মুক্তমনায় আমার প্রথম প্রবন্ধ “বিধ্বংসী ভালোবাসা”- তে আমি মুক্তমনার পাঠকদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম আমার শিল্পকর্ম সম্পর্কে কিছু লিখবো। আমি আজ আমার “মাই বেবি ইজ গ্রোয়িং আউট সাইড অব মাই বডি” এবং “লেটার টু মাই আনবর্ন চাইল্ড” সিরিজ শিল্পকর্মগুলো নিয়ে কিছু লিখবো। আমি মূলত চিত্রশিল্পী এবং চিত্রকলাতে আমার প্রশিক্ষণ থাকলেও আমার আগ্রহ বিস্তৃত, শিল্পের নানান শাখায়। আমি নির্মাণ করতেও খুব পচ্ছন্দ করি। পচ্ছন্দ করি তৈরী করতে।
আমার মা এর জন্ম যশোর জেলাতে এবং হয়তো কারো অজানা নয় যে যশোরের নকশী কাঁথা বিশ্ববিখ্যাত। এমনকি ইংল্যান্ডের বৃটিশ মিউজিয়ামের সংগ্রহেও, দুশো বছর পুরাতন যশোরের অসাধারণ নকশী কাঁথা রয়েছে। সেই থেকে শুরু, কবে থেকে মায়ের কাছ থেকে সেলাই শিখেছি মনে নেই। মা যেমন ঘরেই সেলাই করতেন ও নকশা তুলতেন তাঁর নিজের শাড়ী ও তাঁর সন্তানদের জন্য জামা কাপড়, তেমনি আমি নিজেরও নিজের তৈরী শাড়ী বা জামা কাপড় পরতেই স্বাছন্দ্য বোধ করি সব সময়। সেই সূত্র ধরেই আমার সেই সব অভিজ্ঞতা গুলোকে সংযোজন করতে থাকি আমার শিল্পকর্মে।
সব সময় ভিন্ন ভাবে চিন্তা করাবার প্রবণতা আমার আজীবনের। আমার শিল্পে আমি সবর্দা নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই তুলে ধরেছি। ২০১২ সালের শুরুর দিকে আমি কিছু কোলাজ করি কাপড় দিয়ে। এবং সেই সময় চিন্তা করি আমি, সুতা ব্যবহার না করে, কেনো আমার চুল ব্যবহার করি না? বলাই বাহুল্য আমার চুল মোটা ও অনেক লম্বা এবং খুব ঘন। সেই থেকে আমি চুল আচড়ানোর পর সেই চুল গুলো না ফেলে সংগ্রহ করা শুরু করি এবং আমার শিল্পকর্মে ব্যবহার করা শুরু করি। আমার চুল আমার শরীরের অংশ। আমার ডি এন এ বহন করছে যা। আমার আত্মপ্রতিকৃতি বললেও ভুল হবে না।
চুল সংগ্রহ করার প্রক্রিয়াটি বেশ অবেগঘন। নিজের চুল সাধারণত আচড়ে আমরা ফেলে দেই। তার সাথে আমাদের আর কোনো সম্পর্ক থাকে না; পুরাতন চুলগুলো বা চিরুনীতে লেগে থাকা চুল গুলো কখনই দেখতে কারো ভালো লাগার কথা নয়। সেই চুলগুলোকে আমি যত্ন করে তুলে রাখি। মা যেমন শিশুকে যত্ন করে। যেনো আমি নিজেই নিজের মা। আবার নিজেই নিজের শিশু। এমন একটি দ্বিমুখী সম্পর্ক আমি প্রতিনয়ত গড়ে তুলি নিজের সাথে। যত্ন করে তুলে রাখা চুলগুলো দিয়ে আমি সেলাই করি। নকশা করি । কোনো সময় কন্যা শিশুর জামার আদলে জামা বানাই। ফ্রক বানাই বা, কন্যা বা পুত্র যে কোনো শিশুর জন্য ছোট্টো জামা তৈরী করি, যেটা দেখলে সহজে বোঝার