কাল পূর্ণিমার ডাক
প্রায় আড়াইশো বছর আগের ঘটনা।
ইংরেজদের শোষণ এবং লুণ্ঠনের সহযোগী এবং গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর প্রিয়পাত্র দেবী সিংহের ভয়াবহ অত্যাচার এবং নির্যাতনে রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চল মৃতপ্রায়। দেবী সিংহ ছিলেন ইংরেজ মনোনীত এই অঞ্চলের ইজারাদার। কিন্তু, তাঁর সীমাহীন লোভ লণ্ড-ভণ্ড করে দিয়েছিলো এই জনপদকে। শুধু এই অঞ্চলে নয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা ও বিহারের দেওয়ানী লাভের পর সমগ্র বাংলাদেশ ও বিহারে যে অবর্ণনীয় অরাজকতা দেখা দিয়েছিলো, তার প্রধান কারণ ছিলো দেবী সিংহের লুণ্ঠন ও উৎপীড়ন। তাঁর অপরিসীম অত্যাচার ও অন্তহীন অবাধ লুন্ঠনে রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চল পরিণত হয়েছিলো শ্মশানে। চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছিলো অসহায় কৃষকদের হাহাকার আর গগনভেদী দীর্ঘশ্বাস।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অসহায় হরিণও ঘুরে দাঁড়ায়, এই অঞ্চলের নিরীহ এবং নির্বিবাদী কৃষকেরাও তেমনি ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো। এমনিতেই মৃত্যু হচ্ছে মহামারীর মতো, কাজেই মৃত্যুকে নিয়ে তাদের আর কোনো ভয় ডর ছিলো না। বরং পরম পরাক্রমশালী দেবী সিংহ এবং সীমাহীন শৌর্যবান ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিপুল বিক্রমে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তারা।
খনির ঘন অন্ধকার থেকে যেমন করে উঠে আসে উজ্জ্বল হীরকখণ্ড, তেমনি সাধারণ কৃষকদের মধ্য থেকে উঠে আসেন এক অসামান্য মানুষ, একজন অমিতবিক্রমশালী সিংহ-হৃদয় পুরুষ। নিপীড়িত জনগণকে সংঘবদ্ধ করে দেবী সিংহের বিরুদ্ধে প্রবল তেজে রুখে দাঁড়ান তিনি।
সেটি সতেরো শো তিরাশি সাল। এ বছরই এই অনন্য মানুষটি দেবী সিংহকে করে তোলেন নেংটি ইঁদুরের মতো ভীত এবং অসহায়। ইতর প্রাণীর মতো প্রাণভয়ে পলাতক হন দেবী সিংহ আর এই মুক্তিকামী মানুষটি কাঁপিয়ে দেন বাংলার বুকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে। একের পর এক যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বিপর্যস্ত করে তোলেন তাদের। তবে, শেষ রক্ষা হয় না। এরকমই এক যুদ্ধে আহত হয়ে বন্দি হন তিনি। তারপর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বন্দি দশায় মৃত্যু ঘটে তাঁর। কৃষকদের এই সর্বব্যাপী সশস্ত্র বিদ্রোহই রংপুর বিদ্রোহ নামে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে।
আর এই বিদ্রোহের যিনি নায়ক, জনগণের জন্য আত্মত্যাগকারী সেই বীরের নাম নূরুলউদ্দীন।
ইতিহাসে অন্ধকার পৃষ্ঠা থেকে নূরুলউদ্দিনের বিস্তারিত পরিচয় উদ্ধার করা যায় না। শুধু এইটুকুই জানা যায় যে, তিনিই প্রথম রংপুরের কৃষকদের সংঘবদ্ধ করেছিলেন। তিনি তাদের নিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন নিরীহ কৃষকদের রক্তনালী থেকে রক্ত চুষে খাওয়া দূর্বৃত্তসম দেবী সিংহের হাত থেকে রক্ষা করতে।
রংপুরের বুকে নূরুলউদ্দিন যে বিপ্লবের লাল আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাকে নির্বাপিত করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। আর যাকে কেন্দ্র করে এই বিদ্রোহ, সেই দেবী সিংহকে রংপুর ছেড়ে পালাতে হয়েছিলো জান হাতে নিয়ে। জনগণের চুড়ান্ত জয় হয়তো হয় নি সেদিন, কিন্তু এই সাময়িক জয়ও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে সগৌরবে। আর সেটাই যুগে যুগে সাহস এবং প্রেরণা যুগিয়েছে ভবিষ্যতের গণ বিদ্রোহ এবং জন-আন্দোলনকে।
সুপ্রকাশ রায় তাঁর “ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম” পুস্তকে এবং সুধাংশু পাত্র তাঁর “বাংলার বীর বিদ্রোহী” বইতে এই বীর বিদ্রোহীকে চিহ্নিত করেছেন নূরুলউদ্দিন নামে। অন্যদিকে, সব্যসাচী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর বিখ্যাত নাটক “নূরলদীনের সারাজীবন”-এ নূরুলউদ্দিনকে আখ্যায়িত করেছেন নূরলদীন নামে।
বাংলাদেশে নূরুলউদ্দিনকে কেউ চেনে না, কিন্তু বহু সংখ্যক মানুষ নূরলদীনের কথা জানে। সেটা সৈয়দ হকের এই বিখ্যাত ঐতিহাসিক নাটকের কারণে। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর “নূরলদীনের সারাজীবন” নাটকের ভূমিকাতে লিখেছেনঃ
“ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় নামটি লিখেছেন – নূরুলউদ্দিন, আমরা বলবো ওটা হবে নুরুদ্দিন, কিন্তু আমি ব্যবহার করেছি – নূরলদীন, রংপুরের সাধারণ মানুষেরা যেমনটি উচ্চারণ করবে।”
আমার এই লেখাতেও আমি ব্যবহার করবো নূরলদীন। এই নামটার মধ্যে একটা ইস্পাতসম কাঠিন্য আছে, আছে অগ্নিশিখার অমিত আহবান, আছে আমার দেশের মাটির গন্ধের সাথে মিশে থাকা মাতাল এক অনুভূতি, আছে কাল পূর্ণিমায় রক্তলোলুপ হায়েনার হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য গগনবিদারী কণ্ঠে ডেকে ওঠা এক প্রতিধ্বণির আশ্বাস। জাগো বাহে কোনঠে সবাই।
সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে।
নূরলদীনের কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ী ঢলের মত নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে উঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?’
