১৯৮০ইং সাল।একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এখন দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি।মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্য বিরোধীতাকারী-পাকিস্তানের পক্ষে জাতিসংঘে গিয়ে যিনি বক্তৃতা করেছিলেন-সে শাহ আজিজুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করলেও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখল জিয়াউর রহমান।ফলত: রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট।রাষ্ট্রপতির হাতে ভেটো ক্ষমতা। তার সম্মতি ব্যতিরেকে পার্লামেন্ট কোন আইন পাশ করতে পারবে না।সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে মুছে ফেলা হয়েছে মু্ক্তিযুদ্ধের চেতনাসিক্ত চার মূল নীতি।স্বাধীনতার মাত্র অর্ধযুগ পরে দেশ আবার সে পাকিস্তানী ধারায় ফিরে যাবে-ভাবতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আলমের।এত জীবন দান, এত সম্ভ্রম হারানো-সবই বৃথা হয়ে গেল? যারা সেদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল-তারা সকলে তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছিল না? তা যদি হত-কোথায় আজ তারা? একজন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কিভাবে ক্ষমতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে? ইত্যাকার প্রশ্ন আলমকে অনুক্ষণ পীড়া দিতে লাগল।
আওয়ামী লীগ দক্ষিণ পতেঙ্গা ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসাবে রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে আলম। কিন্তু দলের মধ্যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব আলমকে ভীষণ ভাবে হতাশ করে। নগর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ পরিস্কার দু’গ্রুপে বিভক্ত।কোন কোন সভা-সমাবেশে পরস্পর বিরোধী শ্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে-রুশ-ভারতের দালালেরা হুশিয়ার-সাবধান, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংশ হউক-নিপাত যাক।কোন কোন কর্মীসভা পরস্পর বিরোধী গ্রুপের সংঘর্ষে পণ্ড হয়ে যায়।আলম অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে-বিবাদমান নেতৃবৃন্দের মধ্য দ্বন্দ্ব যতটা না আদর্শিক, তার চেয়ে বেশী নেতৃত্বের লড়াই। আলম আরো বিস্মিত হয়-দ্বন্দ্বে লিপ্ত নেতৃবৃন্দ পরস্পরের প্রতি এত শ্রদ্ধাহীন-তারা একে অন্যের ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা করতেও ছাড়ে না।
চট্টগ্রাম মহানগরে একটি পক্ষ প্রবীণ নেতা সিরাজুল হক মিঞার নেতৃত্বে এবং আরেকটি পক্ষ অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত।সিরাজুল হক মিঞার গ্রুপ বাকশালপন্থী, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর গ্রুপ বাকশাল ধারণার বিরোধী। সিরাজুল হক মিঞার গ্রুপের কার্যালয় আলকরণ-প্রধান সড়কের পাশে পুরানো একটি দোতলা দালানে, আর মহিউদ্দিন চৌধুরীর কার্যালয় খাতুন গঞ্জে আবু তালেব সওদাগরের দোকান কিংবা এন,জি, মো: কামালের বাসায়।
আলম চিটাগাং স্টিল মিলস লি: এর শ্রমিক নেতা সুলতান আহাম্মদ চৌধুরীর সাথে সিরাজুল হক মিঞা আহুত সভায় যায়, আবার এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী আহুত সভাতেও উপস্থিত হয়।আলম সবিস্ময়ে উপলব্ধি করল-দলের এ দ্বন্দ্ব তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত।এমতাবস্থায় দলের নগর কমিটির দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে জে,এম,সেন হলে।১৯৭৮ ইং সাল। সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকা থেকে তোফায়েল আহমদ সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ আসলেন।এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর গ্রুপ সম্মেলনে উপস্থিত হলেও সিরাজুল হক মিঞার গ্রুপ উপস্থিত হল না।আলম তার্ ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ সহ জে,এম,সেন হল প্রাঙ্গনে উপস্থিত হল। সম্মেলন শুরু হবে, নেতৃবৃন্দ মঞ্চে উপবিষ্ট, এমন সময় একদল যুবক সরাসরি মঞ্চে হামলা করল। মাইক ছিড়ে ফেলে মঞ্চে রক্ষিত ব্যানার-ফটো ইত্যাদি ছুঁড়ে ফেলে দিল। শুরু হল ভাঙ্গচুড়।তাদের ভাঙ্গচুড় থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবিও রেহাই পেল না। সাধারণ কর্মীরা ভয়ে এদিক সেদিক দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করল। কয়েক মিনিটের মধ্যে হল চত্বর শুন্য হয়ে গেল।সম্মেলন পণ্ড হয়ে গেল।অবাক বিস্ময়ে আলম এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করল। এক বুক হতাশা ও ক্ষোভ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসল।
