ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা: পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলার দ্বন্দ্ব; একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
ব্রিটিশরা মূলত: মুসলমান রাজন্য হতে ভারতবর্ষের ক্ষমতা অধিকার করেছিল। শাসক শ্রেণী থেকে প্রজা শ্রেণীতে রূপান্তরিত হওয়ার অভিজ্ঞতা মুসলমানদের জন্য সুখকর ছিল না। যার ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশদের সাথে মুসলমানদের দ্বন্দ্বের প্রতিচ্ছবি আমরা সব সময় দেখতে পাই।
১৮৩৭ সালে ভারতের দাপ্তরিক ভাষা পরিবর্তন করে ফারসীর বদলে ইংরেজীর প্রচলন করা হয়। ব্রিটিশদের এই পদক্ষেপকে ভারতের মুসলমানরা তাদের উপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করে।
এর আগে ১৮৩৫ সালে English Education Act প্রবর্তিত হলে, ব্রিটিশ ভারতের ইংরেজী ভাষা ও ব্রিটিশ পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ শুরু হয় কিন্তু মুসলমানরা সচেতনভাবে ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষা হতে দূরে থাকে। এর পিছনে মূলত: ধর্মীয় কারন সহ পরাজিতের শাসকের আক্রোশটি বেশি কাজ করেছিল। এবং আমরা দেখতে পাই, এই আক্রোশটি পরবর্তীতে ভয়াবহ ধর্মীয় চেহারা ধারণ করেছিল।
আধুনিক শিক্ষা থেকে দূরে থাকার ফলে, অনিবার্য পরিণতি হিসেবে ভারতের মুসলমানরা শিক্ষা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, সাহিত্য-সুকুমারবৃত্তির চর্চা, সরকারী চাকুরী সহ সর্বত্র পিছিয়ে পড়েছিল। এই পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের মধ্যে বঙ্গের মুসলমানদের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়; কারন, ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলের যাত্রা বাঙলা হতে শুরু হয়।
ধর্ম, বাঙলা ভাষার আঞ্চলিকতা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা-সাহিত্য চর্চার দিক হতে বাঙলা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল; পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ। পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের অধিকাংশ ছিল ধর্মে মুসলমান, ব্যবসায়-বাণিজ্য-শিক্ষা-সাহিত্য চর্চায় ছিল অনগ্রসর; অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের অধিকাংশ ধর্মে হিন্দু, ব্যবসায়-বাণিজ্য-শিক্ষা-সাহিত্য চর্চায় ছিল অগ্রসর, সবচেয়ে বড় কথা হলো ব্রিটিশদের তৎকালীন রাজধানী কোলকাতা ছিল পশ্চিমবঙ্গে এবং ব্রিটিশদের সরকারী কর্মচারী শ্রেণীর একটি বড় অংশ ছিল বাঙালি হিন্দু।
তাই, খুব স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে দুই বাঙলার হিন্দু-মুসলমানদের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ও মারাঠা সম্রাট শিবাজীর বদ্যনতায় সারা ভারতে মুসলমান-হিন্দুদের মাঝে ধর্মীয় জাতিভিত্তিক দ্বন্দ্ব স্পষ্টভাবে শুরু হয়েছিল। সেই দ্বন্দ্বের প্রভাব ব্রিটিশ শাসনামলেও রয়ে গিয়েছিল। তাই, ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শিক্ষা-সাহিত্য-আর্থিক দিক থেকে এগিয়ে যাওয়া বাঙালি-হিন্দুদের বাঙালি-মুসলমানরা অপছন্দ করতো।
অবশ্য এই অপছন্দের আরেকটি অনুঘটক আছে, তা হলো- ভারতের মুসলমানরা তাদের মসনদ চুড়ান্তভাবে ব্রিটিশদের কাছে খুঁইয়েছিল। তাই, ব্রিটিশদের মিত্রদের ভারতের মুসলমানরা ঠিক মধুদৃষ্টিতে দেখতো না। সেকারনে, ব্রিটিশদের মিত্র ও সরকারী কর্মচারী শ্রেনী হয়ে উঠা বাঙালী-হিন্দুদের সাথে বাঙালী-মুসলমানের হ্রেষাহ্রেষি ছিল।
আগেই বলেছি, দুই বাঙলার মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল আর এই দ্বন্দ্বের পিছনে মূল উপাদান ছিল- ধর্ম ও বাঙলা ভাষার আঞ্চলিকতার পার্থক্য এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য-শিক্ষা-সাহিত্য-সরকারি চাকুরিতে পশ্চিমের অগ্রসরতা ও পূর্বের পিছিয়ে পড়ে যাওয়া।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এসে পিছিয়ে পড়া মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গের উন্নতির জন্য তোড়জোড় শুরু হয়, পূর্ববঙ্গের জন্য আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর দাবি উঠে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ-রদ-বিরোধী আন্দোলন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে আমরা স্পষ্টাবে পূর্ববঙ্গের মানুষদের তাদের ন্যায্য অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হতে দেখি।
