৭১ সালে নিউজউইকের সিনিয়র এডিটর Arnaud de Borcgrave প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একটি সাক্ষাৎকার নেন। সাক্ষাতকারটি তাৎক্ষনিকভাবে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন সহ অনেক পত্রিকায় অনূদিত হয়। সেখানে শরণার্থী ইস্যুতে খোলাখুলি আলোচনা করা হয়। সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ তুলে ধরছি পাঠকের উদ্দেশ্যে;
প্রশ্নঃ এখনো প্রতিদিন ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে ভারত চলে যাচ্ছে- এটাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন ?
উত্তরঃ না, তারা যাচ্ছে না। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। যেভাবে ভারতীয়রা গোলা নিক্ষেপ করছে সীমান্তবর্তী মানুষদের এমনিতেই প্রাণের ভয়ে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে। সীমান্ত চীনের প্রাচীরের মত নয়। সীমান্তে চিহ্ন নেই। ভারতীয়রা বিদেশী সাংবাদিকদের ভারতের ভেতরের ভূখণ্ড দেখিয়ে বলে এটাই সীমান্ত…
প্রশ্নঃ মাত্র কয়েক মাসে ৯০ লাখ মানুষ কীভাবে নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়?
উত্তরঃ সংখ্যাটা আমি মানতে নারাজ। ২০ থেকে ৩০ লাখ হতে পারে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক দিয়ে গুনলে ৪০ লাখও পাওয়া যেতে পারে…
ইয়াহিয়া খানের এই চরিত্র অজানা নয় আমাদের। যুদ্ধকালীন সময়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম দেখানোর জন্য এরা মরিয়া হয়ে ছিল। আপনারা হয়ত জানেন মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানে গঠিত হামিদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করে যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে নিহত মানুষের সংখ্যা ২৬,০০০। তিরিশ লাখকে যারা ছাব্বিশ হাজার বানিয়ে দিতে পারে তারা এক কোটি শরণার্থীকে ২০ থেকে ৩০ লক্ষ বললে আমরা বরং একটু অবাক হই, এতটা বড় ফিগার তারা স্বীকার করে নিলো কি করে!
আসলে ইয়াহিয়া খানের হাতে আর কোন উপায়ও ছিলো না। ৭১ সালে সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি ছিল আমাদের দিকে দিকে। বিশ্বময় সংবাদপত্র গুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে আসলে যে কোন মানুষ স্বীকার করতে বাধ্য হবে ১৯৭১ সালে ভারতে বাঙ্গালী রিফিউজির সংখ্যা ছিলো এক কোটি কিংবা তার চেয়েও বেশী। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিশ্বময় প্রকাশিত প্রায় দেড়-শতাধিক পত্রিকা থেকে আসুন একটু খুঁজে বের করার চেষ্টা করি শরণার্থীদের প্রকৃত সংখ্যা। প্রত্যেকটা রিপোর্ট একটা একটা করে পড়ে দেখা অসম্ভব সেজন্য আমি সব গুলো প্রতিবেদন থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় সংখ্যাটি আলাদা করে বের করেছি। একটা কথা খেয়াল রাখবেন সমস্ত শরণার্থী কিন্তু এক দিনেই ভারতে পাড়ি জমান নি আর তাই সংখ্যাটা বেড়েছে ক্রমান্বয়ে।
. ডেইলি টেলিগ্রাম ৩০ মার্চ ১৯৭১ লিখেছে; ২৫ মার্চ ১৫,০০০ মানুষ দেশ ছেড়ে পালায়।
. নিউইয়র্ক টাইমসের ২৪ মে ১৯৭১ সালের তাদের পত্রিকায় বলেছে এখন ভারতে শরণার্থী সংখ্যা ১৫ লাখ।
. একই পত্রিকা ৬ জুন ১৯৭১ লিখেছে ২০ লক্ষ।
. এরপর একই পত্রিকার ১৩ জুন ১৯৭১ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছে শরণার্থী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ লাখ।
. সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট বলেছে প্রতিদিন ৬০,০০০ মানুষ পালাচ্ছে।
. দ্যা স্পেক্টেটর তাদের পত্রিকায় ১৯ জুন ১৯৭১ বলছে ৫০ লাখ।
. সানডে টাইমস ২০ এবং ২১ জুন ১৯৭১ লিখেছে ৬০ লাখ
. ইকোনমিস্টনিউজ উইক ২৬ জুন বলেছে ৬০ লাখ।
