বাবু প্রবীর ঘোষ তার ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণ দিয়েছেন। এই ভাষণে তিনি অভিজিৎ রায় সম্পর্কে বেশকিছু নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন, যা আমাদের নজরে এসেছে। দুই বাঙলার অনেক মুক্তমনা-বন্ধুরা প্রবীর বাবুর এই বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কেউ কেউ ফেসবুক স্ট্যাটাসে তা প্রকাশ করেছেন, কেউবা মন্তব্য করেছেন। আবার অনেকেই আমার কাছে ব্যক্তিগত মতামত জানতে চেয়েছেন। ভেবেছিলাম- এ নিয়ে কোনো উত্তর দিব না। থাক না, কে কি বললো তা এতো গুরুত্ব দেবার কি আছে? পরে মনে হলো, উত্তর দেয়াটা দরকার। অভিজিৎদা বেঁচে থাকলে তিনি নিশ্চয়ই এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন। কিন্তু তিনি নেই, তার অবর্তমানে দায়িত্বটা আমাদের উপর চলে এসেছে। এই সময় চুপ থাকলে মৌলবাদীদের মত কিছু “অ্যাটেনশন-সিকার” তথাকথিত যুক্তিবাদীরাও প্রশ্রয় পেয়ে মাথায় উঠে বসবে। বিষয়টা সুরাহা হওয়া দরকার। তাই এই লেখা।
১. প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, প্রবীর বাবুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক বা বিদ্বেষ নেই। বাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় তার লেখার সূত্র ধরেই। এই কৈফিয়ত দেবার অর্থ হলো, কেউ যেন আবার ধরে না নেন, ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণ থেকে প্রবীর ঘোষকে আক্রমণ করা হচ্ছে। বরং প্রবীর ঘোষ যেহেতু নিজেই আগ বাড়িয়ে মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায় সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, তাই জবাব তাকে পেতেই হবে।
২. প্রবীর ঘোষের ভাষণের অভিজিৎ-প্রসঙ্গ দেখা যাক।-
“নির্মোহভাবে অভিজিৎ রায়ের কর্মকান্ডকে খুব সংক্ষেপে একটু বিচার করতে চাই। অভিজিৎ রায় বিজ্ঞানের কঠিন তত্ত্বগুলোকে খুব প্রাঞ্জল ভাষায় লিখেছিলেন যা অতি প্রশংসনীয়। কিন্তু উনি যখন সমকামিতার পক্ষে বই লেখেন এবং সমকামিতাকে ‘প্রোমোট’ করার চেষ্টা করেন, তখন তার প্রতিবাদ জানানো ছাড়া আমাদের কাছে উপায় থাকে না। উনি ইদে শুভেচ্ছা বার্তা জানালেন, এটা একজন নিরীশ্বরবাদীর কাছে খুবই বেদনাদায়ক।”
প্রবীর বাবু বেদনাহত। আর আমরাও তার বক্তব্যে যারপরনাই বিস্মিত। বিস্মিত এই কারণে যে, তিনি অভিজিৎ রায়ের ধর্ম-চর্চার খুঁত ধরতে আর কিছু পেলেন না। অভিজিৎ রায় হিন্দু পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। তিনি প্রকাশ্যে নাস্তিক ঘোষণা দিয়েছেন। এখন প্রবীর ঘোষ যদি বলতেন, অভিজিৎ রায় ধূপবাতি-আগরবাতি জ্বালিয়ে ফুল-চন্দন দিয়ে মাটির মূর্তির পূজা করতো, তাহলে আমাদের