বাংলার মাটি বাংলার জল
দিল্লীর সিংহাসনে আসীন তখন সম্রাট শাহ আলম। মুর্শিদাবাদে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবাদার নজমুদ্দৌলা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মাত্র কয়েক বছর আগে পলাশী প্রান্তরে পরাজিত করেছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীকে। ধূর্ত এই কোম্পানি কার কি ক্ষমতা, কার কি অধিকার, তা খুব ভালো করেই জানতো এবং বুঝতো। সে কারণে প্রথমেই তারা প্রাদেশিক শাসনকর্তা নজমুদ্দৌলাকে হস্তগত করে কোম্পানির কর্মচারী পাঠানোর ব্যবস্থা করলো দিল্লীতে সম্রাটের কাছে। দিল্লীর সম্রাট তখন নিজেই নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। মুগল সাম্রাজ্যের আগের সেই শৌর্য-বীর্য আর নেই। ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা তখন। কাজেই, কোম্পানির কর্মচারীর সাথে বেশি কথাবার্তা হলো না। বার্ষিক ছাব্বিশ লক্ষ টাকা সম্রাটকে আর তিপ্পান্ন লাখ ছিয়াশি হাজার টাকা নজমুদ্দৌলাকে দেবার অঙ্গীকার করে সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দেওয়ানী ফরমান নিলো। নজমুদ্দৌলা আগেই রাজি ছিলেন, এখন এই বন্দোবস্তে সম্মত হয়ে একখান নিয়োগপত্র লিখে দিলেন। দিল্লীর সম্রাটের সাথে কোম্পানির এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা বন্দোবস্ত পাকা হয়ে গেলো এতো কম সময়ে যে, একজন মুসলমান লেখক আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, এতো কম সময়ের মধ্যে একটা গাধা বিক্রির কথাও শেষ হয় না। গাধা বিক্রি হয় না, কিন্তু দেশ বিক্রি হয়ে যায় ওই অতো অল্প সময়ের মধ্যেই।
এই সময়ে বাংলাদেশে রাজস্ব আয় ছিলো তিন কোটি টাকা। সম্রাট এবং নবাবকে দেবার পরেও কোম্পানির লাভ থাকে দুই কোটি টাকার উপরে। দেওয়ানী নেবার ছ’মাস পরেই ১৭৬৭ সালের এপ্রিল মাসে মুর্শিদাবাদে কোম্পানির পূন্যাহ হলো। প্রথম পূন্যাহ, কাজেই খুব সমারোহের সাথে তা করা হলো। আমোদ-প্রমোদের কোনো ত্রুটি হলো না। বিলেতে বোর্ড অব ডিরেকটরদের কাছেও এই সুখবর গেলো। তাঁরা কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের শতকরা ১২ ভাগ লভ্যাংশ দেবেন বলে ঘোষণা দিলেন। এই অপ্রত্যাশিত ধনাগমের উপর বৃটিশ সরকারেরও নজর পড়লো। তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে কর চাইলো এবং পার্লামেন্টে এই বিষয়ে এক আইন নিয়ে হাজির হলো। পার্লামেন্টে বহুক্ষণ বিতর্কের পর আইন পাশ হলো যে, কোম্পানিকে কর হিসাবে সরকারকে চল্লিশ লাখ টাকা দিতে হবে। বলা বাহুল্য যে, এই অতিরিক্ত টাকা কোম্পানি তার নিজের পকেট থেকে দেয় নি। এই অতিরিক্ত টাকাটা বাংলার কৃষকদের কাছ থেকেই আদায় করার চেষ্টা করা হয়েছে। রেজা খাঁ তখন রাজস্ব সচিব। তিনি রাজস্বের আয় আরো বেশি করে দেখালেন। তখন নবাব নামে মাত্রই ক্ষমতায়। কোম্পানির লোকদের ইচ্ছাতে সকল কর্ম হতো। সেই সময়ে এই লোকের নিজের বেতনও ছিলো বছরে নয় লাখ টাকা।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা অবস্থা চললেও, দেশের অবস্থা তখন বারোটা বাজার কাছাকাছি। পুন্যাহ করার এক মাসের মধ্যে নবাব নজমুদ্দৌলার নবাব-লীলা সাঙ্গ হলো। বসন্ত রোগে তাঁর মৃত্যু হলো। এর কিছুদিন পরেই দেশে অনাবৃষ্টি হলো। ১৭৬৮ সালে ফসলও তেমন ভালো হলো না। ফলে, ১৭৬৯ সালে প্রবল খাদ্যাভাব দেখা দিলো। কিন্তু, তারপরেও বাংলার নূতন কোম্পানি দেওয়ান খাজনা আদায়ে বিন্দুমাত্রও শিথিলতা প্রদর্শন করলো না। তার পরিবর্তে খাজনা আরো কড়াকড়িভাবে আদায় করা হলো। ওই বৎসরই উত্তর বাংলায় অনাবৃষ্টি ও দক্ষিণ বাংলায় অতিবৃষ্টি হলো। স্থানীয় কর্মচারীরা দুর্লক্ষণ দেখে গভর্নরকে আগতপায় দুর্ভিক্ষের সংবাদ দিতে লাগলেন। কিন্তু, গভর্নর সে সংবাদ কোম্পানির ডিরেক্টরদের জানালেন না।
অনাগত দুর্ভিক্ষের আশংকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও করেছিলো, কিন্তু এই সমাগত দুর্ভিক্ষের প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থাই তারা করে নি। দুর্ভিক্ষ বা দুর্ভিক্ষ প্রায় অবস্থা হলে রাজস্ব সম্পূর্ণ আদায় হবে না, এই চিন্তা কিছুটা হলেও ছিলো হয়তো তাদের মনে। কারণ, এক লাখ টাকার মতো কর সে বছর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। যদিও পরের বৎসরেই তা আদায় করে নেওয়া হয় শক্তভাবে। আর ঠিক তার পরের বছরেই আশংকিত সেই দুর্ভিক্ষ এসে হাজির হয়।
বাংলার ইতিহাসে এ হচ্ছে সেরা দুর্ভিক্ষ। এক কোটি লোক না খেয়ে মারা গিয়েছিলো এই দুর্ভিক্ষে। বাংলার জনসংখ্যা এক তৃতীয়াংশ কমে গিয়েছিলো এই ভয়াবহ দুর্যোগে। এই দুর্ভিক্ষের বৎসরটা ১১৭৬ সাল। সেই জন্য এই সালের নাম অনুসারে এটাকে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ বলা হয়।
এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মধ্যেও কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের প্রতি বিন্দুমাত্রও কোনো অমনোযোগ ছিলো না। কর কমা তো দূরের কথা বরং দুর্ভিক্ষের বছরেই দশভাগ কর বেশি আদায় করা হয়েছিলো। বিহারে, যেখানে এক পাটনাতেই প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশজন মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যেতো ,সেখানেও দুর্ভিক্ষের বছরে চার লাখ ছাব্বিশ হাজার টাকা বেশি আদায় করা হয়েছিলো। রুজুফ খাঁ নামের একজন ফৌজদার রিপোর্ট করেন যে, “অনাবৃষ্টি হেতু খরিফশস্য জন্মায় নি, রবি শস্য এক রকম ভালই জন্মেছে। তাই তিনি তাঁর তহশীলের সমস্ত টাকা আদায় করে বলেছেন দেশে যা জন্মেছিল তা তিনি সমস্ত আদায় করেছেন।“ কোম্পানির আরেকজন কর্মচারী মহম্মদ রেজা খাঁ বলেন যে, “ভয়ানক অনাবৃষ্টি, খাদ্যদ্রব্যের দুর্ম্মূল্যতা, পরে অত্যন্ত অভাব। এই সকল থেকে দেশে যে কি কষ্ট হয়েছে, তা’র আর কি বর্ণনা করব? জলাশয় সব শুকিয়ে গিয়েছে, জল দুষ্প্রাপ্য হয়েছে। এর উপর অনেক লোক গৃহদাহে সর্ব্বস্বান্ত হয়েছে। দিনাজপুর ও পূর্ণিয়া জেলার রাজগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে যে শস্য সঞ্চিত ছিল তা পুড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এ সকল সহ্য করেও প্রজা আশা করেছিল বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাসে বৃষ্টি হবে, কিন্তু জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত একবিন্দু বারিপাত হল না। জমিতে লাঙ্গল পড়ল না, বীজ বোনা হল না।“
দেশের যখন এই শোচনীয় অবস্থা তখনও অনেক স্থানে পূর্ণমাত্রার খাজনা আদায় করা হয়েছে। বর্দ্ধমানের রাজা তেজচাঁদ ১৭৭১ সালের মে মাসে রিপোর্ট করেন যে, “Notewithstanding the hardships and distressess that have befallen the ryots, the poor and inhabitants of this country from the famine the revenues have been collected without balance.” অথচ এই রাজাই ১৭৬৯ সালের নভেম্বরে রিপোর্ট করেছিলেন যে, “দেশে অনাবৃষ্টি, খাদ্যদ্রব্য মহার্ঘ, জমির ফসল শুকিয়ে গেছে এবং তা কেটে গরুকে খাওয়ানো হচ্ছে, পুকুর সব জলশূন্য, অন্নকষ্টের সঙ্গে জলকষ্টও হয়েছে। রবিশস্য বিলম্বে বোনা হয়েছে, বৃষ্টি না হলে তাও মরে যাবে। দলে দলে লোক গ্রাম ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে।“
পূর্ণিয়ার ফৌজদার মহম্মদ আলি খাঁ রিপোর্ট করেন যে, “এমন একটা দিন যাচ্ছে না যেদিন ৩০/৪০ জন লোক না মরছে। ক্ষুধার জ্বালায় দলে দলে লোক মরছে এবং মরছে; বীজের ধান, লাঙ্গলের গরু, চাষের যন্ত্রপাতি লকে বিক্রী করে ফেলেছে। শেষে সন্তান বিক্রী করছে, কিন্তু খরিদ্দার পাওয়া যাচ্ছে না।“
এই রিপোর্ট দেবার পরেও আবার এই লোকই গর্ব করেছে এই বলে যে, “আমি সরকারের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রজার এই দারুণ কষ্টের প্রতি দৃকপাত করি না, লোকের কাতর কান্না শুনি না।“
যশোরের আমীর উজাগর মল্ল রিপোর্ট করেন যে, “লোকে গাছের পাতা খাচ্ছে এবং সন্তান বিক্রি কচ্ছে; কিন্তু তার খরিদ্দার পাওয়া যাচ্ছে না।“
ইংরেজ রেসিডেন্ট রিপোর্ট করেছেন যে, “The scene of misery, that intervened and still continues, shocks humanity too much to bear description. Certain it is that in several parts the living have fed on the dead, and the number that has perished in these provinces that have most suffered is calculated to have been within these few months as six is to sixteen of the whole inhabitants.”
