১
বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, ফরমালিন ফলে ফুলে উঠেচে দেশটা। সুরম্য রাজপ্রসাদের অন্দরে তাই বসিয়াছে জরুরি এক সভা। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়া এমনকি কাঁচা ঘুম থেকে ডাকিয়া তোলা হইয়াছে মহামান্য রাজা!
চোখ কচলাইতে কচলাইতে রাজা মন্ত্রীকে শুধোন, “কি হে, বসিয়া বসিয়া তুমি কাট শুধু ঘাস, এইদিকে বিষালো আম খাইয়া প্রজা মোর হয় লাশ!”
কাঁপিতে কাঁপিতে কহেন মন্ত্রীমশাইঃ “মার্জনা করিবেন, জাঁহাপনা! দুষ্ট বনিক-গনে করিয়াছিলাম সাবধান, তবু তারা চোখে দিতে ধূলা, রাজকোষে করিয়া গেলে অকাতরে দান! কিন্তু ভাবিবেন না, ধর্মাবতার! এইবার আমার খেলায় হবে ওদের সর্বনাশ! ফরমালিন বিক্রয় হয় যেথা, নিমিষেই হানা দিব সেথা, ধসাইয়া দিব সব শয়তানের চেলা, যাহারা আম্র-কুঞ্জে পাকায় ফল পুরিয়া বিষের ঢেলা …..”
শুনিয়া চিৎকার করিয়া উঠেন রাজা: “খামোশ! চোপরাও! শুনিয়া রাখ মন দিয়া, এক মাসের মধ্যে যদি না কর ফরমালিন ধ্বংস, তুমারে আমি করিবই করবি নির্বংশ!”
এদ্রুপ কহিয়া শ্রান্ত রাজা আবার পড়িলেন ঘুমাইয়া!
২
কালাম আম-ওয়ালা হাত-পা ছাড়িয়ে মড়ার মত পড়ে থাকে আড়তের খালি মেঝের উপর! শূন্য ঝাঁকার পানে ক্ষণিক পর পর তাকায়, আর নিঃশব্দে নয়ন জলে ভাসে! বাঙালি আমও ছাড়ল? হায় রে, বাঙালি!
পাশেই শুয়ে থাকা সালাম আম-ওয়ালার মুখ থেকে কিছু সান্তনাবানী নির্গত হয়: “কান্দিস না, কাইন্দা কুনো ফায়দা নাই! একটা ব্যবস্থা হইবই! আল্লাহ্র দুনিয়ায় ব্যবসা কোম আছে?”
বিমর্ষ কালাম আম-ওয়ালা হঠাৎ জ্বলে উঠল:” আর মনে লয়, আল্লাহ্র দুনিয়ায় খালি আমই আছে? কেন, হারামির বাচ্চারা মাচুয়াগো ধরতে পারে না? অহন বাঙালি বাঁচবো কেমনে? টিকব কেমনে এই ধরাধামে ?”
সালাম দুঃখের ভিতরও হেসে উঠিল: “আম না থাকলে কি হইছে? আমের জুস তো নিষিদ্ধ হয় নাই! তাছাড়া ফার্মেসিগুলাও তো বন্ধ হয় নাই! ঐখানে হুনছি বেবাক ফলের ভিটামিনই পাওন যায়! আম খালি গাছেই ধরে না, বুঝলি কালাম! দোকান, রেস্টুরেন্ট, ফার্মেসি – সব জায়গাতেই আম পাওয়া যায়!”
৩
ব্রিজের মোড়ে নতুন একটা ট্রাকের শব্দে সেপাইয়ের চোখ সজাগ হয়ে উঠে, অনেকক্ষণ পর একটা পাওয়া গেছে! জানোয়ারের বাচ্চারা ভয়ে আর শহরেই ঢুকে না!
অতি উৎসাহী হেল্পার আগ বাড়িয়ে বলে উঠে, “একদম ফ্রেছ আম, ছার, এক্টুও ঔষধ নাই কা, ছার, বিসছাস করেন!”
অনেকক্ষণ যাবত হাতখানা নিশপিশ করছিল, তাই দেরি করে না সেপাই, প্রবল চপেটাঘাতে মুহুর্তের মধ্যেই হেল্পারের ডিহাইড্রেশন দেখা দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে ড্রাইভার বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করে ফরমালডিহাইডের কাছে, অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্দুকের বাটের আঘাত একটাও মাটিতে পড়ে না ড্রাইভারকে ছেড়ে, অন্যদিকে বুলডোজারে প্রায় পিষে ফেলা হয় বস্তার পর বস্তা রসালো আম!