সংশয়ীমন কিছুটা বিভ্রান্ত হতো। কিংবা অভিজিৎ রায় যদি পূজার শুভেচ্ছা দিত বলে তিনি দাবি করতেন তাহলেও একটা কথা ছিল। হয়তো ভাবতাম, অভিজিৎদা আবার উল্টোপথে হাঁটলো কখন? প্রবীর বাবু অবশ্য তা দেখাতে পারেননি। তিনি কোনোকিছু খুঁজে না পেয়ে ইদ-শুভেচ্ছার ত্রুটি বের করেছেন। তা প্রবীর ঘোষ, আমাদের একটু বলেন দেখি, অনলাইনে বসে কাউকে ঈদের শুভেচ্ছা জানানো আর ছুরি হাতে গরু জবাই করে ভূরিভোজ করে কোরবানি ঈদ উদযাপন কি এক কথা? আপনার যুক্তিবাদ কি বলে? ভারত-বাংলাদেশে পূজা এবং ঈদ সামাজিক অনুষ্ঠান হিসেবে পালন করা হয়। অভিজিৎ রায় থেকে শুরু করে আমরা দুই বাঙলার হাজার হাজার নাস্তিকরা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বিরোধিতা করি নিরন্তর। কিন্তু কুশল বিনিময় করতে গিয়ে কিংবা মজা করার জন্য হলেও এই ধরনের শুভেচ্ছা বক্তব্য দিই। তাতে যুক্তিবাদের তকমা খসে পড়ে যায়, এমন দাবি যারা করে তাদের জন্য করুণা ছাড়া আর কিছুই নেই আমাদের। যাইহোক, অভিজিৎ রায় বেঁচে থাকলে হয়তো ভালো বলতে পারতেন,- কখন কোন প্রেক্ষাপটে তিনি এই শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। আজ যেহেতু তিনি নেই, তাই এ বিষয়ে বেশি কিছু বলারও নেই আমার। তবে শুধু এটাই বলি, যুক্তিবাদ আপনার মতো কাদামাটির কোনো প্রলেপ নয়, যে কোনো মুসলমান বা হিন্দু বন্ধুর বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করলে যুক্তিবাদীদের জাত চলে যাবে!! এটা খুবই হাস্যকর হেত্বাভাস!
৩. আপনি লিখেছেন,-
“কিন্তু উনি যখন সমকামিতার পক্ষে বই লেখেন এবং সমকামিতাকে ‘প্রোমোট’ করার চেষ্টা করেন, তখন তার প্রতিবাদ জানানো ছাড়া আমাদের কাছে উপায় থাকে না।”
প্রবীর ঘোষ, আপনার বলিহারি যুক্তি মশাই! আমি কুপোকাত!! আজকে যদি আমি ইউজেনিক্সের (সুপ্রজননবিদ্যা) সমাজতাত্ত্বিক-রাজনৈতিক কারণ-ইতিহাস নিয়ে বই লিখি, তবে কি আমিও ইজেনিক্সের সমর্থক হয়ে যাবো?!! দুই হাজার বছর ধরে মানব সমাজে কোনো না কোনো ফর্মে ইউজেনিক্স কার্যকর রয়েছে। ইউজেনিক্স এই সমাজের বাস্তবতা। এটাকে অস্বীকার করার জো নেই। আমেরিকা-ইংল্যান্ড জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইউজেনিক্সের বিভৎসতা মানুষ দেখেছে গত দুই শতাব্দীতে। যে কোনো ইতিহাস-গবেষকের কাছে এ্টা একটা আকষর্ণীয় বিষয়। ইংরেজিসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় প্রচুর গবেষণাধর্মী বই আছে এ নিয়ে। বাঙলাতে হয়তো তেমন কিছু নেই। এখন বাঙলায় যদি কেউ বই লিখে, তবে কি এটা বলা যাবে, ইউজেনিক্সকে প্রমোট করা হচ্ছে? আবার ধরেন,- নাৎসিবাদ-ফ্যাসিবাদ নিয়ে বই লিখলেও আমি হিটলার-মুসেলিনির গোত্রভুক্ত হয়ে যাবো আমি? আরেকটা বিষয়, যতোই