই ধরণের ব্যাবস্থা নেয়া হয় । এর মধ্যে আরেকজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারীবাদী কোনপ্রকার তথ্য প্রমাণ ছাড়া লরেন্স (Lawrence Krauss) ক্রাউস এর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানীর অভিযোগ করেন রেবেকা ওয়াটসনের কাছে গোপনে । পুলিশ বা আইনের কাছে না গিয়ে । তার বিপরীতে তার বক্তব্যকে তুলোধূনো করেন ইউটিউবের বিখ্যাত বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তা ভ্লগার (ভিডিও ব্লগার) থান্ডারফুট(Thunderf00t) ও রাজনৈতিক-সামাজিক কমেন্টেটর ভ্লগার দি এমেইযিং এইথিয়েস্ট(The Amazing Atheist) ।

ঘটনা প্রতিঘটনার স্রোত শেষমেশ থামে দুই গ্রুপ নিজেদের মত নিজেদের সমমনাদের নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়াতে । ইমপ্লিসিটলি স্বীকার করে নেয়া হয়, র‍্যাডিকাল নারীবাদের চাওয়া ও আন্দোলনের সাথে সাধারণ নাস্তিকতা ও বিজ্ঞানবাদী মুক্তচিন্তা আন্দোলনের চাওয়ার মিল খুবই সামান্য । র‍্যাডিকাল নারীবাদ আসলে ধর্ম ও কুসংস্কারে প্রভাবে নারীর উপর চলমান অত্যাচারের অবসানেই সন্তুষ্ট নয় । তাদের চাওয়া পরিপূর্ণ নারীতন্ত্র । অর্থাৎ এখন পুরুষ যে অবস্থানে আছে সমাজে ঠিক সেখানেই নারীরা যাবে আর এখন নারীরা যেখানে আছে সেখানে পুরুষরা । স্বভাবতই এই চাওয়া নাস্তিকতা ও বিজ্ঞানবাদী মুক্তচিন্তকদের কাছে হাস্যকর এবং বিপদজনকও বটে । সেটা ধর্মীয় পাগলামির চাইতে মাত্রায় কিছুটা কম হলেও গুণগতভাবে একইরকম ।

বাংলাদেশে যে সামান্য পরিসরে নাস্তিকতা ও বিজ্ঞানভিত্তিক মুক্তচিন্তার প্রসার শুরু হয়েছে , সেখানেও স্বভাবতই প্রাথমিক পর্যায়ে নারীবাদী ও মুক্তচিন্তাবাদীর মধ্যে উদ্দেশ্যে মিল থাকার কারণে এ দুয়ের মধ্যে সখ্যতা ছিলো । মিলের জায়গা হচ্ছে দুই পক্ষই মনে করে ধর্মীয় গালগল্পগুলা মিথ্যা ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর । এটুকুর বাইরে শুধু নারীবাদী ও মুক্তচিন্তকদের মধ্যেই যে মতের নানান পার্থক্য আছে তা না । দুইজন মুক্তচিন্তকের মধ্যেও পার্থক্য অনেক । আরো একটি ইন্টারেস্টিং গ্রুপের সাথে আদিতে মুক্তচিন্তাবাদের সখ্যতা ছিলো । সেট হচ্ছে কমিউনিস্টদের সাথে । এখানেও সমস্যা ঐখানেই যে ধর্মের অসারতা ও ক্ষতিকরতার বাইরে দুয়ের মধ্যে আর মিলের জায়গা নাই । কমিউনিস্টদের বিশাল অংশতো এখন এইটুক মিলও স্বীকার করে না । এ অংশ এখন বরং ধর্মের পদলেহন করে করে করে, তাদেরকে যে নাস্তিকদের সাথে একভাবে দেখা হত এ পরিচয় ঘুচাতে চাইছে ।

বাংলায় র‍্যাডিকাল নারীবাদের ব্যাপ্তি খুবই কম । তসলিমা ছাড়া তেমন একটা এতদিন ছিলো না । এখন যতটুকু শুরু হয়েছে তা-ও সেই তসলিমা পূজার বিভিন্ন ডেনোমিনেশন । আমাদের অঞ্চল পির-সাধু-সন্যাসীদের রমরমা বাজারের অঞ্চল । এখানে হয়তো পির, পূজা, প্রশ্নহীন আনুগত্য এগুলো ছাড়া কোন আন্দোলনই পানি পায় না । কারণ নানাবিধ হতে পারে । আলস্য একটা । মাথার ঘিলু খাটিয়ে যৌক্তিকতা যাচাইয়ের চাইতে পিরের লেঞ্জা ধরা খুবই সহজ । হতে পারে শক্ত ঘিলুর অভাবও একটা । দশ বারোজন তাত্তিক জোগাড় করার মত যথেষ্ঠ উন্নত মাথার প্রোডাকশন নাই ।

