বাংলাদেশিদের ফেসবু্কিং করতে সবসময় একটা হুজুগের দরকার হয়। কখনো ক্রিকেট, কখনো ব্লগার নাস্তিক, কখনো ভারত কিংবা কখনো পাকিস্তান নইলে রমজান উপলক্ষ্যে ইমানদার প্রোফাইল ফটো। কিছু না কিছু চাই মাঠ গরম রাখতে। এখন হিট যাচ্ছে, ‘সমকামিতা’। এ্যামেরিকায় সমলিঙ্গের মানুষদের একসাথে বসবাসের অধিকার আইনত বৈধ বলে আদালত রায় দেয়ার পর থেকে বাংলাদেশের অনুভূতিপ্রবণ মানুষদের কোমল মনে আবার হেঁচকি উঠে গেছে। ফেসবুকে প্রায় স্ট্যাটাস আর পোস্ট দেখছি, “সমকামিতা, মানি না, মানবো না”। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, ভাই আপনারে জিঙ্গাইসে কে? আপনার মতামত চাইছে কে? আপনে মানার কে? আপনে এ্যামেরিকার আদালতের থেইক্ক্যা বেশি বুঝেন? আপনাকে মানতে হবেই তাই কে বলছে?
প্রকৃতি বৈচিত্র্য ভালবাসে। কেউ বাঁহাতি হয়, কারো কারো ছটা আঙুল থাকে, কারো চোখ ট্যারা, কেউ কথা বলতে আটকায়, কারো চোখের রঙ কটা, গায়ের রঙ, উচ্চতা ভিন্ন হয় মানুষের, তৃতীয় লিঙ্গ কিংবা লিঙ্গহীন হয় তার বেলায়? সেখানে মানি না, মানবো না কেন আসে না? মানুষের অবস্থা দেখলে মনে হয়, ‘সমকামিতা’ একটি ফ্যাশনের বস্তু, দামি ব্র্যান্ডেড সানগ্লাস কিংবা পারফিউমের মতো, যা ইচ্ছে করলেই কেনা বা বদলানো যায়। যার যার স্বাভাবিক জীবন অবস্থা, কেউ বিষমকামী, কেউ সমকামী। কতো মানুষ আগে ‘সমকামি’ হওয়ার লজ্জায় আত্মহত্যা করেছে, পরিবার-পরিজনের নিগ্রহের কারণে। বহু পথ পেরিয়ে আজকে তাদের জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ্যামেরিকার আদালতকে ধন্যবাদ এদের বহু দিনের কষ্টের প্রতি সম্মান জানানোর জন্যে। মুসলমান বা হিন্দু হয়ে জন্মানোর ওপর যেমন মানুষের নিজের কোন হাত থাকে না তেমনি বিষমকামী হবে না সমকামী, লম্বা হবে না বেঁটে তার ওপরও একজন মানুষের হাত থাকে না। যারা আজকে রায়ের বিরুদ্ধে নেচে বেড়াচ্ছে তাদের কী আদৌ ধারণা আছে, এই রায়ের পিছনে কতো চোখের জল, কতো অপমান, কতো মৃত্যু লুকিয়ে আছে যার ওপরে মানুষের কোন হাত ছিলো না?