মূল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি আলম শ্রমিক রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়ে। পতেঙ্গা-হালিশহর শিল্পাঞ্চল নিয়ে গঠিত আঞ্চলিক শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয় আলম।বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা সুলতান আহাম্মদ চৌধুরী হন তার সভাপতি।
ইতোমধ্যে সমাজতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে আলম। আলম বিশ্বাস করতে শুরু করে-বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যেই বাকশান পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেনে। কিন্ত স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র শুধু নয়, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে অনেক নেতৃবৃন্দও বঙ্গবন্ধৃর এ কর্মসূচীর পক্ষে ছিল না।তাদের সকলের চক্রান্তের ফলেই ১৫ ই আগস্টের মর্মান্তিক প্রতিবিল্পব সংগঠিত হয়।
আলম উপলব্ধি করতে শুরু করে-যে রাজনৈতিক দল দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন করে সর্বশেষে মুক্তযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন-স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটানোর জন্য সে রাজনৈতিক দল আদৌ উপযোগী ছিল না।কারণ আওয়ামী লীগ ছিল বস্তুত সমাজের সকল শ্রেণীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি গণসংঠন। কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুক্তির কথা বললও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ারে বাঙ্গালী ওঠতি বুর্জোয় শ্রেণীও স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধীনতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হন। পশ্চিমা ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া ব্যবসার বিপরীতে নিজেদের ব্যবসায়িক সুবিধা পাওয়ান স্বপ্ন এসব বাঙ্গলী উঠিতি বুর্জোয়াদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে কেবল সম্পৃক্ত করে নি, বরং নেতৃত্বেও তাদের শক্তিশালী প্রতিনিধি রাখতে তার সক্ষম হন।ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পশ্চিমা শিল্পপ্রতিদের ক্ষদ্র-মাঝারি-বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে বাঙ্গালী শিল্পপতিদরে শিল্প কারখানা ও ব্যাংক-বীমার মত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করাকে তার কখনো সহজ ভাবে মেনে নেননি।বরং শিল্প-কারখানার জাতীয়করণ কর্মসূচী ব্যর্থ প্রমাণের জন্য তারাও ছিল মরিয়া হয়ে।পঁচাত্তর সালে এসে বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল নামক জাতীয় দল গঠন করলেন, তারা তখন প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর পুনর্জীবিত আওয়ামী লীগের চরিত্রে সে বৈশিষ্ট্য আরো প্রকট হয়ে ওঠল।ইউনিয়ন পর্যায় থেকে থানা জেলা হয়ে কেন্দ্র পর্যন্ত দুই মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে পড়ল আওযামী লীগ-এ বিভক্তির মধ্যেও আছে বহু উপদল । যেখানে সভা,সম্মেলন,কর্মীসভা, সর্বত্র্ই পরস্পর বিরোধী শ্লোগান। এ দ্বিধাবিভক্তি আপাত: আদর্শিক মনে হলেও গ্রুপ-স্বার্থ ও ব্যক্তি দ্বন্দ্বের কারণে একই গ্রুপও বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