নিজেকে কিংবা আপনার দলের লোকেরা আপনাকে “জীবন্ত অ্যানসাইক্লোপেডিয়া” (দ্রষ্টব্য : “প্রসঙ্গ প্রবীর ঘোষ”) বলে পূজা করুক না কেন, সমকামিতার প্রতি আপনার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বলেই দেয়, এ বিষয়ে আপনার জ্ঞান শূন্যের কোঠায়। সমকামিতা একটা জৈবিক বিষয়। আমরা সাধারণ সবকিছুকে দুইভাগে বিভক্ত করতে ভালোবাসি। যেমন ভালো-মন্দ, সাদা-কালো, শাসক-শোষিত ইত্যাদি। কিন্তু অন্য অনেক কিছুর মতো, সাদা-কালোর মধ্যেও ধূসর রঙের অস্তিত্ব আমরা দেখেও না-দেখার ভান করি। প্রাণী-জগতের যৌন-আচরণ শুধু নারী-পুরুষে বিভক্ত নয়। যারা এমনটা যারা মনে করে, তারা আদতে হয় আধুনিক বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না, নয়তো এরা কূপমণ্ডুক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার গুলোর প্রতি আপডেট না হলে প্রগতিশীল মানুষেরা যে একসময় কূপমণ্ডুক হতে বাধ্য- তার প্রমাণ এই দুই বাঙলায় ভুরি ভুরি রয়েছে। আপনি হয়তো সেই তালিকায় নব্য-সংযোজন। চিন্তার কিছু নেই, ইন্টারনেট কানেকশন তো আছে, উইকিপিডিয়া ঘাটুন, গুগল সার্চ দিন, হাজার হাজার রিসার্চ জার্নাল পেয়ে যাবেন। দেখবেন, ওখানে স্পষ্টকরে বলা আছে- সমকামিতা মোটেও প্রকৃতি-বিরুদ্ধ নয়। আপনার জন্য একটা ছোট তথ্য, প্রায় ১৫০০ প্রজাতিতে (প্রজাতি শব্দটা খেয়াল করুন) সমকামিতা বিরাজ করছে। হোমো সেপিয়েন্স (মানুষ) তো একটা প্রজাতি মাত্র এছাড়াও লিজার্ড, ফড়িং, বাইসন, কুকুর, হাতি, শেয়াল, ডলফিন, ইমু, মুরগী, সিংহ, জিরাফসহ বিভিন্ন প্রজাতিতে লক্ষাধিক বছর ধরে সমকামিতা অস্তিত্বশীল। এগুলোকে আপনি কি বলবেন? সমকামিতার জৈবিক অস্তিত্ব না থাকলে এগুলো প্রাণীজগতে বিরাজ করতো কিভাবে? সমকামিতা হয়তো আপনার কাছে, মানে ব্যক্তিবিশেষের কাছে রুচিবিরুদ্ধ কাজ মনে হতে পারে, কিন্তু একজন ব্যক্তি যে জৈবিকভাবেই সমকামী তার কাছেও নারী-পুরুষ সম্পর্কটা কেমন বিবেচনার হবে- একটু ভাবুন তো? এটা স্বীকার করছি যে, ক্ষেত্রবিশেষে এই সমাজে সমকামিতা চাপিয়ে দিয়ে চর্চা করা হয়, এটা সমকামিতার কোনো ত্রুটি নয়, বরং এটাকে ধর্ষণ বলা যায়। পুরুষ যেমন নারীকে ভোগের পণ্য বানিয়ে ধর্ষণ করে, তেমনি অনেক সমকামী পুরুষ বা নারীও নিজ নিজ লিঙ্গের নারী-পুরুষকে ছলে-বলে ধর্ষণ করে। এই আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। ভারত-বাঙলাদেশের আইনে সমাকামিতা আইন-বিরুদ্ধ বলে অজুহাত দেখানোর সুযোগ নেই। কারণ, এই সমাজের আইনগুলো যে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কিভাবে, সেটা আর আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না নিশ্চয়ই। কথা হচ্ছে, এই সমাজে সমকামিতাকে আইন-বিরুদ্ধ বলা হলেও হাজার হাজার বছর ধরেই সমকামিতা এই ভূখণ্ডে রয়েছে। রামায়ন-মহাভারতসহ প্রচুর পৌরাণিক উপ্যাখানে সমকামিতার ইঙ্গিত রয়েছে। এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়, সমকামিতা কোনো পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির ফসল নয়। বরং এই সমাজে বসবাস করা সংখ্যালঘিষ্ট মানুষের যৌন-আচরণ এটি। প্রবীর বাবু, ৬০-৭০ দশকের মনমানসিকতা আর বিজ্ঞানের জ্ঞান নিয়ে একুশ শতকে এসে যুক্তিবাদ ফলানো যাবে না, এটা আপনাকে বুঝতে হবে। আপনার ব্যর্থতা আপনি যুগের সঙ্গে আপডেট হননি। বিজ্ঞানের নবনব আবিষ্কার গ্রহণ করতে পারেননি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে আইন-আদালতের চুলচেরা জেরা-বিশ্লেষণ পেরিয়ে সমকামিতা স্বীকৃতি লাভ করছে। বিজ্ঞানের নতুন নতুন তথ্য এক্ষেত্রে সহায়তা করছে। এই দেশগুলোতে সামাজিক মূল্যবোধ এখন আর রিলিজিয়ন, কাস্টমস দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না, বরং বিজ্ঞানই নির্ধারণ করে দিচ্ছে তাদের মূল্যবোধের কাঠামো। এটা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে। আর যদি আপনি মনে করেন, এসব কিছুই বিকৃত রুচির চর্চা, তবে বলতেই হয় প্রবীর বাবু, আপনি অন্ধ হলে, প্রলয় কিন্তু বন্ধ হবে না। আর অভিজিৎ রায় যদি নিজে ব্যক্তিগতভাবে সমকামী না হয়েও সমকামিতা নিয়ে বিজ্ঞানের গবেষণাসমৃদ্ধ বই লেখেন, তাতে আপনার কাছে “জাত গেল! জাত গেল!” মনে হলেও, সেই আপনিই বরং আমাদের কাছে কূপমণ্ডুকই থেকে যাবেন, ব্যাকডেটেড হয়ে যাবেন। যতোই ইগো ধরে বসে থাকুন না কেন, লাভ নেই।
৪. এরপর আপনি আরও কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। কাকে কাকে পরাজিত করেছেন, কোথায় আপনি বিরুদ্ধবাদীদের সামনে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে কল্লা বাঁচিয়ে চলে এসেছেন, এগুলো আমাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, বাঙলাদেশসহ ভারতের প্রচুর মুক্তমনা মানুষ অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করেনা, আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিও করেনা, যে বিপদে পড়লে পার্টি থেকে সহায়তা নিয়ে শেল্টারহোমে চলে যাবে। অভিজিৎ রায়দের অস্ত্র হচ্ছে তাদের মস্তিস্ক আর কলম। তারা প্রকাশ্যে মৌলবাদীদের হুমকির মুখে চলাফেরা করে। আপনার কল্লা কেন কাটলো না, অভিজিৎ রায়রা কেন কোপ খেল, এগুলো আসলে একধরনের আত্মশ্লাঘায় ভোগা ব্যক্তির আফসোসের ধ্বনিমাত্র। আমি কেবল বলবো, ছোট বাচ্চারা কখনো বটগাছে ঢিল মারে না, তারা দেখতে ছোট হলেও আম গাছে, জাম গাছে ঢিল মারে! প্রবীরবাবু, বুদ্ধিমানকে লিয়ে ইশারা হি কাফি হ্যায়!
