অভিজিৎদার মৃত্যুর পর আমার প্রথম অনুভূতি হল অবিশ্বাস। মাত্র দশ বারো ঘণ্টা আগে একজনের সাথে কথা হচ্ছিল। আমাকে মজা করে বলল, উদাসদা আপনি দেশে আসেন না কেন? আসেন, এসে বইমেলাতে ঘুরে যান। এই যে অভিজিৎদাও তো এসেছে। কত মজা করছে মেলায় ঘুরে। আমাদেরকে দাওয়াতও দিয়েছে তার বাসায়। আপনিও এসে আমাদের দাওয়াত দেন। সেই অভিজিৎদা নেই। প্রথমে শুনলাম আক্রমণ হয়েছে। তড়িঘড়ি ফেসবুক আর নিউজ খুলে খোঁজ নিতে নিতে শুনি তিনি নেই। এরকম কখনো হয় নাকি?

অবিশ্বাস কেটে গেলে তারপরে হল ভয়। প্রচণ্ড একটা ভয়ের স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল বারবার। নিজের জন্য ভয় না। দেশের জন্য ভয়।একটা মানুষকে হুমকি দেয়া হল মেরে ফেলব বলে, তারপরে সত্যি সত্যি তাকে মেরে ফেলা হল। তাকে একটু রগড়ে দেয়া নয়, আহত করা নয় একেবারে জায়গা মতো আঘাত করে সরাসরি মেরে ফেলা হল। এরকম প্যাটার্ন নিয়মিত পাকিস্তানে দেখা যায়। আমাদের দেশেও কি সেটা সম্ভব? ভয়ের কারণ নতুন করে বুঝতে পারা, এটা আমাদের দেশেও সম্ভব। পাকিস্তান আর বাংলাদেশ একই বৃন্তের দুটি ফুল (অভিশপ্ত ফুল) ছিল। এই বাস্তবতা চাইলেও অস্বীকার করা সম্ভব না। বহু রক্ত ঝরিয়ে বৃন্ত ছিঁড়ে সেই অভিশাপ থেকে আমরা বের হয়ে এসেছি ৭১ এ। কিন্তু পাকিস্তান আর আমাদের মূল একই জায়গায় গাঁথা ছিল। চাইলেই বাংলাদেশের পক্ষে খুব সহজে পাকিস্তানের রাস্তায় চলে যাওয়া সম্ভব। পাকিস্তানে আজকে যা যা হচ্ছে, তার সবই আমাদের দেশে অদূর ভবিষ্যতে হতে পারে। হবার জন্য যা যা মালমসলা দরকার সবই আমাদের দেশে মজুত আছে। বাংলাদেশকে একটা সিঙ্গাপুর বা একটা জাপান হবার জন্য অনেক কষ্ট করতে হবে। যোগ্য নেতা লাগবে, মানুষের মন মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশকে পাকিস্তান হবার জন্য খুব বেশী কষ্ট করতে হবে না। কোন নেতার দরকার হবে না। চুপ করে কিছু না করে বসে থাকলেই হবে। এই বাস্তবতা নতুন করে বোঝার কারণেই তীব্র ভয়।

ভয় খানিকটা কেটে গেলে এরপর হল আশা। এই পর্যায়ে এসে মনের মাঝে একটু খুশিও কি উঁকি দিল? হয়তো। চরম স্বার্থপর মানুষের মতো মনে মনে ভাবলাম, অভিজিৎদা তো চলেই গেলে। সেটা নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই। কিন্তু এভাবে তার চলে যাওয়ার কারণে এবার হয়তো দেশ একটা বড় ধাক্কা খাবে। এত বড় অন্যায়কে মানুষ কিছুতেই মেনে নিবে না। দলেদলে মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে। অভিজিৎদা একজন নামকরা লেখক। প্রথম শক্ত প্রতিবাদটা আসবে লেখকদের কাছ থেকে। কলম দিয়ে রক্ত ঝরবে। আশার পর্যায় কেটে গিয়ে এবার আমার অনুভূতি অবাক এবং বিস্ময়ের রাজ্যে প্রবেশ করলো। বিস্মিত হয়ে দেখলাম লেখক গোষ্ঠীর বড় অংশের কলম দিয়ে রক্ত না, মূত্র ঝরছে। দেশের নামকরা লেখকেরা বেশিরভাগই বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত। তাদের বড় ভয় কখন তার জনপ্রিয়তার কোন জায়গাটা কেটে যায়। কেটে গেলে সে তো আর শুকাবে না। আমি আশা করি প্রতিদিন দেশের সিনিয়র নামকরা লেখকেরা পত্রিকার পাতায় গর্জে উঠবেন। তার বদলে দেখতে পাই ‘বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদিতা চাইনা’ টাইপের ফরহাদ মজহারীয় মূত্র বিসর্জন।
অভিজিৎদার পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। হত্যা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে কেন্দ্রে। যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের নানা গণ আন্দোলনের সময় মুখ্য ভূমিকা পালন করে এসেছে তারা কি মেনে নিবে তাদের বুকে ঘটে যাওয়া এত বড় অন্যায়? নিশ্চয়ই ছাত্র শিক্ষক সবাই মিলে গর্জে উঠবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, মৌলবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তেমন কেউ গর্জে উঠে না। কেউ চিৎকার করে বলে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রে কিভাবে শতশত মানুষের সামনেই হুমায়ূন আজাদকে কোপানো হয়, অভিজিৎ রায়কে কোপানো হয়। দেশের সবচেয়ে সম্মানজনক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই অসম্মান কিছুতেই মেনে নেয়া যায়না। কিন্তু অবাক হয়ে দেখি, সবাই বেশ মেনে নেয়। কেউ তেমন গর্জে ওঠে না।