পূর্ববঙ্গের অনগ্রসতরাকে দূর করতে বাঙলাকে প্রশাসনিকভাবে দুই ভাগ করা তখন সময়ের বাস্তবতা ছিল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করা হলে পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবি সমাজের প্রায় সবাই খুশি হয়েছিল এবং এতে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবি সমাজ বঙ্গভঙ্গকে বাঙলাকে দ্বিখন্ডিত করার ব্রিটিশ অপপ্রয়াস হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
১৯১১ সালে পশ্চিমবঙ্গীয় বুদ্ধিজীবি সমাজের ব্যাপক বিরোধিতার মুখে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। ফলশ্রুতিতে, পূর্ববঙ্গে চরম হতাশা দেখা দেয়। এই সময়টাতে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের বিরোধ অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। পূর্ববঙ্গের মানুষরা ব্রিটিশরাজ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। বেশকিছু ক্ষেত্রে পূর্ব-পশ্চিমের এই দ্বন্দ্বটি ধর্মীয় তথা হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের চেহারা ধারণ করে। সে সময় পূর্ব-পশ্চিমের সম্পর্ক এতটাই তিরিক্ষে হয়ে গিয়েছিল যে, মজা করে অনেকেই বলতেন, এবার বুঝি ঘটি-বাঙাল যুদ্ধটা বেঁধেই গেল।
বঙ্গভঙ্গ রদ হবার পর পূর্ববঙ্গের মানুষরা নিজেদের নিগৃহীত অবস্থাটি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে। এই সময়টিতে পূর্ববঙ্গের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আন্দোলন খুব জোরেশোরে শুরু হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ খুব সহজ ছিল না। দুই বঙ্গের শিক্ষিত সমাজের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথকে বন্ধুর করে তোলে।
১৯১২ সালে ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় এসে পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত সমাজ, বুদ্ধিজীবি ও নেতাদের সাথে এক বৈঠক করেন। ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত এই সভায় নওয়াব সলিমুল্লাহ খান, নওয়াব সৈয়দ আলী চৌধুরী, শের-ই-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সহ পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিত্বশীল অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা বঙ্গভঙ্গ রদে তাঁদের হতাশা ব্যক্ত করেন এবং এই অঞ্চলের তথা পূর্ববঙ্গের উন্নতির জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করেন।
পরবর্তীতে, লর্ড হার্ডিঞ্জ পরিস্থিতি বিবেচনা করে ও পূর্ববঙ্গের প্রজাদের সন্তুষ্ট করতে ১৯১২ সালের ০২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করেন। আর এর সাথে শুরু হয় পশ্চিম ও পূর্ববাঙলার বুদ্ধিজীবি ও প্রতিনিধিত্বশীলদের আরেকটি মহাদ্বন্দ্ব।
সরকারিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেবার পর পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবিরা এর বিরোধিতা করা শুরু করেন। সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক মঞ্চ এই বিরোধিতা প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্ব হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের চেহারা ধারণ করে।
ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একদল পশ্চিমবঙ্গীয় বুদ্ধিজীবি লর্ড হার্ডিঞ্জের সাথে দেখা করেন। তাঁরা তীব্রভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং একে বাঙলাকে দ্বিখন্ডিত করার ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের একটি অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
তখন ব্রিটিশ সরকার থেকে জানানো হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টীকে আলোকিত করার প্রচেষ্টা বৈ অন্য কিছু নয়।
এই সময় পশ্চিমবঙ্গীয় বুদ্ধিজীবিরা বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক বক্তব্যও দেয়া শুরু করেন।
গুরুদাস বন্দোপাধ্যায় বলেছিলেন- “পূর্ববঙ্গের মানুষরা মুসলমান ও কৃষক; ওরা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে কি করবে? বিশ্ববিদ্যালয় কি কৃষি কাজ করার স্থান?”
সে সময় এমনও রবও উঠে, “মুসলমানদের জন্য আর কত বিশ্ববিদ্যালয় হবে?”