. ওয়াশিংটন ডেইলি নিইউহ৩০ জুন ১৯৭১ লিখেছে ৬০ লক্ষ।
. দ্যা পালাভার উইকলি ৮ জুন ১৯৭১ বলেছে প্রতিদিন ৫০,০০০ মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে
. ১৭ জুলাই ১৯৭১ ইকনোমিস্ট বলছে ৬৮ লাখ।
. হেরাল্ড ট্রিবিউন ৯ আগস্ট ১৯৭১ বলেছে শরণার্থী এখন ৭০ লক্ষ।
. কাইহান ইন্টারন্যাশনাল ২ আগস্ট ১৯৭১ রিপোর্ট করেছে ৭৫ লক্ষ।
. সেনেগালের লে সেলাই ৭ সেপেম্বার বলেছে ৮০ লক্ষ।
. টরেন্টো টেলিগ্রাম ১৩ই সেপ্টেম্বার বলছে ৮০ লক্ষ।
. দ্যা ইভিনিং স্টার ৩০ সেপ্টেম্বর লিখেছে ৮০ লক্ষ শরণার্থীর কথা।
. ফার ইস্টার্ন ইকনোমিক রিভিউ ২৫ সেপ্টেম্বার বলছে ৮৫ লক্ষ।
. দ্যা এডভান্স মরিশাস ২৭ সেপ্টেম্বার বলেছে ৮৫ লক্ষ।
. দ্যা ওয়েস্টার্ন মেইল ২৮ সেপ্টেম্বার বলেছে ৯০ লক্ষ
. নিউইয়র্ক টাইমস ১১ই অক্টোবর বলছে ৯০ লক্ষ।
. লস এঞ্জেলস টাইমস ১৮ই অক্টোবর বলেছে ৯০ লক্ষ।
. লা লিবর বেলজিক ১৮ অক্টোবর বলছে সংখ্যাটা ১ কোটি ছাড়িয়েছে।
. নিউজউইক ৬ ডিসেম্বর বলেছে ১ কোটি।
. টাইমস ২০ ডিসেম্বর বলেছে ১ কোটি।
একটু বিশ্লেষণী দৃষ্টি নিয়ে লক্ষ করলে দেখবেন ২৫ মার্চ অর্থাৎ যুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকেই শরণার্থীরা দেশ ত্যাগ শুরু করেন এবং সেই সংখ্যাটা মে মাসে এসে দাঁড়ায় ১৫ লক্ষ। জুনের মাঝামাঝি সংখ্যাটা হয় প্রায় ৫০ লাক্ষ যেটা আগস্টে এসে ৭০ থেকে ৭৫ লক্ষ হয়ে যায়। সেপ্টেম্বরে ৮৫ লক্ষ ছাড়িয়ে যায় এবং বাদবাকি সময়ে সংখ্যাটা ছাড়িয়ে যায় কোটির ঘর। পৃথিবীর ইতিহাসে এত কম সময়ে এত বেশী শরণার্থী হবার ঘটনা বিরল।
পৃথিবীর কোন দেশই হঠাৎ করে এক কোটি শরণার্থীকে একসাথে খাওয়াতে-পরাতে পারে না। এটা এক কথায় অসম্ভব। আর যখন এই শরণার্থীদের বড় অংশই শিশু এবং বৃদ্ধ তখন একটা অনিবার্য জিনিস ছিল মৃত্যু। এছাড়া গাদাগাদি করে থাকার কারণে মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ে কলেরা প্রাণ হারায় লাখ লাখ শিশু। মাঝখানে শীতের প্রকোপেও অনেক শিশু মৃত্যু ঘটে। এই অধ্যায়ে আমরা একটু ধারণা নেয়ার চেষ্টা করব ক্ষয়ক্ষতিয় পরিমাণ নিয়ে।
নোবেল বিজয়ী আলফ্রেড কাস্টলার লা ফিগারো, প্যারিস পত্রিকায় ৮ অক্টোবর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যাকে হিরোশিমার পারমানবিক বোমা হামলার চেয়েও ভয়াবহ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন যারা হিরোশিমা ঘটনার শিকার তারা ছিলেন ভাগবান কারণ কিছু বুঝে ওঠার আগের তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন কিন্তু পাকিস্তানের শরণার্থীদের দুর্দশা তার মতে এর চেয়েও ভয়াবহ তিনি লিখেছেন পাকিস্তানি (বাংলাদেশ) শরণার্থীদের জন্য যে তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে তা ফুরিয়ে গেছে। খাবারও রসদ সরবরাহ থেমে গেছে- এটা নিশ্চিত এখন থেকে কয়েকদিনের মধ্যে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটবে তিনি জোর দিয়ে বলেন
“এখনই যদি খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা না যায় তাহলে ৩ থেকে ৫ লাখ বা তার চেয়েও বেশী শিশু মৃত্যু বরণ করবে”
আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি সেই ট্রেজিডিতে লক্ষাধিক শিশু প্রাণ হারায়।
এরপর দেখি মালয়েশিয়ার দ্যা স্ট্রেইট টাইমস ৮ জুন লিখেছে কলেরার মহামারির কথা। সেখানে বলা হয়েছে মহামারিতে শরণার্থী শিবিরে এখন পর্যন্ত মৃত মানুষের সংখ্যা ৮ হাজার। দ্যাগব্লাতে নরওয়ে লিখেছে ৩ লক্ষাধিক শিশু তীব্র অপুষ্টিজনিত মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে। দ্যা অর্ডিন্যান্স নরওয়ে ২৭ সেপেম্বর লিখেছে শুধু ক্ষুধা ও ঠাণ্ডায় লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।
