৩০ জুন আদমজী বন্ধের একযুগ পূর্ণ হলো। বঙ্গীয় বদ্বীপ এলাকার এই অঞ্চলের সোনার বাংলা নামকরণের পেছনে তৎকালীন অর্থনীতির প্রধান আধার সোনালী আঁশ পাটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। ব্রিটিশ আমলতো বটেই, পাকিস্তান আমলেও এই অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিলো পাট। বলা হয়ে থাকে সোনালী আঁশের রপ্তানি আয়ের উপর ভিত্তি করে রাওয়ালপিন্ডি কিংবা ইসলামাবাদের উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু বঞ্চিত থেকেছে পূর্ব পাকিস্তান। ইতিহাস থেকে আমরা দেখি ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা কিংবা ভারত-পাকিস্তানের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা, আজ যারা বিত্ত বৈভবে সমাজের শীর্ষে তাঁদের শিল্প সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন এই পাট শিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে।

আদমজী জুট মিল, সময় ১৯৫৪

ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে যায় এই অঞ্চলের পাট শিল্প। সেই ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তানের ২২ পরিবারের অন্যতম আদমজী পরিবারের তিন ভাই ওয়াহেদ আদমজী ওরফে দাউদ আদমজী, জাকারিয়া আদমজী এবং গুল মোহাম্মদ আদমজী যৌথভাবে ১৯৫০ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ২৯৭ একর জমির উপর আদমজী জুট মিলের নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বর যার উৎপাদন শুরু হয়। পরবর্তী কালে সারা বিশ্বে আদমজী একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়। আদমজীকে বলা হতো প্রাচ্যের ড্যান্ডি (স্কটল্যান্ডের ড্যান্ডি শহরের নামানুসারে)। ব্যাক্তিমালিকানায় প্রতিষ্ঠিত এই মিলের প্রভূত উন্নতি হলেও অবহেলিত থাকে বাংলার অর্থনীতি, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার জনপ্রিয়তার পেছনে এই পাট শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত কিন্তু বঞ্চিত বাঙালিদের ভূমিকা অনেকখানি। সেই সময়ের রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও পাটের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। তখনকার একটি রাজনৈতিক স্লোগান মনে করা যেতে পারে- “সোনার বাংলা শ্মশান কেন?”