এর জবাবে, পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবি ও প্রতিনিধিত্বশীলরা এবং ব্রিটিশরাজ এটা নিশ্চিত করেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নয়, বরং পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া সকল সম্প্রদায় ও জাতির মানুষদের এগিয়ে নেবার জন্য স্থাপন করা হচ্ছে, সকলে এখানে পড়াশুনোর সুযোগ পাবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন, এমন আরেকজন পশ্চিমবঙ্গীয় বুদ্ধিজীবি হলেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তিনি রীতিমত আদাজল খেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতায় নেমেছিলেন। পত্রিকায় লেখালেখি, বক্তৃতা, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করা সহ হেন প্রচেষ্টা নেই, যা উনি করেননি।
আশুতোষ বাবুর এই কর্মযজ্ঞ দেখে লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিসের বিনিময়ে উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিরোধিতা প্রত্যাহার করবেন। আশুতোষ বাবু এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে গিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশরাজের দৃঢ়তা দেখে আশুতোষ বাবুর বরফ গলেছিল; কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি নতুন প্রফেসর পদ সৃষ্টির অনুমতি প্রাপ্তির বিনিময়ে উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিরোধিতা প্রত্যাহার করেছিলেন।
দু’একজনের বরফ গললেও পশ্চিমবাঙলার অধিকাংশ বুদ্ধিজীবি ও প্রতিনিধিত্বশীলরা গোঁ ধরেছিলেন, কোনভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হতে দেয়া যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে দুই বাঙলার বিরোধ বাড়তে থাকে। বিরোধের চেহারা ক্রমশ ধর্ম, ভাষাগত ও জীবনাচরণের পার্থক্যের দিকে রূপান্তরিত হতে থাকে। পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গের বিরোধ তিক্ততার সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়।
অবশ্য এটা অস্বীকার করার উচিত হবে না যে, পশ্চিমবঙ্গের এই বিরোধিতা শুধুমাত্র এক-বাঙলা টিকিয়ে রাখার জন্য ছিল না, এক-বাঙলা তত্ত্বের আড়ালে লুকিয়ে ছিল হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় দ্বন্দ্ব, বাঙলা ভাষার আঞ্চলিকতার পার্থক্য ও ব্যবসায়-বাণিজ্য-শিক্ষা-সাহিত্য-সরকারি চাকুরিতে পুবের চেয়ে পশ্চিমের অগ্রসরতার কারনে তাদের নাক-উঁচা মনোভাব।
পূর্ব-পশ্চিমের এই তুমুল দ্বন্দ্বের মাঝেই ১৯১২ সালের ১২ এপ্রিল ব্রিটিশ-ভারত সরকার বাঙলার প্রাদেশিক সরকারকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একটি সম্পূর্ণ প্রস্তাবনা পাঠায়। সরকারিভাবে বলা হয়, পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনসাধারণকে এগিয়ে নেবার জন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর চাপ কমানোর জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা জরুরি। এর মাঝে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রক্রিয়া শিথিল হয়ে যায়।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত শত বৈরিতা ও আপত্তি সত্বেও ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আলোর মুখ দেখে। আর এর মাধ্যমেই মূলত: পূর্ববঙ্গের আলাদা রাজনৈতিক স্বত্তার পূর্ণ আর্বিভাব ঘটে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভারতের ব্রিটিশ সরকারের যুক্তিটি পরবর্তী সময়ে বাস্তবতা হয়ে দেখা দিয়েছে। সত্যিই পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে আলোকবর্তিকার কাজ করেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়।
পূর্ববঙ্গের মানুষদের মাঝে উচ্চশিক্ষার বিস্তার ও রাজনৈতিক চেতনা বিকাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বস্থানীয় সম্পৃক্ততা তার স্বাক্ষ্য বহন করে।
পরিশিষ্ট:
বর্তমানে কেমন চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়?
এই প্রশ্নের উত্তরটি দু:খজনক; শিক্ষকদের দলাদলি, শিক্ষার্থীদের নোংরা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা, প্রশাসনিক জটিলতা ও সার্বিক মানের স্খলন এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের সুনামকে আজ মৃতবৎ করে ফেলেছে। অবশ্য এই বাস্তবতাটি বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য। আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও দুর্বাত্তয়নের এই কালো থাবার বাইরে নয়।
সবকিছুর পরও পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নতি বাতিঘর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অসামান্য ও চিরস্মরণীয়।
বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথাযথ শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে আলোকিত মানুষ সৃষ্টি করবে, এই কামনায় আজ উঠছি।
[ লেখাটির তথ্যের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইতিহাসবিদ ড. আর. সি. মজুমদারের “ঢাকার সৃত্মি” নিবন্ধটি এবং John F. Riddick এর The History of British India: A Chronology বইটির প্রতি কৃতজ্ঞ ]
ব্যাপারটাকে আসলেই ‘বাঙলাকে দ্বিখন্ডিত করার ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের একটি অংশ হিসেবে’ দেখেছিল বিরোধীতাকারি, পূর্ববাংলার মানুষ অমানুষ হোক বা থাকুক – এইটাই তারা চেয়েছিলেন, এমন ভাবনা নিতান্ত বালখিল্যতা!
কোনভাবেই মানা যাচ্ছে না। পুরো বিষয়টিতেই শুধু রাজনীতি, রাজনীতি আর রাজনীতিই ছিল, আর সবকিছু যা দেখছেন, তা তো তৈরি করা জিনিস, কেন বুঝতে পারছেন না?