তসলিমা ব্র্যান্ডের র‍্যাডিকাল নারীবাদের পিল স্বাভাবিকভাবেই সব মুক্তচিন্তক ও বিজ্ঞান ও মানবতাবাদী নাস্তিকের পেটে সহ্য হবে না । সেটা নিয়ে লিখতে গেলে আরেক আলেফ লায়লা ওয়া লায়লাতুন হয়ে যায় । তবে বাংলাদেশে ও এই অঞ্চলে এখনো নারীর উপর যে পরিমাণ পারিবারীক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অত্যাচার নির্যাতন চলে তাতে র‍্যাডিকাল নারীবাদের ঝামেলার জায়গাগুলোর কাছাকাছি আসতে আরো অনেক বছর লেগে যাবে । কিছুটা দেখা যায় একটা ক্ষেত্রে যে, পুরুষ লম্পট, পুরুষের লাম্পট্য খুব খারাপ এই যৌক্তিক কেইস দাঁড় করানোর পরে, এ ব্র্যান্ডের সমাধান প্রস্তাব হচ্ছে নারীকেও লম্পট হতে হবে । তা-ও ভালো যে পুরুষের ধর্ষণের বিপরীতে এরা সমাধান প্রস্তাব করে না যে নারীদেরও ধর্ষক হতে হবে ।

পশ্চিমে এরই মধ্যে এই ব্র্যান্ডের নারীবাদের ঝামেলাগুলো প্রকাশ পাওয়া শুরু করেছে । কিছু মাস আগে আমেরিকার একটা ভার্সিটিতে এক ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে যায় এভাবে যে, কোন একটা পার্টিতে সে ও তার এক ছেলেবন্ধু প্রচুর পরিমাণে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যায় । মাতাল হয়ে যাবার পর তার আর কিছু মনে নেই । কিন্তু তার মনে হচ্ছে তারা সেক্স করেছে । সেখানে জোর-জবরদস্তির কোন প্রমাণ দূরে থাক সে নিজে সেক্স করেছে কি করে নাই একথাও মনে করতে না পারলেও বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ ছেলেটিকে বহিষ্কার করে । আবার কানাডার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরুষ-অধিকার সংঘ নামে এক সংগঠনের মিটিং কক্ষের বাইরে স্লোগান এবং পিকেটিং এর মাধ্যমে তাদের সমাবেশকে ভন্ডুল করে দেয়া হয় ফায়ার এলার্ম এর সাহায্যে , তাতেও কেউ টু শব্দটি করে নি । নারীর উপর পুরুষের অনেক শতাব্দী ধরে যে অত্যাচার , তার তুলনায় এগুলো খুবই তুচ্ছ ঘটনা হলেও,র‍্যাডিকাল নারীবাদীদের ব্লগ ও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের লেখা পড়লে সহজেই অনুমান করা যায় তাদের ব্র্যান্ডের নারীবাদ আদতে পুরুষের উপর প্রতিহিংসা ছাড়া কিছু না । সেটা নারীর মুক্তিও আনবে না । আনবে কেবল কিছু আগ্রাসী নারীর জন্য ক্ষমতা ।

এরই মধ্যে তাই পশ্চিমে র‍্যাডিকাল নারীবাদ ও যুক্তি-বিজ্ঞান-নাস্তিকতাভিত্তিক মুক্তচিন্তা আন্দোলনের পথ আলাদা হয়ে গেছে । এমনিতে পশ্চিমের দার্শণিক জগতে কিছু একটা ঘটলে আমাদের অঞ্চলে তার ঢেউ আসতে আসতে বছর পঞ্চাশেক লেগে যায় । এক্ষেত্রে হয়তো মাত্র চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই হয়ে যাচ্ছে । মুক্তচিন্তকরা সমাজের থেকে দর্শণে ও চিন্তায় আগানো বলেই সম্ভবত ঘটনাটা এত তাড়াতাডি এখানেও রিপ্লে হচ্ছে । এটা ঘটার ছিলো । দুঃখ করার কিছু নাই ।