মুখবন্ধঃ লেখাটির রচনাকাল ফেব্রুয়ারী, ২০১৪। বিজ্ঞানের চলমান ঘটনার প্রেক্ষিতে এর বিষয়বস্তু কিছুটা পুরনো হলেও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এবং এর আবেদন এখনো ফুরয়নি। বিজ্ঞান ও মহাকাশবিজ্ঞানে আগ্রহী পাঠকগণের কথা বিবেচনা করে লেখাটি মুক্তমনায় উপস্থাপন করা হল।
—————-

জানুয়ারি ২০, ২০১৪, স্থানীয় সময় সকাল ১১:০০ টা। জার্মানির ডার্মস্টাডট এ ইউরোপিয়ান মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, এসার [১] কন্ট্রোল সেন্টারে বসে গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। কম্পিউটারে চোখ বুলিয়ে দেখছেন কোন তরঙ্গ ভেসে আসছে কি না। যে কোন মূহুর্তে জানান দেবে ঘুম থেকে জেগে ওঠা রোজেটা।

দীর্ঘ ৩১ মাস ঘুমিয়ে আছে সে অসীম মহাকাশের কোলে, পৃথিবী থেকে ৮০০ মিলিয়ন কি.মি. দূরে। এই দীর্ঘ সময়ে কী ধরনের প্রতিকূলতার মাঝে সে আছে তা জানার উপায় নেই বিজ্ঞানীদের। তাই, দুশ্চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো কন্ট্রোল রুমে বসে থাকা কারো কারো মনে। অস্থির হয়ে ভাবছিলেন কেউ, এমন কি হতে পারে, এই লম্বা মহাকাশ ভ্রমনে কোন এক অজানা কারণে তাঁর নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা ঠিকমত কাজ করছে না কিংবা প্রচণ্ড বেগে ছুটতে থাকা মহাকাশ- ধূলিকণা তাঁর দেহকে অক্ষত রাখেনি?

সময় বয়ে যাচ্ছে, ১১:০৫, ১১:১০। অপেক্ষার পালা যেন আর শেষ হয়না। তারপর ঠিক ১১:১৭ মিনিটে কন্ট্রোল রুমের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে মনিটরে ফুটে উঠল হিজিবিজি কিছু রেখা, তার সাথে যুক্ত হলো ক্ষীণ শব্দ, বীপ বীপ। গহীন মহাকাশ থেকে রোজেটার ছোট্ট বার্তা, “Hello World!”।

সাথে সাথে আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল সারাটা কক্ষে। রোজেটা-মিশন বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ লাফিয়ে উঠলেন শিশুর মত, জড়িয়ে ধরলেন একে অপরকে। “ঘুমন্ত রাজকন্যা” চোখ মেলেছে কোন সমস্যা ছাড়াই। তার মানে, একমাত্র জেগে থাকা কম্পিউটারটি আপনা-আপনি সচল হয়েছে এবং যথাসময়ে “বার্তা” পাঠিয়েছে। কম্পিউটার ছাড়া অন্যান্য যন্ত্রপাতি এখনও ঘুমিয়ে। পুরো ঘুম ভাঙ্গতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে রোজেটার।

আসুন, এই ফাঁকে জেনে নেই “রোজেটা মিশন” সম্পর্কে, জেনে নেই এর বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য।

১৯৯৩ সালের কথা। এসা’র বিজ্ঞানীরা একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন। গহীন মহাকাশে বিচরণরত ছুটন্ত ধূমকেতুর বুক চিরে দেখতে চান সেটি কী কী পদার্থ দিয়ে তৈরী, পদার্থের পারমানবিক গঠন কী, কীই বা তাদের ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ। তাঁরা জানতে চান, পৃথিবীতে আমরা যে সব মৌল বা যৌগ চিনি তাঁদের সাথে কি ধূমকেতুর পদার্থের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে, নাকি কোন নতুন রাসায়নিক উপাদানের সন্ধান মিলবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা কেন এসব অনুসন্ধান করতে চান?

এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের এই পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি কিভাবে হল সেটা আজ অবধি অজানা। এ ব্যাপারে বেশ কিছু মতবাদ চালু আছে। কারো কারো মতে এটা একটা সম্ভাবনা যে, আমাদের এই পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির জন্য যে অনুকুল পরিবেশ প্রয়োজন সেটা তৈরি হয়েছে অজানা কোন এক প্রভাবকের কারণে, যেটা এই পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে আন্তঃনক্ষত্রীয় কোন ধূমকেতুর সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষের মাধ্যমে।

কিছু বিজ্ঞানী আবার ভাবছেন, এমনটা হতে পারে যে, পৃথিবীতে প্রথম জৈব অনু এসেছে কোন ধূমকেতু হতে যেটা কোন এক অতীতে পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছিল। তারপর, পৃথিবীর অনুকূল পরিবেশে সেই জৈব অনু ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা প্রমান পেয়েছেন যে, ধূমকেতু বহন করে গ্লাইসিন, যেটা একটি আমিনো-এসিড, যা কিনা প্রান সৃষ্টির একটি অত্যাবশকীয় উপাদান [২]।

ধূমকেতুই যদি পৃথিবীতে প্রাণ বহন করে থাকে, তাহলে আবার এও হতে পারে যে, সেই আছড়ে পড়া ধূমকেতুর জন্ম আসলে অন্য সৌরজগতে। কিন্তু সে তাঁর কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ে চলে এসেছে আমাদের সৌরজগতে এবং সাথে বয়ে এনেছে কোন জৈব অনু যার উৎপত্তি হয়েছে তাঁর ফেলে আসা সৌরজগতে। এর মানে, আমরা যে জৈব কোষ দিয়ে গঠিত তাঁর আদি পিতা হতে পারে আমাদের সৌরজগতের কেউ নয়।

এই মতবাদগুলোকে কেউ কেউ অলীক কল্পনার ফসল বলে আখ্যায়িত করতে পারে। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই কল্পনার মাঝেই লুকিয়ে থাকতে পারে এক অজানা সত্য। কাজেই, কল্পনা হোক আর অবাস্তব হোক, এই সম্ভাবনাকে এখনই নাকচ করে দিচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানীদের কিছু প্রশ্ন আছে যেটা সৌরজগতের গঠন সম্পর্কিত। মহা-বিস্ফোরণ তত্ত্ব কিংবা মহাকাশ-স্ফীতি তত্ত্ব অনুসরণ করে সৌরজগতের উৎপত্তি ও প্রসারণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সৌরজগতের উৎপত্তির পর কিভাবে ছুটন্ত পদার্থ কণাসমূহ একত্রিত ও ঘনীভূত হয়ে গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি করে, কিছু তত্ত্ব আবার সেটা ব্যাখ্যা করে (যেমন, নেবুলা তত্ত্ব)। কিন্তু, সত্যিকার অর্থে এখনো পর্যন্ত সৌরজগত ও তাঁর অন্তর্গত বস্তুসমূহের উৎপত্তি, বিকাশ ও বিবর্তন পুরপুরি বোঝা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সৌরজগতের উৎপত্তি ও বিবর্তন সম্পর্কে আরো ভালভাবে জানতে হলে পরীক্ষা করতে হবে সৌরজগতের কোন প্রাথমিক বস্তুকে, যেটা সৌরজগতের উৎপত্তির ইতিহাস বহন করে চলছে। ধরে নেয়া হয়, ধূমকেতু সৌরজগতের আদিতে সৃষ্টি হয়েছে, যেটা গঠিত এমন সব মৌল ও যৌগের সমন্বয়ে, যাদের গুনাবলীর মাঝে লুকিয়ে আছে সৌরজগত গঠিত হওয়ার পথচিহ্ন।

এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে বিজ্ঞানীরা চান কোন এক ধূমকেতুর কেন্দ্রে কি আছে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে। মানব জন্মের ইতিহাসে এ জাতীয় পরীক্ষা আজ অবধি করা হয়নি। আসলে, ধূমকেতুর চারিপাশের বিরূপ পরিবেশ ভেদ করে আদৌ ধূমকেতু-কেন্দ্রে পৌঁছা যাবে কিনা সেটাও এক প্রশ্ন। তারপরও এ জাতীয় গবেষণার বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য বিবেচনা করে হাতে নেয়া হল এক মহাকাশ অভিযানের প্রকল্প, যেখানে একটি ধূমকেতু-কেন্দ্রে প্রাপ্ত জৈব ও রাসায়নিক উপাদানগুলোকে ব্যবচ্ছেদ করা হবে। ঠিক করা হল, একটা পরীক্ষা-যন্ত্র পাঠানো হবে আমাদের এই সৌরজগতে বিচরিত কোন ধুমকেতুতে। আর এভাবেই শুরু হল এক মহাকাশ অভিযানের গল্প [৩]।

