ইবোলা ভাইরাস

ইবোলা কীভাবে ছড়ায়?

-ইবোলা ভাইরাস গুরূতর অসুস্থ রোগীর শরীরনিসৃত তরলের মাধ্যমে ছড়ায়। অসুখের এই পর্যায়ে রোগীরা সাধারণত, বমি, রক্তক্ষরণ, ডায়েরিয়া ইত্যাদি উপসর্গে ভুগতে থাকে। সবচেয়ে ছোঁয়াচে হচ্ছে রক্ত, মলমূত্র এবং বমি। রোগের শেষ পর্যায়ে এসবের একটা ছোট্টো ফোটাতেও প্রচুর পরিমানে ভাইরাস থাকে। কোনো সেবক/সেবীকার হাতে যদি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত লেগে যায় তাহলেও তিনি রোগাক্রান্ত হবেন না, যদি তিনি সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেন। তবে তার হাতের কোনো অংশে যদি কাটা, ছড়ে যাওয়া বা ক্ষত থাকে অথবা তিনি যদি হাত নিজের মুখে, চোখে, নাকে দেন তাহলে ভাইরাস তার শরীরে চলে যাবে।

এ রোগের লক্ষণ কী কী?

-সংক্রমনের দুই থেকে একুশ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়, তবে সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিনের বেশি লাগে না। শুরুতে, মাথাব্যাথা সহ জ্বর, গিরা-গাট এবং পেশীতে প্রদাহ, গলায় ব্যাথা, এবং পেশিতে তীব্র দূর্বলতা দেখা দেয়। এসব উপসর্গের বেশিরভাগই ফ্লু এর মত, তাই শুরুতেই ইবোলা কী না তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। অবশ্য, সাম্প্রতি পশ্চিম আফ্রিকা ফেরত কারো মধ্য এসব উপসর্গ দেখা দিলে এই আশঙ্কাই করা হয়। সংক্রমনের পরবর্তী পর্যায়ে, শুরু হয় পাতলা পায়খানা, বমি সেই সঙ্গে গায়ে চাকা চাকা দাগ ও পেটে ব্যাথা। কিডনি এবং লিভার স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে পারে না। রোগী অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণে ভুগতে পারে, এমনকি কান, নাক চোখ এবং মুখ দিয়েও রক্তক্ষরণ হতে পারে।

ঘাম দিয়ে কি ইবোলা ছড়ায়? কোনো ইবোলা রোগীর ব্যবহৃত ব্যামাগারের যন্ত্র থেকে কি আমার ইবোলা হতে পারে?

-না। ইবোলা আক্রান্ত যার মধ্যে রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে, তার পক্ষে প্রচণ্ড পেশীর দুর্বলতা এবং জ্বর নিয়ে ব্যামাগারে যাওয়া সম্ভব নয়; আর যাদের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়নি, তাদের সংক্রমন তখনো ছোঁয়াচে পর্যায়ে যায়নি। ঘাম এমনিতেও এই ভাইরাসের প্রধান বাহক নয়, বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর বক্তব্য অনুযায়ী, ঘাম থেকে কখনোই পূর্ণ ভাইরাস আলাদা করা সম্ভব হয়নি।

লালার মাধ্যমে কি ছড়াতে পারে?

-WHO বলেছে রোগের ক্রান্তিকালে লালা এবং এমন কি চোখের পানিতেও ভাইরাস থাকার আশঙ্কা রয়েছে, যদিও এ বিষয়ক গবেষণা অপ্রতুল। মাতৃস্থনে ভাইরাসের উপস্থিতি দেখা গেছে। ২০০৭ সালে জার্নাল অফ ইনফেকটাস ডিজিজ এ প্রকাশিত এই আর্টিকেলে ভাইরাস কোথায় কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে সে সম্পর্কে বিস্তারিত পাওয়া যাবে।

টয়লেট সিট থেকে কি ইবোলা আক্রান্ত হতে পারি?

-হ্যাঁ- আক্রান্ত ব্যক্তির মল একটা বড় ঝামেলা, এমনকি মূত্রের মধ্যেও ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কিন্তু এটা হবে যদি, গুরুতর অসুস্থ কোনো রোগি টয়লেট ব্যবহার করে, যা সাধারণত তাদের নিজের বাড়ি বা হসপিটালে হয়ে থাকে। তাই পাবলিক টয়লেটে এই ঝুকি থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।

এটা কি যৌণ সংযোগের মাধ্যমে ছড়াতে পারে?

