কোনো এক মাহফিলে শুনছিলাম, এক মোল্লা আধুনিক সমাজের গোষ্ঠী উদ্ধারে নেমেছেন। উনার জবানিতেই লিখছি:

মোল্লাঃ “আজকালকের মডার্ন, আল্টামডার্ন পুলাপাইনরা দুই কলম তাগুতি বিদ্যা হাসিল করে নিজেরে কী ভাবে?? পোলা-মাইয়া একসাথে বসে ক্লাশ করে। আপনারাই বলেন সেখানে কী হয়… নাউজুবিল্লাহ! বেলেল্লাপনা, প্রেম-ভালোবাসা, জিনা-ব্যভিচার ছাড়া সেখানে কিছু হয়না। তারা আবার বলে মোল্লার দেৌড় নাকি মসজিদ পর্যন্ত। আমি তো বলি  ভাই- মাশাআল্লাহ, মোল্লার দেৌড় জান্নাত পর্যন্ত… (এখানে উনি যে জোশের সাথে কথাটা বলেন সেটা লেখায় বোঝানো সম্ভব না; তবে যারা ওয়াজ মাঝে-মধ্যে শোনেন তাদের কল্পনা করে নিতে কষ্ট হবার কথা নয়)”

আমি মোল্লার উপর পুরো দোষ চাপানোর পক্ষপাতী নই। আমার খুবই কাছের লোক ক্বওমী মাদ্রাসায় পড়ে বলে আমার পক্ষে ক্বওমীদের সাইকোলজি বোঝা কিছুটা সহজ হয়েছে। তবে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি বেকুব বনে গেছি! আমি কল্পণাও করতে পারিনি তাদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের প্রতি এতটা ঘৃণা অব্যক্ত রয়েছে। সম্ভবত একটি স্পার্কের অভাবে তারা বাস্ট হচ্ছেনা! (ইতোমধ্যে একবার স্পার্ক কিন্তু পেয়েছিলো জামাতের মাধ্যমে। একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ইস্যুর সাথে নিজেদের ইস্যুকে গুবলেট পাকিয়ে ফেলায় এবং সরকারের নেয়া ত্বড়িৎ পদক্ষেপের কারণে সে যাত্রা আমরা বিরাট বিপর্যয়ের হাত থেকে অবশ্য বেঁচে গেছি। কিন্তু পালিয়ে কদ্দিন?)

৫ ই মে তে শাপলা চত্ত্বরে লাখ লাখ কওমীদের একত্রিত হওয়ার পেছনে কারন সম্পর্কে মিডিয়া, সরকার সব তরফ থেকেই জানানো হলো এদেরকে ফুসলিয়ে আনা হয়েছে। আমি বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি যারা বাবা-মার নিষেধ উপেক্ষা করেও শাপলা চত্ত্বরে হাজির হয়েছিলো। আমি মনে করি মিডিয়া ও সরকার এক্ষেত্রে হয় সঠিক মেসেজ পেতে ব্যর্থ হয়েছে নতুবা আসল গোমর ফাঁক না করে চেপে গেছে! আমি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলছি, এখানে সামগ্রিক ক্বওমীর চিত্র ফুটে ওঠেনি। এখানে সরকার যে ব্যাপারটা জানে এবং ইচ্ছে করেই গোমর ফাঁক করেনি তা জোরগলায় বলা না গেলেও হাটহাজারী মাদ্রাসায় ৩০ কোটি টাকা মূল্যমানের সম্পত্তি দানের কানাঘুষাকে কেন্দ্র করে সন্দেহ ঘনীভূত হয় বৈকি।

ক্বওমীর ছাত্রদের জেনারেল লাইনে পড়া ছেলে-মেয়েদের ব্যাপারে বিরূপ ধারণা পোষণের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন তাদের উস্তাদ (শিক্ষক)। ছোট বয়স থেকে এদের এতটাই শাসনের উপর রাখা হয় যে এরা মনস্তাত্বিকভাবেই ওস্তাদের সব কথাকে বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়। এছাড়া অবশ্য উপায়ও থাকেনা। ক্বওমীর সিস্টার কনসার্ণ হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ৫ বছর থেকে শুরু করে ১৫/১৬ বছরের ছেলেপেলেদেরও ভর্তি করা হয়। এদের অনেকেই ভর্তি করানো হয় বেয়াড়া বলে!

এসব মাদ্রাসার চাকচিক্যও কিন্তু দেখার মতো! দেখা যায় একটি গ্রামে দু-তিনটি আধাপাকা বাড়ি ছাড়া বাকী সব কাঁচা বাড়ি, অথচ মসজিদ, মাদ্রাসাগুলো টাইলস সহকারে মনোমুগ্ধকর ডিজাইনে তৈরি! লোকে আল্লাহর ঘর না ভাঙার মধ্যে মোজেজা খুজেঁ পায়; আমি মনে মনে বলি, পেট্রোডলার ও দেশি শিল্পপতিদের টাকার ওজনে আবাসিক বিল্ডিংগুলোর তুলনায় ধর্মীয় বিল্ডিংগুলো সঠিকভাবে তৈরি হয় বলেই না এগুলো টেকে বেশিদিন।

