‘মানুষের মৃত্যুদিন হচ্ছে তাঁর সত্যিকারের জন্মদিন। কারণ জন্ম থেকে শুরু হওয়া সার্কিটটা সম্পূর্ণ হয় মৃত্যুতে এসে। মৃত্যুর পর একজন মানুষের পুরো পোট্রেটটা সামনে দৃশ্যমান হয়, তাই মৃত্যুই তাঁর আসল জন্মদিন’। -কথাগুলো সরদার ফজলুল করিমের। মৃত্যুর মাধ্যমে জন্মের সার্কিট যিনি পূর্ণ করেছেন গতকাল। প্রথিতযশা এই দার্শনিকের জন্ম নিম্ন-মধ্যবিত্ত নিরক্ষর কৃষক পরিবারে। ১৯২৫ সালে। ভাই-বোনের মধ্যে চতুর্থ সরদার ফজলুল করিম ছোটবেলায় আক্ষরিক অর্থেই কৃষিকাজ করেছেন বাবার অনুগত সন্তান হিসেবে। লাঙল ধরেছেন বাবার সাথে, কিংবা মইতে চড়েছেন কৃষি জমির মাটি ভাঙার কাজে।

কাঠকয়লার গুড়ো পানিতে মিশিয়ে তৈরি কালি বাঁশের কাঞ্চিতে লাগিয়ে শুকনো তালপাতায় অ-আ-ক-খ’র হাতেখড়ি হয়েছিলো তাঁর এক পঙ্গু শিক্ষক লেহাজ উদ্দিন আহমদের কাছে, যিনি তাঁর দূরসম্পর্কের মামা হতেন। বড়ভাই মউজে আলী সরদার (পরবর্তীতে মঞ্জে আলী সরদার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েও এম.এ. ডিগ্রী শেষ না করেই চাকুরী নিয়েছিলেন সাবরেজিস্ট্রার হিসেবে। তাঁর সাথে সাথে ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন স্কুল শেষে ক্লাস নাইনে এসে ভর্তি হন বরিশাল জিলা স্কুলে। থাকতেন হোস্টেলে। সন্ধ্যা রাতে হোস্টেলের আলো নিভে গেলে চুপি চুপি চলে যেতেন কীর্তনখোলার পাড়ে। বরিশাল নদী বন্দরের টিম টিমে গ্যাসের আলোয় পড়বেন বলে। সেখানে কুলি সর্দারের হাঁকডাক আর প্রতিপত্তিতে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছিলেন বড় হয়ে কুলি সর্দার হবেন! পাঠক যেনো ভেবে না বসেন একাডেমিক বই পড়তে সরদার ওখানে যেতেন। উনি লুকিয়ে লুকিয়ে লাল-নীল ইস্তেহার পড়তেন। আর এই লাল নীল ইস্তেহার সাপ্লাই দিতেন Revolutionary Socialist Party of India (RSPI) এর এক সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী মোজাম্মেল হক। যার কাছ থেকে উনি পড়েছেন শরৎচন্দ্রের পথের দাবী। উজ্জীবিত হয়েছেন। প্রভাবিত হয়েছেন পলিটিক্যাল হতে। এইসব বই পড়াটা সহজ ছিলোনা। নিষিদ্ধ বই। চারিদিকে ব্রিটিশ চর ঘুরে বেড়ায়। বইগুলোর চারপাশটা এমনভাবে কাটা থাকতো যেনো কোথাও লেখা না থাকে বইয়ের নাম। এভাবেই জড়িয়ে পড়েন প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে।

১৯৪০ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন প্রথম বিভাগে। সেবছর মেট্রিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিলেন তিনি। বড়ভাই মঞ্জে আলী সরদারের ইচ্ছেতেই ভর্তি হন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। সেখান থেকে আই.এ.। বর্তমান ফজলুল হক হল তখন ছিলো ইন্টারমিডিয়েট কলেজের হোস্টেল। সরদার ওখানেই থাকতেন। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে উনি দ্বিতীয় হয়েছিলেন, এর আগে কোন মুসলিম ছাত্র এই অঞ্চলে এতো ভালো রেজাল্ট করেনি। পরবর্তীতে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। তাও বড়ভাইয়ের ইচ্ছেতেই, উনি এই বিভাগের ছাত্র ছিলেন। কিছু জানাশোনা ছিলো। কিন্তু করিডোর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দর্শন বিভাগের ডাকসাইটে অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্যের বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে বিভাগ পরিবর্তন করে ভর্তি হয়ে যান দর্শনে।