মূল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি শ্রমিক রাজনীতিতে মনোযোগী হয় আলম।পতেঙ্গা-হালিশহর শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক লীগের ইউনিট কমিটি গঠনে উদ্যোগী হয় আলম।আলমের মনে হতে থাকে সমাজতন্ত্রে কর্মসূচী্ শ্রমিকদের মাঝে দ্রুত জনপ্রিয় করা যাবে।মার্কসীয় তত্ত্বানুসারে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্বও দিতে হবে শ্রমিকশ্রেণীকে।
প্রচণ্ড উদ্দীপনা নিয়ে আলম শ্রমিক লীগ নামক সংগঠনকে সংগঠিত করার চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করে । শ্রমিক লীগকে সংগঠিত করার প্রয়াসে চট্টগ্রাম শহরের পতেঙ্গা থেকে সীতাকুণ্ড-বাড়বকুণ্ড,কালুরঘাট,পাহাড়তলী,নাসিরাবাদ প্রভিৃতি শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের মাঝে সভা-সমাবেশ করে বেড়াতে লাগল আলম । কিন্তু কাজ করতে গিয়ে সে উপলব্ধি করল-এখানেও সে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। এখানেও প্রতি পদে পদে বাঁধা সৃষ্টি করছে বিভিন্ন দলীয় গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব ।আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ জাতীয় শ্রমিক লীগকে শ্রমিকদের মাঝে আওয়ামী লীগের একটি শাখা সংগঠনের বাইরে অন্য কিছু ভাবতে মোটেও অভ্যস্থ নয়।জাতীয় শ্রমিক লীগ একটি ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন। দেশে প্রচলিত শিল্প-সম্পর্ক অধ্যাদেশ দ্বারা এ সংগঠন নিয়ন্ত্রিত হবে। এসব ব্যাপারে বস্তুত আওয়ামী লীগ নেতাদের ন্যূনতম ধারণাও নেই। তারা এ সংগঠনকে শ্রমিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের শাখা সংগঠন হিসাবেই বুঝে ।শ্রমিকদের পেশাগত সমস্যা-অধিকার-দাবী-দাওয়ার চেয়ে দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনা এখানে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ফলত: আওয়ামী লীগ করে না এমন শ্রমিকদের শ্রমিক লীগের সংগঠনে সমবেত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
সবকিছু সুনসান চলছে।ক্ষমতার হালয়ারুটির ভাগাভাগি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন জেলায় অন্তর্দলীয় কোন্দল মাতছাড়া দিয়ে ওঠেছে। চট্গ্রাম জেলা বিএনপি এর কোন্দল মেটাতে স্বয়ং জিয়াউর রহমান, সাথে বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে নিয়ে চট্টগ্রাম এসেছেন দলীয় কোন্দল নিরসন করতে।
৩০ মে জিয়া্উর রহমান চট্টগ্রামে আসেন। সেদিন ছিল ৩১মে-১৯৮১।আলমের ডিউটি ছিল সকালের পালায়। সকাল ৬-00 ঘটিকার মধ্যে আলম তার অফিসে পৌঁছে। তার অফিসের শহরগামী বাস যখন আসল তাদের মধ্যে লালখান বাজার এলাকার কিছু শ্রমিক ছিল। বাস থেকে নেমেই তারা বলাবলি করতে লাগল-গত ভোর রাতে সার্কিট হাউসে ভীষণ গোলাগুলি হয়েছে। কিছু একটা নিশ্চয় হয়েছে।কারণ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সার্কিট হাউসে ছিল।আলম দ্রত অফিসের একটি গাড়ীর ট্রানজিস্টর শোনার জন্য গেল-বেতারে কোন ঘোষণা আসছে কিনা শোনার জন্য। হ্যা, কিছুক্ষণের মধ্যে চট্টগ্রাম বেতার মুখ খুলল এবং একটি অভ্যূত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার খবরের পাশাপাশি বিভিন্ন সামরিক ফরমানও জারী হতে লাগল।কারা এ অভ্যূত্থানকারী, কী তাদের লক্ষ্য ও আদর্শ, চট্টগ্রামের এ অভ্যূত্থানের সাথে ঢাকার কোন যোগাযোগ আছে কিনা, কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না।তখন চট্টগ্রামের স্টেশন কমাণ্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল মঞ্জুর।চট্টগ্রাম বেতারে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠনের ঘোষণা প্রদান করা হল এবং এ তথাকথিত বিপ্লবী পরিষদ বিভিন্ন ঘোষণা প্রদান করা শুরু করল।অন্যদিকে চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার সংবাদ প্রচারের সাথে চট্টগ্রামস্থ সেনা সদ্স্যদের আত্মসমর্পন করার জোরালো আহ্ববান জানানো হতে লাগল।