১৯৫৪ সালে আদমজী জুট মিল

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া শিল্প কলকারখানা জাতীয়করণ শুরু হলে ১৯৭২ সালেই ৫৪৪ টি শিল্প কলকারখানা জাতীয়করণ করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালের ২৬ মার্চ আদমজী জুট মিল জাতীয়করণ করে এর দায়িত্ব বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) কাছে দেয়া হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কিংবা তাঁর পরবর্তী কোন সরকারই দলীয়করণ, দুর্নীতি, আমলাতন্ত্র এসবের ঊর্ধ্বে উঠে বাংলাদেশের সোনার ডিম পাড়া হাঁস পাটশিল্পকে সঠিক পথে টেনে নিতে পারেনি। পাটশিল্পের আধুনিকায়নে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে পুরোপুরি। বরং ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার শিল্প ধ্বংসকারী শিল্পনীতির মাধ্যমে এই শিল্প ধ্বংসের ষোলকলা পূর্ণ করেছে। বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের ১১২ শতাংশ বিদেশী সাহায্যের আড়ালে রাষ্ট্র স্বাক্ষর করে বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচিতে। শুরু হয় ঢালাও বিরাষ্ট্রীয়করণ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মিল কলকারখানাগুলো এমনসব লোকের হাতে ছেড়ে দেয়া হয় যাঁদের কারো কারো সংশ্লিষ্ট শিল্পের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতাই ছিলোনা। কমিটমেন্টহীন এই লোকগুলোর ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেয়ার এবং সেটাকে খেলাপী ঋণে পরিণত করার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় আরো শক্তিশালী একদল লুটেরা ধনিক গোষ্টীর। তাই বলা যায় বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচী শিল্প খাতকে সমৃদ্ধতো করেইনি বরং বিরাষ্ট্রীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের হরিলুটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের পর দেশবাসী আশা করেছিলো শিল্পবান্ধব পরিবেশের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পের বিকাশ করা হবে। কিন্তু সেই আশা সুদূর পরাহতই থেকেছে। ১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর পরামর্শে তৎকালীন সরকারের পাটমন্ত্রী ওয়াশিংটনে বসে ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে আদমজী বন্ধের চুক্তি সই করে বসেন। অথচ তখনো ভারতে নতুন নতুন পাটকল চালু হচ্ছিলো। চাহিদা বাড়ছিলো পাট জাতীয় দ্রব্যের। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালের ৩০ জুন ১২’শ কোটি টাকা লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া হয় এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী এবং সেই ঐতিহ্যবাহী আদমজীতে ২০০৬ সালের ৬ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া উদ্বোধন করেন আদমজী ইপিজেড। ১২০০ কোটি টাকা লোকসানের কথা বলা হলেও এই সময়ে আদমজী সরকারকে শুধু ১৫০০ কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল আর ছয়শ’ কোটি টাকা গ্যাস বিল পরিশোধ করেছিলো। এর বাইরে ট্যাক্স,ভ্যাটতো ছিলোই। অন্যদিকে আদমজীসহ পাট শিল্পের পুনর্বাসনের জন্য যে অর্থ প্রয়োজন ছিলো তারচে’ বেশি টাকা বিশ্বব্যাংক পাট শিল্প গুটাতে খরচ করেছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, আদমজী বন্ধে যখন বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে, ঠিক একই সময়ে তাঁরা ভারতকে ঋণ দিয়েছে নতুন পাটকল স্থাপনের জন্য। এখানে বিশ্বব্যাংকের জিওপলিটিক্সের কাছে বাংলাদেশ নির্লজ্জভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। আদমজীর লোকসানের পিছনে রাষ্ট্রীয় মালিকানা কোন সমস্যা ছিলোনা, সমস্যা ছিলো পুঞ্জীভূত দেনার সমস্যা, মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং সময়মতো আধুনিকায়ন না করা, কোথাও কোথাও দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া অতিরিক্ত জনবল, আমলাতন্ত্র ও দুর্নীতি কিংবা ভুল অর্থনৈতিক নীতিমালার সমস্যা এবং সর্বোপরি দক্ষ ব্যবস্থাপনার সমস্যা। শেষ-বেলাতে এসেও বঞ্চিত করা হয় আদমজীর শ্রমিকদের। তাঁদের অনেকেই গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের টাকা পাননি। বেপজা শেষ পর্যন্ত পরিশোধ করেনি জমি বাবদ ৫২৯ কোটি টাকা।

বিগত মহাজোট সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গিকার ছিলো বন্ধ পাটকলগুলো চালু করা। সেটা হয়নি। খুলনার পিপলস জুট মিল চালু করা হয়েছে বলা হলেও মূলত চালু করা হয়েছে খালিশপুর জুট মিল নামে নতুন একটি মিল। একই অবস্থা সিরাজগঞ্জে বিজেএমসির আরেক বন্ধ ঘোষণাকৃত কওমী জুটমিলেরও। এটিও গতবছর অস্থায়ী ভিত্তিতে ফের চালু করা হয়েছে। ব্র্যান্ডনেমগুলো ঠিক রেখে এগুলো চালু করা হয়নি বিশ্বব্যাংকের আপত্তির কারণে। স্থায়ী কোন শ্রমিকও এগুলোতে নিয়োগ দেয়া হয়নি, হয়নি আধুনিক মেশিন স্থাপন। জোড়াতালি দিয়ে চালু করা এসব মিল স্বাভাবিকভাবেই পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারবেনা এবং লোকসানের অজুহাতে আবারো বন্ধ করে দেয়াটাও অসম্ভব নয়। মাঝখানে বেশ তোড়জোড় হয়েছিলো আদমজীর দুই নম্বর ইউনিটটির পুনঃউৎপাদন শুরু করার, কিন্তু বিশ্বব্যাংকের সাথে চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ কখনোই আদমজীর নামে কোন জুট মিল চালু করতে পারবেনা এবং বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে গিয়ে দেশের স্বার্থেও সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো মুরোদ সরকারের নেই। বিশ্বব্যাংক ‘আদমজী’ নামক ব্র্যান্ড নেমটি আর ব্যবহার করতে দিতে চায়না, এই না চাওয়ার পেছনে রাজনীতি আছে। যেটা ভারতকে লাভবান করছে, বাংলাদেশকে নয়।

