‘সারাদিন নর্দমা ঘাটা যার স্বভাব, ফুলের গন্ধ তার নাকে যায় না’। গান্ধী কি বলেছিলেন কথাগুলো? যেই বলুন, মালালা প্রসঙ্গে বাঙালির ফেসবুকিয় বুদ্ধিজীবীতার নমুনা দেখে আমার নিরেট মাথায় কেন যেন এ  কথাগুলোই বারে বারে  ঘুরে ফিরে উঠে আসছে।

অন্যান্য বছরের মতো এবছরও পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা সহ বিভিন্ন শাখায় নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে (আর এ নিয়ে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ পত্রিকায় ‘নোবেল পুরস্কার এবং আমার অনিয়ত ভাবনা‘ শিরোনামে), যদিও এ নিয়ে লোক জনের খুববেশি আগ্রহ কিংবা উৎসাহ লক্ষ্য করিনি। কিন্তু মালালা ইউসুফজাইয়ের নোবেল শান্তি পুরস্কার (২০১৪) বিজয়ের খবর পত্রিকায় আসার পর থেকেই  ফেসবুক সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শুরু হয়েছে নিরন্তর বানী প্রক্ষেপণের মহড়া। এর মধ্যে আবার কেউ কেউ মালালা সম্বন্ধে একবিন্দু না জেনে তার কাজ, কিংবা অবদান সম্বন্ধে এতটুকু  জ্ঞান না রেখে গালির তুবড়ি ছোটাচ্ছেন অহর্নিশি  – “একটা গুলি খায়াই নোবেল পায়া গেল?” কেউ বা বলছেন,  “মালালা একটা গুলি কেয়ে নোবেল পাইল, আমারে কামান মারো”,কেউ আবার বলছে, “একটা গুলি খাওয়া ছাড়া মালালার শান্তিতে কি অবদান আছে কইবেন কেউ?”

বেচারি মালালা। মাত্র ১৭ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী হয়েও গালি খাচ্ছেন তালিবানদের, ইসলামিস্টদের, মৌলবাদীদের। পাশাপাশি  দেশপ্রেমিক বাঙালিদের, জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশীদের, সেক্যুলারিস্টদের, কমিউনিস্টদের। সবার।

তালিবানি ইসলামিস্ট ঘরনার লোকজন মালালার উপর কেন ক্ষ্যাপা তা বোধ হয় বিশ্লেষণ না করলেও চলবে। কিন্তু অন্যরা?  অন্যদের ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং!

‘পাইক্কা বিরোধী’ দেশপ্রেমিক বাঙালিরা,  জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশীরা, সেক্যুলারিস্টদের কিছু অংশ ক্ষ্যাপা, কারণ পাকিস্তানের সবকিছুই তাদের কাছে হারাম, এমনকি তাদের কেউ ‘যদি ফুল নিয়ে আসে তবুও’। তাদের বাঙালিপনা এমনই যে উর্দু ফার্সি শব্দ, মায় ভাষাও জঘন্য, যদিও তাদের অনেক কথাতেই উর্দু শব্দের আধিক্য চোখে পড়বে, রুনা লায়লার ‘দমাদম মাস্কালেন্দার’ তো বটেই এমনকি বলিউডি সিনেমার কিছু কিছু চোস্ত উর্দু ডায়ালগও তাদের ঠোটস্থ। তাতে কি? ‘পাইক্কার সাথে সম্পৃক্ত’ যে কোন কিছুতেই ‘গাইল’ দিতে হবে না? এদের কাছে তালিবানও যা, আসমা জাহাঙ্গিরও যা, পারভেজ হুদোভয়ও যা, মালালাও তা।

কমিউনিস্ট আর বাম ঘরনার লোকজনের কাছে মালালার পুরস্কার কেবলই ‘পশ্চিমা পুঁজিবাদী চাল’। এদের অনেকে নিশ্চিত,মালালাকে ‘খাড়া’ করা হয়েছে ইসলাম আর আইসিসের বিপরীতে ‘প্রোপাগান্ডা’র মেশিন হিসেবে।  এদের একজন মধ্যে একজন দেখলাম গ্রামসীয় হেজিমনি কায়দায় তত্ত্ব দিয়েছেন, ‘আইসিস আর ইসলামোফোবিয়ার দ্বন্দ্বে এবারের নোবেল পিস প্রাইজ হিসেবে মালালার নির্বাচন তাৎপর্যময়’।

