“Half of me is beautiful
But you were never sure which half.
“Ruth Feldman, “Lilith”

Ruth Feldman, “Lilith”

আদমের রহস্যময় স্ত্রী লিলিথ(Lilith) হিব্রু পরিভাষা হচ্ছে לילית‎; (Lilith), সুমেরীয় আকাডিয়ান (Līlītu) । একেক স্থানে কিছুটা ভিন্ন নামে ভিন্ন অর্থে হলেও লিলিথ এর প্রচলিত অর্থ- রাত্রি। ধর্মমতে লিলিথ ছিলেন আদমের প্রথম স্ত্রী। ঈশ্বর আদমকে সৃষ্টি করার পর ভাবলেন, মানুষের জন্য একা থাকা খুবই কষ্টের। তাই একই সময়ে একই উপাদান অর্থাৎ মাটি দিয়ে সৃষ্টি করলেন লিলিথ’কে।

ওল্ড টেস্টামেন্টের দ্য বুক অফ জেনেসিসে লিলিথ সম্পর্কে লেখা আছে- 1:27 So God created man in his own image, in the image of God created he him; male and female created he them. 1:28 And God blessed them, and God said unto them, Be fruitful, and multiply, and replenish the earth, and subdue it: and have dominion over the fish of the sea, and over the fowl of the air, and over every living thing that moves upon the earth. ইহুদিদের লোকবিশ্বাস হল, লিলিথ হলেন অন্ধকারের কুখ্যাত পিশাচ যিনি নবজাতক শিশুদের অপহরণ করেন। ঈশ্বর আদম’কে যে উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন ঠিক সেরকম ভাবে লিলিথ’কে সৃষ্টি করা হয়। স্পষ্টত যে, সৃষ্টির শুরুতে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা ছিল।

আদম ও লিলিথের মধ্যে দ্বন্ধের শুরু সঙ্গমের মধ্য দিয়ে। আদম নিজেকে শ্রেষ্ঠ দাবী করে লিলিথের উপরে থাকতে চাইলে লিলিথ তা মানলেন না। লিলিথ উপরে থাকার দাবী করলেন। লিলিথের যুক্তি, আমরা দুই জনই সমান। দুইজনই এক উপাদানে তৈরি হয়েছি। আদম জোর করে লিলিথের সাথে যৌনমিলত করতে চাইলে লিলিথ আদমকে ছেড়ে পৃথিবী’তে চলে আসেন। এরপর আদম ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে বলেন; হে মহাজগতের ঈশ্বর, আপনি আমাকে এই কেমন নারী দিয়েছেন, যে কিনা আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে। ঈশ্বর তখন তিন ফেরেশতার মাধ্যমে লিলিথের কাছে একটি ম্যাসেজ পাঠান- “If she agrees to come back, it is good. If not, she must permit one hundred of her children to die every day.”-Alphabet of ben sira

ফেরেশতারা ইজিপ্টের সমুদ্রতীরে লিলিথ’কে খুঁজে পান। ফেরেশতারা লিলিথকে ঈশ্বরের বাণী শোনানোর পর লিলিথ ফিরে যেতে অসম্মত জানান এবং স্পষ্ট করে বলে দেন-My friends, I know God only created me to weaken infants when they are eight days old. From the day a child is born until the eighth day, I have dominion over the child, and from the eighth day onward I have no dominion over him if he is a boy, but if a girl, I rule over her twelve days.” লিলিথ ঈশ্বরের শাস্তিকে মাথা পেতে নিয়ে নিজের স্বাধীনতাকে বির্সজন দেননি। ফলে তিনি হয়ে পড়েন অভিশপ্ত!