প্রাকৃতিক তো নিঃসন্দেহেই সমকামিতা, অন্তত ১৫০০টা প্রজাতিতে এর অস্তিত্ব আছে, যাতে মেরুদণ্ডীই ৩০০+। কিন্তু , প্রকৃতিতে আছে বলেই ভালো, এটা এক ধরনের ভ্রান্ত যুক্তি। এর নাম ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসি বা এ্যাপিল টু নেচার। অজাচারও প্রাকৃতিক, বেগ চাপলে খোলাখুলি ত্যাগ করাও তাই, নগ্ন থাকাও প্রাকৃতিক। আবার, আইনকানুন তেমন প্রাকৃতিক না, রাষ্ট্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা ইত্যাদি বিশেষ প্রাকৃতিক না, তাই বলে এসব কে বা কারা ফেলে দিচ্ছে? প্রকৃতির দোহাই দিয়ে মানা যেমন অযৌক্তিক, তেমনি বাধা দেওয়াও।
অনেকে বলছেন, এতে মানুষের অভ্যাস নষ্ট হবে, বিকৃত রুচির চর্চা হবে। সমাজ নষ্টামির দিকে ধাবিত হবে, সমাজ পচে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এজ ইফ যারা এগুলো করে যাচ্ছে তারা আদালতের এই রায়ের অপেক্ষায় ছিলো আর কী! নষ্টামির জন্যে মোটামুটি বিখ্যাত জায়গাগুলো হলো চার্চ, মাদ্রাসা, জেলখানা, হোস্টেল, ইত্যাদি। আজকাল এর মধ্যে স্কুল আর কোচিংও যোগ হয়েছে। যান ভাই, যারা মানুষের অধিকার মিসইউজ করে, তাদের পারলে ঠেকান। কথা দিচ্ছি, সমকামিতা কেন, কোন কিছু নিয়েই শব্দ করবো না, মুখ একদম বন্ধ। ধর্ষনের নৃশংসতা বন্ধ করুন। সমকামীদের নয় বরং বিষমকামীদের সামলান।
অনেকেই আবার দুজন মানুষের পাশাপাশি থাকার সার্থকতা নিয়ে পড়েছেন। বিয়ে বা লীভ টুগেদার লোকে কেন করে, কী তার উদ্দেশ্য আর কী তার বিধেয়। সন্তান উৎপাদন বিয়ের বা প্রেমের শেষ কথা না। বন্ধ্যা দম্পতিও যেমন পরম করুণাময়ের অশেষ ইচ্ছেয় আছে, তেমনি আছে স্বেচ্ছায় সন্তানহীন থাকাও। এমনকি বিয়ে না করে থাকার মতোও অনেকে আছেন। কাজেই বিয়ে=সন্তানোৎপাদন, এটা মোটেও কোনো উদাহরণ বা যুক্তি না। পৃথিবীর সব প্রেমই যেমন সন্তানপ্রসবে পৌঁছায় না বিষমকামীদের বেলায়, তেমনি সমকামীদেরও হবে না। মজার ব্যাপার হলো, সমকামীদের নিজেদের সন্তানও হয়। এক হিসাবে দেখা যায়, প্রায় সত্তর শতাংশের ওপরেই সমকামীদের নিজস্ব জিনবাহী সন্তান থাকে, বাকিটা দত্তক। কাজেই বংশবৃদ্ধি থেমে যাওয়ার কল্পনাটা রূপকথা, কুযুক্তি। তাছাড়া, পৃথিবীর সব মানুষকে অবারিত সুযোগ দিলেও তারা কখনোই সমকামী হবে না, যেমন সমকামীরা বিষমকামী বা উভকামীতে রূপ নেবে না।
ধর্মপ্রাণ মানুষেরা যেকোন রহস্যময় ব্যাপারের মধ্যেই ওপরওয়ালার লীলাখেলা খুঁজে পান। কুরানে গেলমানের কথা উল্লেখ আছে, সেখানে সমকামিতার প্রশ্ন আসে না? সব ব্যাপারে যারা সৃষ্টিকর্তার রহস্যের ওপরে আস্থাবান, সমকামী মানুষের ব্যাপারে কেন তাদের আস্থা হোঁচট খাবে! সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ছাড়া তো এই সৃষ্টি আসে নি? তারা