ব্রিটিশ এমপি বার্নার্ড ব্রেইন দ্যা টাইমস পত্রিকায় এক দীর্ঘ প্রতিবেদন লেখেন শরণার্থী ইস্যুতে যেটা আলোচনার দাবী রাখে;
তিনি লিখেছেন দিনের পর রাত আসবে এটা যেমন সত্য আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ না আসলে পাকিস্তানে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসবে এটাও তেমনি সত্য কথা। তিনি লিখেছেন পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে এর মধ্যে ৭৫ লক্ষ শরণার্থী ভারতে পাড়ি জমিয়েছে এবং এই সংখ্যাটা বেড়েই চলছে। খাদ্য উৎপাদনের ঘাটতি দেখিয়ে তিনি বলেন শুধু খাবারের জন্য ৩০ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারে।
শরণার্থী ইস্যুতে জাতিসংঘের টনক নাড়ানোর জন্য যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সহায়তা প্রতিষ্ঠান অক্সফোম এগিয়ে আসে। তারা প্রকাশ করে ‘টেস্টিমনি অব সিক্সটি’। ষাট জন বিশ্ব বরেণ্য মানুষের সাক্ষ্য। সাক্ষ্যদাতাদের মাঝে আছেন মাদার তেরেসা, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি। সাংবাদিক জন পিলজার, মাইকেল ব্রানসন, নিকোলাস টোমালিন, এন্থনি মাসকারেনহাস এবং আরও অনেকে।
বিরাট সেই দলিলে সাংবাদিক সানিকোলাস টেমালিনের লেখা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি;
‘যদি এই শিশুদের অতিরিক্ত প্রোটিন দেওয়া না হয়, তাহলে এরা অবশ্যই মারা যাবে। শিশুদের চার ভাগের তিন ভাগ নয় মাসের মধ্যে অবশ্যই মারা যাবে। তার মানে “দশ লাখ শিশু”।’
ষাটজনের সাক্ষ্য থেকে সিনেটর কেনিডির লেখাটি উল্লেখ যোগ্য, উল্লেখ্য সিনেটর কেনিডি বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবিরে যান। তিনি লিখেছেন;
গত তিরিশ বছরে পৃথিবী যত দুর্যোগ মোকাবেলা করেছে তার মধ্যে ভায়াবহটি হচ্ছে পাকিস্তানের সংকট। তিনি লিখেছেন সাপ্তাহের পর সাপ্তাহ গড়াচ্ছে আর মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কেউ কেউ ভারতে যাচ্ছেন আর ৯০ লাখের মধ্যে মাত্র কয়েকশ জনকে খাওয়াচ্ছেন এবং শুশ্রষা দিচ্ছেন।
কোলকাতার সল্ট লেকের শরণার্থী শিবির ঘুরে এসে তিনি জানান ওখানকার ২ লাখ ৫০ হাজার শরণার্থী মোটামুটি ভালো আছেন তারপরেও তার মতে সেখানকার শিশুদের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। বিদেশী ও ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের মতে এই অবস্থা চলতে থাকলে মোট শিশুদের তিন চতুর্থাংশ নয় মাসের মধ্যেই মারা যাবে সংখ্যাটা ১০ লাখ!
তিনি লিখেছেন ৩০ হাজার শরণার্থীর দিয়ারা ক্যাম্পের কথা যেখানে বন্যার পুরো ক্যাম্পটাই তলিয়ে যায়। সেখানকার পরিবার গুলো কাদায় ঢাকা, নিজেদের মল-মুত্র কখনোই ঠিকমত পরিস্কার করা সম্ভব হয় না। পানি ভেঙ্গে খাবার আনতে হয়, ওষুধ থেকেও তারা বঞ্চিত পুরোপুরি।
বন্যার পর আসছে শীত, এই মুহূর্তে ৯০ লক্ষ মানুষের চাই ৩০ লক্ষ কম্বল। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাপড় ও তাবু এরসাথে বাড়ছে কলেরার প্রকোপ।
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির লেখাটি থেকে খানিকটা উদ্ধৃত না করলে এই লেখা সম্পূর্ণ হবে না। আমি তার লেখা থেকে অল্প কিছু উদ্ধৃত করছি তিনি লিখেছেন