এবারে যারা মনে করেন গুলি খাওয়া ছাড়া মালালার কোন অবদান নেই, তারা বোধ হয় জানেনও না গুলি, খাওয়ার তিন বছর আগে – মাত্র ১১ বছর বয়সে বিবিসি সাইটে মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং তালিবানদের প্রচারণার বিরুদ্ধে ব্লগিং শুরু করেছিলেন মালালা। মাত্র এগারো বছর বয়সে ব্লগিং শুনে হয়তো অনেকে ‘অসম্ভব’ ভেবে নাক কুঁচকাতে পারেন, যেমনটি কুঁচকেছেন এক বন্ধু আমার এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস ফেসবুকে দেবার পর। কিন্তু আমার অভিমত হল, এগারো বছরের মেয়ে অবশ্যই ব্লগিং করতে পারেন। আর উদ্যোগটা যেহেতু বিবিসির, তাই উনাকে ব্লগিং করতে সাহায্য করার লোক ছিল বিবিসি থেকে। আর বিবিসির কিন্তু উর্দু সহ ২৬টি ভাষার সার্ভিস আছে।  আর বলা বাহুল্য, উনাকে কেউ গবেষণা-প্রবন্ধ লিখতে বলেনি, মালালা যা লিখছিলেন তা একটা ডায়রির মতো। Gul Makai (পশতুন লোকগীতির এক বীর নারী) ছিল তার পেন নেইম। সেটা করা একেবারে অসম্ভব কিছু ছিল না মালালার জন্য। মালালা তার স্কুলের শীর্ষ স্থানীয় ছাত্রী ছিলেন, প্রায় প্রতি বছরই প্রোক্টর হিসেবে নির্বাচিত হতেন। আমি যখন এ লেখাটা লিখছি তখন আমার হাতে এ বছর প্রকাশিত  ‘আই এম মালালা’ বইটা ধরা। সেখানে স্কুলের অগণিত ট্রফি হাতে মালালার ছবিও আছে। আর মালালার বাবা ছিলেন শিক্ষক, এবং এক সময় স্কুলের প্রিন্সিপাল। তাই মালালার পক্ষে ইংরেজিটা রপ্ত করা সহজ হয়েছিল। তার বাবা আমেরিকান সিরিয়ালের বিভিন্ন ডিভিডি মালালাকে কিনে দিতেন তার ইংরেজিটা পোক্ত করার জন্য। মালালার অন্যতম পছন্দের একটি টিভি প্রোগ্রামের ডিভিডি ছিল Ugly Betty। মালালা তার বইয়ে লিখেছেন –

My father wanted me to continue to improve my English. So he encouraged me to watch a DVD that one of te journalists in Islamabad had given to me: a TV program called Ugly Betty. I loved Betty, with her big braces and her big heart…. My favourite part though, was seeing Betty’s father cook for her instead of vise versa!

 

অবশ্য ব্লগিং যে মালালা করবেনই তা তিনি আগে থেকেই ঠিক করে রাখেননি। এই সময়টা পাকিস্তানের জন্য এক বিশাল ক্রান্তিলগ্ন। মাত্তা, মিঙ্গোরা সহ সোয়াতের মতো পাকিস্তানী পশতুন এলাকাগুলো একেবারে আফগানিস্তানের বর্ডার সংলগ্ন এলাকা। এ এলাকাগুলো আফগানী তালিবানরা ক্রমশ দখল করে নিচ্ছিল। মেয়েদের স্কুল জোর করে বন্ধ করে দিচ্ছিল। তালিবানরা জায়গাগুলো দখল করে মেয়েদের স্কুলে পাঠানো নিষিদ্ধ করতে থাকে, বাধ্যতামূলকভাবে নিকাব, বোরখা প্রভৃতি পড়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। ঠিক এই সময়টাতেই  বিবিসির পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে ব্লগিং এর।  স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা ছাত্র ছাত্রীদের কেউ রাজি না হওয়াতে অনেকটা বাধ্য হয়েই মালালাকে এ দায়িত্ব নিতে হয়। মালালা অবশ্য শুরু থেকেই ছিলেন কিছুটা বিদ্রোহী। মুখ ঢাকা, বোরখা পরার বিরুদ্ধে ছিল সোচ্চার। আমি I am Malala থেকে প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি –

I told my parents that no matter what other girls did, I would never cover my face like that. My face was my identity. My mother who is quite devout and traditional, was shocked. Our relatives thought I was very bold (some said rude). But my father said, I could do as I wished. “Malala will live as free bird” he told everyone.

মালালা তার প্রথম ব্লগটি লেখেন ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখে,  ‘I am afraid’ শিরোনামে। এর পর থেকে লিখেই গেছেন; তালিবানদের বিরুদ্ধে ব্লগিং যখন শুরু করলেন তখন থেকেই মৃত্যু হুমকি পেয়েছিলেন অজস্র। তার লেখায় এমনই আক্রান্ত বোধ করেছিলো তালিবানি জঙ্গিরা যে, যে বাসে করে মালালা স্কুল থেকে ফিরতো সেখানে তারা হামলা করে বসে। দু’জন তালিবানি যুবক বাসে উঠে রাইফেল তাগ করে তার সহপাঠীদের দিকে এবং তাদের বাধ্য করা হয় বাসের মধ্যে মালালা কোন্‌ জন সেটা চিনিয়ে দিতে। সহপাঠীদের একজন ভয় পেয়ে চিনিয়ে দিলে তৎক্ষণাৎ মালালাকে গুলি করা হয়।

হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরেও তিন দিন মালালা সংজ্ঞাহীন ছিলেন। জ্ঞান ফিরেছিলো ইংল্যান্ডে নেয়ার পর। সেখানে সার্জারি করে তার গলার কাছ থেকে বুলেট অপসারণ করা হয়েছিল, এমনকি মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ থামাতে খুলির কিছু অংশ কেটে বাদ দিতেও হয়েছিল।

যারা মালালাকে আজ উঠতে বসতে গাল দিচ্ছেন, তাদের কেউ কি অনুধাবন করতে পারছেন যে সময়টা হেসে খেলে বেড়াবার বয়স, তার সেই ‘মেয়েবেলা’তেই  কি রকম ‘চাইল্ডহুড ট্রমা’র মধ্যে দিয়ে মেয়েটাকে যেতে হয়েছিল? শুধু এই কারণেই তো মালালা শ্রদ্ধা এবং সহমর্মিতা পেতে পারেন আমাদের । তার আগের কিংবা পরের কাজ এবং পুরস্কারগুলো যেমন, নারীশিক্ষার জন্য মালালা ফাণ্ড গঠন, মৌলবাদ বিরোধিতা,  ২০১৩ সালে ইউএন এ তার ঐতিহাসিক বক্তৃতা, ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন’স পিস প্রাইজের জন্য ডেসমণ্ড টুটুর নমিনেশন, শাখারভ পুরস্কার, টাইম ম্যাগাজিনের চোখে ২০১৩ সালের ‘অন্যতম প্রভাববিস্তারকারী ব্যক্তি’ নির্বাচিত হওয়া  – সেগুলো না হয় বাদই দিলাম।

যাহোক, অনেক হাবিজাবি স্ট্যাটাসের ভিড়ে শিবরাজ চৌধুরীর এই স্ট্যাটাসটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, এটি পড়তে অনুরোধ করি –

“একটা গুলি খায়াই নোবেল পায়া গেল?” পাবলিকের কথায় মনে হয় গুলি খাওয়াটা মনে হয় খুব ইজি, যে কেউ খাইতে পারে। অক্টোবর ২০১২ তে মালালা গুলি খাইছিল। কেন খাইছিল সেইটা কি কেউ জানে? এইটুক একটু জানাই।

পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় যখন তালিবানি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হল, তালেবান কী করল? এরা খালি গোলাগুলি ছাড়া সবকিছুই ব্যান করতে পারে। মেয়েদের স্কুলের কথা তো আর বলাই বাহুল্য। এইসব যখন শুরু হইছে, তখন বিবিসি উর্দু চিন্তা করল যে ওইখানের আম আদমিরা কী ভাবতেছে সেইটা ফোকাসে আনা উচিত, এনোনিমাসলি। মালালার বাবা জিয়াউদ্দিন সাহেব একটা স্কুল চালান। তাঁর সাথে পরিচয় ছিল বিবিসি উর্দুর স্থানীয় প্রতিনিধির। তাকে বলার পর এই ব্যাপারে স্টেপ নেয়া হল। কিন্তু তালেবান এর ভয়ে কেউ রাজি হচ্ছিল না। আয়েশা নামের একটা মেয়ে, যে কিনা মালালার চেয়ে বয়সে বড় ছিল, সে প্রথমে রাজি হয়েছিল। পরে তাঁর অভিভাবকরা পারমিট করে নাই। পরে জিয়া সাহেব রিস্ক নিয়ে নিজের মেয়েকেই এই দায়িত্ব দেন। মালালাকে তিনি ওই অস্থিতিশীল অঞ্চলেই নিজে পড়াতেন, অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন মালালার সাথে- মালালা ইংলিশ, উর্দু এবং পশতুতে ফ্লুয়েন্ট। যারা সমালোচনা করল, তারা ভুলে যাচ্ছে যে, সোয়াত উপত্যকা ছেড়ে উনি পরিবার নিয়ে করাচি, পিন্ডি চলে যেতে পারতেন। যান নাই কেন? জিয়া সাহেব নিজেও একজন এডুকেশন এক্টিভিস্ট। যাইহোক, মালালা তখন ব্লগ লেখা শুরু করল। [ লিঙ্ক  এখানে : “ডায়েরি অফ আ পাকিস্তানি গার্ল”]। মালালা মাত্র ১১ বছর বয়সে করাচি প্রেসক্লাবে তালিবান শাসন নিয়ে বলেছিল। উইকিপিডিয়া থেকে তুলে দিলাম। ওখানে লিঙ্ক দেয়া আছে। “How dare the Taliban take away my basic right to education?” Yousafzai asked her audience in a speech covered by newspapers and television channels throughout the region”

বিবিসির ব্লগ সূত্রে ওকে নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস একটা ডকুমেন্টারি বানাবে বলে ঠিক করল। যাইহোক, এইভাবে তালিবান মালালারে চিনল। এরপরে টার্গেট করল। দা রেস্ট ইজ হিস্ট্রি।

সুতরাং, মালালা খালি গুলি খায়াই নোবেল পায় নাই। সোয়াতের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে থেকে যে এতটুকু সাহস নিয়ে এগিয়ে এলো তালেবানের বিরুদ্ধে, এতো অনিরাপদ জীবন নিয়েও যে তারা ওই জায়গা থেকে নিরাপদ জায়গায় চলে যাবার কথা ভাবে নাই, এইসব নিয়ে দেখি কারো মাথাব্যথা নাই।

যাই হোক, এই বেলায় আরেকটু পো* মারি। মালালা গুলি খাবার আগেই সে চিলড্রেন রাইটস এক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচিত। দক্ষিণ আফ্রিকার ডেসমন্ড টুটু(আমি নিশ্চিত, জাতি টুটুরেও চিনে না) ২০১১ সালে মালালাকে ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন’স পিস প্রাইজের জন্যে নমিনেট করেছিলেন। পুরষ্কার আরেকজন পেয়েছিল সেবার। তবে মালালার ব্যাপারে বলা হয়েছিল, “Malala dared to stand up for herself and other girls and used national and international media to let the world know girls should also have the right to go to school”

সুতরাং, আবালামি করার আগে একটু জাইনা নিলে ভাল হয়”।

হ্যাঁ, আবলামি করার আগে জেনে নিলে ভাল হয়, এমন উপদেশ শিবরাজ চৌধুরী দিচ্ছেন বটে, কিন্তু যাদের দিচ্ছেন, তাদের কাছে এটা উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতোই। এরা জানার চেয়ে আমার আপনার চোদ্দগুষ্টি নিয়ে ‘গাইল’ দিতে ওস্তাদ। এতো জানার সময় কোথায় এদের?

গত বছর টিভিতে জন স্টুয়ার্টের ‘ডেইলি শো’ দেখছিলাম বলে মনে আছে। সেখানে একটি পর্বে মালালাকে  আনা হয়েছিল।  তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল –

‘তোমাকে যারা গুলি করেছিল, আবার যদি তাদের কারো সাথে মুখোমুখি হতে হয়, তবে তুমি কি বলবে?’

উত্তরে মালালা বলেছিল –

‘আমি বলব, মেয়েদের পড়ালেখার ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি তোমার মেয়ের শিক্ষার জন্যও আমি লড়ব’।

httpv://www.youtube.com/watch?v=gjGL6YY6oMs

আমরা বুড়ো-হাবড়ারা যখন এ ওর পেছনে লাগাতে ব্যস্ত, ব্যস্ত কথার তুবড়ি ছোটাতে আর কিছু না পড়ে না জেনে ফেসবুকিয় বুদ্ধিজীবীতা জাহির করতে, তখন এই ১৬/ ১৭ বছরের মেয়েটা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে কথা বলতে হয়, কিভাবে কাজ করতে হয়।

আমি আমার স্ট্যাটাসটা ফেসবুকে দেয়ার পর অবধারিতভাবে সেই স্পর্শকাতর বিষয়টিও উঠে এসেছে। যে পাকিস্তান, তার মিলিটারি ত্রিশ লক্ষ বাঙালীর হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী তার সবকিছু অস্বীকার করাটা দোষের কোথায়? এমনটি লিখেছেন এক ফেসবুক বন্ধু স্ট্যাটাসের মন্তব্যে। আমি বলব,  কেউ কিন্তু অস্বীকার করছে না যে পাকিস্তানী সেনারা আমাদের ত্রিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। আমরা তার প্রতিবাদ করছি, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তিও চাচ্ছি। ঘৃণিত পাকসেনাদের বিচারও দাবী করছি, দেশে, এবং আন্তর্জাতিকভাবেও।  আমি নিজেও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমি নিজেও বড় হয়েছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিমণ্ডলেই। তাই  ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ জিনিসটা এতো সংকীর্ণ হবার কথা নয় যে, একটি সাহসী মেয়ে তালিবানদের বিরুদ্ধে একা যুদ্ধ করছে, নারী শিক্ষার প্রসারে কাজ করছে – অথচ তাকে আমরা সাধুবাদ দিতে পারব না, প্রশংসা করতে কুণ্ঠিত হব। এটা করলে আসলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই অপমান করা হয়। আসুন আমরা বিশ্বমানব হতে শিখি। বাঙালিত্বের অপর নাম যে বিশ্বমানব হবার শিক্ষা – তা ভুলে যাই কেন?

আর যে সব বাম ঘরনার লোকজন মালালার পুরস্কারের পেছনে যথারীতি, ‘পশ্চিমা চক্রান্ত’-এর গন্ধ পাচ্ছেন, হেজিমনির হেঁজেল গোঁফে তা দিয়ে ভাবছেন হঠাৎ করেই আইসিস ঠেকাতে এ বছর মালালাকে নির্বাচন করা হয়েছে নোবেলের জন্য, তারা জানেনও না যে, আসলে মালালার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল গত বছরই। গতবছরই মালালা পুরস্কার বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে ছিলেন। সে সময় বহু বিখ্যাত জনের পক্ষ থেকে পিটিশন করা হয়েছিল যেন মালালা এটি পান। ২৫৯০০০ সাক্ষর জমা হয়েছিল সপ্তাহখানেকের মধ্যেই, এমনকি রিচার্ড ডকিন্সের মতো বিজ্ঞানীর পক্ষ থেকেও ক্যাম্পেইন করা হয়েছিল। ২৫৯টি নমিনেশনকে পেছনে ফেলে মালালা এগিয়েও ছিলেন, কিন্তু গতবছর তিনি নোবেল কমিটির বিবেচনায় উত্তীর্ণ হননি। কিন্তু গতবার নোবেল না পেলেও সবাই বুঝেছিল মালালার নোবেল-প্রাপ্তি কেবল সময়ের ব্যাপার।  তো এ বছর তিনি নোবেল পেলে সেটা ভুঁইফোড় ভাবে কিংবা ‘আইসিস আর ইসলামোফোবিয়া’কে ট্যাকেলের জন্য হবে কেন, তা আমার বোধগম্য হল না কোনভাবেই।

অবশ্য এর মাধ্যমে আমি বোঝাতে চাইছি না যে, নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। অবশ্যই আছে। ওবামা,  রুজভেল্ট, হেনরি কিসিঞ্জারের মতো লোকজন এই পুরস্কার পেয়েছেন, যা অবশ্যই বিতর্কিত। কিন্তু এ পুরস্কার তো মার্টিন লুথার কিং, শাঙ্খারভ, মাদার তেরেসা, নেলসন মেন্ডেলাও পেয়েছেন। সেটা ভুলে গেলে চলবে কেন? মালালা এ পুরস্কার পেলে সেটা ঘৃণিত বা হবে কেন, আর নোবেল-পিস-প্রাইজের কবরই বা হবে কেন? মালালার পুরস্কারে খুশি না হতে পারি, অন্ততঃ ঘৃণা করার মতো তো কিছু ঘটেনি।

আরেকটি ব্যাপার। মালালার এ পুরস্কারের প্রচার আর বিতর্কে কৈলাস সত্যার্থীর পুরস্কার প্রাপ্তির ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেছে। তার “বাচপান বাঁচাও” আন্দোলন ভারতের শিশুদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখনও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী অধিকারবঞ্চিত সুযোগসুবিধা বঞ্চিত হয়ে দিন কাটাচ্ছে, এখনো যে কৈলাস সত্যার্থী মতো লোকজন এ জন্য কাজ করে চলেছেন সেটাই আশার কথা।

তারচেয়েও বড় কথা, উপমহাদেশের দুই চিরশত্রুদেশ অন্তত একটি ব্যাপারে এক হয়ে পুরস্কার ভাগ করে নিতে যাচ্ছে। এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় বলাই বাহুল্য।