বাংলাদেশে রোজই জন্ম হয় নতুন খবরের। পত্রিকার পাতা খুলে প্রায় দশটা সংবাদে চোখ বুলালে তার মধ্যে প্রায় আটটি সংবাদই হবে দু: সংবাদ। আমরা বাংলাদেশীরা অভ্যস্তও হয়ে গেছি সহিংসতার সংবাদে। যতক্ষণ পেট্রোল বোমাটি ঠিক আমারই স্বজনের গায়ে এসে না পড়ছে, ততক্ষণ আমরা স্বজন হারাবার ব্যথা অনুভব করি না, প্রতিবাদও করি না। ড. অভিজিৎ রায়ের খুনিরা খুন করে চোখের সামনে দিয়ে পালিয়ে যায়, আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, পুলিশও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। আমরা কেউ খুনিদের ধরিয়ে দেই না। ওয়াশিকুর রহমান বাবুর খুনিদের ধরিয়ে দেয় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা, যাদের মানুষ বলে গণ্য করে না আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজ। আমাদের ভোঁতা মানবতা বোধ নিয়ে আমরা কোন মতে বেঁচে থাকি প্রতিদিন। এখন বাংলাদেশে বোমা হামলা স্বাভাবিক, বুদ্ধিজীবী হত্যা স্বাভাবিক, নারী নির্যাতন স্বাভাবিক, ধর্ষণ স্বাভাবিক, সংখ্যালঘু নির্যাতন স্বাভাবিক, আদিবাসী নির্যাতন স্বাভাবিক, প্রায় সমস্ত রকমের অপরাধই স্বাভাবিক। এইভাবে ক্রমাগত কবে যে আমরা মানবতা বোধ হারিয়ে হিংস্র পশুর চেয়েও অধম জাতিতে পরিণত হয়েছি, টের কি পেয়েছি?

পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনায় কি জাতিগত ভাবে আমরা আমাদের বীভৎসতা দেখতে পেয়েছি? আসুন কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হই। আপনি কি যৌন নিপীড়নকারীদের একজন? ঘটনা ঘটার সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন? বিবস্ত্র মেয়েটির আর্ত চিৎকার শুনে দূরে দাঁড়িয়ে হেসেছেন? মেয়েটি কেন পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে, মেয়েটিরই দোষ বলে যৌন নির্যাতন কারী লম্পট গুলোর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন? নির্যাতিত মেয়েদের শাড়ি নাভির উপরে না নীচে ছিল, ব্লাউজের হাতা কতটুকু ছিল, পিঠ দেখা যাচ্ছিল কিনা এসব বিশ্লেষণ করে অতঃপর অপরাধী নির্যাতনকারীরা নাকি নির্যাতিতা সেই রায় দিয়েছেন? পহেলা বৈশাখে যৌন নির্যাতনের ঘটনা আদৌ ঘটেছে কিনা তা নিয়ে দ্বিধান্বিত? ঘরে ফিরে আপনার স্ত্রী, বোন কিংবা কন্যার বাইরে যাবার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন? পহেলা বৈশাখকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলে বাঙ্গালী সংস্কৃতির অবমাননা করেছেন? বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসবে এহেন ন্যাকারজনক ঘটনা ঘটার পরেও প্রতিবাদ না করে চুপ করে থেকেছেন? এই প্রশ্নগুলোর একটির উত্তরও যদি হ্যাঁ হয় তাহলে দয়া করে একবার আয়নার নিজের চেহারাটা দেখুন, ঐটিই একজন অমানুষের চেহারা। অমানুষরা দেখতে আপনারই মত।

