ইদানিং অনুভূতি এতই তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিয়াছে যে, গাছ নিয়া লিখিতেও ভয় হয়; কখন গাছেরও অনুভূতিতে আঘাত লাগে, লজ্জাবতী লতাও হাতে রামদা’ লইয়া ঘাড়ে কোপ মারিয়া অনুভূতির ব্যথা কমায়।

এক্কেবারে ছোট্টকালে বাড়ি হইতে প্রতিবার বাহির হইবার সময় বড়মা তুলসী গাছ হইতে একটি ইয়া মোটাতাজা তুলসী পাতা তুলিয়া কানের উপরিভাগে গুজিয়া দিতেন। মাঝে মধ্যে হইলেও সহ্য করা যায়; প্রতিদিন কাহাতক সহে। কানের আঘাতের কথা বাদই দিলাম, তুলসী গাছের আঘাতের কথা তুলিতেই বড়মা বলিতেন, ইহা না করিলে ঈশ্বর যে আঘাত পাইবেন। সামলাও ঠ্যালা, দিলেও আঘাত- না দিলেও আঘাত। উভয় সঙ্কট সবদিকেই।

তবুও মনস্থ করিয়াছিলাম একটি নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক ও অনুভূতিতে আঘাতহীন লেখা লিখিব-যাহাতে তেল তেলতেল মসৃণ আঘাতপ্রবন ব্যক্তির আঁতেও যেন ঘা না লাগে।

কী লিখিব? কী লিখিব? চিন্তা করিতে করিতে মনে হইল কিছুদিন আগে মানসিক ব্যাধির জগতে এক নতুন তত্ত্ব পাওয়া গিয়াছে শিলংয়ে। মানসিক রোগীর কিছুই মনে না থাকিলেও স্ত্রীর টেলিফোন নম্বর মনে থাকে।

এই যুগান্তকারী তত্ব পাইতে না পাইতেই আবার আরেকজন স্বগোত্রীয় মানসিক রোগীর চাবুক মারিবার ইচ্ছার কথা জানিলাম। এবারে স্ত্রীকে নয়, আরেকজন বিদ্বান ব্যক্তিকে। ইহার মধ্যে কোন নতুন রোগসূত্রের যোগসূত্র আছে কিনা, তাহা মার্কিণ মুল্লুকে আরেক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করিয়া আরেকটি তত্ব পাইলাম।

সমগ্র জাতি যখন সুক্ষ্ণ সুতার উপর দিয়া হাঁটিয়া চলে, তখন দিনে দুপুরে খুন করিলেও তাহা বিচারহীন স্পর্শ কাতর বিষয় হইয়া পড়ে। সুতা বাবার এই “সুতা তত্ত্ব” খুনীদেরকে আরও অনুপ্রাণিত করিবে নাকি?

উপসংহারে মনে হইতেছে, খুনীরা আজ সমগ্র জাতির ভাসুরে পরিণত হইয়াছে। খুনীদের নাম লইলে জাতির অনুভূতিতে আঘাত লাগিবে, ভোট বাক্স চুরি-চামারী করিয়াও নির্বাচনে জয় লাভ করা যাইবে না। আরও মনে হইতেছে, একটি জাতির অনুভূতির আঘাত যখন কিছু খুনীর অপরাধের সহিত এক করিয়া ভাবা হয়, তখন কিছু না বলিয়া “বুড়ো আঙুল” চোষাই শ্রেয়। বিষ্ময়করভাবে গোটা জাতি আজিকে মুখে “বুড়ো আঙুল” ঢুকাইয়া মৌনব্রত পালন করিতেছে এই ভরসায় যে, নিজে অন্ধ হইলেই প্রলয় বন্ধ হইবে। হইবেক কি?

প্রলয় বন্ধ হইবে কিনা জানি না, তবে আজ “হীরক রাজার দেশে”-র কথা বড্ড মনে পড়িতেছে। তাহার চেয়েও বেশী মনে পড়িতেছে বুয়েটের একটি ঘটনা।

আমরা যখন ছাত্র তখন ইথুওপিয়া হইতে কয়েকজন ছাত্র আসিয়াছিল মেকানিক্যাল বিভাগে। প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ পীড়িত দেশটির ছাত্রগুলোর অবস্থা জ্ঞান-গরিমাতেও তেমনি দুর্ভিক্ষপ্রবনই। কিন্তু অনুকরণ করার প্রচন্ড ইচ্ছা ছিল তাহাদের। তাই যাহা দেখিত তাহাই বলিবার এবং করিবার চেষ্টা করিত। প্রতিদিন সকালে নজরুল ইসলাম হলের সামনে সাত্তার মিয়ার দোকানে ছাত্ররা অর্ডার দিত, “ সাত্তার মিয়া একটা চিড়া দই তাড়াতাড়ি দাও”। তাহা শুনিয়া এক ইথুওপিয়ান ছাত্র বলিত, “ একটা সাত্তার মিয়া, একটা চিড়া, একটা দই আর একটা তাড়াতাড়ি দাও”।

তাই অনেকেই ভাবিতেছেন, নিজের কথা আর না বলিয়া অন্য সবার মতো অনুভূতিতে আঘাতহীন কথা নকল করিয়াই বলিবেন, “একটা সাত্তার মিয়া, একটা চিড়া, একটা দই আর একটা তাড়াতাড়ি দাও”। কিন্তু ইহাতেও শেষ রক্ষা হইবে কি?

অভিজিৎ, ওয়াশিকুর বাবু কিংবা অনন্ত বিজয় কারো সাথেই আমাদের অনেকেরই ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না কোনদিন। এই বিশাল যুদ্ধ ক্ষেত্রে সহযোদ্ধাদের সাথে পরিচয় থাকে না সবসময়। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ-রাজিব-অভিজিৎ-ওয়াশিকুর বাবু-অনন্ত এবং আমরা যাহারা এখনো বাঁচিয়া আছি-সবাই জানি আমাদের আদর্শের শেকড় এক-অদ্বিতীয়-অপরাজিত। একের পর এক মুক্তমনা সহযোদ্ধা বন্ধুদের মৃত্যুতে বুক ভারী হইয়া আসিতেছে। চোখের পাতা ভিজিয়া যাইতেছে। একটি “অনুভূতিহীন লেখা” লিখিবার সময়ও বুকফাঁটা আর্তনাদে অন্তর কাঁদিয়া উঠিতেছে স্বজন হারানোর শোকে। “আমরা শোকাহত কিন্তু অপরাজিত”।