অভিজিৎদা সারাজীবন মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা পিতার যোগ্য সন্তান মুক্তিযুদ্ধকে বুকে ধারণ করে তার নিজের যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। তাই ভাবলাম দেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকা আওয়ামীলীগ নিশ্চয়ই এবার গর্জে উঠবে। এত বড় অন্যায় মেনে নিবে না। অবাক হয়ে দেখলাম আওয়ামীলীগের বড় বড় নেতারা চুপ। তাদের কেউ কেউ চুপে চুপে গিয়ে অভিজিৎদার পিতাকে সান্ত্বনা আশ্বাস দিয়ে আসলেও সেটা যেন মিডিয়াতে হাইলাইট না হয় সে ব্যাপারে প্রবল প্রচেষ্টা চোখে পড়ে। চুপ থাকা তাও কোনভাবে মেনে নেয়া যায়। কিন্তু এই আওয়ামীলীগের ছোট্ট আরেকটা অংশ কওমিলিীগ সেই চুপ থাকার মধ্য দিয়েও গেল না। আমি বেশ মন দিয়ে এই গ্রুপটার দুই একজনের কার্যকলাপ দেখে গেলাম কয়দিন ধরে। তারা প্রথমে বলার চেষ্টা করলো, অভিজিৎদা নিজের দোষেই মরছে। মুক্তমনারা সবাই ফারবীর ইয়ার দোস্ত ছিল, তাই দোস্ত দোস্তকে মেরেছে। তারপর বলল অ্যটেনশন পাবার জন্য আসলে আসিফ মহিউদ্দিন মেরেছে অভিজিৎদাকে। মাঝখানে দুইদিন ধরে টাকা হালাল করার জন্য শামিম ওসমান আসলে যে কত ভালো লোক, তার বিরুদ্ধে সবই মিডিয়ার চক্রান্ত সেটা নিয়ে প্যানপ্যান করলো। তারপর দম নিয়ে দুইদিন পর এসে বলল, আসলে সচলায়তনের চক্রান্তে অভিজিৎদা খুন হয়েছে। সচলই খুন করেছে অভিজিৎদাকে যেন তারা মুক্তমনা থেকে উপর উঠতে পারে। এবং সবশেষে উপসংহার আসলে ছাগু এবং খাসীর ( অভিজিৎ রায়ের মতো উগ্র নাস্তিক!) মধ্যে খুব একটা ফারাক নেই। এরা একে অন্যকে মারবে মরবে, এই ভ্যাজালে শুধু শুধু আওয়ামীলীগকে জড়িয়ে দেশে অশান্তি সৃষ্টির মানে নেই। এক অর্থে এইসব কওমি ঝাণ্ডা ধারী আওয়ামীলীগকে মৌলবাদীদের থেকেও বেশী ভয়ঙ্কর মনে হয়। জানা কথা যে কোন হাইব্রিড জিনিস সবসময়ে বেশী ভয়ঙ্কর হয়। মৌলবাদী জামাতি থেকে মৌলবাদী আওয়ামীলীগ আরও বেশী ভয়ঙ্কর, মাদ্রাসার গছাগুর চেয়ে পিএইচডি করা লছাগু বেশী ভয়ঙ্কর, নাস্তিককে কোপানো ধর্মান্ধের চেয়ে সেই কোপ দেখে মিটিমিটি হাসা সুশীল অনেক বেশী ভয়ঙ্কর!