আদমজীতে কর্মরত শ্রমিক


ঐতিহ্যের আদমজী বন্ধ করে দিয়ে ইপিজেড তৈরি করা হয়েছে। অনেক কোম্পানি প্লট নিয়ে উৎপাদনে গিয়েছে, অনেকে যায়নি, কারখানাই স্থাপন করেনি। ২৭৫ দশমিক ৩৮ একর জমিতে ৬০ টি প্লটের মধ্যে মাত্র ৩৯ টি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে উৎপাদনে আছে। কেউবা ফাঁক ফোঁকর খুঁজছেন প্লট অন্যকে হস্তান্তর করার। এখানে কাঁচা মুনাফা আছে। পানির দরে প্লট বরাদ্দ নিয়ে বিনিয়োগ না করেই যদি হাত ঘুরিয়ে মুনাফা করা যায়, মন্দ কী! কথা ছিলো গোল্ডেন হেন্ডশেকে যাওয়া শ্রমিকরা অগ্রাধিকার পাবে ইপিজেড-এ, পায়নি। এখানেও বঞ্চিত তাঁরা, যারা একদিন দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছিলেন। সেই সারা শরীরের পাটের আঁশ লাগানো শ্রমিকদের কেউ এখন রিক্সা চালায়, কেউ ভিক্ষা করে, কেউবা ছিনতাই- রাহাজানীর মতো অপরাধে জড়িয়ে গিয়েছে। কিংবা কোন শ্রমিকের মেয়ে হয়তো বাধ্য হয়েছে আদিম পেশায় নিজেকে সপে দিতে। রাষ্ট্র এখানে নির্মম, নির্লিপ্ত। না দিয়েছে গোল্ডেন হেন্ডশেকের টাকা না করেছে পুনর্বাসন।

পোশাক খাতকে আজ প্রধান রপ্তানি খাত হিসেবে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ভালো উদ্যোগ। কর্ম সংস্থান হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। কিন্তু একটু কি ভেবে দেখবেন- পোশাক রপ্তানি খাতে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আর এই খাতে ব্যয়িত বৈদেশিক মুদ্রার ব্যালেন্স কতোটা? ইউরোপ আমেরিকার ক্রেতাদের চাহিদা থাকে কাপড় হতে হবে অমুক দেশের, নিদেনপক্ষে সুতাটা অমুক মানের। ফলে সেই কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে। এভাবে তুলা, সুতা, কাপড়, বোতাম, জিপার সহ অন্যান্য কাঁচামালের জন্য ব্যয়িত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাদ দিলে নীট অর্জন পাওয়া যাবে। সেটা কতো? কিন্তু পাটশিল্প থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই দেশীয় উৎপাদন থেকে। কেউ কি ভেবে দেখেছে বিষয়টা? যেই বাজারটা প্রকৃতিগত কারণে একদিন আমাদের ছিলো সেটি এখন চলে গিয়েছে ভারতের কাছে। চলে গিয়েছে না বলে বলা ভালো আমরা তুলে দিয়েছি। কিন্তু পাটের জীন রহস্য আবিষ্কারের পর পাট চাষের জন্য উপযোগী বাংলাদেশ হতে পারতো বিশ্বের শীর্ষ রপ্তানীকারক দেশ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের এই শিল্প। আমাদের মনে রাখতে হবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণেই হিমায়িত চিংড়ি কিংবা চামড়া কখনোই আমাদের ভিত্তি রপ্তানি পণ্য (Base Export Product) হবেনা, হতে পারবেনা। বরং আবহাওয়া, অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তি এবং জীন রহস্য এসবের সমন্বয়ে পাট আবারো হয়ে উঠতে পারে মূল রপ্তানি পণ্য এবং প্রধান অর্থকরী ফসল, সোনালী আঁশ। দরকার শুধু সঠিক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এবং স্বদিচ্ছা।

লেখাটি দৈনিক সমকালে উপসম্পাদকীয়তে ৩০ জুন তারিখে প্রকাশিত