…আমি দেখেছি এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পের অবস্থার মধ্যে বায়পক পার্থক্য। কিন্তু অধিকাংশই বর্ণনা দেয়া অসম্ভব। ক্যাম্প গুলোতে শিশু এবং বৃদ্ধের সংখ্যা মোট শরণার্থীর ৫০ শতাংশ। যাদের বয়স পাঁচ থেকে কম এবং যারা বয় বৃদ্ধ তারাই সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী, এরকম বয়সের মানুষের সংখ্যাই শিবির গুলোতে বেশী, এরা মোট শরণার্থীদের পঞ্চাশ শতাংশ। এদের বেশীরভাগই মৃত্যুবরণ করছে। শরণার্থী শিবিরের মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেলে দেখে দেখে সনাক্ত করা সম্ভব এক ঘণ্টার মধ্যে কারা মারা যাবে আর কাদের ভোগান্তি চিরতরে শেষ হওয়াটা কেবল কয়েকদিনের ব্যাপার মাত্র। শিশুদের দিকে দেখুন, তাদের ছোট্র হাড় থেকে আলগা হয়ে ভাঁজে ভাঁজে ঝুলে পড়া ত্বক, এমনকি তাদের মাথা তোলার শক্তিও নেই। শিশুদের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখুন পা ও পায়ের পাতার পানি নেমে অপুষ্টিতে ফুলে আছে। তাদের মায়ের হাতও নিস্তেজ। ভিটামিনের অভাবে তারা অন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাদের মায়ের হাতও নিস্তেজ। আর সবচেয়ে সবচেয়ে বেশী কঠিন দৃশ্য, গতরাতে যে শিশুটি মারা গেছে, তার মৃতদেহও এখানেই।
… আমি যখন একজন শরণার্থী শিবিরের পরিচালককে জিজ্ঞাসা করলাম তার সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজনটি কি। জবাব এল “একটি শব-চুল্লি” পৃথিবীর অন্যতম বৃহত একটি ক্যাম্পের তিনি পরিচালক”
সবশেষে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মাদার তেরেসার সাক্ষ্য থেকে খানিকটা তুলে ধরছি।
তিনি বলেছেন আমরা যেখানেই থাকিনা কেন অনুধাবন করার চেষ্টা করি আমাদের লাখ লাখ শিশু অপুষ্টি ও ক্ষুধার জ্বালায় ভুগছে, পৃথিবী যদি এগিয়ে না আসে তাহলে এই শিশুরা মৃত্যুবরণ করবে। আমি ৫-৬ মাস ধরে শরণার্থীদের মাঝে কাজ করছি আমি এই শিশু আর প্রাপ্তবয়স্কদের মরতে দেখেছি।
এবারে আসুন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টটি নিয়ে। আর সেই ডকুমেন্ট নিয়ে আমার আগেই দুইজন যোগ্য মানুষ কাজ করেছেন তাদের একজন কুলদা রায় আরেকজন কিংবদন্তী তুল্য মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এম এম আর জালাল
জেনোসাইড নামের একটা বই আছে যার লেখক প্রখ্যাত গনহত্যা গবেষক লিও কুপার। বইটির প্রচ্ছদ করা হয়েছে কিছু সংখ্যা দিয়ে। লেখা হয়েছে—১৯১৫ : ৮০০,০০০ আর্মেনিয়ান। ১৯৩৩-৪৫ : ৬০ লক্ষ ইহুদী। ১৯৭১ : ৩০ লক্ষ বাংলাদেশী। ১৯৭২-৭৫ : ১০০,০০০ হুটু। নিচে লাল কালিতে বড় করে লেখা জেনোসাইড। এই অংকের মানুষ গণহত্যার শিকার। এই আট লক্ষ, ৬০ লক্ষ, ৩০ লক্ষ, এক লক্ষ সংখ্যাগুলো এক একটি প্রতীক। গণহত্যার প্রতীক। ক্যালক্যালেটর টিপে টিপে হুবহু মিলিয়ে দেয়া পূর্ণ সংখ্যার হিসেব এখানে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে পরিকল্পিত গণহত্যার মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাসের প্রতীক। জেনোসাইড বইটি নিয়ে অসাধারন একটি প্রবন্ধ লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এম এম আর জালাল এবং কুলদা রায়। তাদের প্রবন্ধ থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ তুলে ধরছি;
১৯৭১ সালে জুন মাসে লাইফ ম্যাগাজিনের সাংবাদিক জন সার কোলকাতায় এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ফটোগ্রাফার মার্ক গডফেরি। তাঁরা দুজনে একটি গাড়িতে করে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন শরণার্থীদের চিত্র।
সময়টা জুন মাসের মাঝামাঝি। জন সার গিয়েছেন করিমপুরে। বৈষ্ণব ভক্তিবাদের প্রবক্তা চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের এই গ্রামটি পাকিস্তান সীমান্ত থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে। এখানে রাস্তা দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর গণহত্যার শিকার হয়ে এরা হারিয়েছেন এদের স্বজন, গবাদিপশু, ঘরবাড়ি, সহায়সম্পদ। ধারাবাহিক মৃত্যুর তাড়া খেয়ে এইসব ভয়ার্ত মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে জন্য ভারতে ছুটে আসছে। সরাসরি গুলির হাত থেকে ঈশ্বরের দয়ায় এরা বেঁচে এসেছে। কিন্তু নতুন করে পড়েছে নতুন নতুন মৃত্যুর ফাঁদে। এদের পিছনে মৃত্যু। সামনে মৃত্যু। বায়ে মৃত্যু। ডানে মৃত্যু। সর্বত্রই মৃত্যুর ভয়ঙ্কর থাবা এদের তাড়া করে ফিরছে।