এই গবেষণার জন্য ধূমকেতু ৬৭পি/সিজি৪ (চুরিমভ-জেরাসিমেংকো) কে বেছে নেওয়া হল। কারন, এই ধূমকেতুর বেশ কিছু প্রাথমিক তথ্য জানা আছে বিজ্ঞানীদের, যেমন এর আকৃতি রাগবী বলের মত (ছবি ১)এবং এর গতিপথ নির্দিষ্ট, যেটা বৃহস্পতি ও মঙ্গলের কক্ষপথকে আড়াআড়ি অনুসরণ করে বক্রপথে চলছে এবং সূর্য, পৃথিবী ও মঙ্গল এর চারিদিকে ঘুরছে।

01Komet-Totale2

ছবি ১. ধুমকেতু ৬৭পি/সিজি এর কম্পিউটার অনুকরন, সুত্রঃ ডিএলআর [৫]

দুর্বার গতিতে ছুটে চলা (গতিবেগ ঘন্টায় ১ লক্ষ কি.মি. এর অধিক) একটা ধূমকেতুকে ধাওয়া করে তাঁর পিঠে অবতরণ করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রথমেই ধূমকেতুকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করা হল বিভিন্ন ভাবেঃ হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে ছবি তুলে সেগুলি বিশ্লেষণ করা হল, ধুমকেতুটির চারপাশের ধূলিকণার বলয়, বৈদ্যুতিক ও চৌম্বক ক্ষেত্র গুলি পরীক্ষা করা হল, গানিতিক মডেল তৈরী করে কম্পিউটারে অনুকরণ করা হল এবং একটা পথ-মানচিত্র চূড়ান্ত করা হল।

তারপর একটা কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরী করে বিভিন্ন অত্যাধুনিক পরীক্ষা-যন্ত্র সন্নিবেশ করা হল। নাম দেওয়া হল এর “রোজেটা”, মিশরীয় যুগের এক প্রাচীন শিলালিপি সমৃদ্ধ পাথরের নামানুসারে। রোজেটা পাথরে লিপিবদ্ধ হায়রোগ্লিফিক্স কিংবা গ্রীক মুদ্রন পাঠোদ্ধার করে আমারা যেমন এক প্রাচীন মানব সভ্যতার ধারনা পেয়েছিলাম, ঠিক তেমনি এই রোজেটা পরীক্ষা-যন্ত্র আমদের উম্মোচিত করবে সৌরজগতের জন্মবৃত্তান্ত কিংবা প্রানের উৎপত্তির অজানা তথ্য, এমনটি বিজ্ঞানীদের আশা।

রোজেটা তৈরীতে এসা’র সাথে কাজ করলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা। দুটি প্রধান অংশ এতে, একটি হল “রোজেটা অরবিটার”, যেটা কিনা ধূমকেতু ৬৭পি/সিজি এর চারপাশে প্রদক্ষিণ করে ধূমকেতুর আবহমন্ডল এবং উপরিপৃষ্ঠ পরীক্ষা করবে (ছবি ২), আরেকটি হল “ফিলেই ল্যান্ডার”, যেটা ধূমকেতুর পৃষ্ঠে অবতরণ করে নমুনা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করবে (ছবি ৩)। পদার্থের ভৌত ও রাসায়নিক গুনাবলী নির্ণয়ে যে সব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি প্রয়োজন, তাঁর প্রায় সবই ফিলেই ল্যান্ডারে আছে। আর আছে অত্যাধুনিক কম্পিউটার, যা কিনা নিয়ন্ত্রণ করবে এই যন্ত্রগুলির কর্মপদ্ধতি এবং সমন্বয় করবে বিভিন্ন কর্মপদ্ধতির মধ্যে।

রোজেটা অরবিটার’এ বিশাল দুই বাহু জুড়ে সৌর বিদ্যুৎ কোষ লাগানো হল সুর্য থেকে আলো সংগ্রহ করার জন্য। রোজেটার যন্ত্রগুলি সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করে চালু থাকবে। মহাকাশে ভ্রমণরত রোজেটার সাথে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করা হবে নাসা’র ৭০ মিটার ব্যাস বিশিষ্ট ডীপ-স্পেসস্টেশন এন্টেনা।

ছবি ২. রোজেটা অরবিটার, সুত্রঃ ডিএলআর [৫]

03artikel_vorbeiflug3

ছবি ৩. ফিলেই ল্যান্ডার, সুত্রঃ ডিএলআর [৫]