জনগণ হতভম্ব। কোথা থেকে কি হয়ে গেল তা তারা বুঝতে পারছেনা।টিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে ঢাকার অনুষ্ঠানের পরিবর্তে নির্বাক স্লাইড শো’র মাধ্যমে বিপ্লবী পরিষদের নানা ঘোষণা প্রচার করা হতে লাগল। বস্তুত: রেডিও টিভির মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও ঢাকার মধ্য মনস্তাত্বিক লড়া্ই চলতে লাগল। অবশেষে বিপ্লবী পরিষদের নিতৃবৃন্দ রণে ভঙ্গ দিল। জেনারেল মঞ্জুর সপরিবারে পালিয়ে গেল। তাবে জীবিত কিংবা মৃত ধরার জন্য ঢাকা থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হল। ফটিকচড়ির একটি চা বাগানে পুলিশের হাতে জেনারেল মঞ্জুর ধরা পড়লে তাকে হাটহাজারী থানায় নিয়ে আসা হল। সেনাবাহিনীর একটি দল তাকে পুলিশের কাছ খেকে ছিনিয়ে নিয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে আসা হল।অত:পর ঘোষণা করা হল-একদল উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্যদের হাতে জেনারেল মঞ্জুর নিহত হয়েছে।একাত্তুরের আরো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডারের জীবন অবসান ঘটল। বস্তুত: পুরা ঘটনা্টাই সহস্যাবৃত।কারা কোন উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করল, জেনারেল মঞ্জুর কিভাবে নিহত হলেন, ঢাকায় এ ষড়যন্ত্রের কুশিলব কারা ইত্যাকার বিষয় এখনো রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। তবে পুরা ঘটনার ফলশ্রুতিতে কেবল মুক্তিযোদ্ধারিই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।লাভবান হয়েছেন অমুক্তিযোদ্ধা জেনারেল হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ।অবসান ঘটে জিয়ার শাসনামল।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার শাসন দেশকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাব পশ্চাদে নিয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন মেজর ।ঘটনাচক্রে চট্টগ্রাম শহরে অবস্থানের কারণে এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তিনি চট্টগ্রাম বেতারে ২৭ সে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সে ঘটনা একজন অখ্যাত মেজরকে বিখ্যাত করে তুলে।একই ভাবে ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীর উপপ্রধান থেকে প্রধান হওয়া, ৩রা নভেম্বরে খালেদ মোশাররফের ব্যর্থ অভ্যুত্থান, অত:পর ৭ই নভেম্বরের তথাকথিক সিপাহী জনতার বিপ্লবের পথ ধরে তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শৗর্ষে আরোহন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমাণ্ডার জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণ কিছুটা আশ্বস্ত হন যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর খুনীচক্র দেশকে যেভাবে পাকিস্তানী ভাবধারায় নিয়ে গিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা জিয়া দেশকে সেখান থেকে আবারো মুক্তিযুদ্ধে চেতনাসিক্ত পথে নিয়ে আসবেন। কিন্তু না । সকলকে হতবাক করে দিয়ে মেজর জিয়া খুনী চক্রের প্রদর্শিত পথেই দেশ পরিচালনা করতে লাগলেন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মৌল চেতনা ধর্মেনিরপেক্ষতা, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি তিনি সংবিধান থেকে মুছে ফেললেন এক কলমের খোঁচায়।সংবিধানের শৃরুতে “পরম করুণাময় আল্লাহের নামে শুরু করিলাম” বাক্য যোগ করে তিনি বাংলাদেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রূপ দিতে চাইলেন।বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরা তাকে ক্ষমতায় বসালে তিনি কখনো সমাজতেন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না । জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুন: চালু করেছেন বলে যে দাবী করা হয়, তা বস্তুত: সত্যের অপলাপ মাত্র।