সাংবাদিক জন সার করিমপুরের রাস্তায় দেখতে পেলেন অসীম দৈর্ঘের লম্বা শরণার্থী মানুষের মিছিল। তাদের কারো কারো মুখে রুমাল গোজা। একটা লোকের কাছে তিনি গেলেন। কোনোভাবে রুমালটি মুখ থেকে সরিয়ে লোকটি শুধু বলতে পারলেন, কলেরা। কলেরা। আর কিছু বলার নেই। পিছনে পাক সেনাদের গুলি। আর সঙ্গে কলেরা। সামনে অন্ধকার। কোথায় চলেছে তারা—কেউ জানে না। মৃত্যুকে সঙ্গী করে তবু তারা এগিয়ে চলেছে।
করিমপুরের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে কোলকাতা বরাবর, তার বামদিকে শরণার্থী শিবির। এখানে আশ্রয় নিয়েছে ১৫০০০ মানুষ। এই শরণার্থী শিবিরে কলেরা নির্মমভাবে হানা দিয়েছে। ৭০০ জন ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে। বাকীরা শিবির ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পালাবে কোথায়? কলেরাও তাদের সঙ্গে চলেছে। খোলা জায়গায় পড়ে আছে মরা মানুষ।
জন সার দেখতে পাচ্ছেন–
ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন নেমে এসেছে। তীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে ছিড়ে খুড়ে খাচ্ছে মরা মানুষের দেহ। তাদের চোখ চক চক করছে। কিন্তু মৃত মানুষের সংখ্যা এত বেশী যে শকুনের খেয়ে শেষ করতে পারছে না। শকুনদেরও খাওয়ায় অরুচি এসে গেছে। মরা মানুষের গা থেকে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলেছে জামা কাপড়। তাদের অনেকের তখনো গা গরম। সবেমাত্র মরেছে। পথে ঘাটে নালা নর্দমায়—সর্বত্রই কলেরায় মরা মানুষ পড়ে আছে। জন সার দেখতে পেয়েছেন একটি শিশুর মৃতদেহ। শিশুটির গায়ে একটি শাড়ির অংশ পেঁচানো। তাঁর হতভাগী মা পেঁচিয়ে পুটুলি বানিয়েছে। ট্রাকের চলার সময় অসুস্থ শিশুটি মারা গেছে। চলন্ত ট্রাক থামেনি। মৃত ছেলের জন্য ট্রাক থামানো কোনো মানেই হয় না। আরও অনেক মৃতপ্রায় মানুষ এই ট্রাকেই ধুঁকছে। আগে পৌঁছাতে পারলে হয়তো কোনো হাসপাতাল পাওয়া যেতে পারে। তাদের সুযোগ মিলতে পারে চিকিৎসার। বেঁচেও যেতে পারে। এই আশায় সময় নষ্ট করতে কেউ চায় না। শিশুটির পুটুলী করা মৃতদেহটিকে ট্রাক থেকে রাস্তার পাশে ধান ক্ষেতে ছুড়ে ফেলা দেওয়া হয়েছে।
একটি ওয়ান ডেকার বাসের ছবি তুলেছে জন সারের সঙ্গী ফটোগ্রাফার মার্ক গডফেরি। বাসটির হাতল ধরে ঝুলছে কয়েকজন হতভাগ্য লোক। আর ছাঁদে বসে আছে–সব মিলিয়ে জনা সত্তর জন। কেউ কেউ বমি করছে। কারো কারো মুখে রুমাল চাপা। কেউ কেউ রুমালের অভাবে হাতচাপা দিয়েছে। ছাঁদের মানুষের বমি জানালা দিয়ে বাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আর বাসের মধ্যের বমি জানালা দিয়ে বাইরে ছিটকে পড়ছে। পথে। ঘাটে। মাঠে। খালে। জলাশয়ে। হাটন্ত মানুষের গায়ে। বমির সঙ্গে জীবনবিনাশী কলেরার জীবাণু। এইসব হতভাগ্য মানুষের চোখ গর্তের মধ্যে ঢোকানো। আর তার মধ্যে জ্বল জ্বল আতঙ্ক। বাসভর্তি করে কলেরা চলেছে। বাইরে পড়ে আছে একটি মৃতদেহ।
‘এই সব মানুষ এত বেশী সংখ্যায় মরেছে যে আমরা গুণতে পারিনি। গোণা সম্ভব নয়।‘ একজন স্বেচ্ছাসেবক সাংবাদিক জন সারকে বলছেন, এরা জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে। তারা চলছে তো চলছেই। তীব্র রোদে হাঁটতে হাঁটতে তারা ক্লান্ত—অবসন্ন। তৃষ্ণার্ত হয়ে পথের পাশ থেকে আঁজলা ভরে কলেরাদুষ্ট পানি পান করছে। তারা এত দুর্বল হয়ে পড়ছে যে, আক্রান্ত হওয়ার পর একদিনও টিকতে পারছে না। মৃত্যুর কোলো ঢলে পড়ছে।