উপায় নেই আসলে কোন লিঙ্গের শিশুর জন্য বানানো জামাটি। বিষয়টি তখন একটি অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে বা রহস্যময়তার সৃষ্টি করে। যদিনা কেউ আমার সম্পর্কে জেনে থাকে তবে হয়তো ভাববে যে আমি আমার নিজের সন্তানদের কথা ভেবে সৃষ্টি করেছি সে সব শিল্পকর্ম গুলো বা সে সব জামা গুলো তৈরী করেছি। কিন্তু শিশুহীন একজন নারী হিসেবে আমি মূলত আমার অদেখা সন্তানদের জন্য জামা সেলাই করি । জানি না সে কন্যা না পুত্র … সে আমার স্বপ্নশিশু… সে মানব শিশু …
সেই থেকে আমি ক্রমাগতভাবে আমার চুল ব্যবহার করছি আমার শিল্পকর্মে। নিজের আত্মজীবনী মূলক আমার শিল্পকর্মগুলো। আমি সাধারণত, ব্যবহৃত শাড়ী, বা নতুন শাড়ী ব্যবহার করি, বা সুতির কাপড় ব্যবাহার করি এই কাজ গুলোর জন্য। আমি যদিও মোটা দাগের নারীবাদী নই তবু আমি জানি এই শিল্পকর্ম গুলো আমার নারী জীবনের যন্ত্রনার কথা বলে , বলে আমার অভিজ্ঞতার কথা, আমার সংগ্রামের কথা।
মা যেমন একটি শিশুকে জন্ম দেবার জন্য নিজের জরায়ুতে তাকে বহন করে সুদীর্ঘ নয়টি মাস ; যেমন করে তার শরীরের ভেতরে বেড়ে উঠতে দেয় আরো একটি স্বত্তা, আরো একটি জীবন, আরো একটি স্বপ্ন। আমি আমার শিল্পকর্মগুলোকে বেড়ে উঠতে দেয় ঠিক তেমন করে আমার শরীরের বাইরে, অদৃশ্য কোনো জরায়ুতে। আমি দেখি তাদের বেড়ে ওঠা আমার চারপাশে।
যে উপাদান বা কাপড় গুলো আমি ব্যবহার করি সেগুলোর মসৃনতা বা অমসৃনতা এবং রং নির্বাচনে আমি অনেক ব্যক্তিগত অনিভূতিকে প্রাধান্য দেই। সেগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। বেশীর ভাগ সময় সাদা কাপড় বা শাড়ী ব্যবহার করি। খুব যুক্তি সংগত কারণে যে যাতে আমার চুল গুলো স্পষ্ট দেখা যায় এবং সাদা রঙ যে অর্থ বহন করে সেগুলোও আমার কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সাদা শান্তির রঙ, কোনো ক্ষেত্রে সাদা হলো বৈধব্যের বা বেদনার রঙ। সাদা হতে পারে মেঘ বা পানি বা প্রকৃতির রঙ। সাদা এবং কালো অনেক ক্ষেত্রে আমার কাছে সাদা কাগজ ও কালো কালির রঙ। যা কিন্তু আমার অভিব্যক্তির কথা বলে … মাঝে মেধ্যে চলতি পথে আমি যদি হঠাৎ করে খুজে পাই কোনো মৃত ঘাস ফড়িং বা প্রজাপতি, সেগুলোকেও স্থান দেই আমার আমার শিল্পকর্মে।