তারপর নির্ণয় করা হল রোজেটার যাত্রাপথ ও নির্ধারণ করা হল সময়-রেখাঃ কোথায়, কবে এবং কিভাবে রোজেটাকে পরিচালনা করা হবে। প্রস্তুতি পর্বে সময় লাগলো প্রায় দশ বছর। ঠিক করা হল, মার্চ ২০০৪ এ রোজেটা উৎক্ষেপ করা হবে ফ্রেঞ্চ গানা’য় (দক্ষিন আমেরিকা) অবস্থিত এসা’র মহাকাশ বন্দর থেকে। গণনা করে বের করা হল ২০১৪ তে রোজেটা মিলিত হবে ধূমকেতু ৬৭পি/সিজি এর সাথে। ২০১৫ তে মিশন শেষ হবে। তারপরের বছর গুলোতে চলবে তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করা। পুরো মিশনে রোজেটা ১১ বছরের অধিক সময় মহাকাশে বিচরণ করবে এবং পাড়ি দেবে প্রায় ৭ বিলিওন কি.মি.।

কয়েকটি কারণে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে এই মিশন হয়ে উঠল অসম্ভবকে সম্ভব করার গল্প। প্রথমত, পৃথিবী থেকে এত দুরের কোন বস্তুকে লক্ষ্য করে অতীতে কখনও কোন কৃত্রিম উপগ্রহ নিক্ষেপ করা হয়নি যেটা একটি দীর্ঘ এবং নিয়ন্ত্রিত কক্ষপথ তৈরি করে ভ্রমণ করে এবং যে কক্ষপথের বিস্তৃতি বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথ পর্যন্ত। এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার জন্য কৃত্রিম উপগ্রহের গতি ও কক্ষপথ নিয়ন্ত্রণ এতটাই নিখুঁত ও বাঁধাহীন হতে হবে যে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব কিনা, বিশেষ করে মহাকাশের হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যে, তাঁর একটা অনিশ্চয়তা থেকে যায়, যদিও গানিতিক ভাবে এটা দেখানো যায় যে এই লম্বা দূরত্ব অতিক্রম করা কোন ব্যপারই না। দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাথা ঘামাতে হয়েছে, সেটা হল দুর্বার গতিতে ছুটে চলা ধূমকেতুটির কক্ষপথে রোজেটাকে এমন ভাবে নিক্ষেপ করা, যাতে করে সে ধূমকেতুটির বিরূপ পরিবেশ সফল ভাবে ভেদ করার পর তাঁকে কেন্দ্র করে তাঁর চারিদিকে প্রদক্ষিণ করতে পারে।

আজকের অবস্থান থেকে বলা যায় (জানুয়ারী ২০১৪ এর পরবর্তি সময়), রোজেটা সফলভাবে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ধূমকেতু ৬৭পি/সিজি এর কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে। এজন্য রোজেটাকে অবশ্য এক জটিল কৌশলে তিন বার পৃথিবীর এবং একবার মঙ্গল গ্রহের অভিকর্ষ বলকে কাজে লাগিয়ে (gravity assist manoeuvre) ত্বরান্বিত হতে হয়েছে।

ত্বরান্বিত হওয়ার প্রক্রিয়াটা বেশ দীর্ঘ। এ প্রক্রিয়ায় রোজেটার নিজস্ব উপবৃত্তাকার কক্ষপথটিকে এমন ভাবে নির্ণয় করা হয়, যাতে সে একটা নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীর কক্ষপথের পাশ দিয়ে পরিভ্রমন করে এবং পৃথিবীর একদম কাছাকাছি চলে আসে। এতে করে সে পৃথিবী ও সূর্যের অভিকর্ষ বলের টানে অত্যাধিক গতিপ্রাপ্ত হয়। এহেন ত্বরান্বিত অবস্থায় সে তাঁর নিজের কেন্দ্রবিমুখী বলের কারণে পৃথিবীর কক্ষপথের পাশ থেকে ছিটকে দূরে সরে পড়ে এবং নতুন আরেকটি নিজস্ব উপবৃত্তাকার কক্ষপথ তৈরি করে, যে কক্ষপথের পরিধি আগেরটার চাইতে আরো অনেক বড়। এভাবে কক্ষপথের পরিধি বাড়িয়ে রোজেটাকে সরিয়ে দেয়া হয় পৃথিবী থেকে অনেক দূরে। বর্তমান মিশনের জন্য এ প্রক্রিয়ায় রোজেটার গতিপথ পরিবর্তন করা হয় পর্যায়ক্রমে ২০০৫ সালে পৃথিবী, ২০০৭ সালে প্রথমে মঙ্গল ও পরে পৃথিবী এবং সব শেষে ২০০৯ সালে পৃথিবীর অভিকর্ষ বলকে কাজে লাগিয়ে (ছবি ৪)।