তিনি লিখেছেন, কাঁটাখালি গ্রামে রাস্তার পাশ থেকে হৈঁচৈ করে একটি ট্রাক থামাতে চেষ্টা করছে একদল শরণার্থী। তারা করুণ স্বরে আবেদন করছে ট্রাকচালককে তাদেরকে ট্রাকে তুলে নিতে। তাদের মধ্যে যারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে তারা রাস্তার পাশে মাটির উপরে শুয়ে আছে। তাদের পরিবার পরিবার অসহায় হয়ে চেয়ে। তাদের হেঁটে যাওয়ার শক্তি নেই। যাদের সঙ্গে কিছু টাকা পয়সা আছে তারা কোনোমতে ট্রাকে উঠে পড়েছে। ট্রাকে করে তারা কৃষ্ণ নগর হাসপাতালে যেতে পারবে। সেখানে চিকিৎসা পাওয়ার চেষ্টা করবে।
করিমপুরের আশেপাশে গ্রামগুলোতে কোনো ডাক্তার নেই। কলেরা ভ্যাক্সিন নেই। নেই কোনো প্রতিষেধক অষুদপত্র। কাছাকাছি কৃষ্ণনগরে একটি হাসপাতাল আছে। হাসপাতালের উদ্দেশ্যে অসুস্থ মানুষ চলেছে মানুষের কাঁধে চড়ে। ঝোড়ায় করে। কেউবা বা বাঁশের তৈরি টেম্পোরারী স্টেচারে করে। গরুর গাড়িতে। কেউবা রিকশায়।
কৃষ্ণ নগর হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা নেই। যারা হাসপাতালে এর মধ্যে এসে পড়েছে—তখনো বেঁচে আছে, তাদের রাখা হয়েছে বাইরে খোলা মাঠে। যাদের চিকিৎসা শুরু হয়েছে তাদের রাখা হয়েছে অস্থায়ী ছাউনিতে। বাঁশের কাঠামোতে কাপড় বসিয়ে ছোটো ছোটো শিবির করে চাউনি তৈরি হয়েছে।
সেখানে কিছু কিছু মানুষ বেঁচে থাকার জন্য মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তাঁদের চোখ গর্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। অর্ধচেতন বা অচেতন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পড়ে আছে। তাদের মুখে মাছি পড়ছে। মশা ঘুরছে। অনন্তবিদারী দুর্গন্ধ। স্বজনদের কেউ কেউ হাত দিয়ে, তালে পাখা দিয়ে বা কাপড়ের আঁচল দিয়ে মাছি তাড়ানোর চেষ্টা করছে। সাদা এপ্রোন পরা নার্সরা তাদের শিরায় ঢোকানোর চেষ্টা করছে সেলাইন। তাদের চেষ্টার কমতি নেই। কিন্তু নার্সের বা ডাক্তারের সংখ্যা হাতে গোণা। অপ্রতুল।
এই হতভাগ্যদের অর্ধেকই শিশু। সাংবাদিক জন সার একটি সাত বছরের ফুটফুটে মেয়ে শিশুকে তুলে এনেছে রাস্তা থেকে। তার চোখ বড় করে খোলা। তার হাত ঝুলে পড়েছে। নার্স এক পলক দেখেই বলছে, সব শেষ। কিছু করার নেই। মেয়েটি মরে গেছে। একজন ক্লান্ত ডাক্তার বলছেন, এর চেয়ে কুকুর-বেড়ালেরাও ভালো করে মরে। কিছুটা হলেও তারা চেষ্টা তদ্বির পায়। আর এই শরণার্থী মানুষদের কলে পড়া ইঁদুরের মত মরা ছাড়া কপালে আর কিছু লেখা নেই।
এতক্ষন তো দেখলেন বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে মৃত্যুর আশংকা নিয়ে অনেক অনেক লেখা, কিন্তু আদতে ঠিক কত মানুষ মারা গিয়েছিলো শরণার্থী শিবিরে সেটা আমাদের জানা নেই। আর জানা সম্ভব হবে কি না তাও জানি না। তবুও একটু রিসার্চের রাস্তা ধরে আইডিয়া করা যায় সংখ্যাটা।
The Lancet কে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে পুরনো মেডিকেল জার্নাল। এটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক মেডিকেল জার্নালও বলা হয়ে থাকে। তাদের রিসার্চ জার্নালে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়েও সচেতনতা তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিবির নিয়ে একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে তারা তাদের একটি জার্নালে
তাদের ভাষ্য কোলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপকে নিয়ে, যারা একাত্তরের জুনের শেষ থেকে বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারি শুরু পর্যন্ত পাঁচ মাস চালু থাকা একটা রিফিউজি ক্যাম্পের ওপর সার্ভে চালায়। এবং তাদের সার্ভেটি খুবই বিশ্বাসযোগ্য কারণ সেইসব ডাটা প্রত্যেকটি ঘর থেকে আলাদা আলাদা ভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই সার্ভের উদ্দেশ্য ছিলো ক্যাম্পের জনসংখ্যা, সেখানকার মানুষের বয়সের ধরণ আর মৃত্যুহার নিয়ে।