৫. সর্বশেষে আপনি বলেছেন,-
“সৎ হোন, সাহসী হোন, মিথ্যা বাগাড়ম্বর বন্ধ রাখুন এবং বেড়ালকে বাঘ সাজাবার চেষ্টা করবেন না। না-হলে আন্দোলনকে শেষ করতে শত্রুর দরকার হবে না, আপনারাই যথেষ্ঠ।”
এই লাইনটা পড়তে গিয়ে আমি হাসতে হাসতে শেষ। আপনার অনেকগুলো বই পড়েছি। অলৌকিক নয় লৌকিকের ৫টা খণ্ড, আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, প্রসঙ্গ প্রবীর ঘোষ, গেরিলা যুদ্ধের A to Z থেকে আজাদী আরও কিছু। বইগুলো পড়তে গিয়ে একসময় মনে হয়েছে, দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো যুক্তিবাদী আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য কতোই না চেষ্টা করছে, আর আপনি কার্টুন চরিত্র হিম্যান, আয়রন ম্যানের মতো একে একে জিতে যাচ্ছেন, তবু মিডিয়া আপনাকে ব্ল্যাক আউট করে রাখছে, এ নিয়ে আপনার আফসোসের শেষ নাই। “মুই কি হনুরে” টাইপের লেখা পড়তে পড়তে আপনার আত্মঅহমিকায় ভরা চরিত্র নগ্নভাবে ফুটে ওঠে, সেটা কি আপনি নিজে বোঝেন না? অনেক তো কথা হলো, এবার আপনাকে একটা পুরাতন কৌতুক শোনাই:- এক বনে একটা ইঁদুর খুব ছোটাছুটি করছে। একবার এই গর্তে তো আরেকবার আরেক গর্তে ঢুকছে। এই দেখে একটা বনবিড়াল বললো, কিরে ইদুরের বাচ্চা, তুই এতো ছুটাছুটি করছিস কেন? ইঁদুর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,- কেন খবর পাওনি? হাতি যে ধর্ষিত হয়েছে, শোননি? বনবিড়াল নির্বিকার হয়ে বললো, শুনেছি, তাতে তোর আবার কি হলো? তুই এতাে দুঃশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছিস কেন? ইঁদুর এইবার খুব ভাব নিয়ে বললো,- কেন জান না বুঝি, সবাই যে আমাকেই সন্দেহ করছে!!
প্রবীর বাবু! আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট! কী বলেন?
৬. পাঠক, প্রবীর ঘোষের বই পড়ে আমার সাধারণ ধারণা, তিনি একটা জিনিষই অনেক জোর গলায় প্রতিষ্ঠা করতে চান, দুনিয়ার সব খারাপ, অমুক খারাপ, তমুক খারাপ, সব সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল, শোষক শ্রেণীর হাতিয়ার, কেবল তিনিই এই যুগের রামচন্দ্র! তিনিই কেবল সব থেকে ভালো। সব থেকে আলাদা। যাই হোক, এটা তার ব্যাপার। তিনি এরকম ভাবতেই পারেন, আমাদের জন্য চিন্তার বিষয় হচ্ছে, তার মুরিদানেরাও দেখি এটা অন্ধভাবে বিশ্বাস করা শুরু করছে। এই ধরনের ব্যক্তিপূজা যে দুই বাঙলায় যুক্তিবাদী-মুক্তমনার আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, এবং করবে, সেটা কবে তাদের বোধগম্য হবে- তা আল্লাই মালুম! থুক্কু! যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষের মালুম!
৭. পাঠক, আপনাদের মনে এতক্ষণে এই প্রশ্নের উদয় হয়েছে, প্রবীর বাবুর অভিজিৎ রায়ের প্রতি কেন বিরূপ মনোভাব প্রদর্শন করতে গেলেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। তবে তার আগে কয়েকটা তথ্য দিই। তার উপর ভিত্তি করে লেখা মুরিদানের বই “প্রসঙ্গ প্রবীর ঘোষ”সহ আরো বেশ কিছু বইয়ে তাদের srai.org ওয়েব সাইটের লক্ষ লক্ষ ভিজিটের ঢোল ফাটিয়েছেন। আপনারা জানেন কি, ২০০০ সাল বা এরপরে অভিজিৎ রায় কলকাতা বই মেলাতে গিয়ে প্রবীর ঘোষের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। প্রবীর ঘোষের দলের রানা হাজরা নামের একজনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে নিজ উদ্যোগেই মার্কিন এক বন্ধুর (সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল কিনা জানি না) সহায়তায় তাদের ওয়েব সাইটটি তৈরি করে দিয়েছিলেন অভিজিৎ রায়। এই সাইটটি দীর্ঘদিন, প্রায় ৫ বছরের উপর দেখভাল করেন অভিজিৎ রায়। এই ওয়েব সাইটের উপর একসময় লেখা থাকতো “মুক্তমনা প্রাউডলি প্রেজেন্টস”। অর্থাৎ অনলাইন জগতে প্রবীর ঘোষের প্রথম পরিচিতি কিন্তু অভিজিৎ রায়ই করে দিয়েছিলেন। বাঙলাদেশের বহু লোক অভিজিৎ রায়ের তৈরি করা ওয়েব সাইটের মাধ্যমেই প্রবীর ঘোষের সঙ্গে যোগযোগ করতে পেরেছিলেন। প্রবীর ঘোষ তার লেখা মাদার তেরেসার উপর একটা বই (খুব সম্ভবত ইংরেজি) উৎসর্গ করেছিলেন। বইটা অভিজিৎ রায়ের সংগ্রহেও ছিল অনেকদিন। যাইহোক, সেই অভিজিৎ রায় জীবিত থাকাকালে প্রবীর ঘোষকে কখনো খাটো করে কোনো কথা বলেননি। বরং প্রবীর ঘোষের অবদানকে সবসময়ই সম্মান জানিয়েছেন। অভিজিৎ রায়ের প্রথম দিককার প্রচুর লেখায় এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। আর প্রবীর ঘোষও যদিও অভিজিৎ রায়ের উত্তোরাত্তর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হতেন, সেটা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় প্রকাশ করলেও কখন কলম ধরার সাহস করেননি। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর তিনি আর তর সহ্য করতে পারলেন না। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ অভিজিৎ রায়ের লেখনীর প্রশংসা করছে, তার মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করছে, হত্যার বিচার দাবি করছে, সেখানে প্রবীর বাবু এসেছেন অভিজিৎ রায়ের স্ববিরোধিতা খুঁজে বের করতে! প্রবীর বাবু, আপনার এই ঈর্ষাপরায়ণ মনোভাব অভিজিৎ রায়কে কলুসিত করতে পারবে না, বরং মুক্তচিন্তার আন্দােলনকে হয়তো কিয়ৎকালের জন্য থমকে দিতে পারে। এর বেশি কিছু নয়। আপনি অনেকবারই দাবি করেছেন, আপনি নাকি সবসময় মিডিয়ায় ব্ল্যাকআউট হয়ে যান, এই জন্য আপনার ক্ষোভের শেষ নেই। অথচ অভিজিৎ রায় হত্যার এই মর্মান্তিক ঘটনা জাতিসংঘ, ইয়োরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে, যা আপনার এই সত্তোর্ধ্ব জীবনে কখনো কল্পনাও করা সম্ভব হয়নি। এই জন্যই কি এতো আত্মম্ভরী মনোভাব প্রদর্শন? কি জানি, আপনিই জানেন আপনার মনের খবর!
৮. শেষ করার আগে একটা কথা বলে যাই। কথায় আছে, ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। আপনি নিশ্চয়ই প্রস্তুত আছেন এর জন্য। অভিজিৎ রায়ের খুঁত ধরেছেন আপনি, তিনি নাকি নিরীশ্বরবাদী হয়েও ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন! তা মশাই, আপনি যে প্রায় প্রতিটা লেখাতে তসলিমা নাসরিনের সমালোচনা করেছেন, তসলিমা নাসরিন সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়ানড়ক, দালাল ইত্যাদি কত অভিধায় ভূষিত করেছেন, সেই আপনিই কিন্তু আপনাদের ওয়েব সাইটে দীর্ঘ দিন ধরে তসলিমার পাশের আপনার হাস্যোজ্ব্বল ছবি প্রদর্শন করে নিজের শোভা বর্ধন করেছিলন। এটা কি আমরা ভুলে গেছি? এটাকে কি বলে? সুবিধাবাদী আচরণ নাকি স্ববিরোধিতা?
ধন্যবাদ।
জয়তু মুক্তমনা, জয়তু যুক্তিবাদ।
স্ববিরোধী-সুবিধাবাদীদের পতন হোক।

“অভিজিৎ রায় সম্পর্কে প্রবীর ঘোষের বক্তব্যের লিংক :