যাই হোক, লেখার জন্য ধন্যবাদ!
@গুবরে ফড়িং,
আপনার যুক্তি ফেলনা নয়; এটাই বেশিরভাগ বিরোধিতাকারীর বিরোধিতার মূল কারণ ছিল। তবে, সবাই এমনটি ছিলেন না। এদের অনেকেই ছিল জাত্যভিমানী ও ধর্মান্ধ।
তবে, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনকে ডিভাইড এন্ড রুলের অংশ বিবেচনা না করে, শিক্ষার আলো বিস্তারের অংশ হিসেবে দেখলেই তাঁরা বেশি ভালো করতেন।
হিন্দুরা এসব না করলে পাকিস্তান কখনই হত না । ঢাকার নবাবদেরকে আর ১৯০৬ সনে মুসলিম লীগ নামে একটি আলাদা দল করার দরকার থাকত না। সেই ঢাকার নবাবদের দলই ১৯৪৭ এ একটা দানবিয় রুপ ধারণ করে দেশ বিভাজনের কারন হয় দাড়ায়।
@tausif,
আপনার এই অবজার্ভেশানটি সঠিক নয়।
মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়েছিল, এর দায় হিন্দুদের নয়, এর দায় সর্ম্পূণরূপে মুসলমানদের।
এটা ঠিক যে, অনেক হিন্দু বুদ্ধিজীবি মুসলমানদের অবজ্ঞা করেছেন। মুসলমানদের উচিত ছিল এই অবজ্ঞার জবাব দেয়া শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি ও সুকুমার বৃত্তির চর্চা, ব্যবসায়-চাকুরীতে এগিয়ে যেয়ে দেয়া কিন্তু তা না করে মুসলমানরা ঋণাত্মক পন্থা অবলম্বন করেছে।
আর ভারত কি সাংবিধানিকভাবে হিন্দু রাষ্ট্র? নিশ্চয় না। ভারত সাংবিধানিকভাবে সেক্যুলার রাষ্ট্র এবং ভারতে মুসলমানরা পাকিস্তান-বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভালো আছে।
ভারত রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে মুসলমানরা অধিকার বঞ্চিত হবে, এটা একটি ভুল ধারণা ছিল। মোদ্দা কথা, ধর্মের ভিত্তিতে ৪৭-এ দেশভাগ অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর হয়েছে আর তা ভোগ করছে মুসলমানরাই।
মুসলমানদের অপ্রয়োজনীয় জিদ আর ভুল সিদ্ধান্তের দায় হিন্দুদের উপর চাপানো বিবেচকের কাজ হবে না।
@তামান্না ঝুমু,
সম্ভবত: আকবর মুসলমান ছিলেন না; আকবর তার প্রবর্তিত ধর্মমত দ্বীন-ই-ইলাহীর জন্য বেশ কিছু হিন্দু, মুসলমান ধর্মগুরুদের বন্দী করেছিলেন বলে জানি।
অবশ্য এর রেফারেন্স এই মুহুর্তে দিতে গেলে খুঁজতে হবে; কোথায় পড়েছিলাম ঠিক স্মরণ করতে পারছি না।
আসলে, পৃথিবীর সব শাসকই নিজ ধর্ম কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ বা নিজের মতামত সবসময় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে; কেউ তা করেছে এবং করছে গায়ের জোরে, কেউবা মিশনারী প্রক্রিয়ায়।
@সাব্বির হোসাইন,
বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগুরুদের মাধ্যমে রাজ দরবারে সবগুলো ধর্মের সারাংশ বা তাদের পছন্দমত অংশ প্রার্থনা করানর নিয়ম প্রচলন করা হয়েছিল বলে জানি। তাদেরকে বন্ধি করে রাখা হয়েছিল, এটা জানা ছিল না। হতেও পারে। সব শাসকই কম-বেশি শোষক বইকি।
চমতকার তথ্যবহুল লেখা…অনেক কিছু জানলাম।
ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্ব আওরংগজেবের আমল থেকেই শুরু হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত বলা যায় না। আওরংগজেবেরও বহু আগে সুলতানী আমলে ধর্মের নামে বিভিন্ন শাসক যেভাবে বারে বারে ভারতবর্ষ হানা দিয়ে লুটপাট, গনহত্যা, দাস বানানো, বলপূর্বক ধর্মান্তকরন এসব করেছিল তাদের তূলনায় আওরংগজেব তেমন কিছু না। তখন থেকেই মুসলমানদের বিদেশী শক্তি হিসেবেই দেখা হয়েছে। বাংলাতেও তার প্রভাব ছিল, হিন্দুরা বাংগালীদের মুসলমান সংস্কৃতির কারনে বাংগালী হিসেবেও গন্য করত না। এ ছাড়াও ইসলাম ধর্মে কনভার্ষনও হিন্দুদের মানসিক পীড়া দিত। ফলাফল হল পাশাপাশি বসবাস করেও আজ পর্যন্ত দুই জাতি পৃথক সত্ত্বা হিসেবেই থেকে গেছে। এর প্রভাবে এমনকি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়ও আজো কেবল একে অপরকেই দোষারপ করে। এক পক্ষের দাবী বিদেশী আক্রমনকারী শক্তি তাদের ভয়াবহ অত্যাচার করেছে, জোর করে ধর্মান্তর মন্দির ধ্বংস করেছে, অপর পক্ষের দাবী তাদের ধর্মে স্বেচ্ছা ধর্মান্তকরনে হিংসায় জর্জরিত অপর পক্ষ বানোয়াট অভিযোগ করছে…এই অসূস্থ সংস্কৃতির শেষ কবে হবে কে জানে।