এই রকম শোচনীয় অবস্থার মধ্যেও যেখানে কোনো প্রজার ঘরে কিছু শস্য ছিলো, কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীরা তা জোর করে অল্প মূল্যে কিনে নিয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি করতেও দ্বিধা বোধ করে নি।
নবাবী আমলের শুরুতে সুবেদারী ফরমানে দিল্লীর সম্রাট বাংলাদেশ “জেন্নেৎউল বিলেত” অর্থাৎ ‘পৃথিবীতে স্বর্গতূল্য বলে’ বর্ণনা করেছিলেন। আর সেই নবাবী আমলের শেষে সেই বাংলারই এই করুণ অবস্থা। কিছু লোভী মানুষের কারণে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বাঙলা তখন মহাশ্মশানে পরিণত।
এই রকম এক পরিস্থিতে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল হয়ে এলেন। রাজস্ব সংগ্রহ প্রণালীর সংস্কার শুরু হলো। হেস্টিংস এসেই শুরুতে কালেক্টর ও তাঁর সহকারীদের বেতন বৃদ্ধি করে দিলেন। এঁদের বেতন খুবই অল্প ছিলো। তাঁদের এই স্বল্প বেতন তাঁরা পুষিয়ে নিতেন অসাধুতার মাধ্যমে এবং গোপনে নিজে ব্যবসা করে। বেতন বাড়িয়ে ধারণা করা হয়েছিলো যে, পর্যাপ্ত পরিমাণে বেতন পেয়ে, এরা আর অসাধু পন্থা অবলম্বন করবে না। তবে, এতে করেই যে তারা সবাই সাধু সন্ন্যাসী বনে যাবে রাতারাতি, এই আশাও হেস্টিংস করেন নি। কাজেই, সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে, পাঁচ বৎসরের জন্য ঠিকা দিয়ে খাজনা আদায় করা হবে। একজন কালেক্টর একজন দেশীয় দেওয়ানের সহযোগিতায় এই কার্য সমাধা করবে।
এর আগে জমিদাররা রাজস্ব আদায় করে নবাবী গভর্মেন্টকে দিতেন। এই সব জমিদারদের সকলকে খারিজ করে দেওয়া হলো না। কাউকে কাউকে অবশ্য সরানো হয়েছিলো। ঠিকার প্রস্তাবে নতুন, পুরাতন, সকলের কাছেই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা চাওয়া হলো। যারা সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে স্বীকার করলো, তারাই নতুন ঠিকাদার হিসাবে দায়িত্ব পেলো। আর যারা অস্বীকার করলো, তাদের জায়গায় অন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হলো।
সর্বত্র ঠিকাদার নিযুক্ত হলো। কিন্তু কোম্পানির আশংকা হলো যে, ঠিকাদারেরাও প্রজাদের উপর অত্যাচার করে অতিরিক্ত কর আদায় করবে। এ বিষয়ে কোম্পানি কিছু ব্যবস্থা নিলো। হৃষীকেশ সেন তাঁর ‘বাঙলার কৃষকের কথা’-বইতে লিখেছেনঃ
“প্রজা নবাব সরকারে যে কর দিয়ে আসছে তার অতিরিক্ত আর কিছু নেওয়া না হয়, তার জন্য যথারীতি আদেশ প্রচার করা হল। কিন্তু প্রজা যে কর দিয়ে আসছে তার মধ্যেই যে অনেক অতিরিক্ত কর প্রবেশ লাভ করেছে তা আর দেখা হল না। আদেশ হল যা হয়ে গিয়েছে, তাত হয়েই গিয়েছে, সে সম্বন্ধে আর কিছু করা যাবে না, কিন্তু আর কোন নূতন ‘আবওয়াব’ আদায় করা হবে না। যদি কেউ তা করে ত তা বে-আইনী হবে।”
শকুনে ছাওয়া শ্মশান ভূমি
দেবী সিংহের বাড়ি ছিলো পশ্চিম ভারতের পানিপথের কাছাকাছি এক গ্রামে। তিনি বৈশ্য সম্প্রদায়ের লোক। এই ব্যক্তি ব্যবসা উপলক্ষে ভাগ্যান্বষণে মুর্শিদাবাদ এসে উপস্থিত হন। মুর্শিদাবাদ তখন গৌরবপ্রভায় মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লিকে লজ্জা দিতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যে সারা ভারতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে আসীন। ইউরোপীয় এবং দেশিয় বণিক দিয়ে মুর্শিদাবাদ পরিপূর্ণ। বাণিজ্যের স্রোত তীব্রবেগে বয়ে চলেছে মুর্শিদাবাদের মাঝখান দিয়ে। এই স্রোতেই নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন দেবী সিংহ নিজেকে। ভাসালেনও নিজেকে তিনি, কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না। ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে না পেরে ক্রমে ক্রমে কোনঠাসা হয়ে পড়লেন তিনি। এই অবস্থায় ব্যবসায়ের আশা ত্যাগ করে কাজের চেষ্টায় ঘুরতে লাগলেন তিনি।
বাংলার ভাগ্যবিধাতা তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা। তাদের শোষণযন্ত্রকে আরো সক্রিয় করার জন্য তারা রাজস্ব আদায়কারী হিসাবে নিযুক্ত করেছে মহম্মদ রেজা খাঁকে। এই লোকের চোখের চামড়া এবং হৃদয় বলতে কিছুই ছিলো না। বাংলা-বিহারের সবটুকু রক্ত চুষে খেয়েছে ড্রাকুলার মতো। এর রাক্ষুসে ক্ষুধাকে নিবৃত্ত করতে গিয়ে ছিয়াত্তরে বাংলা ও বিহারকে বরণ করতে হয়েছিলো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষকে।
এই রেজা খাঁর পায়ের উপর আছাড় খেয়ে পড়লেন দেবী সিংহ। রতনে যেমন রতন চেনে, তেমনি দুর্বৃত্ত চেনে দুর্বৃত্তকে। দেবী সিংহকে চিনতে ভুল হয় না রেজা খাঁর। মোটা টাকা ঘুষ খেয়ে পূর্ণিয়ার জেলার রাজস্ব আদায় এবং শাসনভারের দায়িত্ব রেজা খাঁ অর্পণ করেন দেবী সিংহের উপরে। দেবী সিংহ পুর্নিয়ার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব লাভ করে নিজ মূর্তি ধারণ করেন এবং সুযোগ পেয়ে প্রজাদের সর্বস্ব কেড়ে নিতে থাকেন। তাঁর অত্যাচারে পূর্ণিয়ার কৃষকগণ ঘরবাড়ি ছেড়ে বনে-জঙ্গলে পলায়ন করে প্রাণ বাঁচায়। অল্প দিনের মধ্যে সমগ্র এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে যাবার উপক্রম হয়। আগে পূর্ণিয়ার ইজারার বন্দোবস্ত হতো নয় লক্ষ টাকায়। কিন্তু, সুজন্মার সময়েও ছয় লাখের বেশি আদায় করা সম্ভব হতো না। কিন্তু, দেবী সিংহ এর বন্দোবস্ত নিয়েছিলো ষোল লক্ষ টাকায়। এই ষোল লাখ টাকা আদায় করতে গিয়েই দেবী সিংহ পূর্ণিয়াকে জনমানবহীন শ্মশানে পরিণত করেন। এই অসহনীয় শোষণ-উতপীড়নের ফলে যখন নানা জায়গায় কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয় তখন ইংরেজদের টনক নড়ে। জেনারেল হেস্টিংস তাঁকে পদচ্যুত করলেন।
এই কয়েক মাসের মধ্যেই ইংরেজ চরিত্র সম্বন্ধে দেবীর বেশ ভালো একটা ধারণা গড়ে উঠেছে। তাই খুব একটা ঘাবড়ালেন না তিনি। ছুটে গেলেন হেস্টিংস সাহেবের কাছে। তার পায়ের কাছে ঢেলে দিলেন লক্ষ লক্ষ মুদ্রা। নিজের টাকা নয়, পূর্ণিয়ার জনসাধারণের বুকের রক্ত থেকে নিংড়ানো টাকা। উৎকোচ পেয়ে দেবী সিংহের প্রতি দরদ উথলে উঠলো হেস্টিংসের। তিনি রাতারাতি কয়েকজন ইংরেজ তরুণকে নিয়ে প্রাদেশিক রেভিনিউ বোর্ড গঠন করলেন। আর দেবী সিংহকে নিয়োগ দিলেন এই সভার কার্যাধক্ষ্যের পদে। এ প্রসঙ্গে নিখিলনাথ রায় তাঁর ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ বইতে লিখেছেনঃ
“এই সময় হেস্টিংস নিজের সুবিধা মত কয়েকজন অনভিজ্ঞ ইংরেজ যুবককে লইয়া মুর্শিদাবাদে ‘প্রাদেশিক রেভিনিউ বোর্ড’ গঠন করেন। দেবী সিংহ সেই বোর্ডের সহকারী কার্যাদক্ষ্যের পদে নিযুক্ত হয়। দেবী সিংহ সুযোগ বুঝিয়া বিপুল অর্থ উৎকোচ দিয়া এবং বোর্ডের সভ্যদের জন্য একটি নর্তকী-সমাজ গঠন করিয়া বোর্ডের সদস্যদের বশীভূত করে। এইভাবে দেবী সিংহ প্রকৃতপক্ষে বাংলার রাজস্বের কর্তা হইয়া বসে।“