-হ্যাঁ। এমনকি সুস্থ্য হয়ে যাওয়া রোগীর বীর্যেও প্রায় ৯০ দিন এই ভাইরাসের অস্তিত্ব থাকতে পারে।

কোনো ট্যাক্সি যেটাতে করে আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, সেই ট্যাক্সিতে উঠে কি আমিও আক্রান্ত হতে পারি?

– কোন কিছুর উপরে আক্রান্ত রোগীর শরীর নিসৃত তরল লেগে থাকলে সেখান থেকে ইবোলা ছড়াতে পারে। তাই যদি ট্যাক্সিতে কেউ বমি করে, বা রক্তপাত করে সেখানে বসে কোন ব্যক্তির আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে যদি তাদের শরীরে কাঁটা-ছেড়া থাকে বা তারা অশুদ্ধ হাত দিয়ে নিজের মুখমন্ডল স্পর্শ করে। ইউরোপ আমেরিকাতে কোনো রোগী ইবোলা আক্রান্ত নির্ণীত হলে, তার চলাফেরা, সংস্পর্শে আসা মানুষদের খুজে বের করার জন্য পাবলিক হেলথ অথোরিটী ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করে। অসুস্থ অবস্থায় ব্যবহৃত যেকোনো ট্যাক্সিকেই খুঁজে বের করে সঙ্ক্রোমনমোচন করা হয়।

রোগীর স্পর্শ করা দরজার হাতল ধরে কি আমিও ইবোলা আক্রান্ত হতে পারি?

– হ্যাঁ, যদি হাতলে রক্ত, বমি বা মলমূত্রের অংশ লেগে থাকে, যেটা আক্রান্ত রোগীর বাড়িতে বা হাসপাতালে খুবই সম্ভব। তবে যাদের হাতের চামড়া অক্ষত এবং যারা তাদের চোখ নাক মুখ স্পর্শ করে না এবং ঘন ঘন হাত ধুয়ে ফেলে তাদের আক্রান্ত হবার আশঙ্কা নেই।

সঙ্ক্রমন ঠেকাতে রেলওয়েস্টেশন, স্কুল এবং অন্যান্য পাবলিক প্লেসে কী করা যেতে পারে?

– ইংল্যান্ডের পাবলিক হেলথ অর্গানাইজেশনের সংক্রমনমোচনের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। কোনো স্থানে যদি, কোনো দৃশ্যমান সঙ্ক্রমন উৎস থাকে যেমন, বমি, রক্ত, মলমূত্র ইত্যাদি, এবং এমন কিছু থাকে যেটা অনেক মানুষ স্পর্শ করে, যেমন দরজার হাতল, টেলিফোণ ইত্যাদি সেগুলোকে ডিসপোজেবল তোয়ালে দিয়ে ভালো করে মুছে ফেলতে হবে। এরপর অই স্থান সাবান পানিয়ে দিয়ে ভালোমত ধুয়ে শুকিয়ে ফেলতে হবে। তারপর সেই স্থানের সংক্রমন মোচনের জন্য চারভাগ পানিতে একভাগ ব্লিচিং পাওডার দিয়ে দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এই ধোঁয়ামোছা যারা করবেন তাদেরকে অবশ্যই পুরোপুরি ভাবে আবৃত হতে হবে। ডিসপোজেবল হাতমোজার মধ্যে ফুল হাতা শার্টের হাতা গুজে নিতে হবে এবং পাজামাও মোজার মধ্যে ফরে নিতে হবে সেই সঙ্গে পরতে হবে চারদিক আটকানো বুট জুতা। শরীরের কোনো কাটাছেড়া বা ঘষে ছিলে যাওয়া অংশ অবশ্যই প্লাস্টার করে নিতে হবে। তবে আক্রান্ত ব্যক্তি যেসব করিডোর বা এলাকা দিয়ে স্রেফ পার হয়ে গেছে সেগুলো সেগুলো ধোঁয়ার দরকার নেই।

ভাইরাস কতদিন টিকে থাকে?

– এই ভাইরাস খুবই নাজুক এবং সহজেই অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাবে, শুকিয়ে যাওয়ায়, বা উচ্চতাপে (পশ্চিম আফ্রিকায় যেটা আছে) নষ্ট হয়ে যায়। আর সংক্রমন মোচক হিসাবে সাবানপানি বা অ্যালকোহল জেল কাজ করে। একটা শীতল ভেজা স্থানে শরীরনিসৃত তরলের মধ্যে এই ভাইরাস রেখে দিলে সর্বোচ্য কয়েকদিন মাত্র টিকতে পারে।

খাদ্য কি নিরাপদ?