আমার চুল ও অনেক কাপড় জড়ো করে বা শাড়ীর কাপড় ব্যবহার করে আমি যে কাঁথাটি সেলাই করেছি ২০১২ সালে, সেটি সাথে আমাদের নকশী কাঁথা সাদৃশ্যতা আছে। আমার মনে পড়ে আমি দেখেছি বৃষ্টির দিনে কিভাবে মাটির বারান্দায় গ্রামের বাড়ীতে মা খালারা পা বিছিয়ে নকশী কাঁথা সেলাই করতো। সেই সেলাইয়ের সাথে জড়িয়ে আছে তাদের অনেক মুহুর্ত অনেক সুখ-দু:খের স্মৃতি। তাদের সেলাই করা নকশী কাঁথাগুলো হয়ে উঠতো এক একটি অনবদ্য শিল্পকর্ম ; আমি সেই ঐতিহ্যকে আমি সেই সংস্কৃতিকে আমার মতো করে, নিজের অভিজ্ঞতার আলোয়, নিজের শরীরের অংশ ব্যবহার করে আবো বেশী ব্যক্তিগত করে তোলার চেষ্টা করেছি।
সৃষ্টির কথায়, শিশু জন্মের কথায়, মনে পড়ে গেলো জরায়ুর পাতলা পর্দার কথা; শিশু মায়ের গর্ভে থাকার সময় যেমন পাতলা চাদরে ঢাকা থাকে; থাকে নিরাপদ; থাকে আদর। তেমনি কাঁথার আদরে আমাদের থাকি নিশ্চিত ভাবে ঘুমে। শিল্পকলার সেই আশ্রয়টা আমার জন্য বড় স্পর্শকাতর, একজন নিঃসঙ্গ মানুষ হিসেবে একজন শিশুহীন নারী হিসেবে।
এই ধরনের বিভিন্ন বিয়ষ বস্তু নিয়ে আমি কাজ করি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে, যা কিনা প্রত্যেকটা মানুষের জীবনের সুখ-দু:খের কথা বলে। আমার কথাগুলো হয়তো আমার মতো করেই কিছুটা ভিন্ন। আমার একটি কবিতা সবশেষে …
জন্মের আগে সিদ্ধার্থ স্বপ্ন ছিলো
ঘরে ফিরতে দেখলাম
একটা জুতো,
ছোট্ট শিশুর
মা তার অমনোযোগী
ছিলো বুঝি?
ফুল গুলো ছিড়ো না
গাছেই থাক ওরা
অন্ধকার এলে
জেনে যাবে
ও গুলো আসলে
গাছেদের জরায়ু !
বইটির আলোচনা পড়েছিলাম ফেসবুকের বইপড়ুয়া গ্রুপে। আপনার কাজ, লেখা আর বইটার আলোচনা সব মিলিয়ে খুব টাচি। অনেক অনেক শুভকামনা সামনের প্রদর্শনীর জন্যে
ধন্যবাদ । শুভকামনা আপনার জন্যও … 🙂
নিরুপায় হয়ে আাপনার দৃষ্টি আকর্ষন করছি ৷কারন আপনাদের দেয়া email link invalid. যাই হোক আমি ব্লগটিতে নিয়মিত Gangchil নামে কমেন্টস করছি ৷ আমি আপনাদের সহায়িকা পড়েছি ৷ আমার ভালো লেগেছে ৷ আমি আপনাদের মতাদর্শ গ্রহন করে নিচ্ছি ৷ একই সাথে অনুরোধ করব আমাকে সদস্য পদ দেয়া হোক ৷ উল্লেখ্য আমি সামু ব্লগেও লিখে থাকি .
Email [email protected]
আমি জানিয়ে দিয়েছি। ধন্যবাদ ।
খুব সুন্দর।
🙂
চমৎকার অনুধ্যান, নিজের আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য কিছু অংশকে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশের অংশ করে নেয়ার সৃজনশীল প্রয়াস। দেশে আমার চোখে পড়েনি কোন শিল্পীকে এত সাবলীলভাবে তাদের নিজেদের সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করতে..অনেক শুভকামনা।
🙂
অন্ধকার এলে
জেনে যাবে
ও গুলো আসলে
গাছেদের জরায়ু !
—অসাধারণ!
🙂
চমৎকার লেখা। এ ব্যাপারে আরো বেশি বেশি লেখা চাই/
ধন্যবাদ । অবশ্যই…..