রাজস্বের কর্তা হয়ে শুধু রাজস্ব নয়, আরো নানাবিধ করও আদায় করা শুরু করলেন দেবী সিংহ। প্রজাদের কাছ থেকে আদায় করলেন ঠিকই, কিন্তু এর এক কানাকড়িও জমা দিলেন না সরকারী তহবিলে। তার বদলে স্বনামে এবং বেনামে কিনতে লাগলেন জমিদারির পর জমিদারি। এই অবস্থা চরম সীমায় পৌঁছোলে শাসকদের চৈতন্যোদয় ঘটে। চারিদিক থেকে হেস্টিংসের উপর চাপ আসতে থাকে দেবী সিংহকে পদচ্যুত করার। এবার সত্যি সত্যিই বেশ মুশকিলে পড়লেন হেস্টিংস। আর কোনো উপায় না দেখে রেভিনিউ বোর্ড ভেঙে দিলেন তিনি।
এরকম পরিস্থিতিতে কী করতে হয়, তা দেবী সিংহ খুব ভালো করেই জানেন। আবারো তিনি ছুটে গেলেন হেস্টিংসের কাছে। টাকায় কথা বলে, রাগকেও জল বানিয়ে দেয়। হেস্টিংসেরও তাই হলো। তিনি নরম হয়ে গেলেন। কিন্তু, লোকজন সব ক্ষেপে আছে দেবী সিংহের উপর। কাজেই, তাঁকে মুর্শিদাবাদে রাখার সাহস পেলেন না। মাসে এক হাজার টাকা বেতনে দিনাজপুরের নাবালক রাজার দেওয়ান নিযুক্ত করে তাঁকে মুর্শিদাবাদ থেকে সরিয়ে দিলেন। তখন থেকে দিনাজপুর আর রংপুরই হলো দেবী সিংহের শোষণ-উৎপীড়নের প্রধান রঙ্গভূমি।
এবার আর সমালোচনার করার কেউ থাকলো না। সরকারি ক্ষমতার কেন্দ্রভূমি থেকে অনেক দূরে তিনি। শুরু হলো রংপুরের বুকে দেবী সিংহের অত্যাচার। ইংরেজরা এমনিতেই রাজস্ব বাড়িয়েছিলো ক্ষমতা দখলের পর। দেবী সিংহ বাড়ালেন আরো দশগুণ। এই কর দেবার সাধ্যি কৃষক সম্প্রদায়ের ছিলো না। বাকি পড়তে থাকলো কর। কর যাদের বাকি পড়লো তাদেরকে দেবী সিংহের লোকেরা ধরে নিয়ে এসে নির্মমভাবে প্রহার করলো। লুটে নিলো তাদের সহায়-সম্বল যা কিছু আছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। কখনো কখনো প্রহারের মাত্রা এতো বেশি হতো যে, ওই প্রহারের চোটেই ভবপারে পাড়ি দিতো অনেক কৃষক। নিখিলনাথ রায় তাঁর মুর্শিদাবাদ কাহিনীতে লিখেছেনঃ
“দিনাজপুরের দেওয়ানী লাভ করিবার পরের বৎসরই দেবী সিংহ দিনাজপুর, রংপুর ও এদ্রাকপুর পরগনার ইজারা বন্দোবস্ত করিয়া লইল। ইহার পর হরেরাম নামক এক পিশাচ প্রকৃতির মনুষ্য তাঁহার সহকারী নিযুক্ত হইয়া দেশমধ্যে ভয়াবহ কাণ্ডের ক্রীড়া দেখাইতে লাগিল। কি জমিদার, কি প্রজা, কি স্ত্রী কাহারও বিন্দুমাত্র নিষ্কৃতি ছিল না। এরূপ লোমহর্ষক অত্যাচার কেহ কখনও দেখে নাই, কেহ কখনও শুনে নাই।“
ইজারা গ্রহণ করার পরে শুধুমাত্র প্রজাদের উপরই অত্যাচার শুরু করলেন না দেবী সিংহ। অন্যান জমিদার এবং ভূস্বামীদের উপরেও অবিশ্বাস্য রকমের কর বসালেন তিনি। এই কর এমনই অবিশ্বাস্য যে, কারো পক্ষে তা দেওয়া সম্ভব নয়। ফসল বিক্রি করে তো দূরের কথা, ঘর-বাড়ি বিক্রি করেও করের টাকা যোগানো সম্ভব ছিলো না। কর আসছিলো না বলে শুরু হলো জমিদারদের উপরও অত্যাচার। জমিদাররা জমি হারালো। আর সেই জমি নামমাত্র মূল্যে কিনে রাখতে লাগলেন দেবী সিংহ। এমনকি ‘লাখেরাজ’ (করবিহীন জমি এগুলো) জমিও বাজেয়াপ্ত করা হলো। কর আদায়ের জন্য জমিদারদের স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য করা হলো। সেই সময় রংপুর ও দিনাজপুরে অনেক মহিলা জমিদার ছিলেন। তাঁদের জমিদারি তো বিক্রি হলোই, সাথে তাঁদের গহনাপত্রও বাদ গেলো না।
নিরীহ চাষীদের উপর দেবী সিংহের অত্যাচার ভয়াবহ আকারে পোঁছোলো। দেবী সিংহ এবং তাঁদের লোকেরা চাষীদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাদের পথের ভিখারিতে পরিণত করলো। চাষীরা প্রাণ বাঁচাতে গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়ে বনে-জঙ্গলে আশ্র্য নিতে থাকলো।তাদের না পেয়ে তাদের ঘরবাড়ি সব তছনছ করা হলো, জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। এ যেনো এক শ্মশানভুমি। এই অবস্থা সম্পর্কে দেবী সিংহ নিজেও লিখেছেনঃ
“ইহা অত্যন্ত বিড়ম্বনার বিষয় যে, বাংলার অন্যান্য স্থান অপেক্ষা রংপুর প্রদেশের কৃষকদের মধ্যেই অধিক অন্নকষ্ট উপস্থিত হইয়াছে, শস্য কাটার সময় ব্যতীত অন্য কোন সময় তাহাদের ঘরে কোনরূপ সম্পদ পাওয়া যায় না। কাজেই তাহাদিগকে অন্য সময়ে অতিকষ্টে আহারের উপায় করিতে হয়, এবং এই জন্য দুর্ভিক্ষে বহুসংখ্যক লোক কাল-কবলে পতিত হইতেছে। দুই-একটি মৃৎ পাত্র ও একখানি পর্ণ কুটীর মাত্র তাহাদের সম্বল, ইহাদের সহস্রখানি বিক্রয় করিলেও দশটি টাকা পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।“
একে বলে মাছের মায়ের পুত্রশোক। দেবী সিংহ অতি নির্ভুলভাবে রংপুর অঞ্চলের কৃষকদের দুঃখ দৈন্যের কথা তুলে ধরেছেন। শুধু, এইটুকু বলতে ভুলে গেছেন যে, তাদের এই দুর্দশার জন্য মূলত তিনিই দায়ি। তাঁর বলা এইসব হতভাগ্য ‘পর্ণ কুটীর’ বাসীরাও তাঁর রাহুগ্রাস থেকে রক্ষা পায় নি।নিখিলনাথ রায় তাঁর ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’-তে লিখেছেনঃ
“কৃষকগণ খাজনার দায়ে দলে দলে শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া কারাগারে প্রেরিত হইল, অবিরত বেত্রাঘাতে তাহাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত হইল। অধিকাংশ কৃষক পলায়ন করিয়া বনে-জঙ্গলে আশ্রয় লইল। ক্রমে ক্রমে সমস্ত দেশ মহাশ্মশানের ন্যায় হইয়া উঠিল। যাহারা অবশিষ্ট রহিল তাহদের নিকট হইতে সমস্ত টাকা আদায়ের চেষ্টা হইল।“
ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুল্লিতে পড়া বলে একটা কথা আছে না, অনেকটা সেরকম দশা হয়েছিলো তখন চাষীদের। এই অঞ্চলে শুধু দেবী সিংহই ছিলো না, ছিলো সুদখোর মহাজনেরাও। দেবী সিংহের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য কৃষকেরা মহাজনদের কাছে হাত পাতা শুরু করে। জমি-জমা বন্ধক রেখে সুদে টাকা ধার করে দেবী সিংহের কর শোধের চেষ্টা করা শুরু করে। কিন্তু, তারা জানে না যে, এই অঞ্চলের জল-ডাঙা কোনোটাতেই নিরাপদ নয় তারা। দেবী সিংহ যদি হয় ডাঙার বাঘ, তবে মহাজনেরা হচ্ছে জলের কুমীর। এদের সুদের হার এতো বেশি ছিলো যে, এই ঋণ শোধ দেওয়া কৃষকদের জন্য অসম্ভবই ছিলো। চক্রবৃদ্ধিহারে এই সুদ বেড়ে এমনই অবস্থা গেলো যে, কৃষকরা তাদের জমিজমা, গৃহ, লাঙ্গল, বলদ, মই সব হারালো মহাজনদের সর্বনাশা লোভের ফাঁদে পড়ে। তারপরেও তাদের জীর্ণ পর্ণকুটিরে সামান্য যে দুই একটা বস্তু থাকতো, তাও লুটে নিত দেবী সিংহের অনুচরেরা। লুটে নেবার পরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যেতো সেই পর্ণকুটিরে। শত কষ্ট স্বীকার করেও যারা এতো দিন আশ্রয় ত্যাগ করে নি, তারাও এখন বাধ্য হয়ে বন্য পশুর মত বনে জঙ্গলে বসবাস করতে লাগলো। পিতা বিক্রি করলো পুত্রকে, স্বামী বিসর্জন দিলো স্ত্রীকে, ভাই হারালো ভাইকে।
নিখিলনাথ রায় ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’-তে দেবী সিংহের অত্যাচারের ফলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো, তার করুণ বিবরণ লিখেছেন এভাবেঃ