-হ্যাঁ, যদি ভালমত রান্না করা হয়। ইবোলা ভাইরাস রান্না করলে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। শিকার করে আনা কাঁচা মাংসে অবশ্য ঝুকি থেকে যায়। অতীতে আফ্রিকায় খাওয়ার জন্য শিকার, জবাই করা বন্য প্রাণীর মাংস থেকে এই রোগ ছড়িয়েছে।

ইবোলা ভাইরাস কি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়? আমি কি মাস্ক পরবো?

– না। এই ভাইরাস বাতাসে ছড়ায় না। নানান রকম গুজব সত্ত্বেও ইউএন ইবোলা মিশন ফর ইমার্জেন্সি রেসপন্স বলেছে, ব্যপক অনুসন্ধানেও এই ভাইরাসের বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানোর প্রমান পাওয়া যায়নি। এ রোগে আক্রান্ত রোগী খুব বেশি হাঁচি কাশি দেয় না, WHO এক বিবৃতিতে বলেছে, “ মহামারী সঙ্ক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে এই ভাইরাস ছড়ানোর যে প্যাটার্ন দেখা যায় সেটা বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানো ভাইরাস যেমন, হাম, জলবসন্ত বা বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়া যেমন যক্ষার সাথে মেলে না।”

কেউ যদি আমার মুখের উপর হাঁচি-কাশি দেয়?

– তাত্ত্বিক ভাবে এই আশঙ্কা থেকেই যায় যে কোনো গুরুতর ইবোলা আক্রান্ত ব্যক্তি অন্য কারো মুখের উপর জোরে কাশি বা হাঁচি দিয়ে ফেললো যার সঙ্গে সঙ্গে কফ-থুতুর বড় ফোটা কাছে ধারে কারো কাছে চলে যাবে। তবে ইবোলা রোগীর নিকটবর্তী ব্যক্তি সম্ভবত একজন সেবক/সেবীকা যিনি অবশ্যই মুখোশ সহ নানান রকম প্রতিরোধি কাপড় পরে থাকবেন।

ইবোলা ভাইরাস ছড়ানোর উপায় কি মিউটেশনের মাধ্যমে পরিবর্তি হতে পারে?

– যদিও ভাইরাসের পরিব্যপ্তি (মিউটেশন) ঘটে, বিজ্ঞানীরা বলেন, জানা মতে কোনো ভাইরাস তাদের ছড়ানোর উপায় পরিবর্তন করে নি, এবং ইবোলার ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

নভোচারীদের মত প্রতিরোধী পোষাক কি আসলেই কোনো কাজের; কেননা কিছু সাস্থকর্মী এসব পরার পরেও আক্রান্ত হএয়ছেন?

– এসব পোষাক কাজ করে যতক্ষণ তাদের সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়। পোষাকের হাতমোজা বা বাইরের অংশ ভাইরাসে ভরে থাকা অবস্থায় পোষাক খোলার সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। ইউএস সেন্টার ফর ডিজেজ কনট্রোলের এ বিষয়ক সুনির্দিষ্ট নির্দশনা রয়েছে, যেটা নিশ্চিত করে খালি হাতে যেন পোষাকের বাইরের অংশ স্পর্শ করতে না হয়।

স্ক্যানারের মাধ্যমে কি আক্রান্ত মানুষের প্রবেশ নির্ণয় করা যায়?

-না। স্ক্যানার দিয়ে শুধু যেটা দেখা যায় তা হলো শরীরের উচ্চ তাপমাত্রা। ইবোলা ছাড়াও, বাড়তি তাপমাত্রা সর্দি-জ্বরের ভাইরাস বা এমনকি রজনিবৃত্তির কারণেও হতে পারে। সেক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা বেশি এমন সবাইকে রক্তপরীক্ষা করতে হবে। আরো সমস্যা হচ্ছে, মানুষ পশ্চিম আফ্রিকা থেকে নানা ভাবে আসতে পারে, কারণ এয়ারলাইন সবসময় আক্রান্ত দেশ থেকে সরাসরি আসে না, সে সঙ্গে নৌ ও স্থলবন্দরেও স্ক্যানার বসাতে হবে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, কোনো আক্রান্ত ব্যক্তি তার সংক্রমনের লক্ষণ দেখা দেওয়ার কয়েকদিন আগেই চলে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকবে, ফলে ইবোলা আছে কি না সে সন্দেহ করার উপায় থাকবে না।

লেখাটি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত How to avoid being infected with Ebola নিবন্ধের বঙ্গানুবাদ।