মোস্তাককে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন কয়েকজন বিদ্রোহী মেজর।অথচ তিনি যে সরকার গঠন করেছিলেন, তা ছিল বেসামরিক সরকার।একইভাবে জিয়াকেও ক্ষমতায় বসিয়েছিল কর্ণেল তাহেরের উস্কানীতে সংগঠিত তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের নামে কিছু সেনা সদস্যরা-যা কোন অবস্থানেই বৈধ বা গণতান্ত্রিক ছিল না।অত:পর সায়েম বাধ্য হয়ে তাকে পুনর্বার ক্ষমতায় বসান এবং তিনি গঠন করেন সামরিক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি ফৈজী সরকার।প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সামরিক কর্মকর্তাদের তিনি পদায়ন করেন।ফলত: একদলীয় শাসনের চেয়ে স্বৈরতান্ত্রিক রূপ লাভ করে তার সরকার।বাঙালি জাতিয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা বলে তিন বাংলাদেশকে বস্তুত একটি ইসলামী দেশের ভাবমূর্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাই স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিবৃন্দকে তিনি তার পাশে সমবেত করেন।মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে হিজবুল বাহারে নৌ সফরে গিয়ে ছাত্র আন্দোলনকে কলুষিত করার পথ উম্মুক্ত করেন।যে শাহ আজিজুর রহমান জাতিসঙ্ঘে পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধীত করে বক্তব্য রেখেছিলেন, সে শাহ আজিজেকে তিনি করলেন বাংলাদেশে প্রধান মন্ত্রী।
পচাঁত্তুরের খুনীদের জিয়া বিভিন্ন ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা শুধু করেন নি, অধিকন্তু তাদের বিচারের পথ চিরতরে বন্ধ করার জন্য জারী করা ইনডেমনিটি অধ্যাধেশকে সংবিধানের অংশে পরিণত করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে বিচার করলে নির্দ্বিধায় বলা যায়-মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার শাসন বাংলাদেশকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে অনেক পশ্চাদে নিয়ে যায়।চলবে–
(কৈফিয়ত: আমার উপরোক্ত ধারাবাহিক লেখাটির ষষ্ট পর্ব পোস্ট করেছিলাম ১৭ জানুয়ারী-২০১৫। তার পর বেশ কিছু দিন আমি আমার ব্লগে ঢুকতে পারি নি। সে বিষয়টি নিয়ে অভিজিৎ এর সাথে যেদিন আমার বাক্য বিনিময়, সেদিনই তিনি বাংলাদেশে নির্মমভাবে খুন হন। তার নিহত হওয়ার ঘটনা আমকে এমনভাবে ক্ষুদ্ধ ও ব্যথিত করে যে-দীর্ঘদিন আমি আর ব্লগে লিখিনি-লিখেতে ইচছা হয় নি । তাই সপ্তম কিস্তি পোস্ট করতে এ বিলম্ব।যে বিষয়টি আমাকে ভীষণ পীড়িত করেছে-তাহল অভিজিৎ কেন এদেশে আসল এত হেলাফেলা করে। মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য তার বেঁচে থাকা যে খুব প্রয়োজন ছিল । ভীতু হওয়া নয়, আপোষকামীতা নয়, নয় পশ্চাদাপসরণ-কিন্তু লড়াইয়ে জিতার জন্য কৌশলীত আমাদের হতেই হবে।)
“মাতৃভাষাকে দাবিয়ে রাখলে তার পরিণতি হয় ভয়ানক।বাংলাদেশের উদাহরণই ধরা যাক।পাকিস্তান হওয়ার পর উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়ে ছিল।কিন্তু(পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলিয়ে) অবিভক্ত পাকিস্তানে জনগণের ৬০ শতাংশ বাংলায় কথা বলতো,আর বাকী ৪০ শতাংশ লোক হিন্দী,বালুচী,পাঞ্জাবী ও উর্দু ভাষায় কথা বলতো।এই ছিল প্রকৃত ভাষা পরিস্থিতি।কিন্তু উর্দু ভাষাকে জাতীয় ভাষা করায় পূর্ব পাকিস্তান(বর্তমান বাংলাদেশ) বিদ্রোহ করলো।শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ভেঙ্গে গেল,ও বাংলাদেশ স্বাধীন হ’ল।সেই সময়ের একটি বিখ্যাত গান – ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়’ – জনগণের আবেগের উদ্বোধন ঘটিয়েছিল,আর মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবীকে ঘিরে সমস্ত দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।জনগণের আবেগ কে বেশী দিন জোর করে’ দাবিয়ে রাখা যায় না।মানুষ মাতৃভাষাতেই সব থেকে ভালভাবে নিজেকে প্রকাশ করে’ থাকে।আর সেই মাতৃভাষাকে দাবিয়ে রাখার অর্থ প্রাণধর্মকে হত্যা করা।
ভাষা-নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই ধরণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে মেনে না নিয়ে যদি কেউ জোর করে’ বিশেষ কোন ভাষাকে অন্য ভাষার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তবে তা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও উত্তাপকে বাড়িয়ে দেশকে বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে ঠেলে দেবে।এই আত্মঘাতী নীতি উগ্র ভাষান্ধতাকে আরও উস্কে দেবে – যা সমাজের সুস্থ পরিবেশকে কলুষিত করে’ দেবে।
—-(শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার)