“শুধুমাত্র ভালোবাসাতেই আমার আগ্রহ, এবং আমি সেই সব বিষয়গুলোর সংস্পর্শে আসতে পছন্দ করি যাদের সৃষ্টি ভালোবাসাকে কেন্দ্র করেই”- রুশ চিত্রশিল্পী মার্ক শাগালের উক্তি । পৃথিবীর তাবৎ শিল্পীদের মনের কথাই হয়তো এটা । অন্তত আমার মনের কথা তো বটেই । ভালোবাসা ছাড়া সৃষ্টি কি সম্ভব ? কখনই সম্ভব নয় । শিল্পীদের ভালোবাসার প্রকৃতি যদিও বেশ অদ্ভুত হয়ে থাকে কিন্তু তারা সব কিছুকে ভালোবাসাতে পারে, আবার হয়তো বা কোনো কিছুকেই ভালোবাসে না, কিছুটা হলেও নার্সিসিজম কাজ করে এমন ভাবাটাও অমূলক নয়। এমন এক অদ্ভুত টানাপোড়নের মধ্যে হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা যন্ত্রণা, হতাশা, কষ্ট বা না পাবার বেদনায় তিলে তিলে তারা সৃষ্টি করে যান এক একটি শিল্পকর্ম, যেনো অদৃশ্য কোনো মাতৃ জঠরে জন্ম নিচ্ছে নিত্য নতুন শিশু ।
শিল্পীরা চিরপ্রেমিক, তারা প্রেমে বুদ হয় প্রতিনিয়ত, সে প্রেম হতে পারে প্রকৃতির জন্য, মানুষের জন্য এমনকি শিল্পের জন্য ও । শিল্পীদের ভালোবাসার বা প্রেমের সেই রহস্যময় জগতটি কেমন, আমাদের হয়তো অনেকটাই অজানা । কিন্তু কোনো শিল্পীকে এবং তার শিল্পকর্মকে জানতে বা বুঝতে গেলে, তার জীবন সম্পর্কে অবশ্যই আমাদের জানতে হবে । ভালোবাসা ব্যাতীত কোনো শিল্পীই, শিল্পী হয়ে উঠতে পারে না । সেদিক থেকে বিবেচনা করলে শিল্পী সত্ত্বাকে তার প্রেমিক সত্ত্বা থেকে আলাদা করে দেখার কোনো অবকাশ নেই ।
১৮৮৮ সালের ডিসেম্বরের ২৩ তারিখের এক শীতের রাত। দক্ষিন ফ্রান্সের একটি শহর আর্লস; আমরা সেই রাতের কথা জানি যখন, ডাচ শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গো একটি কাগজের মধ্যে কিছু একটা জাড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তাঁর পায়ের ধাক্কায় পাথর ছিটকে পড়ছে এদিকে সেদিকে, তাঁর টালমাটাল চলার ভঙ্গি আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে সে প্রকৃতিস্থ নয় । অন্ধকারের ভেতরেও লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, তাঁর কানের পাশ দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে । সে তার গন্তব্যে থেমে যায় এবং একটি দরজায় ধাক্কা দেয় । চিরপরিচিত সে দরজা এবং পরিচিত এক রমণী দরজা খুলে দিয়ে খুব চেনা ভঙ্গিতে তাকে ভেতরে আসতে বলে, শিল্পী ভিনসেন্ট সেই রমণীর হাতে তাঁর কাগজের প্যাকেটটি গুজে দিয়ে দ্রুত পায়ে ফিরে যায়। অতঃপর আকাশে বাতাসে নারী কন্ঠের চিৎকার ভেসে আসে …
ভিনসেন্ট তাঁর কানের খানিকটা অংশ কেটে সেই পতিতাকে সে রাতে উপহার দিয়ে আসেন, কিন্তু ভিনসেন্ট কেনো তাঁর নিজের কান কাটতে যাবেন ? আজো আমাদের কাছে অজানা । সবাই ভালোবাসার রমণীকে ফুল উপহার দেয়, দেয় মূল্যবান কোনো বস্তু, ভিনসেন্ট কেনো নিজের কান ছিড়ে দিতে যাবেন ? কে জানে ? সে ঘটনার কোনো সুস্পষ্ট সাক্ষী বা তথ্য আমাদের জানা নেই । মনে করা হয় ভিনসেন্ট ও শিল্পী গঁগ্যা দুজনই খুব চাপা স্বভাবের ছিলেন বলে কেউ কোনো দিনো সে বিষয়ে মুখ খোলেননি। অনেকের ধারণা, হয়তো শিল্পী বন্ধু পল গগ্যাঁ’র সাথে তার তর্কবিতর্কে বা হাতাহাতির ফলে এমন দূর্ঘটনা ঘটেছিলো যে ভিনসেন্ট তাঁর কানটাকে বাঁচাতে পারেনি, অথবা হিংসা বশত নিজেই নিজের কান কেটে দিয়ে এসেছিলো সেই পতিতাকে যাকে সে পেতে চেয়েছিলো খুব আপন করে (?)। অথবা তাঁর অসহনীয় মানসিক যন্ত্রনাকে ভুলতে গিয়ে, সে তাঁর শারীরিক কষ্টকে বাড়িয়ে নিতে চেয়েছিলো শতগুনে । ভিনসেন্ট একের পর এক আত্মঘাতী প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রত্যাখানের বেদনাগুলোকে ভুলতে চেয়েছিলের তার জীবদ্দশায় । যদিও সেকারণেই ১৮৮৯ সালের শুরুর দিকে আমরা উপহার পাই অসাধারণ এক শিল্পকর্ম; যার শিরোনাম ছিলো – “ কানে ব্যান্ডেজ বাধা আত্ম-প্রতিকৃতি” । ভিনসেন্ট ভ্যান গো আরো একবার পৃথিবীকে জানিয়ে দিলেন, কষ্ট ছাড়া সৃষ্টি হয় না ।
আরো একটু অতীতের দিকে ফিরে গেলে দেখা যাবে যে, ১৮৭৫ সালে ভিনসেন্ট যখন লন্ডনে তার চাচার গুপিল গ্যালারিতে কর্মরত ছিলেন একজন সাধারণ শিল্পকর্ম বিক্রেতা হিসেবে ; তখন তিনি সেখানে উরসুলা লয়ার নামের ৫৮ বছরের বেশী বয়স্ক এক বিধবা মহিলার বাসায় লজিং থাকতেন। তিনি তাঁর ১৯ বছর বয়সি মেয়ের সাথে একটি বাচ্চাদের স্কুল পরিচালনা করতেন সেই বাড়ীতেই। ভিনসেন্ট সেই সময় উরসুলা লয়ারের কন্যা ‘ইউহেনিয়া লয়ার’র অনুরাগ প্রার্থী হন। ভিনসেন্ট জানতো না যে সে গোপনে ইতিমধ্যে অন্য কারোর বাগদত্বা হয়ে আছে, বা জানলেও ভিসেন্টের অদম্য আগ্রহ সে চাপা দিতে না পেরে, উরসুলা কন্যাকে ভালোবাসার কথা ব্যাক্ত করেন । কিন্তু হায় ! তাকে শুধু প্রত্যাখানই করা হয়না, করা হয় অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে, অপমানও করা হয় নির্মম ভাবে । যদিও ভিনসেন্ট ইউহেনিয়া কে অনুরোধ করে সেই সম্পর্ক ছিন্ন করতে তাঁর জীবনে চলে আসতে, কিন্তু তাতেও সে রাজি না হলে, ভগ্নহৃদয় ভিনসেন্ট মারাত্মক ভাবে মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়েন। ফলশ্রুতিতে ভিনসেন্ট নিজেকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে নেন, একা হয়ে পড়েন । কোনো এক পর্যায়ে তিনি ভাই থিওকে চিঠিতে লেখেন ‘আমি হয়তো সারা জীবন চিরকুমার রয়ে যাবো ’।
নারীজাতি শক্ত পুরুষের নিকট যতটা নমনীয় আচরন করতে পারে, ভিনসেন্টের মতো শিশুর মতো সরল একজন পুরুষের নিকট তারা ততটাই নির্মম হয়ে উঠতে পারে ।
যদিও ছোটো ভাই থিও কে ভিনসেন্ট সব সময় চিঠি লিখেতো কিন্তু, তাঁর ভালোবাসা বা প্রণয় বিষয়ে সে খুব কম উল্লেখ করেছে। ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে, সে থিও কে লেখে “আমি একজন নারীকে চলে যেতে দিয়েছি, সে অন্যকে বিয়ে করেছে। আমি তার কথা ভোলার জন্য অনেক দূরে চলে এসেছি, ভুলতে পারিনি । বিধ্বংসী ।”— কথা গুলো থিওকে সে বলে ছিলো ক্যারোলাইনকে উদ্দেশ্য করে ।
যদিও মনে করা হয় ইউহেনিয়া ভিনসেন্টের প্রথম প্রেম, তবে মতান্তরে ভ্যান গো এর আগেও একজন তরুনীর প্রেমে পড়েছিল বলে মনে করা হয় । তার নাম ক্যারোলাইন হানবেক । নেদারল্যান্ডের রিজউইকে তাদের সংক্ষিপ্ত এক সাক্ষাতে ভিনসেন্ট এই তরুনীর প্রেমে পড়ে যান- যাকে তিনি নাম দেন ‘সব থেকে কোমল বুনোফুল’ বলে । কিন্তু যখন জানতে পারেন তাঁরই এক জ্ঞাতিভায়ের সে বাগদত্তা বা তখন, ভিনসেন্ট তার অনুজ থিও কে বলেছিলো “আমি যদি কোনো ভালো রমণী খুঁজে না পায়, তবে খারাপই সই’- আমি একা থাকতেপারবো না, কোনো পতিতা হলেও চলবে”। যদিও ভিনসেন্ট সব সময় শারীরিক চাহিদা থেকে তাড়িত হবার চেয়ে, মানসিক আশ্রয় খুঁজতেন, খুঁজতেন সমমনা কোনো নারীকে, তার চিন্তা চেতনার সঙ্গি করতে । ক্যারোলাইনের কথা ভিনসেন্ট তাঁর চিঠিতে নানা স্থানে উল্লেখ করেছেন । এমনকি তিনি ক্যারোলাইন এবং তার স্বামী উইলেম কে ও চিঠি লিখতেন । থিওকে কোনো একটি চিঠিতে ভ্যান গো উল্লেখ করেছিলেন, অল্প বয়সের সেই প্রেম ও প্রত্যাখানের কথা, সেই প্রত্যাখানের বেদনা যে বৃথা যায়নি সেটাও তিনি নিশ্চিত করেছেন । ভিনসেন্টের সাহসী সব পদক্ষেপ এবং জীবনকে ঝুকির মধ্যে ঠেলে দিয়েও তিনি তার সৃষ্টিকে রেখেছিলেন সচল, জীবনের সব ব্যার্থতা কে পিছনে ফেলে তিনি শিল্পকে আপন করে নিয়েছিলেন ।
ইউহেনিয়া লয়ারের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এবং মানসিকভাবে বিভ্রন্ত ভবিষ্যৎ শিল্পী যখন হল্যান্ডে ফিরে যান তখন, তার জ্ঞাতিবোন কি ভসে’র প্রেমে পড়েন আবার । ১৮৮১ সালের অগাস্ট মাসে কি ভসে সদ্য বিধবা হয়ে ঘরে ফিরেছেন তার পুত্রকে নিয়ে । এবং ভিনসেন্ট প্রেমে ব্যর্থ হয়ে পুনরায় জীবনে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। তিনি তাঁর জ্ঞাতিবোন কি ভসে কে প্রেম নিবেদন করলেন এই বলে যে; ‘আমি তোমাকে ততটুকুই ভালোবাসি যতটুকু নিজেকে’-‘তুমি কি আমাকে বিয়ে করার ঝুকি নেবে’? স্বাভাবিক ভাবেই পারিবারিকভাবে বাধা আসে । কারণ, উনবিংশ শতাব্দীতে হল্যান্ডে চাচাতো-মামাতো ভাই বোনের মধ্য বৈবাহিক সম্পর্ক হওয়াকে নিষিদ্ধ বলে গন্য করা হতো । কি এর বাবা তার মেয়ের সাথে ভিনসেন্টকে দেখা করতে না দেয়ায়, তাঁর ধারণা হলো যে, মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি কাজটা করছেন, তাই ভিনসেন্ট জোর করে, কি এর সাথে দেখা করতে চায় একদিন এবং একটি জ্বলন্ত মোমবাতির উপর হাত রেখে বলেন, “ আমাকে ওর সাথে দেখা করতে দাও, তা না হলে আমি আমার হাত সরাবো না এই আগুন থেকে ”।
কিন্তু হায়, নিয়তি যখন ঠিক করে রেখেছে তাঁর ভাগ্যে ভালোবাসা জুটবে না, কোনোদিনো, নিয়তিকে কে খন্ডাতে পারে ? কি ভসে আবারো নির্মম ভাবে এই খেপাটে শিল্পীকে প্রত্যাখান করেছিলো । এবং চিৎকার করে বলেছিলো ‘না , নাহ, কখনই না!’
শিল্পী ভ্যান গো কে কোনো নারীই সঠিকভাবে চিনতে পারেনি সেদিন । কারণ সময়ের আগে জন্ম নেয়া প্রতিভাধর মানুষকে বোঝার ক্ষমতা, তার সমসাময়িকদের মধ্যে থাকে না । তবে আর ভিনসেন্টের মৃত্যুর শত বছর পরেও তিনি হয়েছেন শত শত রমণীর প্রেরণা ও ভালোবাসার কেন্দ্র । সেই অর্জন গুটিকয়েক সাধারণ রমণীর ভালোকবাসা পাবার থেকে শতগুনে বেশী ।
ভিনসেন্টকে মনে করা হতো, শিশু সুলভ একজন মানুষ, যে সমাজের বাকি দশজন মানুষের মতো চিন্তা করতে জানতো না, যার কোনো বৈষয়িক জ্ঞান ছিলো না, লোভ বা লালসা কোনোটাই তাঁর ছিলো না । সে মানুষকে চিনতে বা বুঝতে পারতো না সঠিকভাবে । থিও কে সে একবার চিঠিতে লিখেছিলো যে “সম্পর্কতো শুধু নেবার জন্য নয়, দেবার জন্যও” । ভিনসেন্ট সব সময় সবক্ষেত্রে নিজেকে উজাড় করে দিতে চেয়েছিলেন । তাঁর সাথে কয়েকজন পেশাদারী পতিতার সম্পর্কের কথাও জানা যায় । তাদের মধ্যে সিন হুরনিকের নাম সব থেকে পরিচিত । ১৮৮১-১৮৮৩ সালের মধ্যেকার ঘটনা । ভিনসেন্ট ভ্যান গো এর অনেক শিল্পকর্মে আমরা সিন হুরনিক কে দেখতে পাই । তিনি তার কাজের মডেল হিসেবে তাকে ব্যবহার করেছেন । সিন হুরনিক তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলো; এক পর্যায়ে ভিনসেন্ট সিন হুরনিক এর সাথে এক সাথে বসবাস শুরু করেন । পরবর্তিতে সিন হুরনিক একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিল এবং আমরা সেই শিশুটিকেও ভিনসেন্টের কাজে দেখতে পাই । পাগলাটে শিল্পী পরিবার ও সমাজের বিরুদ্ধে গিয়েও সেই শিশু এবং তার পাঁচ বছরের একটি বোন সহই সিনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, অবশেষে ভাই থিও এর অনুরোধে সে সিন হুরনিককে পরিত্যাগ করে; একই সথে অবসান হয় ভিনসেন্টের একমাত্র সংক্ষিপ্ত সংসার জীবনের । “হ্যা আমি একটা বেশ্যা ! – আমার সাথে জীবন কাটানো আর নদীতে ঝাপ দেয়া একি কথা ।” বলেছিলো সিন হুরনিক ভিনসেন্টকে ।
ধীরে ধীরে ভিনসেন্ট নিজ ভাগ্যের মানচিত্রটা পড়তে পেরে, মেনে নিতে বাধ্য হন যে নারী জাতির মন যখন ঈশ্বরও বুঝতে পারেনি তখন সে আর বৃথা চেষ্টা না করে, মনোযোগ দিতে শুরু করেন পড়াশুনা ও শিল্পচর্চাতে । যাযাবরের মতো ঘুরে দেখতে থাকেন চারপাশের জগতটাকে। নিজেকে সম্পূর্ণরুপে সমর্পণ করেন প্রকৃতির কাছে । এবং শিল্পের কাছেও আত্মসমর্পণ করেন তিনি। অতঃপর মাত্র দশ বছরের অবিরাম চেষ্টায় তিনি নিজেকে বিশ্বের প্রথম সারির শিল্পীদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন । তাঁর সৃষ্ট ‘সূর্যমুখী’ বিশ্বের সব থেকে জনপ্রিয় শিল্পকর্ম বলে বিবেচিত আজকের দিনে ।
শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গো কেনো পাগলের মতো রমণীদের ভালোবাসা পাবার জন্য ছুটেছেন? কেনইবা তিনি হাহাকার করতেন, কোনো নারীর স্পর্শের জন্য । খুব সংক্ষিপ্ত করে বললে, বলতে হবে, শৈশব থেকে ভিনসেন্ট ছিলেন মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত । ভিনসেন্ট এর জন্মের ঠিক এক বছর আগে তাঁর এক ভায়ের জন্ম হয়েছিলো এবং সে শিশু অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে । তার নামও ছিলো ভিনসেন্ট। এ কথা জানার পর থেকেই ভিনসেন্ট নিজেকে, মনে মনে দায়ী করতেন সে ঘটনার জন্য। শুধু তাই নয়, ভিনসেন্ট তাঁর মায়ের কাছ থেকে কোনো স্নেহ বা ভালোবাসা না পেয়ে ধীরে ধীরে দূরে সরে আসেন । এবং আমৃত্যু তিনি একটি কথাই বোঝার চেষ্টা করেন সেটা হলো, কেনো তাঁর মা, তাঁর শিল্পকর্মকে ‘দু:সহনীয়’ বলেছিলো এবং কোনো দিনো কোনো প্রশংসা করেননি। ভিনসেন্ট ভ্যান গো এর সাথে তাঁর মায়ের সম্পর্কের দূরত্ব ছিলো সারাটি জীবন; তাই ভিনসেন্ট রমণীর ভালোবাসা, মমতা, স্নেহ, আদর পাবার জন্য ব্যাকুল ছিলেন । ভিনসেন্ট এর আয়ু মাত্র ৩৭ বছর হলে কি হবে, তাঁর মা তিন পুত্র সন্তানের অকাল মৃত্যুর পরেও দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন ।
যে নারীটির অবদানের কথা না বললে অসম্পূর্ন থেকে যাবে সে হলো – জোয়ানা ভ্যান গো । ভিনসেন্টের ছোট ভাই থিও ভ্যান গো এর স্ত্রী ও সন্তানের মা । জোয়ানার সঙ্গে ভিনসেন্টের সম্পর্কের ব্যাপ্তি খুব সংক্ষিপ্ত কালের । কিন্তু এর স্থায়িত্ব আজীবনের । জোয়ানা যদিও ছিলেন তাঁর ছোটো ভাই এর স্ত্রী, তবুও ভিনসেন্টের সাথে ছিলো তার বন্ধুর মতো সম্পর্ক । এক পর্যায়ে জোয়ানাই নেন ভিনসেন্টে এর মায়ের স্থান, বোনের স্থান বা সহধর্মিনীর স্থান । জোয়ানা তার শিশু পুত্রকে বুকে নিয়ে, ভিনসেন্টের শিল্পকর্ম আকড়ে ধরে, থিও ও ভিনসেন্টের চিঠিপত্রগুলোকে আগলে রেখে সামনে এগিয়ে গেছেন এবং ভিনসেন্টের মৃত্যুর ১৬ বছর পরেও হলে তাকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেই তবে ক্ষান্ত হয়েছেন । যে সব রমণীরা ভিনসেন্টকে ফিরিয়ে দিয়ে নারী জাতির কলঙ্ক হয়ে রয়ে গিয়েছিলো, জোয়ানা একহাতে সেই দাগ মুছে দিয়েছিলেন । আর শিল্পকলার জগতের আকাশে আমাদের উপহার দিয়েছেন একটা উজ্জ্বলতম নক্ষত্র ।
তারপরেও ভালোবাসা বেঁচে থাকে । শিল্পীরা প্রেমে পড়ে, সৃষ্টি করে অনবদ্য সব সৃষ্টিকর্ম । মানব বা মানবীর প্রতি প্রেম শিল্পীর জীবনকে লণ্ডভণ্ড করে দিলেও সৃষ্টির প্রশ্নে ও সৃজনশীল চর্চায় সে থাকে অনঢ় এবং অবিচল । আত্মসমর্পণে শিল্পী নিজেকে ভাসিয়ে দেয়না সমাজ সংসারের চিরায়ত সংস্কারের মাঝে । সে ভেসে চলে ভিন্ন স্রোতে। একা। বিচ্ছিন্ন ভাবে । তার চলার সঙ্গি তাঁর হৃদয় মাঝে বয়ে চলা ভালোবাসার ঝর্ণাধারা । ভালোবাসা ও প্রেমই তার সৃষ্টিশীলতার চালিকা শক্তি । ভিনসেন্ট ভ্যান গো যেমনটি বলেছিলেন – “ অনেক কিছুকে একসঙ্গে ভালোবাসা ভালো, ভালোবাসার মধ্যেই শক্তি লুকিয়ে থাকে, যে বেশী ভালোবাসতে জানে সে বেশী পরিশ্রম করতে পারে এবং বেশী অর্জন করতে পারে এবং ভালোবাসায় যে কাজ করা হয় তা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ’’।
(চলবে…)
ভালো লাগলো। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
এত ভালবাসবেন না শেষটায় রোমান্টিক অনুভূতিতে আঘাত লাগবে
🙂
আমার পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি হচ্ছে, পৃথিবীতে খুব সীমিত সংখ্যক মানুষ প্রকৃতভাবে ভালোবাসতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তাদের ভালবাসা অনুধাবন করতে পারে না। তাই প্রত্যাখ্যানের উপাখ্যান রচিত হয়। কজন পারে এই ব্যথ্যা-বেদনাকে শিল্পের ভাষায়-সৃষ্টিকর্মে ফুটিয়ে তুলতে? আপনি যথার্থই বলেছন- এ জায়গাটিতেই সাধারণের সাথে শিল্পীদের পার্থক্য।
আরেকটি বিষয় আমাকে আনন্দিত করলো, সেটা হলো ভিনসেন্ট ভ্যান গো নিজে যেমনটি ছিলেন, যেসব অভিজ্ঞতা লাভ করে বেদনাতুর হয়েছেন, যেভাবে ভেবেছেন, যেভাবে চেয়েছেন- সেসবই তার সৃষ্টিকর্মে যেন তুলে ধরেছেন। নিজের ভাবনা-চেতনা-ভালোবাসার সাথে সাংঘর্ষিক কিছু করেন নি। একজন প্রকৃত শিল্পী হবার ক্ষেত্রে এই বিষয়টির কি কোনো গুরুত্ব আছে?
প্রশ্নটা করলাম কারন, বর্তমানে আমাদের দেশে যেন ব্যক্তির কাজে কর্মে এই সাংঘর্ষিকতা- এই স্ব-বিরোধীতাটাই প্রকাশ পায় বারে বারে। এদেশে হিজাবিনীরা চারুকলার শিল্পী হয়, ধর্মবাদীরা বিজ্ঞানী-ও-বিজ্ঞান লেখক হয়। এ ধরণের দৃষ্টিকটু স্ববিরোধীতায় আদৌ কি মহৎ-ও-সুন্দর সৃষ্টি সম্ভব?
লেখাটি অনন্য। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম। শুভ কামনা।
ধন্যবাদ । তোমার মন্তব্য আমার লেখাটির চেয়ে অনেক গুনে গভীর অর্থ বহন করছে ।
ঠিক একারণেই ভ্যান গো এর মত প্রকৃত শিল্পীর দেখা পাওয়া কঠিন ; শিল্পী হয়তো অনেক থাকতে পারে । 🙂
খুবই ভালো লেগেছে. তবে আপনার ছবিটার মানে বুঝলাম না. লেটার টু মাই আনবর্ণ চাইল্ড .
ধন্যবাদ!
আমার ‘লেটার টু মাই আনবর্ন চাইল্ড’ সিরিজটা নিয়ে পরে আরেকদিন লেখা যেতে পারে 🙂 …
সবগুলি ছবিই চমৎকার; যদিও আমি চিত্রকর্ম বুঝি না। লেখাটিও ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ। নিয়মিত লেখা চাই। আপনার আঁকা কয়েকটা কয়েকটা ছবি এবং ছবিগুলি সম্পর্কে আপনার বক্তব্য ও আঁকার ইতিহাস নিয়েও পোস্ট দিতে পারেন কিন্তু।
ধন্যবাদ নীলাঞ্জনা, অবশ্যেই আমার কাজ নিয়ে লিখবো । আগ্রহ প্রকাশের জন্য আবারো ধন্যবাদ । শুভকামনা ।
সুখপাঠ্য লেখা। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
“শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গো কেনো পাগলের মতো রমণীদের ভালোবাসা পাবার জন্য ছুটেছেন? কেনোইবা তিনি হাহাকার করতেন, কোনো কোমলমতি নারীর স্পর্শের জন্য”-
আসলেই কি তাই? প্রেমে ব্যর্থ হওয়া যেমন স্বাভাবিক তেমনি একাধিক প্রেমে পরাও তো স্বাভাবিক। তিনি পাগলের মত রমনীদের ভালোবাসা পাবার জন্য ছুটেছেন এটা তাঁর জীবনী পড়ে মনে হয়নি।
ভ্যান গো কে বাংলাদেশে ভ্যান গোগ নামে চিনতাম। ভ্যান গো সম্ভবত আমেরিকান উচ্চারণ, তাই কি?
ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য । ঠিক বলেছেন, উত্তর আমেরিকাতে ভ্যান গো বলা হয়।
লেখাটির বিষয় বস্তু যে কোনো সাধারণ মানুষের প্রেমে পড়া নিয়ে নয়, বরং শিল্পীদের প্রেমে পড়ার যে ভিন্নতা সাধারণ মানুষদের থেকে এবং ভালোবাসার ক্ষেত্রে তাদের যে তীব্রতা কাজ করে সেই বিষয়টি নিয়ে । ভালোবাসার মতো একটা বিশুদ্ধ অনুভূতিকে স্পর্শ করার যে আকুলতা কাজ করে এবং সেটিকে তাদের সৃজনশীলতার মাধ্যম প্রকাশ করার আগ্রহ দেখা যায়, সেই বিষয়টি তাদেরকে সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক করে ।
ভিনসেন্টকে যারা জানেন, তারা জানবেন যে তিনি ভালোবাসা পাবার জন্য কতটা ব্যাকুল ছিলেন ! এবং সেটার কারণও উপরের লেখাতে উল্লেখ করা হয়েছে । এই বিষয়ে যথেষ্ট সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর চিঠিপত্র এবং শিল্পকর্মগুলোতে ।
কোন লেখকের লেখা জীবনী পড়েছেন আপনি সেটার উপরে নির্ভর করছে বিষয়টি । 🙂
চমৎকার লেগেছে। আশাকরি নিয়মিত আপনার লেখা পাবো।
নেদারল্যান্ডে দেখি সবাই উচ্চারণটা করে ভান খোখ, যেহেতু ডাচ ভাষায় g এর উচ্চারণ ‘খ’ এর মতো। অবশ্য তিনি যেহেতু ফ্রান্সেও বা এমনকি ইংল্যান্ডেও ছিলেন সেহেতু ডাচ উচ্চারণে ডাকাটা বোধহয় বিরল। আমি ঠিক জানি না খোখের নাম আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কিভাবে উচ্চারণ করা হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য সব ডাচ নাম ডাচভাবেই লিখি। যেমন ক্রিস্টিয়ান হাওখেন্স (Huygens)।
আর কয়েকটা বানান ভুল ও/বা টাইপো চোখে পড়ল। ব্লগে লেখার ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত বানান/টাইপো নিয়ে অত সতর্ক থাকি না। তারপরও মনে হয়, টাইপো না থাকলে পড়তে আরো ভালো লাগে। আমার যা চোখে পড়ল নিচে উল্লেখ করলাম: 🙂
“আমরা উপহার পায় অসাধারণ এক শিল্পকর্ম” — “পাই”?