যাহোক, মূল কথায় ফিরে আসি। একটা বাচ্চা যখন তার বাবা-মার ভালোবাসার বদলে হিংস্র ওস্তাদদের লাঠির আঘাত পায় তখন তার সাইকোলজিকাল ইফেক্টটা কেমন হয়?? ভেবে দেখেছি কখনো?? বাচ্চাটিকে যখন ছোট্ট বয়সেই ভিক্ষাবৃত্তির জন্য রাস্তায় নামানো হয় (বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফেতরা কিংবা কুরবানির চামড়া বিক্রির টাকা সংগ্রহ করা; কোথাও চাল, ধান এসবও দিতে দেখেছি), তখন তার আত্নমর্যাদাবোধের কতটুকু বাকি থাকে তা কী কখনো মাপার চেষ্টা করেছি?? এক রুমে গাদাগাদি করে শুতে গিয়ে ছোট্ট বয়সেই সে বাস্তবতার নিষ্ঠুর দিকটা দেখতে পায়। সে বুঝতে পারে সবল হরদম দুর্বলের অধিকার খর্ব করছে এবং এটাই নিয়ম! আবার এটাও দেখতে পায় তার মতোই দেখতে অপর এক শিশু নিজের মনে স্কুলে যাচ্ছে, মজা করতে করতে এটা ওটা শিখছে, অন্তত ওর মতো গৎবাঁধা বিজাতীয় ভাষায় লেখা ৬৬৬৬ টা লাইন সামান্য যবর-যের এর ব্যত্যয় ব্যতিরেকে ঠোঁটস্থ করছে না; এসব কী এই বয়সের কচি ব্রেনে সুদূরপ্রসারী ইফেক্ট ফেলে না??

হ্যাঁ, ফেলে। কারণ সেও মানুষ। যখন সে দেখতে পায় তার মতই আরেক ছেলে তার চাইতে অনেক অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে তখন সে স্বাভাবিকভাবেই ঈর্ষা না করে পারে না। আর সে ঈর্ষাটা দিনের পর দিন চলতে চলতে রূপ নেয় বিদ্বেষে। সেই সাথে বাবা-মাকে কাছে না পাওয়ার অভিমান তাতে যুক্ত হয়ে আস্তে আস্তে সে পুরো পৃথিবীটাকেই ঘৃণা করতে শুরু করে। এ কারণেই ক্বওমীদের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের মারাত্নক ঘাটতি চোখে পড়ে। তাদের ভালবাসা জুড়ে থাকে মক্কা-মদীনা, রাসূল আর বেহেশত। শৈশবের দুঃসহ স্মৃতিগুলো যখন তাড়িয়ে বেড়ায় তখন কল্পনায় শহীদ হয়ে বেহেশতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে হয়তো মনকে শান্ত রাখে।

ছেলেমেয়ে একসাথে পড়লে তাদের মধ্যকার পারস্পরিক জড়তা অনেকখানি কেটে যায়। ছেলেটি অনুভব করতে শেখে মেয়েটিও তার মতই রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। এতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে, বোঝাপড়াও হয়। কিন্তু মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্রটি যখন কৈশোর পেড়িয়ে যেৌবনে পদার্পণের মাধ্যমে বাস্তব দুনিয়ায় প্রবেশ করে তখন বিপরীত লিঙ্গের কাউকে সাধারণ পোষাকে দেখলেই তাদের মধ্যে একদিকে সংকোচ, অপরদিকে আকর্ষণ -এ দ্বিমুখী সংকট জাগ্রত হয়। সে না পারে জীবনসঙ্গীনীকে সঠিকভাবে ভালোবাসতে, না পারে শ্রদ্ধা করতে। পারে কেবল সম্ভোগ করতে। বাবা-মায়ের এ গ্যাপ নিঃসন্দেহে প্রভাব ফেলে সন্তানদের উপর।

অর্থাৎ মোটামুটিভাবে বলা যায় প্রজন্মের ঐ অংশটা সমাজের প্রতি একটা বিরূপ ধারণা নিয়ে বড় তো হয়ই, উপরন্তু সমাজের নানান আচরণ তার ধারণা আরো পোক্ত করে। এমতাবস্থায় তাদের কাছ থেকে সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখতে চাওয়াটা বাতুলতা। তারা তাদের আখিরাত গোছাতে সদা তৎপর। এরা এ দেশের খাবে, এ দেশের পরবে, অভাবের দিনে পাশের বাড়ি থেকে ধারটা পর্যন্ত করবে কিন্তু শুকরিয়া আদায় করবে অলীকে! হইলো কিছু এইটা?? তাদের মন পড়ে থাকে বেহেশতী মহলে, সমাসন্ন সুখের কল্পনায় বিভোর হয়ে নিজের শৈশবের কষ্টটাকে হয়তো আড়াল করতে চায়!

তাদের অধিকাংশই দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির সূচকে প্রভাব ফেলে না, কারণ তারা সচরাচর উৎপাদনের কাজেও লাগেনা। তারা সম্পূর্ণ মূল্যহীন কিছু আরবি বাক্য আউড়ে টাকা নিয়ে যায়। উৎপাদন কিংবা সৃজনশীল কাজের জন্য নয় বলেই এরা এ ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশে “বোঝার উপর শাকের আটিঁ।”

যে হারে এ সংখ্যাটা বাড়ছে, এখনই যদি আগল না দেয়া যায় তাহলে আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতে তার প্রভাব হবে ভয়াবহ। একদল অতিরিক্ত কাজ করে করে মরবে, আরেক দল কাজ না করে বসে বসে মরবে! কিংবা শেষমেষ হয়তো মধ্যপ্রাচ্যের ভূত এই বাংলার বুকেও বিচরণ করবে! দেশ হয়ে উঠবে অস্থিতিশীল…