প্রতিবছর এইচএসসি, এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফল প্রকাশের পর পত্রপত্রিকায় কোন স্কুল প্রথম-দ্বিতীয় হয়েছে, কোন স্কুলের ছেলেমেয়েরা সেরা সেগুলো ঘটা করা প্রকাশ করা হয়। সেখানে অধ্যক্ষদের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়, তারা খুব গর্ব করে বলেন কিভাবে তাদের স্কুলের শিক্ষকেরা ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন, কিভাবে ছেলেমেয়েরা পড়ালেখার পাশাপাশি নাচ-গান-বিতর্কে অংশ নেয়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতেই পারে এটা একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা, স্কুলে-স্কুলে এমন প্রতিযোগিতা থাকলে সব স্কুল-কলেজ সেরা হবার জন্য ছাত্রদের পড়ালেখার পরিবেশের প্রতি যত্নবান হবে, শিক্ষকরা আরো বেশি আগ্রহ নিয়ে পড়াবে সেরা হবার আশায়। কিন্তু বাস্তবে কি হচ্ছে?

লক্ষ্য করুন যত্ন নিয়ে শিক্ষকতা করানোর পিছে এখন মোটিভেশনটা কিন্তু ছাত্র বড় বিজ্ঞানী হোক, বিশ্বসেরা সাহিত্যিক হোক, বড় ডাক্তার হোক সেরকম কিছু না, মোটিভেশনটা হয়ে যাচ্ছে স্কুলে এ+ এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাক, আমার স্কুল/কলেজ দেশের সেরা হোক যাতে আমি গর্ব করে সবাইকে বলতে পারি, অধ্যক্ষদের জন্য আরেকটা মোটিভেশন হলো পরের বছর ভালো ছাত্র বেশি পাওয়া যাবে। যখনই মোটিভেশনটা ছাত্রের কল্যাণ থেকে আত্নগর্বতে চলে যাচ্ছে তখনই হয়ে যাচ্ছে সমস্যাটা, ছাত্র গোল্লায় গেলে যাক কিন্তু এ+ বেশি পেতে হবে এরকম একটা মানসিকতা হয়ে যাচ্ছে শিক্ষকদের মধ্যে।

প্রশ্ন ফাস নিয়ে অনেক হইচই হলেও যে ব্যাপারটা নিয়ে কথাবার্তা কম হচ্ছে সেটা হলো শিক্ষকদের সহায়তায় নকল। দেশের তথাকথিত সেরা অনেক স্কুল-কলেজেই শিক্ষকরা পরীক্ষার হলে ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে সাহায্য করে, এবং পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করে লেখাকে উৎসাহিত করেন। সবথেকে খারাপ অবস্থা হয় যখন ‘ক’ কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সিট পড়ে ‘খ’ কলেজে এবং ‘খ’ কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সিট পড়ে ‘ক’ কলেজে। তখন দুই কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে তখন এক ধরণের সমঝোতা হয়ে যায় ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার হলে সাহায্য করার ব্যাপারে। ন্যায়-নীতি, শৃঙ্খলা নিয়ে গর্ব করা সেনাবাহিনী পরিচালিত আদমজি কলেজ, রাজউক কলেজের ভিতরে খোজ নিলে দেখা যাবে ঠিক এই ঘটনা ঘটছে, সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে ভালো খাতির থাকলে নিজেই যাচাই করে দেখতে পারেন, তবে অনেকে কলেজের সুনাম রাখার জন্য হয়তো স্বীকার করবে না। আরো অনেক দুর্নীতি এসব কলেজে হয়, সেগুলো অপ্রাসঙ্গিক।

আমি জানি কথায় চিড়ে ভিজবে না, একটা ব্লগ পড়ে নির্লজ্জ দুর্নীতিবাজ শিক্ষকেরা আদর্শ শিক্ষক হয়ে যাবে না। এদের মধ্যেই যেসব সৎ আন্তরিক শিক্ষক আছেন তাদের কথা ভাবলে কষ্ট হয়, নিশ্চয়ই সহকর্মীদের এই নির্লজ্জতা দেখে তাদের কষ্টে বুক ফেটে যায়। যেসব ছেলেমেয়েরা সারাবছর পড়ালেখা করে দেখে তাদের শিক্ষকরা এরকম দুর্নীতিবাজ তাদের মনে তখন কি চিন্তা ঘুরে সেগুলো এইসব শিক্ষকদের শুনাতে পারলে খুব ভালো হতো!

এখন কথা হলো কি করা যেতে পারে এটার বিরুদ্ধে? আমি জানিনা সমাধান কি তবে আমার ধারণা যে মোটিভেশনের কারণে এসব ঘটছে সেটা নষ্ট করে দিতে পারলেই অনেকটা কাজ হবে। এ ব্যাপারে সাহায্য লাগবে সাংবাদিকদের। এ বছর থেকে যদি প্রথম আলো সহ বড় বড় সংবাদপত্রগুলো এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কোন স্কুল প্রথম হয়েছে, কোন কলেজে বেশি এ+ পেয়েছে এগুলো বড় করে ছাপানো বন্ধ করে দেয় তাহলেই কিছুদিন পর স্কুল-কলেজগুলো প্রথম-দ্বিতীয় হবার মোটিভেশন হারাবে। বরং এদেশের কৃতি ছেলেমেয়েদের খবর বেশি করে ছাপানো যেতে পারে। কয়জন জানে বাংলাদেশী ছেলেমেয়েদের কথা যারা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে দারুণ সব গবেষণা করছে, অলিম্পিয়াড জিতছে, দারুণ সব প্রজেক্টে অংশ নিচ্ছে, মানুষের জন্য কাজ করছে? এদের কথা বেশি করে ছাপানো হোক, সবাই জানুক এ+ পাওয়া শিক্ষার উদ্দেশ্য না। অভিভাবকেরা সাধারণত সাহিত্য না পড়লেও প্রায় সবাই প্রচুর পত্রিকা পড়েন বা টিভিতে খবর দেখেন, তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হোক এইচএসসি বা এসএসসি পরীক্ষা ২টি বড় মাইলফলক হলেও জীবনের মুল লক্ষ্য এগুলোতে ভালো করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না, কঠোর পরিশ্রম না করে সাফল্য পেয়েছে পৃথিবীতে এরকম একটা উদাহরণও পাওয়া যাবেনা। তাই অভিভাবকদের মোটিভেশনও যেন ছেলেমেয়েকে এ+ পাইয়ে দিয়ে প্রতিবেশীর কাছে গর্ব করা না হয়ে যায়! সাংবাদিকদের কাছে কি আমরা এই সচেতনতা আশা করতে পারি?

এবং অবশ্যই কোন স্কুলের সীট কোথায় পড়বে এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা হোক। এটা করা না হলে শিক্ষকদের জন্য দুই নম্বরী করা খুব সহজ হয়ে যায়।

সব প্রতিকুলতার মধ্যেও যেসব শিক্ষক, অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের সত্যিকারের শিক্ষিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন আর প্রচুর বই পড়তে উৎসাহিত করেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলো, আপনারা আছেন বলেই এখনো দেশ টিকে আছে।