ন্যায় অন্যায় যাই করুক, তিনি দেখবেন, আমাদের মানা না-মানা নিয়ে বেহুঁশ হওয়ার কী আছে? কুরানে বলা আছে, “আশরাফুল মাখলুকাত” মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ। ক্যাটাগরি করা হয় নাই, কারা কারা তার মধ্যে আছে আর কারা নেই। আশাকরি কোরান সার্বজনীন হিসেবে, আস্তিক, নাস্তিক, হিন্দু, জৈন, সমকামী, বিষকামী, বাঙালি, পাহাড়ি সবার কথাই বলেছে। তাই ব্যাপারটা তাঁর হাতেই ছেড়ে দেন, তিনি দ্বীন দুনিয়ার মালিক, তিনিই দেখবেন।
আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট থেকে বলতে চাই, যে দেশে দুজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ভালবেসে একসাথে থাকার অধিকার নিয়ে টানাটানি চলে সে-দেশের মানুষের সমকামিতার মতো মানবিক ব্যাপার নিয়ে মানা না-মানার দিকটা না-ভাবলেও চলবে। আপনাদের মানার দরকার নেই, নিজ নিজ কাজেই বরং মন দিন।
অনেকেই এটাকে একটা রোগ ভাবেন, তাদের জ্ঞানের পরিধি আর বোঝার মন বিচার করে, বলার কিছু নেই।
একজন মানুষকে সম্মান করতে, ভালবাসতে শিখুন। তার স্বাভাবিক জীবনটা স্বাভাবিক ভাবে দেখুন, তারও আপনার আমার মতো নিজের পছন্দে বেঁচে-থাকার পূর্ণ অধিকার আছে, সেটুকু মেনে নিন।
সর্বোপরি, কোন ব্যাপার নিয়ে জ্বালাময়ী, বিদগ্ধ স্ট্যাটাস দিয়ে লাইকের বন্যায় ডুবে যাওয়ার আগে, বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা করুন, জানুন তারপর লিখেন। অন্যের জন্যে নয়, জানতে চেষ্টা করুন নিজের জন্যে। যে-ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে কোন কিছুর উপসংহার টানছেন সে-ধারণাটি কতোটুকু সঠিক, সেটি জানার প্রয়োজন আছে বই কি। হুজুগের বন্যায়, ভেসে যাচ্ছে ন্যায় আর অন্যায়…
তানবীরা
০৭/০২/২০১৫
সেটাই তো হ্ওয়া উচিত। এই হুজুগে যেমন হেফাজতিরা নেমে পড়েছে, তেমননি নতুন প্রজন্ম্ও খোলা চোখে দেখছে সব কিছু। সেদিনই কলেজে পড়ুয়া ছেলে ইনবক্স করে সমকামিতা নিয়ে জানতে চাইছিল। তাকে মুক্তমনা ও গুরুচণ্ডালির কিছু লিঙ্ক দিয়েছি।
আর সমকামিতা নিয়ে আমার একটি প্রতিবেদন এখানে।
All the Cadet Colleges in Bangladesh a= Government Subsidize Sodomy Promotion
বুঝলাম না এই মন্তব্যের সাথে আমার পোস্টের কী যোগসূত্র
একজন মানুষকে সম্মান করতে, ভালবাসতে শিখুন। তার স্বাভাবিক জীবনটা স্বাভাবিক ভাবে দেখুন, তারও আপনার আমার মতো নিজের পছন্দে বেঁচে-থাকার পূর্ণ অধিকার আছে, সেটুকু মেনে নিন।
সহমত …
ধন্যবাদ লেখাটির জ়ন্য।