এরপর ঈশ্বর আদম’কে স্বীকার করবে এবং অধীনতা মেনে নেবে এমন আরেকটা নারীকে সৃষ্টি করা হয় যার নাম-ইভ বা ইভা বা হাওয়া। ইভা যেন আদমের অধীনতা মেনে নেয় সেজন্যে আদমের পাঁজড়ের হাড় দিয়ে ইভা’কে সৃষ্টি করা হয়। সুতরাং এটি স্পষ্টত যে, ধর্ম মতে পুরুষের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহী নারী হলেন লিলিথ। ধর্ম মতে তাহলে যিনি আমাদের আদি সৎ মা’ও বটে!

ইহুদিদের লোকবিশ্বাসে লিলিথ একজন শয়তান চরিত্রের অধিকারী হলেও ইহুদি নারীবাদীরা লিলিথ’কে একটি বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে দেখেন। তারা মনে করেন লিলিথ হল সেই নারী যিনি পুরুষের সমান ছিলেন। পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থে নারী’কে পুরুষের সমান উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করেনি কিংবা পুরুষের মতন অধিকার দেয় নি। যা একমাত্র লিলিথ’কে দেওয়া হয়েছিল সৃষ্টির শুরুতে।

বিদ্রোহী নারী লিলিথ নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল সবসময়। সমাজে ও ধর্মে লিলিথ হলেন অন্ধকারের নারী, অশুভ আত্মা, খুনি মহিলা, শিশু ভক্ষণকারী চরিত্রের অধিকারী। চার হাজার বছর ধরে সুমেরীয় মিথে, ইহুদিদের সমাজে ও গ্রন্থে, ইজিপ্ট, গ্রিক সভ্যতায় লিলিথ চরিত্রটি বেঁচে আছেন। সেই ধারাবাহিকতায় ওল্ড টেস্টামেন্টেও লিলিথ চরিত্রটি উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ৩ হাজার খ্রিস্টপূর্বে সুমেরীয় মিথলজিতে লিলিথের কথা উল্লেখ আছে। সিরিয়ার একটি প্রস্তরে একটি লেখা পাওয়া যায় যেখানে লেখা ছিল- “O flyer in a dark chamber, go away at once, O Lili!” ব্যাবিলনীয় গ্রন্থে আছে-পুরুষ মানুষ যদি বাড়িতে একা ঘুমায় তাহলে লিলিথের ফাঁদে সে ধরা পড়তে পারে। পুরুষের সাথে সঙ্গমের মাধ্যমে লিলিথ অন্য শয়তানদের জন্ম দেয় এমনই এক ধারণা তাদের মধ্যে ছিল।

তবে লিলিথের রূপে ও ব্যক্তিত্বে অনেক কবি সাহিত্যিক অভিভূত হয়েছেন। যেমন কবি দান্তে গ্যাব্রিয়েল রোসেত্তি ১৮৬৮ সালে (Dante Gabriel Rossetti)  লিলিথের মায়াময় চুল নিয়ে লিখেছেন- “Was the first gold” আইরিশ উপন্যাসিক জেমস জয়েস (James Joyce) লিলিথকে চিত্রায়িত করেছেন ‘Patron of abortions’ হিসেবে। আধুনিক নারীবাদীরা আদম থেকে মুক্তিকামী এক নারী হিসেবে লিলিথকে কল্পনা করেন। এছাড়া ইহুদিদের একটি ম্যাগাজিনের নাম লিলিথ এর নাম অনুসারে। এছাড়া দুস্থ মহিলাদের সাহায্যের জন্য কনসার্ট ও স্তন ক্যান্সার ইনিস্টিটিউট Lilith Fair নামে পরিচিত। রেনেসাঁস যুগে মাইকেল এঞ্জেলো লিলিথের একটি ছবি আঁকেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে লিলিথ অর্ধেক নারী অর্ধেক সর্প যিনি কিনা জ্ঞান বৃক্ষকে কুণ্ডলিত করে আছেন।