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ আমলের আগে সম্ভবত মুসলমান শিখ যুদ্ধ হয়েছে হিন্দু মুসলমান লড়াই থেকে বেশী। জাহাংগীর আওরংগজেবের আমলে দুই (ঠিক কার কার আমলে এখন মনে পড়ছে না) শিখ ধর্মগুরুকে হত্যা করা হয়েছিল, শিখ সমাজে যাদের অবস্থান অনেকটা নবীর মত। পৃথিবীবাসীর কপাল ভাল যে শিখ জাতির ধর্মীয় সূত্র সমূহে ধর্মগুরু হত্যাকারী জাতির প্রতি কেয়ামত তক ঘৃনা পোষন বা নিশ্চিহ্ন করা সম্পর্কিত কোন শান্তিপূর্ন ঐশ্বী বানী নাজিল হয়নি। আমার জানামতে শিখরা পাঞ্জাবের বাসিন্দা বিধায় গোলযোগ সে অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। মধ্য বা দক্ষিন ভারতেও মুসলমান শিখ গোলযোগ হয়েছিল জানা ছিল না।
@আদিল মাহমুদ,
চমৎকার মন্তব্য।
এই বিষয়টা সব অঞ্চলের মুসলমান শাসকদের জন্য বাস্তবতা; খুব কম মুসলমান শাসক পাওয়া যাবে, যারা ধর্মের কারনে মানুষ নিপীড়ন করেনি।
ভারতে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব পুরোনো ব্যাপার হলেও, তার ভয়ংকর চেহারাটা অর্থাৎ চুড়ান্ত শত্রুতা বোধ করি শিবাজী-আওরঙ্গবেজের সময় থেকে শুরু।
দক্ষিন ও মধ্য ভারতে মুসলমান-শিখ সংঘাতের কোন তথ্য আমিও পাইনি; মুসলমান-শিখ দ্বন্দ্ব বৃহত্তর পাঞ্জাব অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ।
সরলীকরণ করলে বলা যায়, দক্ষিন ভারতে মুসলমান-দক্ষিন ভারতীয় হিন্দু এবং মধ্য ও উত্তর ভারতে মুসলমান ও মারাঠা-জাঠ-দোগরা হিন্দুদের দ্বন্দ্ব।
অনেক তথ্যবহুল। অজানা অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে পারলাম।
@আবেদ হোসেন,
ধন্যবাদ।
ভাল লাগলো নিবন্ধটা। প্রভুত্ববাদী মনোভাব থেকেই পশ্চিম বাংলা পূর্ব বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল। এখনও তাদের ভিতরে এই কৌলিন্য মনোভাবটা কাজ করে। এটা বুঝা যায় তাদের সাথে যৌথ ভাবে কোন কাজ করতে গেলে- দেশে বিদেশে সব জায়গায়।
@শাখা নির্ভানা,
চমৎকার ব্যাখ্যা।
বঙ্গভঙ্গ হয়ত পূর্ববঙ্গের জন্য লাভজনক হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ “বাঙালী” কে সাইজ করার জন্য এই উদ্যেগ নিয়েছিল সে কথা খুব জোর দিয়ে লেখায় দেখিনি। ইংরেজদের ভারতবর্ষে যে দুটো জাতি নাভিশ্বাস উঠিয়ে ফেলেছিল তারা বাঙালী আর পাঞ্জাবী। ৪৭ সালে দেশভাগের সময় সুদেআসলে তার উসুল করে নেয় ইংরেজ। গোটা ভারতবর্ষে ইংরেজদের তাড়াতে বাঙালীদের অবদান সবচেয়ে আগে। যেহেতু লেখাটি হিন্দু-মুসলমান বাঙালী নিয়ে-তাই এটা বলা এখন দোষের হবে না যে, হিন্দুদের অবদানই ছিল সমস্ত আন্দোলন সংগ্রামে, মুসলিমরা ছিল যেখানে নিষ্কৃয়।… ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীদের সবাই কি পূর্ববঙ্গ বিদ্বেষী তথা মুসলিম বিদ্বেষী ছিল? জামাতীদের একটা প্রচারণা আছে, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী ছিল। এই লেখায় সেটা নেই। অন্যসব বুদ্ধিজীবীদের নাম এসেছে। যাই হোক, লেখাটি পড়ে চরম হিন্দু বিদ্বেষী তথা পশ্চিমবাংলার প্রতি শত্রুভাপন্না হয়ে পড়লাম। দেশভাগের যৌক্তিকতাও খুজে পেলাম! সব মিলিয়ে ছাগুকূলদের এতদিনকার দৃষ্টিভঙ্গির মিল পাওয়াতে ৪৭ সালের দেশভাগ ইস্যুতে অনেকখানি কাছাকাছি এসে পড়লাম !