Letter to a child never born – বইটি পড়েছিলাম, আমার অত্যন্ত ভালোলাগা একটি বই। পড়ার পর থেকেই মনে হয়েছিল বইটি শুধু আমার পড়লেই চলবে না, অনেকেরই পড়া উচিত, কথা গুলো অনেকেরই শুনা উচিত। আপনার শিল্পকর্ম মনে হচ্ছে সেই কথাগুলোই বলছে আপনার ভাষায় – অসাধারন। কনসেপ্টটা আমি অন্য একটা কাজে ব্যাবহার করব, নকল করব বলতে পারেন – ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আগেই, কারন, এরকম কাজের নকল করার লোভ সামলানো সম্ভব নয় ।
এমন কোনো কাজ করতে হয় না যাতে ক্ষমা চায়তে হয় । আমি নকলের বিপক্ষে সব সময়, নিজেও করিনি কখনও । অনুমতি দিতে পারবো না ।
আমার অভিজ্ঞতার সাথে কারোটা মিলবে না ।
বিষয়টাকে ঠিক নকল বলা যাবে না বোধহয়- অরিয়ানা অনাগত শিশুর সাথে কথা বলেছে উপন্যাসে, আপনি ক্যানভাসে বা কাঁথায় আমি বলবো মঞ্চছে এই যা। আর সেখানে আপনার শিল্প অনুপ্রেরনা হয়ে থাকবে আমার সেটে। আশা করি আপত্তি নেই-
আপনি যাদের কাছ থেকেই অনুপ্রাণিত হোন কেনো, তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন আশা করি ।
আপনার সৃষ্টিশীল যাত্রার প্রতি শুভকামনা রইল… মেঘেদের শুভ্রতা আপনার সঙ্গী হোক…
ধন্যবাদ … 🙂
শুভকামনা !
ছোটো বেলায় আমাদের ঠাকুমা ,দিদিমা ,পিসিমারা দেখতাম নানা রকম উপকরণ যেমন দিয়াসালাই বাক্সে,দিয়াসালাই কাঠি, নারকেল তেলের বোতল,স্ট্র, ডিম রাখার কাঠ কাগজের খোলা,পাটের থলে ইত্যাদি দিয়ে নানা রকমের হাতের কাজ করত।
এখন মেযেরা সিরিয়াল দেখে হাতের কাজ করেনা।
একদম ঠিক 🙂 ……………….
অভিনন্দন শিল্পী।
সুন্দরের সৃষ্টির পথ নিষ্কন্টক হোক।
ধন্যবাদ, হোক নিষ্কন্টক ….
শুভকামনা !
@ আসমা সুলতানা মিতা,
দারুণ, যাদু শুধু শিল্পে নয় লেখায়ও আছে। খুব ভাল লাগলো, আরো চাই।
ধন্যবাদ, এমন অনুপ্রেরণা পেলে অবশ্যই লিখবো ….
আপনার শিল্প-চিন্তার বৈচিত্র পাঠক-দর্শক-শিল্পবোদ্ধাদের মনে চিন্তার খোরাক যোগাবে নি:সন্দেহে ! আপনার শিল্প-কর্মগুলো চমৎকার! আপনার শৈল্পিক উপস্হাপনা অসাধারণ ! আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ! আপনার আরো অনেক অনেক শিল্পকর্মের সাথে পরিচিত হবার অপেক্ষায় রইলাম !
ধন্যবাদ । আসছে সেপ্টেম্বর থেকে একটি প্রদশর্নী হতে যাচ্ছে, কানাডাতে সেটার কাজ নিয়েই ব্যাস্ত আছি ; হয়তো পরবর্তিতে সেটা নিয়ে লিখতে পারি । শুভকামনা রইলো ।
সবুজ ফ্রকটি খুব কিউট।
🙂
একজন শিল্পী ও ব্লগারের সংগে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। মুক্তমনায় প্রথম ফটোব্লগ বোধহয় আমিই করেছিলাম। তবে একজন শিল্পী নিজের শিল্পকর্মর সংগে ব্লগ লিখে পাঠকদের পরিচিত করিয়ে দিচ্ছেন, মুক্তমনাতে তো বটেই, বাংলা ব্লগেই এমনটি খুব দেখা যায় না। চমতকার শিল্পকর্ম, ভাবনা ও লেখনি। নকশি কাথার মায়াটুকু জাদুময়। আপনাকে অভিনন্দন!
ধন্যবাদ বিপ্লব ভাই । অনেক ভালো লাগলো …