যৌন সহিংসতার এই ঘটনার পরবর্তী সময়ে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের পরিকল্পনায় অংশ নেয়া মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আশার খবর হচ্ছে, প্রতিবাদীদের অধিকাংশই আসলে নারী। যে নারীদের অন্তঃপুরে বন্দী করার স্বপ্নে হেফাজতে ইসলাম নেতা আল্লামা শফী বিভোর হয়ে আছেন, সেই নারীরাই মুখর হয়ে আছেন প্রতিবাদে। আল্লামা শফী বলেছেন “পহেলা বৈশাখের দিনে ঢাকায় নারীর বস্ত্রহরণসহ শ্লীলতাহানি হয়েছে। একসঙ্গে ছেলে-মেয়ে লেখাপড়ার সুযোগে অশালীন চলাফেরার কারণে এ পরিণতি হয়েছে।” ইতিপূর্বেও তিনি দাবী করেছিলেন নারী-পুরুষ একসাথে পড়া লেখা করতে পারবে না, কাজ করতে পারবে না। নারীদের স্বামীর সংসারের জিনিসপত্র দেখ ভাল করে রাখার মত শিক্ষাগত যোগ্যতাই তিনি যথেষ্ট মনে করেন। হেফাজতে ইসলামের মত একটি বড় দলের নেতা হয়েও তিনি যৌন সহিংসতা কারী নরপশুগুলোর শাস্তি দাবী না করে আঙ্গুল তুললেন নারী পুরুষের একসাথে পড়া লেখা করার দিকে। যিনি কথায় কথায় বলেন ইসলামে নারীকে সবচেয়ে বেশী সম্মান দেয়া হয়েছে, অথচ তার বক্তব্যেই প্রতীয়মান হয় যে, নারীকে তিনি তেঁতুলের মত লালসার বস্তুর চেয়ে বেশী কিছু ভাবেন না। আজ আল্লামা শফী ও তার দলের বিরুদ্ধে নারীর প্রতি অসম্মানের যে অভিযোগ তুলছি, তার প্রমাণ দিয়েছে সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনকে হেফাজতে ইসলাম শারীরিক ভাবে নির্যাতন করে। ইসলামের কথা বলা যে দল নারীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে নারীর প্রতি তাদের সম্মানের নমুনা দেখায়, সেই দল পহেলা বৈশাখে নারীর উপর চালানো যৌন সহিংসতার শাস্তি চাইবে, সে আশা করাও যে বোকামি, জনগণ তা বোঝে। হেফাজতে ইসলামের মধ্যযুগীয় কুশিক্ষার জবাব দিতে এ দেশের নারী জনগোষ্ঠীই যথেষ্ট। সেই নাদিয়া শারমিন, যাকে আপনাদের দলের অমানুষগুলো পিটিয়েছিল রাস্তার উপরে, তিনি বহাল তবিয়তেই সাংবাদিকতা করছেন, সাহসী নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছেন যেখানে আপনারা এখনো মাদ্রাসায় বসে ছাত্রদের শেখাচ্ছেন নারীকে কিভাবে অসম্মান করতে হয়। এবারও নারী প্রতিবাদী হয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, নারী তার মর্যাদা রক্ষায় হুজুর মৌলভী বা যৌন নিপীড়কের দয়ার উপর মোটেও নির্ভরশীল নয়।

একাত্তর টিভির সাথে সংলাপে বসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকটর বলে গেলেন, একমাত্র লিটন নন্দীর বক্তব্য ছাড়া যৌন সহিংসতার অভিযোগ তারা পান নি। পুলিশ ঘটনাস্থলে নারীর নিরাপত্তা রক্ষায় এগিয়ে আসেনি, দুজন যৌন সন্ত্রাসীকে ধরে পুলিশের কাছে দিলেও তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় ঘটে গেলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি এখনও। অথচ সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে, বহু ছবিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যৌন সন্ত্রাসীদের চেহারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা শাড়ি চুড়ি হাতে নিয়ে থানা ঘেরাও করেছে। আমাদের প্রশাসনও আসলে নির্লজ্জ। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায়, তারা মূলত সন্ত্রাসীদের সেবায় নিয়োজিত। পুলিশি দায়িত্ববোধ তো পরে, মানবিক বোধেও কি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বাঁধে না?

পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ খুঁজে যৌন সন্ত্রাসীদের নাগাল পাচ্ছে না, অথচ একাত্তর টিভির প্রতিবেদক ফারজানা রূপা ঠিকই দেখিয়ে দিলেন কতিপয় ব্যক্তি কিভাবে সংগঠিত করেছে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা। আর সাথে সাথে তিনি পেয়ে গেলেন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কাছ থেকে মৃত্যুর হুমকি। ফারজানা রূপাকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের হুমকি ইঙ্গিত করে পহেলা বৈশাখে যৌন হয়রানির ঘটনা সুপরিকল্পিত এবং এই জঙ্গি দলটি ঘটনার সাথে জড়িত। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম যদি পরিকল্পিত ভাবে যৌন হয়রানি করে থাকে, তাদের উদ্দেশ্য কি? পহেলা বৈশাখ বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর উৎসব, যা কোন বিশেষ ধর্মের মানুষের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। বাঙ্গালী নারীর শাড়ি, মেলা, ঢোলের বাদ্য মনে করিয়ে দেয় বাঙ্গালী জাতি হিসেবে আমাদের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। ইসলামী চরমপন্থি সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাস ছড়িয়ে মুছে ফেলতে চাইছে আমাদের বাঙ্গালী হৃদয়ের সংস্কৃতিকে। এবারই প্রথম নয়, প্রথমে আমাদের সংস্কৃতির উপর আঘাত হেনেছিল বোমা হামলা করে, এইবারে করল নারীকে আঘাত করে। তারা আশা করেছিল, পরবর্তী বছর থেকে হয়ত নারী আর উৎসবের আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে রঙ্গিন প্রজাপতির মত বেরুবে না ঘর থেকে, বাঙ্গালীর উৎসব হারাবে বর্ণচ্ছটা, সঙ্গীতের সুর আর ক্রমেই জয়ী হয়ে যাবে মৌলবাদের কালো থাবা! তবে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম যা জানেনা, বাঙ্গালী নারীরা আজ অব্দি কোন কালেই পাশবিকতার কাছে হার মানে নি, সে যতই ধর্মের মোড়কে বাজারে ছাড়া হোক না কেন! একাত্তরে নারীর উপর নির্যাতন চালিয়েছে পাক বাহিনী আর রাজকার বাহিনীর পুরুষেরা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পুরো পরিবারকে হত্যা করেছে তাদেরই মদদ-পুষ্ট পুরুষেরাই, সারাদেশে বোমা হামলা চালিয়েছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির পুরুষেরাই। ড. হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দার, ড. অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু এদের হত্যাকারীরাও পুরুষই। কিন্তু আজ পর্যন্ত নারী সন্ত্রাসে জড়ায়নি, সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয়ও দেয় নি। ইসলামের নাম ব্যবহার করে মুসলিম পুরুষকে খুনিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব হলেও নারীরা মানুষই আছে। আজ যখন এই নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে তোমরা অস্ত্র হিসেবে বেছে নিলে, নারীরা কিভাবে তোমাদের প্রতিরোধ করে, এবার তা শুধু তোমাদের দেখবার পালা।

পহেলা বৈশাখের ঘটনাতে বাংলাদেশের সমস্ত নারীর কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেছে, নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব এবার নারীদেরই নিতে হবে। সরকার তাদের পাশে দাঁড়াবে না, পুলিশ সন্ত্রাসীদের ছেড়ে দেবে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনা অস্বীকার করবে, দলগত ভাবে হামলায় ভাই, স্বামী, বাবাও অসহায়ের মত চেয়ে চেয়ে দেখবে। ওরা এবার কেবল তরুণী মেয়েদের নয়, মায়ের কোল থেকে শিশুকে নামিয়ে মাকে নির্যাতন করেছে, বাবার পাশ থেকে কিশোরী মেয়েকে কেড়ে নিয়ে নির্যাতন করেছে। তাই প্রতিবাদে মুখর হয়ে গেছে প্রতিটি মেয়ে। মেয়েরা আত্মরক্ষার শপথ নিচ্ছে। রান্নাঘরের যে ছুরি তারা এতদিন সবজি কাটতে ব্যবহার করেছে, যে কাঁচি এতো দিন কাপড় কাটতে ব্যবহার করেছে, যে খোঁপার কাঁটা এতদিন তারা চুল বাঁধতে ব্যবহার করেছে তাই এবার নিজেদের প্রতিরক্ষায় ব্যবহার করবে। যে মেয়েরা আজ নিজেদের প্রতিরক্ষায় নিজেরাই স্বাবলম্বী হবে বলে ঠিক করেছে, সে যেদিন মা হবে, সেদিন তার মেয়েকে গানের, নাচের, কুরানের শিক্ষকের কাছে পাঠানোর পাশাপাশি মার্শাল আর্টের স্কুলেও পাঠাবে। সমগ্র জাতির অর্ধেক যদি এইভাবে তাড়া করে যৌন সন্ত্রাসীদের, কোথায় পালাবে তোমরা? লিটন নন্দীদের মত কয়েকজন পুরুষ ছাড়া বাকিরা যদি সকলে অমানুষও হয়ে গিয়ে থাকে, তাতে নারীদের অগ্রগতি থমকে দাঁড়াবে না। এতো কাল সমাজের ঘরে ঘরে পুরুষ বুক ফুলিয়ে বলেছে নারীর নিরাপত্তার দায়িত্ব তাদের। যৌন সন্ত্রাসীরা পুরুষের সেই মিথ্যে অহমিকা এবার ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। আর প্রতিবাদী করে তুলেছে নারী সমাজকে। এই নারী শক্তিকে ঠেকানোর সাধ্য কার!