@সুষুপ্ত পাঠক,
বঙ্গভঙ্গ ও ঢাবি প্রতিষ্ঠাকে পূর্ববঙ্গের একজন মানুষ হিসেবে প্রশাসনিক দিক থেকে আমি আর্শীবাদ হিসেবে দেখি। তাই, বৃহত্তর অর্থে বিরোধিতা করলেও এই লাভজনক সঙ্কীর্ণতাকে সমর্থন করি।
দেশভাগের সময় আমি যতদূর জানি ব্রিটিশরা পুরো বাঙলাকে নিয়ে স্বাধীন বাঙলা রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেছিল।
আর মুসলমানদের একটি হঠকারিতার কথা আমি প্রায়ই বলি যে, ব্রিটিশরা না আসলে এই ভারতে মুসলমানরা কয়েকটি পকেট বাদে বিলুপ্ত হয়ে যেতো।
তার কারন, মুঘলদের পতনদের সময় মারাঠা আর শিখ যে রাজাদের উত্থান ও বিকাশ হয়েছিল, সেগুলো পুরোপুরি ধর্মান্ধ ছিল।
উত্তর ভারত ও বর্তমান শিখদের মুসলমান নিধন ও নিপীড়ন এবং উত্তর-মধ্য-দক্ষিন ও পূর্বভারতে শিখদের মুসলমান নিধন ব্যাপক জোরেশোরে চলছিল।
তাই, ব্রিটিশরা ভারতের অধীশ্বর না হলে মুসলমানদের অস্তিত্ব কতখানি টিকে থাকতো, তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
এছাড়া, আধুনিক ভারত ব্রিটিশরা ছাড়া কতখানি সম্ভব হতো, তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায়; তৎকালীন হিন্দু, মুসলিম কিংবা শিখ, যেই হোক না কেন, তাদের অস্ত্র ব্যাতিত অন্য ক্ষেত্রে আধুনিকতার চর্চা বস্তুত: কতখানি ছিল তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
বর্তমান অবস্থা কেমন, সে বিতর্কে না যায় কিন্তু ব্রিটিশদের আগমন আমি ভারতবর্ষের জন্য আর্শীবাদ হিসেবে দেখি।
মুসলমান-হিন্দু বিরোধ ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের আগমনের আগেও ছিল। ব্রিটিশরা শাসনের প্রয়োজনে শুধু তা জ্বাল দিয়ে টিকিয়ে রেখেছিল।
ঢাবি প্রতিষ্ঠার বিরোাধিতা যারা করেছিলেন, তাদের এই বিরোধিতার কারন ছিল বিভিন্ন। কেউ এক বাঙলা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, কেউবা জাত্যাভিমানী ছিলেন, কেউবা ধর্মের বিরোধের খাতিরে বিরোধিতা করেছিলেন। তবে, ধর্মের বিষয়টা আমার পর্যবেক্ষনে খুব অল্প ব্যাক্তির কথায় ধরা পড়েছিল। বাকি সবাই হয় এক বাঙলার স্বার্থে, নয়তো জাত্যাভিমানের খাতিরে বিরোধিতা করেছিলেন।
দেশভাগের প্রসঙ্গে আসি, পাকিস্তান সৃষ্টি আর পূর্ববঙ্গ ও আসামের জন্য আলাদা বিভাগ সৃষ্টির মধ্যে তো বিস্তর ফারাক।
একটির উদ্দেশ্য ধর্মকে পুঁজি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি আর অপরটির উদ্দেশ্য ছিল প্রাদেশিক শাসনের সুবিধের জন্য বিভাগ (পিছনে ডিভাইড এন্ড রুল নীতি থাকলেও)।
এক বাঙলা নিয়ে রাষ্ট্র হলে, সেখানে কিন্তু পূর্ব বাঙলা, আসাম, পশ্চিম বাঙলা, ত্রিপুরা, মিজোরাম আলাদা আলাদা প্রদেশ হতো।
আমি ব্যাক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পদ্ধতির পক্ষপাতি।
এই লেখাটা পড়ে হিন্দু বিদ্বেষী হবার যৌক্তিক কারন কি সত্যিই আছে?