“যদি কেহ অত্যাচারের বিভীষিকাময়ী মূর্ত্তি দেখিতে ইচ্ছা করেন, যদি কেহ মানবপ্রকৃতির মধ্যে সয়তানবৃত্তির পাপ অভিনয় দেখিতে চাহেন, তাহা হইলে একবার দেবীসিংহের বিবরণ অনুশীলন করিবেন। দেখিবেন, সেই ভীষণ অত্যাচারে কত কত জনপদ অরণ্যে পরিণত হইয়াছে। কত কত দরিদ্র প্রজা অন্নাভাবে জীবন বিসর্জ্জন দিয়াছে। কত কত জমীদার ভিখারীরও অধম হইয়া দিন কাটাইয়াছে। কুলললনার পবিত্রতাহরণ, ব্রাহ্মণের জাতিনাশ, মানীর অপমান, এই সকল পৈশাচিক কাণ্ডের শত শত দৃষ্টান্ত ছত্রে ছত্রে দেখিতে পাইবেন। দেবী সিংহের নাম শুনিলে, আজিও উত্তরবঙ্গ প্রদেশের অধিবাসিগণ শিহরিয়া উঠে! আজিও অনেক কোমলফৃদয়া মহিলা মূর্চ্ছিতা হইয়া পড়েন। শিশুসন্তানগণ ভীত হইয়া, জননীর ক্রোড়ে আশ্রয় লয়! সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে এরূপ পাশব অত্যাচারের দৃষ্টান্ত অধিক নাই বলিয়াই আমাদের বিশ্বাস। মানুষ হইয়া মানুষের প্রতি এরূপ নির্দ্দয় ব্যবহার কখনও সম্ভবপর কি না তাহা আমরা স্থির করিয়া উঠিতে পারি না। কল্পনায় সে চিত্র আঁকিতে গেলে আপনিওই ভীত ও চকিত হইয়া উঠে। মানুষ কখনও সে চিত্র দেখাইতে পারে না, দেখাইতে হইলে অমানুষী ক্ষমতার প্রয়োজন। কঠোরতায় হৃদয় না বাঁধিলে তাহার পূর্ণ চিত্র প্রদান করা দুঃসাধ্য। মহামতি বার্ক ইংলণ্ডের মহাসমিতির নিকট সেই অত্যাচারকাহিনী বর্ণণা করিতে করিতে এরূপ অস্থির হইয়া উঠিয়াছিলেন যে, আর অধিক দূর অগ্রসর হইতে পারেন নাই। তথাপি তাঁহার সেই অবিনাশিনী বর্ণণা হইতে আজ আমরা দেবী সিংহের পৈশাচিক চরিত্রের যে চিত্র দেখিতে পাই, তাহাতেই স্তম্ভিত হইতে হইয়। তাই বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছেন, “পৃথিবীর ওপারে ওয়েষ্টমিনিষ্টার হলে দাঁড়াইয়া এদ্মন্দ বর্ক দেবীসিংহকে অমর করিয়া গিয়াছেন। পর্ব্বতোদগীর্ণ অগ্নিশিখাবৎ জ্বালাময় বাক্যাস্রোতে বর্ক দেবীসিংহের দুর্ব্বিসহ অত্যাচার অনন্তকালসমীপে পাঠাইয়াছেন। তাহার নিজ মুখে সে দৈববাণীতুল্য বাক্যপরম্পরা শুনিয়া শকে অনেক স্ত্রীলোক মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িয়াছিলেন- আজি শত বৎসর পরে সেই বক্তৃতা পড়িতে গেলে, শরীর রোমাঞ্চিত ও হৃদয় উন্মক্ত হয়।“
দেবী সিংহের নৃশংস অত্যাচারে সমগ্র উত্তরবঙ্গ হাহাকারময় এক জনপদে পরিণত হয়। এ যেনো এক মহাশ্মশান। চারিদিকে শুধু মৃত্যুর গন্ধ, চারিপাশে শুধু ধ্বংসস্তুপ, আর অরাজকতায় ছাওয়া অন্ধকার।
নদীর জলে আগুন ছিলো
অত্যাচার যখন চরমে পৌঁছায় তখন নিরীহ, দুর্বল এবং নির্বিষ সাপও ফণা তুলে ঘুরে দাঁড়ায়, ছোবল দিতে এগিয়ে আসে। রংপুর ও দিনাজপুরের মানুষও দেবি সিংহের এই নির্মম অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করলো না। এমনিতেই তারা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলো বনে-জঙ্গলে। এবার সংগঠিত হলো তারা। আর মার খাওয়া নয়, বিনা প্রতিবাদে মরে যাওয়া নয়, এবার রুখে দাঁড়াতে হবে। এই দৃপ্ত চেতনা নিয়ে দলবদ্ধ হলো তারা। বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে দিলো সমবেতভাবে চারিদিকে। নিখিলনাথ রায় ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’-তে লিখেছেনঃ
“যখন চাষীদের উপর এই কর বৃদ্ধি ও তাহাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যার উপর পাশবিক অত্যাচার অবাধে চলিতে লাগিল, যখন তাহারা বন্য পশুর মত দলে দলে বনে বনে ভ্রমণ করিয়াও অত্যাচারের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইল না, চক্ষুর সম্মুখে নিজেদের কুটীর ও যথাসর্বস্ব অগ্নিমুখে ভস্মীভুত হইতে লাগিল, তখন আর তাহারা স্থির থাকিতে পারিল না। কাজেই এই সমস্ত ভীষণ অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া উত্তর-বঙ্গের প্রজাগণ দলবদ্ধ হইয়া ব্যাপক বিদ্রোহ আরম্ভ করিল।“
কৃষকদের মধ্যে যে ক্রোধ দিন দিন ধরে জমা হচ্ছিলো তা ১৭৮২ সালের শেষ দিকে তা পুঞ্জীভূত আকার ধারন করলো। উত্তর বঙ্গের কৃষককূল নিজেদের অনিবার্য ধ্বংস থেকে আত্মরক্ষার শেষ উপায় হিসাবে ইংরেজ বণিকরাজের শাসন ও নিষ্ঠুর শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উড়ালো। সমস্ত উত্তর বঙ্গ জুড়ে শুরু হলো এক মহা বিদ্রোহের সূচনা। রাজশক্তির বিপুল শক্তির বিরুদ্ধে সর্বহারা কৃষকদের সুসংঘটিত এক বিদ্রোহের আলোড়নে আলোড়িত হয়ে উঠলো সমগ্র এলাকা।
প্রতিটা আন্দোলন, সংগ্রাম, বিদ্রোহ কিংবা বিপ্লবেই দেখা যায় যে, কোনো না কোনো মহান নেতার আবির্ভাব ঘটে গেছে। এই বিদ্রোহেও তাই হলো। অন্ধকার খনিগর্ভ থেকে বেরিয়ে এলো একখণ্ড হীরের টুকরো। নুরলদীন শক্র হাতে এই কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব হাতে নিলেন। ইতিহাসে নুরুলদীনের কোনো প্রকৃত পরিচয় নেই। জানা যায় না, কে ছিলেন তিনি? কোথায় জন্মেছেন, কোন গ্রামে ছিলো তাঁর নিবাস। শুধু এইটুকু জানা যায়, তিনিই প্রথম রংপুরের কৃষকদের সংঘবদ্ধ করেছিলেন।
শুরুতে তিনি অবশ্য সশস্ত্র বিপ্লব ঘটাতে চান নি। চেয়েছিলেন ইংরেজ সরকার দেবী সিংহের অত্যাচার থেকে তাদের রক্ষা করুক। রংপুরের কালেক্টরের কাছে তাদের দাবি সম্বন্ধে একখানা আবেদনপত্র পেশ করে এই দাবি পূরণের জন্য সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলো। আবেদনপত্রের সাথে বহু লোকের সই সংগ্রহ করে সংযোজন করে দেওয়া হলো। আবেদনপত্রে তাদের দূরাবস্থার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছিলো আর সেখানে ছিলো কতকগুলো অনুরোধ আর উপরোধ।
দেবী সিংহ ঘোড়েল লোক। তাঁর লুণ্ঠিত অর্থের একটা অংশ তিনি কালেক্টরকেও দিতেন। তাই, আবেদনপত্রের ফলশ্রুতিতেও কোনো তদন্ত হলো না। কালেক্টর দাবি পূরণের জন্য কোনো চেষ্টাই করলেন না। নূরলদীন এবং কৃষকেরা বুঝে গেলেন যে, অনুরোধে কোনো কাজ হবে না। জোর করেই হটাতে হবে দেবী সিংহকে এবং দেবী সিংহের সমর্থক রংপুরের ইংরেজ কালেক্টরকে। বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা সমবেতভাবে নূরলদীনকে অধিনায়ক নির্বাচন করে তাঁকে ‘নবাব’ হিসাবে ঘোষণা করে দিলো।
নূরলদীন উত্তর বঙ্গের কৃষকদের বিদ্রোহের পরিচালনার ভার গ্রহণ করলেন। দয়াশীল নামের একজন কৃষককে তাঁর দেওয়ান নিযুক্ত করলেন। তারপর এক ঘোষণা পত্রের মাধ্যমে দেবী সিংহকে আর কর না দিতে আদেশ জারি করলেন। দেবী সিংহ এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ব্যয় সংকুলানের জন্য কৃষকদের উপর ডিং খরচ নামে বিদ্রোহের চাঁদা ধাররয করলেন। ১৯১১ সালে প্রকাশিত Gazetteer of Rangpur District-এ এ সম্পর্কে লেখা হয়েছে,
“The exactions of a notorious farmer Raja Deboi Singh of Dinajpur, caused an insurrection of the cultivators in 1783. The revenue officers were driven out. A petition of grievances was submitted to the collector, who offered various concessions, which did not serve to quell the disturbance. The insurgents committed several murders, and issued a proclamation that they would pay no more revenue. They forced the cultivators of Cooch Behar to join them, and sent parties into Dinajpur to raise the people there. One of the leaders assumed the title of Nawab; and a tax called dingkharacha, or sedition tax, was levied for the expenses of the insurrection.”
