ওদের বাড়িতে একদম কোণায় একটা ঘর ছিলো। তাকে আপনারা পড়ার ঘর বলতে পারেন, লাইব্রেরি বলতে পারেন, স্টাডি বলতে পারেন, কম্পিউটার রুম বলতে পারেন কিংবা পারেন আরও কিছু বলে ডাকতে, কিন্তু রাফিদা’র ভাষায় ওটার নাম – ‘গুহা’। ওটা নাকি ছিলো অভি’র গুহা। যে গুহার দেয়ালগুলো বইয়ের তাক দিয়ে ঘেরা, আর বিশাল স্ক্রীনের একটা কম্পিউটার সে গুহায় প্রায় সারাক্ষণই চলছে। ওখানে বসে অভি লিখতো। অনেক, অনেক, অনেক লিখতো। সকালে উঠে দাঁত মাজতো, কফি বানাতো, অফিসে যেতো, অফিস থেকে ফিরে ঘরের কিছু কাজ করতো, তৃষাকে পড়াতো, রাফিদার সাথে গল্প করতো, রাতের খাবারের পর হয়তো ত্তৃষাকে নিয়ে কি লেখা নিয়ে কি বাড়ির কোন ব্যাপার নিয়ে কিছু কথা বলতো – তারপর আবার লিখতো। যখনই সুযোগ পেতো, লিখতো।

তা সে তো আমরা জানিই। লেখক পরিচয় তো লিখতো বলেই। কিন্তু, আর? আর কী করতো, অভি নামের ছেলেটা? ব্লগে বা বইয়ে যে প্রবল যুক্তিবিশ্বাসী, কার্যকারণনির্ভর অভিজিত রায়কে মানুষ চেনে, তার বাইরের খেয়ালী, স্বতস্ফূর্ত, ছেলেমানুষ অভিকে চিনতে হলে আপনাদের ঐ বাড়িটাতে যেতে হবে। কোন কারণের বালাই ছাড়াই ঐ বাড়িটাতে হটাৎ একটা ‘হো হো’ চিৎকার শোনা যেতো, বিকট বেসুরে কে যেন জেমসের একটা গান গেয়ে ফেলতো, কিংবা তৃষার স্কুলের বন্ধুদের জীবনের নানা ‘জটিল’ সমস্যা নিয়ে সুগভীর আলোচনাশেষে উদ্ভট একটা সিদ্ধান্ত বেরুতো। না, কোন যুক্তি টুক্তি যেন খুঁজতে যাবেন না তাতে। কী, কেন, কীভাবে – জগৎসংসারের এই ত্ত্রিরহস্যের সমাধান জনসম্মুখে তুলে ধরতে যার উৎসাহের কোন কমতি ছিলো না, ব্যক্তিজীবনে তার বেশিরভাগ ‘কী, কেন, কীভাবে’র উত্তর ছিলো – “ধুউউউর!”

ছোট্টবেলা থেকেই তৃষা আর অভির কিছু নিজস্ব ভাষা ছিলো। রোজ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওরা দুজন দুজনকে বলতো ‘গুডুনাইটু’। সারাদিনের অজস্র হাবিজাবি কথা আর হাসাহাসি আর ফাজলামোর ইতিটা হতো ঐ শব্দটা দিয়ে। ঐ শব্দটার মধ্য দিয়ে হয়তো এমনকি অনুচ্চারিত একথাটাও ওদের দুজনের মাঝখানে ভেসে থাকতো – ‘আচ্ছা, এখন ঘুমাতে যাই, কাল আবার হবে – আজকের মতোই অনেকগুলো আনন্দময় মুহূর্ত দিয়ে তৈরী আরেকটি দিন।“ আর হবে?