অভিজিৎদা আমাদের বুয়েটের ছাত্র এবং নামকরা স্কলার ছিলেন। আমি ভাবলাম আর কেউ প্রতিবাদ করুক না করুক বুয়েটের সবাই এবার গর্জে উঠবে। এর আগে একবার ভিসির পদত্যাগ না কোন এক ইস্যুতে দেখেছিলাম ক্যাম্পাসে অনেকেই রক্ত দিয়ে প্রতিবাদ করেছিল। কোন কথার কথা না, সত্যি সত্যি সূচ ফুটিয়ে গায়ের রক্ত বের করে বোতলে ভরে কি কি সব কাণ্ড করেছিল। আর এবারে তাদের প্রতিষ্ঠানের একজনকে এভাবে কুপিয়ে মেরে ফেলা হবে প্রতিষ্ঠানের মাত্র এক মাইলের মধ্যের একটা জায়গাতে। আবেগি বুয়েট ছাত্ররা কি ছেড়ে দিবে? অবাক হয়ে দেখলাম, হ্যাঁ ছেড়ে দিবে। প্রতিবাদ যে হয়নি তা নয়। আমি একবার বুয়েটের কিছু ছাত্রের তাদের টিউশনি ছাত্রী ফেটিশ নিয়ে এখানা গল্প লিখেছিলাম খোঁচা দিয়ে। সেটার কারণে যা প্রতিবাদ হয়েছিল অভিজিৎদার জন্য তার অর্ধেক প্রতিবাদও বুঝি হয়নি। বাপরে বাপ, সে কি প্রতিবাদ। দুই বছর আগের লিখা গল্প, এখনো অনেকে থেকে থেকে জ্বলে উঠে সেই নিয়ে। কত বড় সাহস, প্রতিষ্ঠানের অপমান করে। না হয় আমরা গোপনে বুয়েট বুয়েট মিলে ছাত্রী পড়াতে গিয়ে কবে কোন ছাত্রীর ব্রা দেখা গেল আর কোন ছাত্রী পা গিয়ে একটু ছুঁয়ে দিল সেগুলো নিয়ে একটু দুষ্টু মিষ্টি আলাপ করি। কিন্তু তাই বলে বাইরে সবার সামনে বাকি সব হাবিজাবি প্রতিষ্ঠানের হাবিজাবি লোকেদের সামনে এইসব হাবিজাবি কথা ফাঁস করে প্রতিষ্ঠানের এত বড় অপমান কি সহ্য করা যায়? না, যায়না। তবে তার প্রতিষ্ঠান থেকে সামান্য দূরে প্রতিষ্ঠানের একজনকে কুপিয়ে মারলে প্রতিষ্ঠানের তেমন অপমান হয়না। বিশেষ করে সেই লোক যদি নাস্তিক হয়ে থাকে তবে তো আরও হয়না। তাই সেটা দিব্যি সহ্য করা যায়। এমনকি অভিজিৎ রায় হত্যা তদন্তের জন্য একজন বুয়েট শিক্ষককে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এই অপমানটুকুও অভিজিৎ রায় হত্যার অপমান থেকে বেশী গায়ে লাগে লোকের। সেই নিয়ে গর্জে ওঠে লোকে। অভিজিৎদার জন্য তেমন কেউ তেমনভাবে গর্জে ওঠে না।

অবাক হয়ে তাই দেখি, কেউ গর্জে উঠে না। শুধুমাত্র গুটিকয়েক লোক একঘেয়ে সুরে ঘ্যানঘ্যান করে যায়, ও ভাই এক মাস চলে গেল। কিছু তো হল না বলে বলে। সেটাও খুব বেশিদিন বলার সুযোগ হবে না। ত্রিশ লাখ মৃত্যু হজম করে ফেলে এই দেশের কিছু না করা লোকজন। বিচার চেয়ে একটার বেশী দুটো কথা বলে বিরক্ত হয়ে বলে, আর কত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা করবেন। আর অভিজিৎ রায় মাত্র একজন মানুষ। তাই এই ক্ষেত্রে আরও জোর গলায় সবাই থামিয়ে দিবে, ‘আর কত ব্যবসা করবেন অভিজিৎ রায়কে নিয়ে’ বলে।

স্বাধীনতার অর্থ একেকজনের কাছে একেক রকমের। আমার কাছে সহজ। আমার কাছে স্বাধীনতা মানে পাকিস্তান না হওয়া। আমরা স্বাধীন মানেই হচ্ছে আমরা পাকিস্তানের অংশ নই, তাদের মতবাদ অর কার্যকলাপের সাথে একমত নই। আমার কাছে তাই স্বাধীনতা দিবস মানে ‘হ্যাপি বাড্ডে বাংলাদেশ’ বলে চিক্কুর দিয়ে দুইটা মোমবাতি জ্বালানো না। আমার কাছে স্বাধীনতা দিবস মানে নতুন করে একবার মনে করিয়ে দেয়া, আমরা একসময় পাকিস্তান ছিলাম। এখনও আমাদের রক্তে পাকিস্তান রয়ে গেছে। সেই দূষিত রক্ত পরিষ্কারের চেষ্টা করে যাওয়া আর পুনরায় পাকিস্তান না হয়ে যাওয়াই অনেক রক্তে অর্জন করা স্বাধীনতাকে রক্ষা করার অপর নাম। বনের পাকিস্তান চলে গেছে ৭১ এ। মনের যে পাকিস্তান মৌলবাদের নাম নিয়ে জুড়ে বসেছে সেটা কবে যাবে? যদি নাই যায় আর যদি বাংলাদেশ আরেকটা পাকিস্তানেই পরিণত হয় তবে এই ত্রিশ লক্ষের আত্মত্যাগ, এই স্বাধীনতা আসলেই অর্থহীন।