নুরলদীন উত্তরবঙ্গের নানা স্থানে ঘুরে ঘুরে কৃষকদের সংগঠিত করতে লাগলেন। তাঁর কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেলো কৃষকদের কারণেই। মার খেতে খেতে মানুষ তখন এমনই মরিয়া যে সবাই উন্মত্ত হয়ে আছে প্রতিশোধ নেবার স্পৃহায়। নুরলদীনের কথায় দলে দলে মানুষ মিলিত হতে থাকে এক পতাকার নিচে। সবাই এক লক্ষ্যে অবিচল। দেবী সিংহের বর্বরসূলভ শোষণ-উৎপীড়ন, নিপিড়নের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ এবং এই অঞ্চল থেকে ইংরেজদের শাসনের মূলোচ্ছেদ করা। বিদ্রোহীদের আহবানে কোচবিহার ও দিনাজপুরের বহু স্থানের কৃষকগণও নূরলদীনের বাহিনীতে যোগ দিলো।
এর পরই পরগনায় পরগনায় শুরু হয় বিদ্রোহীদের অভিযান। ১৭৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে সমগ্র রংপুর পরগনায় বিদ্রোহ আরম্ভ হয়। বিদ্রোহী কৃষকরা রংপুরের সমস্ত এলাকা থেকে দেবী সিংহের কর সংগ্রহকারী কর্মচারীদের বিতাড়িত করে। শুধু বিতাড়িতই নয়, বহু কর্মচারী এদের হাতে মারাও যায়। এরা যে এক তরফা আক্রমণে মারা গিয়েছে, তাও নয়। প্রায় জায়গাতেই এই কর্মচারীরা বরকন্দাজ নিয়ে বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করতে নেমেছিলো, কিন্তু তাদের সাথে পেরে ওঠে নি। দেবী সিংহের পৃষ্ঠপোষক কিছু জমিদারও ছিলো। তারা এগিয়ে এলো দেবী সিংহের সাহায্যে। বিদ্রোহ দমনের জন্য শক্তি প্রয়োগের ব্যবস্থা নিলো তারা। বিদ্রোহীরা ছাড়লো না। পালটা আক্রমণে ভস্মীভুত হলো এদের বাড়ি-ঘর। তাদের নায়েব নোমস্তাদেরও ধরে ধরে হত্যা করা শুরু হলো। কোচবিহারের ইতিহাস গ্রন্থের খাঁন চৌধুরী আমানতুল্লা আহমেদ লিখেছেন,
“ইহার পর কাকিনা, ফতেপুর, ডিমলা, কাজিরহাট এবং টেপা পরগনায় বিদ্রোহীরা দলবদ্ধ হইয়া কর-সংগ্রাহক নায়েব এবং গোমস্তা প্রভৃতিকে যত্র তত্র তত্র বধ করিতে আরম্ভ করে। ডিমলার জমিদার গৌরমোহন চৌধুরী বিদ্রোহীগণকে বাধা দিতে অগ্রসর হইলে তাঁহারও জীবনান্ত ঘটে।“
দেখতে দেখতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত অঞ্চলে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই এসে যোগ দিতে লাগলো নুরলদীনের দলে। ক্রমশ বিশাল হয়ে উঠলো দল। এদের শক্তির সাথে না পেরে পালিয়ে গেলো দেবো সিংহ। পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলো রংপুরের কালেক্টর গুডল্যান্ড সাহেবের কাছে। দেবী সিংহের লুটের টাকার ভাগ গুডল্যান্ড সাহেবও পেতেন বলে তাঁদের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিলো। এ ছাড়া বিদ্রোহীদের প্রতি তিনি আদৌ সন্তুষ্ট ছিলেন না। তারপরেও বিদ্রোহীরা তখন পর্যন্ত ইংরেজদের কোনো ক্ষতি করে নি বলে আগ বাড়িয়ে তাদের সাথে ঝামেলা করার কোনো ইচ্ছা তার ছিলো না। টাকা কামাতে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এই দেশে এসেছেন। যতখানি ঝামেলামুক্তভাবে টাকা কামানো যায়, ততখানিই মঙ্গল। দেবী সিংহের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব কোনো হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ না যে, তাঁর বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। দেবী সিংহও এটা জানেন। কাজেই, রংপুরে এসেই তিনি গুডল্যান্ড সাহেবকে প্রচুর অর্থ উপঢৌকন হিসাবে দিলেন। এবার গুডল্যান্ড সাহেব নড়ে চড়ে বসলেন। কর্তৃপক্ষের কাছে জানালেন যে, নূরলদীন নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে সমগ্র রংপুর ও দিনাজপুরে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটেছে। বিদ্রোহীরা ইংরেজদেরও প্রভূত ক্ষতি করছে এবং জমিদারদেরও অব্যাহতি দিচ্ছে না। অবিলম্বে এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করা হোক।
কালেক্টরের নিজের অধীনেও ছিলো একদল সৈন্য। লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ডের অধীনে এলো আরো একটি দল। সাথে কিছু সংখ্যক কামান। ম্যাকডোন্যাল্ড তার বিরাট বাহিনী নিয়ে রংপুরে প্রবেশ করেই সেটাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দিলো। এরা বিদ্রোহীদের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করার আগে পোড়ামাটি নীতি নিয়ে অগ্রসর হলো। সৈন্যরা যে পথ দিয়ে গেলো, সেই পথে যাকে দেখতে পেলো, তাকেই হত্যা করলো। শিশু হত্যা এবং নারী নির্যাতন করতেও কোনো দ্বিধা তারা করলো না। জ্বালিয়ে দিতে লাগলো গ্রামের পর গ্রাম।
ম্যাকডোনাল্ডের সৈন্যদের এই নিষ্ঠুর অত্যাচার বিদ্রোহীরা নীরবে সহ্য করলো না। যারা মারা যাচ্ছে, তারা তাদেরই কারো বাবা, ভাই বা আত্মীয়স্বজন। কাজেই, প্রতিশোধ নেবার আক্রোশে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো বৃটিশ সৈন্যের উপর। নানান জায়গায় শুরু হয়ে গেলো খণ্ডযুদ্ধ। সেই সব যুদ্ধের কোনোটাতে জয়ী হলো বিদ্রোহীরা, কোনোটাতে বিজয়ী হলো ইংরেজ সেনাবাহিনী। অবশেষে, বিদ্রোহীরা সিদ্ধান্ত নিলো ইংরেজ শাসনের প্রধান ঘাঁটি মোগলহাট বন্দরের ইংরেজ কুঠির উপর আক্রমণ করার। এই কুঠিটি ছিলো রংপুরের ইংরেজ শক্তির মুল কেন্দ্রগুলির অন্যতম। এই আক্রমণে নেতৃত্ব দিলেন নূরলদীন।
মোগলহাটের যুদ্ধের সময় বিদ্রোহীদের প্রধান বাহিনীটি অবস্থান নেয় পাটগ্রামে। ইংরেজ সেনাপতি লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোন্যাল্ড তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহীদের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু, পথের মধ্যেই বিদ্রোহী বাহিনীর সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা পেয়ে ভীত হয়ে পড়েন তিনি। ফলে, সম্মুখ যুদ্ধের পরিবর্তে কূটকৌশলের আশ্রয় নেন তিনি। তাঁর সৈন্যরা যুদ্ধের সাজপোশাকের উপর সাধারণ কাপড় পরে সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশ ধারণ করে। তারপর রাতের আঁধারে নিঃশব্দে পাটগ্রামের কাছে এসে বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ঘিরে ফেলে। ১৭৮৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারির অতি ভোরে ম্যাকডোন্যাল্ড বাহিনী বিদ্রোহীদের উপর গুলি চালনা শুরু করে। অতর্কিত এই আক্রমণে হকচকিয়ে যায় বিদ্রোহীরা। ইংরেজদের মতো আধুনিক সমরাস্ত্র তাদের ছিলো না, ছিলো না যুদ্ধের সুশিক্ষিত প্রশিক্ষণ পদ্ধতি। এই আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যায় তারা। ফলে, দলে দলে নিহত হয় তারা, আহত হয় অসংখ্য আর বাকিরা প্রাণভয়ে পলায়ন করে। নূরলদীনের সহকারী দয়াশীল মারা যান। গোলার আঘাতে আহত গুরুতরভাবে আহত হন নূরলদীন। ইংরেজরা তাঁকে আহত অবস্থায় বন্দি করে। আঘাত এতোই গুরুতর ছিলো যে, মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। গুডল্যান্ড তাঁর রিপোর্টে লিখেছিলেন
“In an attempt to burn Mughalhat, the self-styled Nawab’s forces were defeated, and the Nawab himself wounded and taken prisoner. A party of sepoys under Lieutenant Macdonald marched to the north against the principal body of insurgents and a decisive engagement was fought near Patgram on the 22nd February 1783. The sepoys disguised themselves by wearing white clothes over their uniform and by that means got close to the rebels, who were utterly defeated; sixty were left dead on the field, and many others were wounded and taken prisoners.”