তাদের ভাষ্য মতে ১,৭০,০০০ শরণার্থীর ঐ ক্যাম্পে কম করে হলেও ৪০০০ মানুষ মারা যায়। তারা বলেছে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশী হতে পারে, স্বাভাবিক মৃত্যুকে তারা বিবেচনা করেনি এবং নিহতদের বড় অংশই ছিলো শিশু। এই প্রবন্ধে আরো তথ্য আছে তবে আমার দরকার এটুকুই।
আমাদের কাছে যে ডাটা আছে সেটা থেকে আমরা আগেই দেখছি জুনের আগে থেকেই প্রচুর শরণার্থী ভারতে পাড়ি জমায়। টাইম পত্রিকার ২৪ মে ৭১ সংখ্যা থেকে জানা যায় শরণার্থীর সংখ্যা তখন ছিলো ১৫ লক্ষ এরপর একই পত্রিকার ১৩ জুন ৭১ সংখ্যা অনুসারে সেটা বেড়ে দাড়ায় পঞ্চাশ লাখে। সানডে টাইমস ২১ জুন ৭১ লিখেছে শরণার্থীর সংখ্যা ৬০ লাখ, ইকনোমিস্ট লিখেছে ২৬ জুন তারিখে যে শরণার্থীর সংখ্যা ততদিনে ৬০ লাখ ছাড়িয়েছে।
এখানে দেখালাম সেই শরণার্থী শিবির খোলার আগেই প্রচুর মানুষ দেশ ছেড়েছেন এবং তাদের অনেকে অবশ্যই মারা গিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত নিউজ উইকের ৬ ডিসেম্বর ৭১ থেকে জানা যায় শরণার্থীর সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়েছে।
আমার পড়ালেখায় যতটুকু জানি ভারতের শরণার্থী শিবিরের মধ্যে কোলকাতার শিবিরগুলোই মোটামুটি ভালো বলে বিবেচিত হয়, অন্য অনেক শরণার্থী শিবিরের অবস্থা ছিলো অনেক ভয়াবহ, ছিলো না নূন্যতম খাদ্য আর চিকিৎসা সেবা, সুতরাং সেসব শিবিরে মৃত্যুহার হওয়ার কথা আরও ভয়ঙ্কর রকম বেশী, কিছু কাম্পে কলেরার প্রকোপের কথাও আমরা শুনেছি। বন্যা, শীত এসব তো বাদই দিলাম।
তবুও অনেক কমিয়ে এই সংখ্যাটাকেই ধ্রুব ধরে যদি শরণার্থী শিবিরে নিহত মানুষদের সংখ্যাটা কত হতে পারে সে নিয়ে ধারনা করতে চাই তাহলে হিসাবটা দাঁড়ায় অনেকটা এরকমঃ
১,৭০,০০০ মানুষের মধ্যে কমপক্ষে মৃতঃ ৪,০০০
তাহলে; এক কোটি মানুষের মাঝে পাঁচ মাসে ন্যূনতম নিহতের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ।
ষাট লাখ জনগোষ্ঠী দেশ ছাড়ার পর এই হিসাব করা হয়েছে। পুরো হিসাবটা আরও ভয়াবহ, হয়ত এই সংখ্যাটার দ্বিগুণ কিংবা তিনগুন। কারণ বলা হয়েছে এটা পাঁচ মাসের হিসাব আর ক্যাম্পটা কোলকাতার সেরা ক্যাম্প যেখানে ছিলো পর্যাপ্ত ডাক্তার, খাদ্য আর থাকার জায়গা
আর জন সারের হিসাবে ১৫০০০ মানুষের মাঝে মৃতঃ ৭০০
তাহলে; এক কোটি মানুষের জন্য হিসাবটা হয় প্রায় পাঁচ লাখ
এখানে আমরা দেখেছি এটা জুন মাসের হিসাব। যদি ধরেও নেই এই শিবিরটা প্রথম থেকেই ছিলো অর্থাৎ মার্চ শেষ দিক থেকে। তাহলে মাত্র তিন মাসের মৃত্যুর হার এটা। এই ক্যাম্প যদি ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ি হয়ে থাকে তাহলে সম্ভবত আপনারা সংখ্যাটা আঁচ করতে পারছেন
আমার ব্যাক্তিগত অভিমত মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিবিরে নিহত মানুষের সংখ্যা কম করে হলেও সাত থেকে থেকে নয় লক্ষ। আর যদি সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েও হিসাব করি কোনক্রমেই পাঁচ লাখের কম হবে না।
আজকের দিনে যারা পুরো যুদ্ধেই মৃতের সংখ্যা দুই কিংবা তিন লাখ দাবী করে তাদের আসলে জানা উচিত শরণার্থী শিবিরে মৃত মানুষ গুলোর কথা। এদের শহীদের মর্যাদা দেয়া হবে কি না আমি জানি না কিন্তু এদের মৃত্যুর কারণ সেই একটাই ‘পাকিস্তান’।
আশা করি সামনের দিন গুলোতে শরণার্থীদের নিয়ে আরও অনেক কাজ হবে, আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ অংশটির চিত্র ফুটে উঠবে আরও পরিস্কার হয়ে।
তথ্যসুত্রঃ
১) বাংলাদেশ জেনোসাইড এন্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস
২) বিদেশীর চোখে ১৯৭১
৩) জেনসাইডঃ লিও কুপার
৪) গনহত্যার অন্য অধ্যায়ঃ এম এম আর জালাল, কুলদা রায়
৫) genocidebangladesh.org
৬) The Lancet অফিসিয়াল ওয়েবসাইট
৭) উইকিপিডিয়া
😥 অনেক সুন্দর লেখছেন স্যার। আপনাকে ধন্যবাদ
ভাল গবেষনামূলক প্রবন্ধ।
এরকম একটি তথ্য বহুল কাজ সত্যি প্রসংশাযোগ্য। আশা করছি মানুষের নজর কাড়বে লেখাটি… :line:
আরিফ রহমান, আপনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আমরা অবশ্যই ঋণী থাকবো আপনার প্রতি।
কয়েকটি তথ্য এখানে যোগ করতে চাই-
১। ১২ জুলাই বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, সমগ্র বাংলাদেশে মোট ৩ কোটি মানুষ গৃহহীন।
২। দিল্লীতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান সাহাবুদ্দিন বলেছেন- খুন, অঙ্গহানী, ধর্ষণ, নিগ্রহ সব মিলিয়ে ৯ মাসের বর্বর শাসনে বাংলাদেশে মোট ৭ লক্ষ নারীর জীবন নষ্ট হয়েছে।
৩। কোথাও কোথাও যেমন মেঘালয়ে কিংবা দিনাজপুরে শিবিরবাসীর সংখ্যা স্থানীয় জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায়।
৪। কোটি মানুষের ক্ষুধা মেটাতে গেলে রোজ কোটির অধিক টাকা চাই।
৫। ৮২,০২৬ তাঁবু আর ২৪ হাজার ত্রিপল সংগ্রহ করা হয়েছিল আশ্রয় গড়ার জন্য।
৬। খবরের কাগজ, ডাকটিকিট, রেভিনিউ স্ট্যাম্প, সিনেমার টিকিট এসবের উপর অর্ডিন্যান্স করে সারচার্জ বসানো হয়েছিল।
৭। জারজ ইয়াহিয়া প্রথমে বলেছিল, ওরা কলকাতার ফুটপাতবাসী। ভারত বানিয়ে বানিয়ে শরণার্থী আনিয়েছে। শেষে কবুল করেছিল, হ্যাঁ, বিশ লাখের মত মানুষ ভারতের প্ররোচনায় দেশ ছেড়ে চলে গেছে।
৮। ‘কাসা’, ‘রামকৃষ্ণ মিশন’, ‘অক্সফাম’, ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ’, কলকাতার মেডিকেলের ছাত্র-চিকিৎসক, ফার্মাসিউটিক্যালসহ দেশী-বিদেশী অনেক সেবাপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছিল।
৯। ভারত সরকার হিসেব করে বলেছিল, শরণার্থীদের সবাইকে মার্চ নাগাদ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো পর্যন্ত ব্যয় দাঁড়াবে ৩৭২ কোটি টাকা।
১০। ভ্যাটিকানসহ ১৭টি দেশ নগদ ও ত্রাণদ্রব্যসহ ৭২ কোটি টাকার সাহায্য দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু পরে হিসেব করে দেখা গেছে, ঐ প্রতিশ্রুতির মাত্র ৩৮ ভাগ অর্থাৎ ২৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকার মত সাহায্য পাওয়া গেছে। এই টাকায় শরণার্থীদের মোট ১০ দিন খাওয়ানো সম্ভব হয়েছে। প্রতিশ্রুতির ঘোষণা যেভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, প্রতিশ্রুতি রক্ষার এই বিপুল পার্থক্যের কথা খুব সামান্যই প্রকাশিত হয়েছে।
১১। আগস্টের গোড়ায় সিনেটর কেনেডির সঙ্গে শরণার্থী শিবিরে আসা পুষ্টি বিশেষজ্ঞের হিসেবে দিনে কয়েক হাজার শিশুমৃত্যুর কথা।
সূত্র-গ্রন্থ: বাংলা নামে দেশ
চমৎকার তথ্যবহুল একটি লেখা। আমরা এক নির্লজ্জ অকৃতজ্ঞ জাতি।
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু / নিভাইছে তব আলো
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছো / তুমি কি বেসেছো ভাল?
এ লজ্জা, এ কষ্ট কোনদিন ভুলার নয়-
httpv://www.youtube.com/watch?v=j7w3OztQaxA
httpv://www.youtube.com/watch?v=qfryIrKdXGU
দুর্দান্ত একটি কাজ করেছেন দাদা। খুবই তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা।এ বিষয়ে এতোটা তথ্যসমৃদ্ধ লেখা আমি এর আগে পড়িনি।অশেষ ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
সার , কি আর বলবো? এটি সত্তিই বহুল খবর ও দুর্লোভ চিত্র সমৃদ্ধ একটি অসাধরন লেখা। অনেক করে কিছু জানার আছে। অসংখ ধন্নবাদ আপনাকে । ভালো থাকবেন।
অসাধারণ
অসাধারণ! অসাধারণ!
কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয় এই অতি অতি প্রয়োজনীয় লেখাটির !