আজকে ঠিক একমাস হলো। একমাস হয়ে গেলো অভিকে মেরে ফেলা হয়েছে। এই একমাসে পৃথিবীর বহু দেশের বহু মানুষের বহু ভাষায় নিন্দা, ক্রোধ, প্রতিবাদ, ঘৃণা বহু কিছুই প্রকাশিত হয়েছে। অনেক মিছিল, শোকবার্তা, লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু তারপরও কিচ্ছু হয়নি। খুনীরা ধরা পড়েনি, তদন্তের কোন বিশেষ অগ্রগতির কথা শোনা যায়নি, এরকম অবিশ্বাস্য নৃশংস একটা ঘটনার ঠিকঠাক বিচার হবে বা হতে যাচ্ছে সেরকম ইঙ্গিতবাহী কিছুই জানা যায়নি।

তাহলে এইই? এটাই তাহলে বুঝে নেবো আমরা যে, যে যে যার যার জীবন কোনমতে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করাটাই আমাদের পরমার্থ হওয়া উচিত? একটা সুখী, সফল, নিশ্চিন্ত জীবন থাকার পরও যে তাগিদে বা ভেতরের যে প্রেরণায় অভি লিখতো সেটা আসলে বড়সড় একটা বোকামি ছিলো? বরং কীভাবে আরও বেশি টাকা রোজগার করা যায়, অথবা পরের প্রোমোশনটা কীভাবে এগিয়ে আনা যায় এটাই হওয়া উচিত ছিলো ওর আসল লক্ষ্য? তাহলে কিন্তু একদিক থেকে বিরাট একটা ঝামেলা মিটেই যায়! এই যে আমরা শিল্প, সংস্কৃতি, বুদ্ধির চর্চা, মুক্তচিন্তা, সভ্যতাকে সামনে এগিয়ে নেয়া হেনা তেনা কত কী নিয়ে মাথা ঘামাই, দরকারই নেই তার! শুদ্ধুমাত্র খাবো, ঘুমাবো, আর খাবো, ঘুমাবো। ব্যাস, শেষ। দরকার কী বাবা ঝুঁকি নিয়ে? ইরাক কি সিরিয়ায় সভ্যতার ইতিহাস ধবংস করতে বারুদ ব্যবহার করা হচ্ছে, আমরা নাহয় চাপাতিই বেছে নিলাম? শেষবিচারে ফল তো একই, অপূরণীয় ক্ষতি এবং থেমে যাওয়া।

একটা মানুষ আসলে একটাই মানুষ নয়। একটা মানুষ একটা সমষ্টি। তার চারিপাশের মানুষগুলোর সাথে নানারকম সম্পর্কের, মিথস্ক্রিয়ার, ভালোবাসার, দায়িত্বের সমষ্টি। একটা মানুষ শুধু একটাই মানুষ নয়। একটা মানুষ একইসাথে অনেকগুলো মানুষ। যে মানুষটা বিজ্ঞানের ওপর লেখে, কিংবা যুক্তি দিয়ে কথা সাজায় সেই একই মানুষটা হাবিজাবি মজার কথা বলে রাফিদার রাগ ভাঙ্গায় বা খামোখাই হা হা করে হেসে ওঠে। মাঝে মাঝে অকারণে ছেলেমানুষের মতো রেগে ওঠে। ওদের বাড়িটা আনন্দ দিয়ে ভরে রাখে। গাঢ় একটা ভালোবাসায় রাফিদা আর তৃষাকে ঘিরে রাখে।

একটা মানুষ চলে যাওয়া মানে তো শুধু একটা মানুষেরই শূন্যতা নয়।

রাফিদা আর তৃষা আবারও ভালো থাকবে, একসময়। এই কষ্ট কাটিয়ে উঠবে, একসময়। অভি ওদের দিয়ে গেছে এতোটাই, যে এমনকি এই ঘটনার পরেও ওরা অভিরই জন্য ভালো থাকতে পারবে। শুধু চাওয়া, এই ঘটনার বিচার হোক। এমন ঘটনার অবসান হোক। মুক্তচিন্তা অব্যাহত থাকুক।

তোমাকেও তাই বলি অভি – চিন্তা কোরোনা, তুমিও ভালো থেকো। গুডুনাইটু।