১২ শত’কে স্পেনে লিলিথকে শুধু আদমের বৌ নয় শয়তানের বৌ হিসেবেও উপস্থাপন করা শুরু হয়। মানুষ বিশ্বাস করতে থাকে জিশু যখন আবার ফিরে আসবেন তখন শয়তানের সাথে লিলিথের সম্পর্ক ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের ধারণা ছিল লিলিথ ও শয়তানের মিলনের ফলে প্রতিনিয়ত শয়তান উৎপাদন হচ্ছে। ইহুদিদের লোক বিশ্বাস ছিল; তিন ফেরেশতা সানভি, সানসাভি, সামানগেলোপ(Sanvi, Sansanvi and Samangelof) নামে কবজ ব্যবহার করলে লিলিথ শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের কাছে আসতে পারে না। অনেক সময় লিলিথ থেকে পরিবার’কে সুরক্ষা করার জন্যে তারা লাল ফিতা দিয়ে বন্ধনী দিতো। তবে আধুনিক যুগে ইহুদিদের অনেক নারীবাদী ও কবিরা লিলিথের পালিয়ে যাওয়াটা পুরুষের অধীনতাকে অস্বীকার করা স্বাধীন নারী চেতনা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এছাড়া ইহুদি কবিরা লিলিথকে নিয়েও কবিতা লিখছেন। আমেরিকান লেখিকা Judith Plaskow’র সুপরিচিত বই “The Coming of Lilith। নামেই বোঝা যাচ্ছে বইটি লিলিথ’কে নিয়ে লেখা। এছাড়া বিভিন্ন জন বলে থাকেন, লিলিথ ছিলেন একজন ‘উন্নাসিক নারী’ যিনি আদম কিংবা ঈশ্বর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতে চান নি। আরেক গল্পে বলা হয়, লিলিথ সাপ হয়ে স্বর্গের বাগানে চলে যায় এবং ইভ’এর সাথে বন্ধুত্ব করেন। পরবর্তীতে একে অন্যের সাথে নিজেদের কথা শেয়ার করেন। তাদের বন্ধুত্ব হয় এবং দুই জন জ্ঞানের অন্বেষণ করেন। এভাবেই ইভ স্বর্গীয় বৃক্ষের নিষিদ্ধ আপেলটি খান। এই কাহিনী’র উপর ভিত্তি করে অনেক কবি সমকামিতার কবিতাও লিখেছেন।

লিলিথকে কেন্দ্র করে কয়েকটি সিম্বল সমাজে আছে। যদিও সিম্বলগুলো শয়তানের সিম্বল হিসেবেই স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। কারণ প্রাচীনকাল থেকেই লিলিথ যেহেতু শয়তানের চরিত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে সেহেতু সিম্বলগুলো পবিত্রতার নয় বরং অশুভ ও শয়তানের প্রতিক হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ধর্মে কিংবা সমাজে নারী’কে শয়তান কিংবা নারী শয়তানের সঙ্গী এসব ধারণাগুলো হাজার বছরের ধরে বিভিন্ন গল্পে বিভিন্ন মিথের মাধ্যমে একস্থান হতে আরেক স্থানে বিস্তৃতি লাভ করেছে। নারী পুরুষের সমান অধিকার চাইলে নারী’র উপর শয়তান ভর করেছে কিংবা সে শয়তান হয়ে উঠছে বলে অপবাদ দেওয়া হয়। ইউরোপে অসংখ্য নারী’কে পিশাচ হিসেবে অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের সমাজেও নারী’কে শয়তানের সহযোগী কিংবা নারী খারাপ কাজ করতে উৎসাহিত করে এমন ধারণা আছে। পুরুষ তান্ত্রিক সমাজের ঈশ্বরও একজন পুরুষতান্ত্রিক খোদা। ফলে তিনিও নারী’কে পুরুষের মতন সমঅধিকার দিতে নারাজ। আজকে আমাদের সমাজের নারী’রা যে সমঅধিকারের দাবী তোলে ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসারে সেই দাবী সর্বপ্রথম তোলেন সৃষ্টির প্রথম নারী, মানবের আদি মাতা- লিলিথ।