সবাইকে দেখি এই একটা কথাই বারবার বলে। আচ্ছা সমকামীদের সমকামী যেন বানিয়েছে কে? প্রকৃতিই তো, নাকি? তারা তো মায়ের গর্ভে বসে প্রকৃতিপ্রদত্ত জীনকে নিজের ইচ্ছায় নিজের হাতে ডিজাইন করে জীনের গঠন পালটে দেয়নি। আর প্রকৃতিপ্রদত্ত কয়টা জিনিসইবা আমরা ঠিকভাবে যেমন ছিলো তেমন রেখেছি? জঙ্গলে ভর্তী পৃথিবীর গাছপালা সব কেটে লোকালয় বানিয়েছি, পাহাড় কেটে বানিয়েছি সমতল, সেসব কিছুতে প্রকৃতির দুঃখে আমরা কাতর হইনা, যত প্রকৃতিপ্রেম জেগে ওঠে সমকামীদের বিরুদ্ধে। আমি সমকামি দেখতে না পারলে একটা কিছু যুক্তি তো দেখানো লাগবে আর কি, হোমোফোবিয়া ইট ইজ। মুক্তমনাদের অনেকের মধ্যেও এই জিনিসটা দেখি। এটা থাকা খুব বেশি দোষের কিছু না। আমাদের বৈষম্যে ভরা সমাজই এটা শিখিয়েছে। তবে যাদের হোমোফোবিয়া আছে তারা আরো বেশি বেশি সমকামিদের ওপরে পড়ুন, জানুন। আস্তে আস্তে আপনাদের কাছেও স্বাভাবিক মনে হবে।
এসব সম্বন্ধে খোলামেলা মন্তব্য দিলে আবার ভাবে, বিদেশে এসে মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। উলটা পালটা বকছি স্মার্ট হওয়ার জন্যে 🙂
এই হিসাবটা কোথা থেকে পাওয়া ? পুরো জিনিসটা পড়তে চাই ।
@ দূরের পাখি,
সত্তর শতাংশের হিসেবটা হাতে নেই তবে সমকামী মহিলা বা সমকামী পুরুষেরা ইতোমধ্যে তাদের নিজস্ব সন্তান জন্ম দিয়ে লালন পালন করছেন তা তো সত্য । সমকামী পুরুষের চাই নারীর ডিম্বানু আর সমকামী মহিলার দরকার পুরুষের শুক্রানু । মহিলাদের জন্যে প্রক্রীয়াটা যত সহজ অবশ্য পুরুষের জন্যে তত সহজ নয়, কারণ উভয় ক্ষেত্রেই একজন নারীর গর্ভের প্রয়োজন । বিজ্ঞান একদিন পুরুষের এই অসুবিধেটাও দূর করে দিবে বলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন ।
এখানে আছে http://www.lifelongadoptions.com/lgbt-adoption/lgbt-adoption-statistics
আপনি আরো সার্চ করে দেখতে পারেন নেটে
এখানের লিংকটা আগে একজন দিয়েছিলেন । ডেটাগুলো কিন্তু আপনি যেকথা বলতে চাচ্ছেন সেটা বলছে না । এখানকার ডেটা অনুযায়ী
৭০ ভাগের নিজস্ব বায়োলজিক্যাল সন্তান, বাকী ৩০ ভাগ দত্তক নেয়া সন্তান । এখন যদি একহাজার যুগলের মধ্যে ১০ টা যুগল মাত্র সন্তানসহ বসবাস করে আর তাদের ৭ যুগলের সন্তান বায়োলজিক্যাল এবং ৩ যুগলের সন্তান দত্তক নেয়া হয় তাহলেও কিন্তু ডেটাটা সত্য হয় । কিন্তু সেটা আপনার পয়েন্টকে সমর্থণ করে না ।
আপনি যেটা বলতে চাচ্ছেন তার জন্য যত সমকামী যুগল আছে তাদের মধ্যে কতভাগ সন্তানসহ বসবাস করছে সেটার ডেটা লাগবে । বায়োলজিক্যাল নাকি দত্তক নেয়া সেটা গুরুত্বপূর্ণ না ।
আপনার প্রথম প্রশ্নটা থেকে দ্বিতীয় প্রশ্নটা ভিন্ন, নীচে আর একটা লিঙ্ক দিলাম
http://www.childwelfare.gov/pubPDFs/f_gay.pdf
যদিও আমার কাছে সমকামী কিংবা বিষকামী কারো বিয়ের উদ্দেশ্যই শুধু সন্তান হতে পারে না। সার্থক প্রেম বা বিয়ের মানদন্ড সন্তান উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে নেই বলেই আমার বিশ্বাস
Comment…ঠিক বলছেন