“কানে ব্যান্ডেজ বাধা আত্মপ্রতিকৃতি” — “বাঁধা” হবে না?
“একটি বাচ্চাদের স্কুল পরিচালনা করতেন নেই বাড়ীতেই” — “সেই”, “বাড়ি”
দূর্বল -> দুর্বল
প্রনয় -> প্রণয়
rijswijk এর ডাচ উচ্চারন রাইসভাইক। অবশ্য ইংরেজি উচ্চারণ করাতেও কোনো সমস্যা নেই, তাও জানাতে ইচ্ছা হলো।
বাগদত্বা -> বাগদত্তা
“থাকতেপারবো” — মাঝে স্পেস বাদ গেছে
ঝুকি -> ঝুঁকি
বিভ্রন্ত -> বিভ্রান্ত
Kee Vos — কেই ভোস হবে ডাচ উচ্চারণ। পাশে লাতিন অক্ষরেরটাও লিখে রাখলে বোধহয় আরো ভালো হয়।
খন্ডাতে -> খণ্ডাতে
জানেতা -> জানতো
“লোভ বা লালসা কোনোটায় তাঁর ছিলো না” — কোনোটাই
অন্তসত্বা – অন্তঃসত্ত্বা
Sien Hoornik — ডাচ উচ্চারণ সিন হোরনিক বা হৌরনিক
১৬ বছর পরেও হলে — পরে হলেও?
কয়েকবার “ভিনসেন্টকে” টা “ভিনসেন্টে” হয়ে গেছে।
লন্ডভন্ড -> লণ্ডভণ্ড?
ঝর্নাধারা -> ঝর্ণাধারা
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম…
ধন্যবাদ, সময় নিয়ে পড়ে বানান শুধরে দেবার জন্য । ঠিক বলেছেন টাইপো থাকলে পড়তে আরাম বোধ হয় না ।
ভিনসেন্ট ভ্যান গো’র নাম উচ্চারন করা বেশ কঠিন একটি কাজ, বলা হয়ে থাকে ডাচরা ছাড়া কেউ নামটি সঠিক ভাবে উচ্চারন করতে পারে না । এমনকি ডাচরাও আঞ্চলিক এলাকা ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উচ্চারন করে । মূলত গলার ভেতর থেকে কাশি দেবার মতো কোনো শব্দ বের হয় যেনো , যেটা কোনো বাংলা অক্ষর ‘গ’ বা ‘খ’ এর মতো না । বরং মাঝামাঝি একটা শব্দ ।
আমার নাম আসমা – পশ্চিমে এরা বলে আজমা অথবা আ্যজমা অথবা আশমা … কিংবা মিতা কে বলে মিটা বা মাইটা । আমরা যেভাবে বাংলায় আসমা বলি সেভাবে তারা বলতে পারে না । নামের উচ্চারনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলিক ভঙ্গি মেলানো সম্ভব নয় । এই কথা গুলো উপরে উল্লেখিত সব নামের জন্য প্রযোজ্য ।
শুভকামনা ।
লেখা চালিয়ে যান আপা।টানা দুইবার পড়ে শেষ করলাম……
ধন্যবাদ
ভ্যান গো.. মনে আছে তুমি বলেছিলে আর্ট নেই আর্টিষ্ট আছে শুধু, যারা তাদের জীবনটাকে নিংড়ে দেন, ভ্যান গো যা দিয়ে গেছেন পৃথিবীকে তা অকল্পনীয়। থিও র বিধবা স্ত্রী ভ্যান গো র প্রতি থিওর ভালোবাসাটাকে ধরে রেখেছিলেন.. জোয়াানা না থাকলে আমরা ভ্যান গো কে পেতাম না.. কি পরিমান পরিশ্রম করে তিনি ভ্যান গো কে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তার প্রতিটি ক্যানভাস সযত্নে রেখে। আশা করছি এই সিরিজটি চলবে..ভ্যান গো’র কথা মতই ..জীবনকে জানার একটি ভালো উপায় অনেক কিছুকে ভালোবাসা। শুভকামনা।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