তবে হ্যাঁ, মুসলমানিত্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পাঠ করলে অনেক কিছুই মনে হতে পারে।
এই লেখায় আমি ঐতিহাসিক ড. আর. সি. মজুমদারের বর্ণিত ইতিহাসের আলোকে ঢাবি প্রতিষ্ঠার সময় দুই বাঙলা বিরোধ ও তার কারণ সংক্ষেপে পক্ষালম্বন ব্যাতিরেকে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি, তাতে সাম্প্রদায়িক চেহারা খুঁজে বেড়ানো অমূলক।
ঢাবি প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা যারা করেছিলেন, তাদের বিরোধিতার কারণ এক বাঙলা যেমন ছিল, তেমনি ধর্ম ও জাত্যাভিমানও ছিল।
ছাগুকূল কি ভাবিলো, তা দিয়ে নিশ্চয় ইতিহাস পরিবর্তন হবে না।
ভালো থাকুন।
শুভ কামনা।
@সাব্বির হোসাইন,
আপনি যে অর্থেই বিরোধীতা করেন না কেন বিরোধীতাই তো করলেন। যদিও আমি ক্লিয়ার না ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় গঠনে আমি বিরোধী কিনা।
আমি যতদূর জানি শরৎ বসু এই প্রস্তাব তুলেছিলেন। ব্রিটিশদের কথা আমি জানি না। এটা একটা সিরিয়াস অংশ, যদি আপনার কাছে কোন লিংক থাকে দিতে পারেন।
আপনার কাছে এই অংশটা ডিটেইল জানতে চাইছি। কারণ আপনিই লিখেছেন ইংরেজরা মুসলিমদের কাছ থেকেই ক্ষমতাটা কেড়ে নিয়েছিল। মুসলিম ক্ষমতার সময় কেমন করে মুসলিমরা বিলুপ্ত হয়ে যায়? তাও সারা ভারত!
কোন সন্দেহ নাই বিষয়ে। একমত।
একমত। মুক্তমনাতেই সুফিদের ইসলাম প্রচারের উপর গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখা আছে দেখতে পারেন।
যদি খুব অল্প লোক ধর্ম বিদ্বেষী স্থান থেকে বিরোধী করে থাকে, আর বেশির ভাগ বাঙলার স্বার্থে- তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা করাই কি উচিত ছিল না? অথচ আপনার লেখার মেজাজটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন!
@সুষুপ্ত পাঠক,
এখানে আমি ভুল বলেছি; ব্রিটিশরা নয় বরং সোহরোওয়ার্দী ও শরৎচন্দ্র বসু স্বাধীন বাঙলার প্রস্তাব করেছিলেন।
ব্রিটিশরা স্বাধীন বাঙলার প্রস্তাব দেয়নি কিন্তু তারা এক বাঙলা প্রতিষ্ঠার একটি বিকল্প রেখেছিল। মাউন্টব্যাটনের প্ল্যানে ব্রিটিশরা বলেছিল, যদি বাঙলার বিধান সভার নেতৃবৃন্দ এক বাঙলার পক্ষে ভোট দেয় তবে বাঙলাকে ভাগ করা হবে না।
অন্যদিকে স্বাধীন বাঙলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন সোহরোওয়ার্দী ও শরৎচন্দ্র বসু কিন্তু বাঙলার মুসলিম-হিন্দু দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক টানাপোড়নে ও মতের অনৈক্য এবং পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারনে এই প্রস্তাবটি আলোর মুখ দেখেনি।
ধর্মান্ধ (প্রকৃত ধর্মপালনকারী) আওরঙ্গজেবের সময় থেকে মুঘল তথা মুসলমানদের শাসন ক্ষমতার পতন শুরু হয়। মুঘলদের ভারতের অধীশ্বর গণ্য করা হলেও শাহ আজমের সময় থেকে কয়েকটি পকেট বাদে বস্তুত: ভারতের কোথাও তাদের ক্ষমতার বাহাদুরি ছিল না। রাজ্যহীন সম্রাট বা, মুকুট সম্রাট শব্দগুলো বোধ করি এই ক্ষেত্রে বেশি যোগ্য হবে। এখানে একটা কথা বলে রাখা উচিত, মুঘলদের পতনের যুগে ভারতে প্রচুর স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হলেও এদের প্রায় সবাই মুঘলদের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতো; মহীশুর সালতানাত, নিজাম, রোহিলাখন্ড, বাঙলা, গুজরাটের সালাতানাত, দক্ষিন ভারতের শিয়া সালতানাত, উদিয়ার রাজা, অযোধ্যা, ইত্যাদি।
মুঘলদের পতনের সময় মারাঠা সাম্রাজ্য, জাঠ, শিখ সাম্রাজ্য গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আর্বিভূত হয়। আওরঙ্গজেব তার শাসনামলে প্রকৃত ইসলামিক নিয়ম চালু করে পুরো ভারতে অমুসলমানদের নিপীড়ন করা শুরু করে।