শেষ বিকেলের বহ্নিশিখা
নূরলদীন মারা গেলেন। কিন্তু যে বিদ্রোহের আগুন তিনি জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তা তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে নির্বাপিত হলো না। বরং তাঁর মৃত্যুতে বিদ্রোহীরা আরও ক্ষিপ্ত হলো, প্রতিশোধের আগুন তাদের রক্তে মজ্জায় ঢুকে গেলো। নূরলদীন নিজেও জানতেন যে, বিদ্রোহের যে আগুন তিনি জ্বালাচ্ছেন, সেই আগুনে একদিন তাকেও পুড়ে মরতে হবে। তাঁর মৃত্যুতে যাতে সব শেষ না হয়ে যায়, তাই তিনি আগেই বলে গিয়েছিলেন এই কথাগুলোঃ
“আমার মৃত্যুতে যেন বিদ্রোহের অবসান না হয়। প্রাণ থাকতেও ক্ষমা করো না অত্যাচারীদের। আর রাজকোষে জমা দিও না এক কপর্দকও।“
বিদ্রোহীরা তাদের নেতার আদেশ পালন করেছিলো অক্ষরে অক্ষরে। সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হবার জন্য যে সামর্থ তাদের থাকার কথা ছিলো, তা নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিলো মোগলহাটের যুদ্ধে, কাজেই চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যেতে থাকে তারা। সেই সাথে শত অত্যাচার সত্ত্বেও রাজস্ব দিতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। শুধুমাত্র রংপুরেই খাজনা বাকি পড়ে যায় চার লক্ষ টাকার মতো।
টাকা বাকি পড়াতে টনক নড়ে কোম্পানির। ঘটনা কী তা জানার জন্য আর রাজস্ব আদায়ের জন্য পিটারসন নামের একজন ইংরেজ কর্মচারীকে পাঠানো হলো কমিশনার নিযুক্ত করে।
ইংরেজ মানেই যে সবাই খারাপ, তা কিন্তু নয়। এই পিটারসন সাহেবও ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ। রংপুরে এসে সবকিছু দেখে তিনি শিউরে উঠলেন। কোনো গ্রামে লোকজন নেই। কোথাও কোনো বাজার-হাট বসে না। কৃষকেরা জমিতে চাষাবাদ করে না। যেদিকে তাকানো যায়, শুধু ভস্মীভূত কুটির চোখে পড়ে। কোনো মনুষ্য বসবাসের জায়গা যেনো এটি নয়, এ এক বিরান শ্মশানভূমি। এই অবস্থা দেখে একেবারে হতভম্ভ হয়ে গেলেন তিনি। তীব্র ভাষায় নিম্নোক্ত বক্তব্য তিনি লিখে পাঠালেন কোলকাতায়ঃ
“আমার প্রথম দুই পত্রে প্রজাদের উপর কঠোর অত্যাচার, এবং তাহারই জন্য যে তাহারা বিদ্রোহী হইয়াছে সেকথা সাধারণভাবে বিবৃত করিয়াছি। আমার প্রতিদিনের অনুসন্ধানে তাহা আরও দৃঢ় হইতেছে। তাহারা যদি বিদ্রোহী না হইত, তাহা হইলে আমি আশ্চর্য জ্ঞান করিতাম। প্রজাদের নিকট হইতে রাজস্ব আদায় করা নাই, তাহাদের উপর রীতিমত দস্যুতা এবং সঙ্গে সঙ্গে তাহাদিগকে কঠোর শারীরিক যন্ত্রণা ও সর্বপ্রকার অপমানে জর্জ্জরিত করা হইয়াছে। ইহা যে কেবল কতিপয় প্রজার উপর হইয়াছিল এমন নহে, সমস্ত দেশেই এইরূপ ভাবেই অত্যাচার বিস্তৃত হয়। মনুষ্য চিরকাল পরাধীন থাকিলেও যখন অত্যাচার সীমা অতিক্রম করিয়া উঠে, তখন তাহার প্রতিবিধানের জন্য তাহাকে অগত্যা উত্থিত হইতে হয়। আপনারা এই সমস্ত প্রজাদিগের অবস্থা বিবেচনা করিয়া দেখিবেন যে, যখন অসম্ভব কর আদায়ের জন্য, তাহাদের সমস্ত সম্পত্তি লুণ্ঠন করিয়াও অর্দ্ধাংশের পরিশোধ হইল না, তাহার উপর আবার তাহাদিগকে কঠোর শারীরিক পরিশ্রম যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইল, ইহার উপর যখন তাহাদের পরিবারের উপর সতীত্বনাশ ও জাতিনাশের অত্যাচার হইতে লাগিল, এরূপ ক্ষেত্রে তাহাদের কি করা উচিত? আপনারা বিশেষরূপে অবগত আছেন যে, এতদ্দেশীয়েরা আপনাদিগের স্ত্রী ও জাতির উপর যেরূপ অনুরক্ত, তাহাতে তাহারা এরূপ অবস্থায় কতদুর সহ্য করিতে সক্ষম হয়?“
দেবী সিংহ এবং রংপুরের কালেক্টর গুডল্যান্ড সাহেবকে এবার কোলকাতায় তলব করা হলো। রেভিনিউ কমিটি দেবী সিংহের অনাচারের প্রমাণ পেয়ে তাঁর হাত থেকে রাজস্ব আদায়ের ভার তুলে নেয়। জমিদার এবং প্রজাদের দেবী সিংহের নিকট খাজনা দিতে নিষেধ করে। নিজের কুকীর্তি ঢাকা দেবার জন ৭০ লাখ টাকা সঙ্গে নিয়ে ছুটে যান । ওই টাকা তিনি বিচারকমণ্ডলীর মধ্যে ভাগ করে দেন।
তখন বিচারের নামে যা হলো, তা হচ্ছে প্রহসন। রায়ে বলা হলো যে, দেবী সিংহ এবং গুডল্যান্ড সাহেবের কোনো দোষ নেই। ঈর্ষাকাতর হয়ে পিটারসন তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা রিপোর্ট করেছেন। সুপ্রকাশ রায় তাঁর ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম বইতে লিখেছেনঃ
“গভর্নর-জেনারেল হেস্টিংস ষড়যন্ত্র পাকাইয়া গুডল্যান্ডের কোন দোষ নাই বলিয়া তাহাকে অব্যাহতি দেন। দেবো সিংহ তাঁহার সঞ্চিত বিপুল অর্থ দ্বারা বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে বশীভূত করিয়া রাখিয়াছিল। হেস্টিংস তাহাদের লইয়া দেবী সিংহের বিচারের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটি বিচার করিয়া রায় দেয় যে, দেবী সিংহ সম্পুর্ণ নির্দোষ, পিটার্সনই তাঁহার নামে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়াছেন। হেস্টিংস ইংলণ্ডে যে রিপোর্ট প্রেরণ করেন তাহাতেও তিনি এই রায় সমর্থন করেন।“
প্রহসনের রায়ে দেবী সিংহ নির্দোষ প্রমাণিত হলেন ঠিকই, কিন্তু প্রজা বিক্ষোভ এবং অসন্তোষের কারণে তাঁর পক্ষে আর ফিরে আসা সম্ভবপর হলো না। প্রথমতঃ তাঁর আশ্রয়দাতা হেস্টিংস সাহেব দেশে ফিরে গেলেন। গভর্নর জেনারেল হয়ে এলেন লর্ড কর্নওয়ালিশ। সুতরাং হেস্টিংসের পক্ষে দেবী সিংহকে আর কোনো সরকারী কার্যে নিযুক্ত করা সম্ভব হয় নাই। দ্বিতীয়ত টাকা খেয়ে বিচারকমণ্ডলী দেবী সিংহকে নির্দোষ প্রমাণ করলেও তাঁর প্রতি কর্তৃপক্ষের আস্থা আদৌ ছিলো না। তবুও দেবী সিংহ চেষ্টা করেছিলেন লর্ড কর্নওয়ালিশকে ভজনা করতে। সুবিধা না হওয়ায় মুর্শিদাবাদে তাঁর বিরাট জমিদারীতে ফেরত গেলেন। এতকাল ধরে লুণ্ঠনের মাধ্যমে যে টাকা পয়সা রোজগার করেছিলেন, সেগুলো দিয়ে বিপুল পরিমাণে ভূসম্পত্তি কিনে মুর্শদাবাদের নসীপুর রাজ-পরিবার প্রতিষ্ঠা করেন।
রংপুর বিদ্রোহের অবসান ঘটলো এখানেই। বিদ্রোহের অবসান হলেও শোষণমুক্ত তারা হতে পারে নি। দেবী সিংহের অপসারণের পর লর্ড কর্নওয়ালিশ রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারা প্রথা বন্ধ করেন এবং ১৭৯০ সালে উত্তর বঙ্গ ও বিহারের জমিদারগোষ্ঠীর সাথে দশশালা বন্দোবস্ত করেন। এই দশশালা বন্দোবস্ত অবাধ শোষণ-উৎপীড়নের আর একটা নতুন দরজা খুলে দিলো। বীজ বুনে দিলো আগামী দিনের বিদ্রোহ আর আন্দোলনের। নূরলদীনের দেখানো পথ বেয়ে বাংলার ঘরে ঘরে পরবর্তী সময়ে জেগে উঠতে থাকলো আরো হাজারো নুরলদীন।
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়
ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।
আসুন, আসুন তবে, আজ এই প্রশস্ত প্রান্তরে;
যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে,
তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?
কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রুপাত করে?
সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে।
নূরলদীনের কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ী ঢলের মত নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে উঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?’
সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ
১। ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন – সুপ্রকাশ রায়
২। বাংলার বীর বিদ্রোহী – সুধাংশু পাত্র
৩। মুর্শিদাবাদ কাহিনী – নিখিলনাথ রায়
৪। বাঙলার কৃষকের কথা – ঋষীকেশ সেন
৫। নূরলদীনের সারাজীবন – সৈয়দ শামসুল হক
৬। Gazetteer of Rangpur District – published in 1911.
৭। The Annals of Rural Bengal – Sir William Wilson Hunter
৮। Burkes Speech at the Impeachment of Warren Hastings – Edmund Burke
নূরোলদীনের সহযোগী রাজা দয়াশীল , ভবানি পাঠক , তার মা সম্রাজ্ঞী লালবিবির সহ অসংখ্য ফকির সন্ন্যাসীদের সহিত তেইশে জুন সতেরশ সাতান্ন সালের পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজ উদ দৌলার পরাজয়ের পর সর্ববৃহত্ আন্দলোনের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আমার জন্মস্থান ।যেথায় সবচেয়ে বেশি ফকির সন্ন্যাসীরা আত্নহতি দান করেন নগর মীরগঞ্জের তালুক তামপাট মৌজার ঐতিহাসিক সমরদীঘি নামক স্থানে। ঐতিহাসিক এই স্থানটিকে সরনীয় করে রাখতে স্থানীয় যুব শক্তি ক্লাব রংপুর অনেক প্রকল্প গ্রহন করছে।নূরোলদীনের আরো বেশী তথ্য পিডিএফ আকারে চাই।
ফরিদভাইকে ধন্যবাদ, ধ্ন্যবাদের উপর যদি কিছু থাকে তাও দেব। উত্তরবঙ্গের (রংপুর ও দিনাজপুর) কৃষক বিদ্রহের নায়ক নুরুলদ্দীনের সম্বন্ধে ভালোভাবে জানতে পাড়লাম। ইংরেজদের বিরুদ্ধে এটাই বোধ হয় প্রথম বিদ্রোহ। তারপরে ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানীর মত বিদ্রোহীরা আসেন।
আমার খুব সৌভাগ্য যে নূরলদীনের সারাজীবন নাটকে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল (চট্টগ্রামে ‘‘থিয়েটার গিল্ড” এই নাটকটি করতো ‘‘১১৮৯” নামে, আমি ২০০১-০২ সালে ঐ দলে কাজ করতাম)। আমাদের দলের প্রধান টিপু (অহিদুল আজম টিপু) ভাই নূরলদীন এর চরিত্রে অসাধারণ কাজ করতেন। আজো ‘‘জাগো বাহে, কোনঠে সবাই শুনলে শিরদাঁড়া দিয়ে স্রোত নামে) আজ এই লেখা পড়ে আবারও সেই অনুভূতি তৈরী হলো। ফরিদ ভাইকে ধন্যবাদ, চমৎকার এই লেখাটার জন্য। এখন যদি নাটকটাতে আবার কাজ করতে পারতাম! বোধ করি, আরও গভীর থেকে কাজটা করতে পারতাম।
রংপুরের মেয়ে হিসেবে পূর্বপুরুষদের ইতিহাস বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়লাম।রংপুরের আরেকটি ঐতিহাসিক চরিত্র দেবী চৌধুরানী, তিনিও বৃটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।বঙ্কিম চন্দ্রের উপন্যাস আছে তার ওপর, ছবিও হয়েছে কলকাতায়। শুনেছি আমার পূর্বপুরুষ দেবী চৌধুরানীর সাথে বৃটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
লেখক কে অনেক শুভেচ্ছা, কালের অতল থেকে ইতিহাসকে তুলে আনার জন্য …
@লাইজু নাহার,
অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম।
@তামান্না ঝুমু,
আপা কেমন আছেন?
ব্য্স্ততার কারণে আসা হয়না সবসময়।
@লাইজু নাহার,
ইংরেজদের বিরুদ্ধে যাঁরাই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলো, তাঁদেরকেই ইংরেজরা চিহ্নিত করেছে ডাকাত হিসাবে। এই চিহ্নিতকরণ থেকে বাদ যায় নি ভবানী পাঠক, বাদ যায় নি মজনু শাহ, বাদ যায় নি নূরলদীন, বাদ যায় নি দেবী চৌ্ধুরানী। J. A. Vas এর লেখা Rangpur District Gazetteers দেবী চৌধুরানীকে ডাকাত হিসাবে চিহ্নিত করে এই কথাগুলো লেখা হয়েছেঃ
অসাধারণ। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের মণি-মানিক্য তুলে এনে আমাদের পুরো জাতিকেই কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করছেন।
চলুক।
@গুবরে ফড়িং,
আমার যেটুকু সাধ্য আছে, সেটুকুই করার চেষ্টা করছি। কাউকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্দ করার চেয়েও, নিজের দায়বদ্ধতা মেটাতেই বরং বেশি ব্যস্ত আমি।
অসাধারন কাহিনী।
৭৬ এর মর্মন্তুদ এর কথা শুধু শুনতাম, অন্তর্নিহিত কাহিনী জানা ছিল না।
আমার ধারনা ছিল শামসুল হল নুরালদীনের সারা জীবন লিখেছিলেন, নুরলদীন নয়।
@আদিল মাহমুদ,
আমারও।
@আদিল মাহমুদ,
[img]http://d1cdd9ctvqfjk5.cloudfront.net/av/imgrok_62273.GIF[/img]
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, গত বছর কিছুটা জানতে পেরেছিলাম প্রথম আলোতে প্রকাশিত নিবন্ধে। আর এখন অনেক কিছু জানতে পারলাম। 🙂
@বিবেকবান নাগরিক,
কষ্ট করে পড়েছেন বলেও আপনারও ধন্যবাদ প্রাপ্য আমার তরফ থেকে। বিশাল লেখা, পড়তে গিয়ে ধৈর্য ধরে রাখাটা কঠিনই বটে। নুরলদীনকে নিয়ে প্রথম আলোতে কে লিখেছিলেন? মনে আছে কি?
অনেক ধন্যবাদ অজানা ইতিহাস তুলে ধরার জন্য। দিনাজপুর আমার পূর্বপুরুষদের আবাস; আমার দাদার প্রজন্ম পর্যন্ত সবাই কৃষকই ছিলেন। দেবী সিং এর সময়ে আমার পূর্বপুরুষেরা কি করে টিকে ছিলেন তা এখন কেবল অনুমানের বিষয়।
এর আগে উল্লেখ করা সন গুলো খ্রীষ্টাব্দে, আর এটি বোধ হয় বাংলা সন?
বাড়তি ধন্যবাদ লেখার শেষে দেয়া সুন্দর কবিতাটির জন্য। :rose:
@মনজুর মুরশেদ,
কবিতাটার জন্য সৈয়দ শামসুল হক ধন্যবাদের প্রাপ্য। নূরলদীনের সারাজীবন নাটকটা কাব্যের ছন্দে গভীর মমতা দিয়ে লিখেছেন তিনি। মাস্টারপিস একটা, সাথে ক্লাসিকও, সময়কে অতিক্রম করে যাবে এই নাটক।
@ফরিদ আহমেদ,
নাটকটা দেখা হয় নি, কেবল টিভিতে আসাদুজ্জামান নুরের কন্ঠে কিছু অংশ শুনেছিলাম বলে এখন মনে পড়ছে।
@মনজুর মুরশেদ,
সালটা বাংলা সাল হিসাবে দিয়েছি এই কারণে যে, এই দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলে ইতিহাসে খ্যাত। ১৭৭০ সাল দিলে এই বিষয়টাতে সংশয় থেকে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।