অনার্স এবং মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হবার পর একটা স্কলারশিপের অফার আসে বিলেত থেকে। যেটি দর্শনের জন্য বরাদ্দ ছিলো এবং শুধু মুসলিম ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ ছিলো। ফর্মালিটি ছিলো শুধু কোলকাতার রাইটার্স বিল্ডিঙে গিয়ে ইন্টারভিউতে এটেন্ড করতে হবে। সরদার ফজলুল করিম কোলকাতা গেলেন। কিন্তু প্রথমে রাইটার্স বিল্ডিঙে না গিয়ে গেলেন কমিউনিস্ট পার্টির হেড কোয়াটারে। সেখানে মুজাফফর আহমেদ, নৃপেন চক্রবর্তী (পরে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী) প্রমুখের সামনে সরদার হাসতে হাসতে বললেন ‘আমি তো বিলেত যাচ্ছি’। জবাবে হাসতে হাসতে ইনারা বলেন ‘আপনি বিলেত যাবেন আর আমরা এখানে বসে বসে ভেরেণ্ডা ভাজবো’?

সরদার ফজলুল করিম বলেন ‘আমাকে কী করতে হবে?’

‘কাঁথা কম্বল নিয়ে পার্টি অফিসে চলে আসেন, বুঝেন না কী করতে হবে?’ পার্টি নেতাদের উত্তর।

সরদার আর ইন্টারভিউ দিতে গেলেন না। ছিঁড়ে ফেললেন ইন্টার্ভিউ লেটার। কাজ শুরু করলেন পার্টির হয়ে। ১৯৪৬ সালে সেই ডাকসাইটে অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্য্য বললেন তুমি কাল থেকে ক্লাস নাও বিভাগে। যোগ দিলেন দর্শন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর মুসলিম কমিউনিস্টদের পুলিশ খোঁজা শুরু করলে পুলিশের খাতায় নাম উঠে সরদারের। পার্টি নেতারা বলেন ‘তুমি তো চাকরি করে কাজ করতে পারবেনা। পুলিশ তোমাকে খোঁজ করছে। চাকরি ছেড়ে দাও’। উনিও ডিপার্টমেন্ট চেয়ারম্যানের কাছে দরখাস্ত করলেন। বিভাগীয় প্রধান ওটা দেখে চোখ কপালে তুলে বলেন ‘হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ইট’? সরদার বললেন ‘স্যার একটা ডিসিশন হয়ে গেছে। এটা আর বদলানো যাবেনা’। সেই হরিদাস বাবু, যাঁর লেকচার শুনে সরদার দর্শনে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি বলেছিলেন ‘আই হ্যাভ নেভার সিন এ বয় লাইক হিম’। মানে এ ছেলে একটু অন্য পথে হাঁটে। যতো সহজে শিক্ষকতায় যুক্ত হয়েছিলেন তারচে’ সহজে সেটি ছেড়ে দিলেন।

চাকরি বাকরি ছেড়ে তিনি আশ্রয় নেন এক ছোটবোনের বাসায়। সিদ্ধেশ্বরী এলাকায়। সেখানে এসে উপস্থিত হন সরদারের বৃদ্ধ বাবা আর বড়ভাই। তাঁরা তাঁকে স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধকরে নিয়ে যেতে চান বরিশাল। কিন্তু সরদার জানেন, সেটা হবেনা। সদরঘাটে ইন্টেলিজেন্স আছে। তাঁকে ধরে ফেলবে। আঘাত পাবে প্রিয় বাবা আর বড় ভাই। তাই সরদার কৌশলে ইনাদের হাত থেকেও পালান। ১৯৪৮ এর মাঝামাঝি থেকে চলে যান আত্মগোপনে। শুরুতে ফজলুল হক হলে থাকার একটা আপাত চেষ্টা করলেও মুসলিম লীগের ছেলেরা এসে বের করে দেয় হল থেকে। সরদার পার্টিকে শেল্টার দিতে বলেন। কিন্তু পার্টি তখন মিলিট্যান্ট হলেও গণভিত্তি দুর্বল ছিলো। ডাকসাইটে হিন্দু কমিউনিস্টরা ভারতে চলে যাওয়ায় কর্মী সঙ্কট ছিলো প্রকট । শেল্টার দেয়ার মতো যায়গা ছিলোনা, অবস্থাও ছিলোনা। ফলে পার্টির পরামর্শে পাবনা ঈশ্বরদী পার্বতীপুর হয়ে কোলকাতায় প্রবেশ করেন সরদার ফজলুল করিম। কোলকাতায় প্রবেশের পর সরদার নিজেকে নিরাপদ ভাবতে শুরু করেন। ফ্রি-স্টাইল চলা শুরু করেন। আশ্রয় নেন রিফিউজিদের কাছে। কিন্তু এই রিফিউজিদের অবস্থা ছিলো খুবই করুণ। নিজেদের ভাগ্যই দোদুল্যমান। ভাগ্যক্রমে দেখা হয়ে যায় দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার তৎকালীন সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবিবের সাথে। পরে ওনার বাসায় উঠে পড়েন। কিন্তু সরদার জানতেন না ইন্টেলিজেন্সের কাছে খবর বাতাসের আগে পৌঁছোয়। একদিন শেষ রাতে সাদা পোশাকে পুলিশ এসে হাজির। সরদার ফজলুল করিমকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞেস করলেন-
-‘নাম কী’?
-‘আমার নাম ফজলুল করিম’।
-‘আপনি কী করেন?’
-‘আমি কলেজে পড়ি’।
-‘কী পড়েন? কোথায় পড়েন?’
-‘আমি চাখার কলেজে পড়ি। বিএ পরীক্ষা দিয়েছিলাম গতবার, পাশ করতে পারিনাই। এইবার আবার দেবো’।
-‘এখানে কেন এসেছেন?’
-‘বেড়াতে’।
এরপর পুলিশ নিজেদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা বলে। ‘নো নো, নট দিজ ওয়ান। সাম বিগ গাই। সাম বিগ সরদার ফ্রম ইস্ট বেঙ্গল’। পুলিশ এই সরদারকে পছন্দ করলোনা। তাঁরা চলে গেলো।
সরদার সটকে পড়লেন ঐ বাসা থেকে। চলে এলেন ইস্ট বেঙ্গলে।

পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে আত্মগোপনে থাক অবস্থায় নরসিংদী থেকে গ্রেফতার হন ১৯৪৯ সালে। সেই গ্রেফতার হওয়া সরদার ফজলুল করিম মুক্তি পান ১৯৫৫ সালে। জেলে বসেই উনি নির্বাচিত হয়েছিলেন পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য। এরপর আবার গ্রেফতার হন আবার মুক্তি পান। এভাবে একদশকেরও বেশি সময় উনি কাটিয়েছেন কারা অন্তরালে। আমৃত্যু ধারণ করেছেন কমিউনিস্ট চেতনা, যদিও শেষদিকে এসে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সরাসরি সংযুক্তি ছিলোনা, কিন্তু আদর্শ থেকে নড়েননি একচুল। আদর্শের জন্য তিনি লোভনীয় স্কলারশিপের চিঠি ছিঁড়ে ফেলেন অবলীলায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়েদেন এক কথায়। মোদ্দাকথা আদর্শ ছাড়া অন্য কিছুকে উনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি কখনো। সমসাময়িক গার্মেন্টস শ্রমিক প্রসঙ্গে উনি বলেছিলেন ‘‘এক সময়ের অবরোধবাসিনী এ সময়ের গার্মেন্ট শ্রমিক। তারা প্রতিদিন ভোরে উঠে রাজপথ ধরে কাজে যায়। এরা শ্রমিক। এদের শ্রমে দেশ ও অর্থনীতি চলে। ফলে আমি বলি, রাজপথে গার্মেন্ট শ্রমিক হাঁটে মানে, প্রতিদিন সকালে বিপ্লব হেঁটে যায়।’

দর্শন শাস্ত্রের মতো কাঠকোট্টা বইকে উনি সাবলীল ভাবে অনুবাদ করেছেন পাঠকের জন্য। দর্শনের অনুবাদ ছাড়াও উনি বিভিন্ন সমসাময়িক কিংবা ইতিহাস নিয়েও লেখালেখি করেছেন। লিখে রেখে গিয়েছেন অনন্যসাধারণ স্মৃতিচারণ।

সরদার ফজলুল করিম সারাজীবনই গণ-মানুষের হতে চেয়েছেন, তাঁদের কথা বলতে চেয়েছেন, থাকতে চেয়েছেন সাধারণ ভাবে। বেশ ক’বছর আগে এক সম্মাননা অনুষ্ঠানে উনি বলেছিলেন ‘৪৮ বছর ঢাকা শহরে আছি, ঢাকা শহর আমার হয়নি, আমিও ঢাকা শহরের হতে পারিনি’। উনি আসলে ঢাকা শহরের নন, উনি গণ-মানুষের হতে চেয়েছিলেন। সেটা হয়েছেন। সেখানেই তাঁর জন্ম থেকে শুরু হওয়া সার্কিটটা সম্পূর্ণ হয়েছে, তাঁর পুরো পোট্রেটটা দৃশ্যমান হয়েছে, হয়েছে নতুন জন্ম, আগামী প্রজন্মের জন্য।