04Chmielewski

ছবি ৪. রোজেটার ভ্রমণ পথ, সুত্রঃ ডিএলআর [৫]

২০০৯ সালে পৃথিবী’র অভিকর্ষ বলকে কাজে লাগিয়ে রোজেটা যে নতুন উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পরিচালিত হয়, সেই কক্ষপথটির পরিভ্রমণ রেখা বৃহস্পতির কাছাকাছি চলে যায়। কাজেই, রোজেটার ভ্রমনপথে সে কোন এক সময়ে সুর্য থেকে এত দূরে চলে যাবে যে তাঁর বাহুতে লাগানো সৌর বিদ্যুৎ কোষগুলির শক্তি সংগ্রহের মাত্রা একদম কমে যাবে। এত অল্প বিদ্যুৎ দিয়ে রোজেটার সব যন্ত্রপাতি চালু রাখা সম্ভব নয়। ঠিক করা হল এই বিশেষ দুরত্ত্বে পৌঁছার পর রোজেটার সব যন্ত্রপাতিগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। শুধু জাগিয়ে রাখা হবে একটি এলার্ম ঘড়িকে, যেটি যথা সময়ে (৬৭পি/সিজি এর সাথে মিলিত হওয়ার বেশ আগে, জানুয়ারি ২০১৪ তে) রোজেটাকে জাগিয়ে তুলবে, আর চালু রাখা হবে একটি তাপযন্ত্র, যেটি মহাকাশের ভয়াবহ ঠাণ্ডায় রোজেটার পরিক্ষা-যন্ত্রগুলিকে গরম রাখবে। তারপর, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রোজেটা চলতে থাকবে তাঁর নির্দিষ্ট কক্ষপথ বরারব।

রোজেটার ঘুমিয়ে পড়ার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় ৮ই জুন ২০১১ তে, যখন রোজেটার অবস্থান সূর্য থেকে ৬৬০ লক্ষ কি.মি. দূরে। একটি নিয়ন্ত্রিত কম্পিউটার প্রোগ্রাম রোজেটার সব যন্ত্রপাতি একে একে বন্ধ করে দেয়। এমনকি, রোজেটা যে রাডারের মাধ্যমে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করত সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। পৃথিবীর কন্ট্রোল সেন্টারের যে কম্পিউটারগুলো গত আট বছর (২০০৪-২০১১) সরব ছিল রোজেটার পদচারনায়, সেগুলো এখন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। রোজেটার সাথে যোগাযোগের আর কোন উপায় নেই, যদি না সে নিজে যোগাযোগ করে।

এই দিনটি ছিল রোজেটা বিজ্ঞানীদের জন্য একটা মন খারাপ করা দিন। গত আটটি বছর বিজ্ঞানীরা রোজেটার সাথে ছিল প্রতিটি মুহূর্ত। তাঁকে পথ দেখিয়েছে, চলার পথে যাতে তাঁর যন্ত্রগুলি ঠিকমত কাজ করে সেটা খেয়াল রেখেছে, প্রয়োজনে তাঁর যাত্রাপথ পরিবর্তন করে বিপদকে পাশ কাটিয়েছে। মা বাবা শিশুকে যেমন আগলে রাখে ঠিক তেমনি তাঁকে আগলে রেখেছে বিজ্ঞানীরা এই সৌরজগতের এক বিশাল মহাকাশ বলয়ে। তাই, রোজেটা যখন পৃথিবীর সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে মহাকাশের গহীনে চলে গেল, বিজ্ঞানীদের মন তখন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তাঁর সাথে যোগ হয় শঙ্কা এটা ভেবে যে রোজেটার চলার পথে যে কোন বাধা আসলে সেটা আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

বিজ্ঞানীদের সকল পরিশ্রমকে সার্থক করে দীর্ঘ ৩১ মাস ঘুমিয়ে থাকার পর গত ২০ জানুয়ারী, ২০১৪ রোজেটা নিজ থেকে যোগাযোগ করল পৃথিবীর সাথে। পৃথিবী থেকে ৮০০ মিলিয়ন কি.মি. দূরে অবস্থানরত রোজেটার বার্তা পেয়ে স্বভাবতই বিজ্ঞানীদের আনন্দের সীমা রইলো না। সেই আনন্দের মাঝেই শুরু হল মিশন সফল করার পরবর্তী পদক্ষেপ।

ধূমকেতুর কক্ষপথে ঢোকা এবং এর পৃষ্ঠদেশে অবতরণ করা এই রোজেটা মিশনের একটি অন্যতম জটিল অংশ। বিজ্ঞনীরা এখন থেকেই সকল অনুকূল ও প্রতিকূল অবস্থাগুলি খতিয়ে দেখছেন যাতে সাফল্যের সম্ভবনা সর্বোচ্চ হয়। আর নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখছেন ধূমকেতু ৬৭পি/সিজি’র গতিবিধি।

ইতিমধ্যে, রোজেটা ছুটে চলছে ঘন্টায় প্রায় ৩ হাজার কি.মি. বেগে ধূমকেতু ৬৭পি/সিজিকে লক্ষ্য করে। রোজেটার কক্ষপথ ধূমকেতুর কক্ষপথ থেকে ছোট হওয়ায় তাঁদের মধ্যকার দুরত্ব কমছে প্রতিদিন একটু একটু করে। ধীরে ধীরে সচল করানো হচ্ছে রোজেটার সব পরীক্ষা-যন্ত্র (২১ টি)। পরিকল্পনা আনুযায়ী মার্চ ২০১৪ এ সচল করা হবে ফিলেই ল্যান্ডার। মে মাসে রোজেটা তাঁর ছুটে চলার কৌশল পরিবর্তন করবে ধূমকেতু ৬৭পি/সিজি এর কাছাকাছি আসার জন্য (comet rendezvous manoeuvre)। আগস্টে সে পৌঁছে যাবে ধূমকেতুর কেন্দ্রীয় অংশে (ধূমকেতুর লেজকে ভেদ করে), তারপর এমনভাবে ধূমকেতুর কক্ষপথে ঢুকে যাবে যাতে সে ধূমকেতুটিকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করতে পারে। প্রদক্ষিণরত অবস্থায় সে তুলতে থাকবে ধূমকেতুর ত্রিমাত্রিক ছবি (ছবি ৫)।

05rosetta_probe_comet

ছবি ৫. ধূমকেতুর চারপাশে ঘুরে পৃষ্ঠভাগের ছবি তুলছে রোজেটা (অনুমিত ছবি), সুত্রঃ এসা [৬]

সেই ছবি থেকে সম্ভাব্য পাঁচটি স্থান নির্ধারণ করা হবে, যেখানে ফিলেই ল্যান্ডার নামতে পারবে। নভেম্বর ২০১৪ এ ফিলেই ল্যান্ডারকে ধূমকেতুতে নামানো হবে। ধূমকেতুর পৃষ্ঠদেশে নামার পরই ফিলেই ল্যান্ডারের পা থেকে হারপুন ছুটে যেয়ে ধূমকেতুর মাটির ভিতর ঢুকে যাবে এবং ফিলেই ল্যান্ডারকে শক্তভাবে ধূমকেতুর পৃষ্ঠদেশের সাথে আটকে রাখবে।
তারপর চলবে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের কাজ।

আশা করা হচ্ছে, এই অসাধারণ মহাকাশ গবেষণা প্রকল্প আমাদের সৌরজগৎ ও প্রাণের উৎপত্তি রহস্যের জটিল ধাঁধার কিছু অংশ উম্মোচিত করবে। তবে, এই গবেষণার ফলাফল আমাদের জন্য কি বিস্ময় বার্তা নিয়ে আসবে, সেটা জানার জন্য আমাদেরকে এ বছরের শেষ অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

তথ্যসুত্রঃ
[১] http://www.esa.int/Our_Activities/Space_Science/Rosetta
[২]http://www.nasa.gov/mission_pages/stardust/news/stardust_amino_acid.html
[৩] http://www.dlr.de/dlr/en/desktopdefault.aspx/tabid-10394/
[৪]http://www.esa.int/Our_Activities/Space_Science/Rosetta/Comet_67P_Churyumov-Gerasimenko
[৫]http://www.dlr.de/dlr/desktopdefault.aspx/tabid-10394/663_read-9218/#gallery/13409
[৬] http://www.esa.int/esatv/Videos/2014/01/Rosetta_orbiting_the_comet