পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র বিরোধিতা নিয়ে অনেক আন্দোলন হয়েছে, লেখালেখি হয়েছে। এ নিয়ে অনেক বই আছে। স্বাধীন বাংলাদেশে রবীন্দ্র বিরোধিতা নিয়ে আবার মুখর। স্বাধীন দেশের পরাধীন ইস্যু। স্বাধীনতাকে পর করার পায়তারা।
রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর। বিশ্ব কবি। আমাদের জাতীয় সংগীত রচয়িতা। সংগীতটি জাতীয় সংগীত করার জন্য লেখা হয়নি। আমরা সংগীতটি জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচন করেছি। এ নিয়ে একটা মহলের মনে গোসসা আছে। ক্ষত আছে, ক্ষোভ আছে, দ্বেষ আছে। হিন্দুর লেখা গান কেন আমাদের জাতীয় সংগীত। যদিও উনি হিন্দু নন।

অনেকে বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি থাকতে রবীন্দ্র নাথের গান কেন জাতীয় সংগীত । যদিও দুজনের একজনও আমাদের দেশে জন্ম গ্রহণ করেননি। তাছাড়া, কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে জাতীয় সংগীত ঘোষণার বেশ কয়েক বছর পরে। আর? আর বিষয়টি এভাবে তুলনীয়ও নয়। নজরুলও এ কথা সজ্ঞানে শুনলে লজ্জা পেতেন।প্রতিবাদ করতেন।

এখন শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নিয়ে দুটো দল বিরোধিতা শুরু করেছে।
ইসলামী দল বিরোধিতা করছে সরাসরি। শাহজাদপুরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে প্রচারপত্র বিতরণ করার সময় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে গত ১ মে নয়জনকে আটক করেছে পুলিশ। এরা ঢাকার রাজারবাগ এলাকার পীর জিল্লুর রহমান খানের অনুসারী এবং আল-বায়্যিনাত সংগঠনের সদস্য বলে স্বীকার করেছেন।

অন্য দলটি বলছে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে বিরোধিতা করেছিলেন।। কাজেই তার নামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা নিয়ে তারা দ্বিধান্বিত।
প্রসঙ্গক্রপমে উল্লেখ করছি যে, রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ স্থাপন নিয়ে একটা গোষ্ঠি বিরোধিতা করছে। এ বিরোধিতা সহিংস রূপও নিয়েছিল। মেডিকেল কলেজ স্থাপনের বিরোধিতাকারীদের পক্ষে তাদের আঞ্চলিক ভাবনা, তাদের জাতিসত্বার অস্তিত্ব,পার্বত্য শান্তি চুক্তির প্রেক্ষাপটে ব্যালিড, যৌক্তিক, প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয়।তাদের বিরোধিতা কিছু শর্ত সাপেক্ষ। কিন্তু বিরোধিতা সত্বেও সরকার মেডিকেল কলেজে ক্লাস শুরু করতে পেরেছে। তর্কের খাতিরে বলছি, কারণ রবীন্দ্র নাথ যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে বাধা দিয়েছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। যদি পাওয়াও যায় সে ক্ষেত্রে আমার যুক্তি হল, এখন থেকে পঁচানব্বই বছর পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্তু লারমার নামে কোন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা আসলে কোন দল এ নিয়ে আজকের মেডিকেল কলেজের বিরোধিতার কথা বলে সন্তু লারমার নামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে বাধা দেওয়াকে নিশ্চয়ই বিবেকবান ও ইতিহাস সচেতন কেউ যৌক্তিক মনে করবেন না।
তেমনি তর্কের খাতিরেও রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে বিরোধিতা করেছিলেন বলে তার নামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যাবে না তা সুস্থ সাংস্কৃতিক মস্তিষ্কের পরিচায়ক নয়।
রবীব্দ্র গবেষকেরা রবীন্দ্র নাথ যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে বিরোধিতা করেননি এ নিয়ে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করছেন। রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করলে তাঁকে এই বিশ্ববিদ্যলয় প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছর পরে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনেই বিপুলভাবে সংবর্ধনা দিতেন না। আর রবীন্দ্র নাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে বিরোধিতা করার পরও সংবর্ধনা দিয়েই থাকেন আর উনি সংবর্ধনা নিয়েই থাকেন তবে তো তা চুকেই গেছে।