উত্তর ভারতের মুসলমান পাঠানরা (দুররানী সাম্রাজ্য বিস্তারের সময়) শিখ ও হিন্দু (কাশ্মিরি পন্ডিত ও জাঠ) নিপীড়ন করে আসছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুসলমান পাঠানরা সম্ভবত: দু’বার শিখ জাতিকে পুরো ধুয়ে-মুছে দিয়েছিল, এই সময় মুসলমানদের শিখ-নিপীড়ন এতটাই বেশি ছিল যে, শিখরা এই সময়টাকে হলোকাস্ট বলে।
উত্তর ভারতে শিখদের হাতে মুঘল ও মুসলিম পাঠানদের ক্ষমতা সংকুচিত হবার পর শিখরা তাদের উপর শত বছর ধরে ধর্মের কারনে করা নিপীড়নের শোধ তোলে। শিখ সাম্রাজ্যের ধর্মীয় নিপীড়ন এই বইতে পাবেন- ওয়াল্টার লওরেন্সের দ্য ভ্যালি অব কাশ্মির, বংশী পন্ডিতের এক্সপ্লোর কাশ্মিরি পন্ডিত; মুসলিম-শিখ দ্বন্দ্ব বুঝার জন্য আরেকটি বই আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে; হার্নিকের রিলিজিয়ন এন্ড ন্যাশনালিজম ইন ইন্ডিয়া।
উনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দু ধর্মাম্বলী দোগরাদের শাসনামল দেখতে পারেন।
মারাঠা সাম্রাজ্যের পুরো ভিতটাই ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। তাদের রাজ্য বিস্তার, সারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তাদের মৌসুমী আক্রমন ও লুটতরাজে তাদের ধর্মীয় জাতীয়তাবোধের চেতনার ছাপ স্পষ্ট।
এখানে মজার ব্যাপার হলো, স্বাধীন রাজ্যগুলো সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতো মুঘলদের আর একটি বড় মাসোয়ারা দিতো মারাঠাদের।
ওই যে বললাম, এক বাঙলার তত্ত্বকে সমর্থন করি কিন্তু তা যুক্তরাষ্ট্র পদ্ধতিতে; পশ্চিম বাঙলা, আসাম, পূর্ব বাঙলা, ত্রিপুরা ও উপজাতিদের জন্য আলাদা প্রদেশের ভিত্তিতে। দুই বাঙলা এক প্রদেশ হিসেবে কখনোই থাকতে পারতো না। আমাদের মধ্যে বৃহত্তর অর্থে মিল থাকলেও ভাষা ও জীবনাচরণে ব্যাপক অমিল। এই ক্ষেত্রে শাখা নির্ভানা ভাইয়ের মন্তব্যটি উল্লেখযোগ্য।
@সুষুপ্ত পাঠক,
আরেকটি বিষয় দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে…
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাবি প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন বলে একটা কথার চল আছে। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে ঢাবি প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গীয় বুদ্ধিজীবি ও প্রতিনিধিত্বশীলদের নিয়ে একটি জনসভায় রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন।
এটি একটি ডাহা মিথ্যে কথা।
কারন, ওই বছরের ২৪ মার্চ রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে আসেন এবং গীতমাল্য (১৯১৪) গ্রন্থে সংকলিত বেশ কিছু গান-কবিতা লিখেন।
সবচেয়ে মজার বিষয়, গীতমাল্যে সংকলিত “স্থিরনয়নে তাকিয়ে আছি” কবিতাটি শিলাইদহে ১৫ চৈত্র ১৩১৮ (ইংরেজী ২৮ মার্চ ১৯১২) তারিখে রচিত হয়।
১৯১২ সালে নিশ্চয় এমন কোন প্রযুক্তি ছিল না যে, কবিগুরু শিলাইদহ থেকে কোলকাতার গড়ের মাঠে উড়ে আসবেন। :lotpot:
রবি ঠাকুর ঢাবির বিরোধিতা করেছেন, এরকম কোন অকাট্য প্রমাণ আমি পাইনি।
@সাব্বির হোসাইন,
আমিও পাইনি। তবু আপনার লেখার আবহে পরবর্তীতে এরকম অভিযোগের (কুৎসাই বলবো) ডিফেন্স দুর্বল হয়ে যেতে পারে কোন নবীনের। ভাল থাকবেন।
@সুষুপ্ত পাঠক,
কুৎসায় কি আসে যাই বাহে, আলোচনার দরজা তো খোলাই।
আর যে নিন্দে করবে, সে বিষয় সম্পর্কে সত্য ও পরিষ্কার ধারণা পেলেও করবে; ওদের নিয়ে ভেবে কি লাভ বলুন।
আলোচনা চলুক।
ভালো থাকবেন। 🙂