প্রচারপত্র বিলিকারী বিরোধীদের বক্তব্য—“বিশ্ব ভারতীর আদলে শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে সেখানে সাংস্কৃতিক চর্চা করা হবে। যা ইসলাম ধর্মের বিরোধী। কেননা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই নাস্তিক ছিলেন। তিনি ইসলাম তথা নবীজীর বিরুদ্ধেও বিরূপ মন্তব্য করেছেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় চাই। তবে এটি রবীন্দ্রনাথের নামে নয়। বরং অন্য যে কোন মুসলিম সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ও দার্শনিকের নামে হোক, তাতে আমাদের আপত্তি নেই।তবে অবশ্যই সেখানে নগ্ন ও অপ সাংস্কৃতিক চর্চা বন্ধ রাখতে হবে। এ বিষয়ে জনমত তৈরীর জন্যই আমরা প্রচারপত্র বিলি করছিলাম।”

একমত না হলেও বক্তব্যটি স্পষ্ট। এরা মুসলিম ভিন্ন আর কিছু বুঝে না। এরা অন্ধ। এদের পৃথিবী আরব ভূখন্ড পর্যন্ত। এদের জ্ঞান একটা মাত্র বইয়ে সীমাবদ্ধ। এদের বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। তারা চৌদ্দ শত বছর আগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের আলোকে যেহেতু জীবনযাপনকে প্রাধান্য দেন, সেহেতু পঁচানব্বই বছর আগের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে কোন মতামতের সাথে আজকেও তুলনা করতেই পারে।
কিন্তু তথাকথিত সুশীল সমাজের লোক কেন এসব বিষয় এমন কথা বলছেন?

ফেইসবুকে রুমা নামে জনৈকা বলেছেন,

‘‘বিশ্ববিদ্যালয়টি কি রবীন্দ্রনাথের নামে তৈরি হচ্ছে না বিশ্বভারতী এর আদলে তরি হচ্ছে? এটা যদি রবীন্দ্রনাথের নামে হয় আর অন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মত তাহলে ঠিক আছে কিন্তু তা যদি বিশ্বভারতীর আদলে তৈরি হয় তো আমার মনে হয় প্রত্যেক বিবেকবান মুসলমানের একটু ভাবা উচিৎ, বিশ্বভারতী থেকে পড়ে আসা কয়েকজন শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি চর্চা করাই আজ আমরা নির্দ্বিধায় দোল এর মত হিন্দু ধর্মের অনুষ্ঠান উদযাপন করি, তাহলে পুরা একটা বিশ্ববিদ্যালয় হলে কি হবে??? এখন অনেকেই বলবেন দোল উদযাপন করলে সমস্যা কথায়………… ?? আমরা বাঙালি কিন্তু মুসলমান এটা ভুলে গেলে তো আর চলবেনা………। মন মানসিকতা উদার করতে হবে কিন্তু ঈমান ও তো ঠিক রাখতে হবে…………………………।’’

আমি বিবেকবান ও ঈমানের কিছু নমুনা দিতে বলেছিলাম। উত্তর নেই।

একটা দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। কোনটা স্থানের নামে। কোনটা ব্যক্তির নামে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত। সে স্মৃতিকে জাগরুক রাখতেই ওখানে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ। আমি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কারণ আমি একজন রবীন্দ্র ভক্ত। রবীন্দ্র সংগীতের চেয়ে সুমিষ্ট স্বর ও সুর আমি সাধারণত অন্য গানে পাই না।আমার ক্লান্তিতে রবীন্দ্র নাথ আশ্রয়।আমার আনন্দে রবীন্দ্র নাথ আশ্রয়। আমার বিষাদে রবীন্দ্র নাথ আশ্রয়। আমার কারও ক্ষণিক বিদায়ে রবীন্দ্র নাথ আশ্রয়। কারও চির বিদায়েও রবীন্দ্র নাথ আশ্রয়।

পরিশেষে বলছি—– রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন কি করেননি এর নিয়ে গবেষণা হতেই পারে। তবে,তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই যে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন, তবুও কি এখন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাধা দেয়া উচিত ? আর যে কারণ দেখিয়ে লিফলেট বিলি হচ্ছে তা কি সমর্থন যোগ্য ? হাসিব না কাঁদিব? কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমার রবীন্দ্রানুভূতিতে যে আঘাত লেগেছে।