মুহুর্তেই এক অভাবনীয় জটলা তৈরি হয় জায়গাটিতে! পড়িমরি করে ছুটে আসতে থাকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা! টোপর-ভর্তি করে আম জনতা তুলে নেয় ডাঁসা ডাঁসা, রসালো, গোপাল গোপাল সব আম! অনেক অনেকদিন তারা দেখেনি এত এত আম, বিনে পয়সায় আম-সুখ করার এমন মহা-সুযোগ করে দেয়ার জন্য লোকগুলো মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রাজবাহাদুরের নিকট!
৪
এরপর থেকে ট্রাকগুলি আর শহরেই ঢোকে না। গ্রামের হাড়-হাভাতের দল অবশেষে পানির চেয়েও কম দামে আম খেতে শুরু করে এবং আম-দরদি রাজার জন্য দুহাত তুলে দোয়া করতে থাকে!
একদিন এভাবে জয় হয় দেশের আমজনতার! ধনীদের একটি একচ্ছত্র অধিকার ছিনিয়ে এনে এক নতুন ইতিহাস গড়ে দেশের আম-জনতা!
ফরমালিনের বিষয়টি নিয়ে প্রথমে মাঠ গরম করেছে মিডিয়া। ঢাকা মহানগর পুলিশ এর সারাসি উদ্যোগ শুরু হয়ার পরদিন রাস্তায় গাড়িতে এক সহযাত্রী– এই উদ্যোগে কিছুই হবে না বলে মন্তব্য করলেন। উত্তরে আমি বললাম– দেখুন অনেকেরই বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। যার প্রমাণ পেলাম গত দুদিন ধরে ফল ব্যবসায়ীদের সমিতি নড়ে চড়ে বসায়। ওরা বলছে ওদের হয়রানি করা হচ্ছে। আমার জানতে ইচ্ছ করে– মিডিয়ায় যখন খবর বেড়োতে শুরু করল তখন আপনারা কোন গর্তে লুকিয়ে ছিলেন? তখনই তো আপনারা নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থের পাশাপাশি জনস্বার্থে ফরমালিনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা কিভাবে নেওয়া যায় তার উদ্যোগ নিতে পারতেন। দেখলাম তো আপনাদের সংবাদ সম্মেলনে ঢাবি, বুয়েটসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। ঐ শিক্ষকরা কেন টনকে টন ফল ধ্বংস করার পর জেগে উঠলেন?
বুঝতে পারছি না, ডিএমপির ফরমালিন বিরোধী কার্যক্রমের সঙ্গে কেন বিশেষজ্ঞরা যুক্ত ছিলেন না। বাংলাদেশে তো অপরাধ বিজ্ঞান পড়ানো হয়। সেই বিজ্ঞানীরা এই অপরাধের বিরুদ্ধে কি কিছু ভাবছেন না।
ফরমালিন যারা মেশায় তারা খারাপ মানুষ। যারা ফরমালিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে তাদের উদ্যোগটি ভালো কিন্তু এতে কোনো বুদ্ধিমত্তার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে বুদ্ধিমান মানুষ নেই তা তো নয়। কিন্তু মুর্খরাই যেন সব কর্তৃত্ব দখল করে আছে।
@আলসেকুড়ে,
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
না, এমন লোক দেখানো উদ্যোগটিই বরং ভাল নয়। ফরমালিন ধ্বংস করতে হলে আমবাগানে হানা দিতে হবে আম ফলনের আগেই, বিষাক্ত রাসায়নিকের কেন্দ্রগুলি গুঁড়িয়ে দিতে হবে, তা না করে চেকপোস্টে ফরমালিন ধরতে গেলে, ঐ সকল আম আমজনতার ভাগ্যেই জুটবে, ফেলে যাওয়া আম টোপর ভরে তুলে নিতে দলে দলে ছুটে আসবে আমজনতা!
সময়োপযোগী রম্য রচনা।
@গীতা দাস,
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, দিদি! রম্য ঢংটি ধরে ফেলেছেন বলে আনন্দ হচ্ছে!
গল্পের ন্যায় বাস্তবেও যদি এমনটি হত; মন্দ হত না 🙂
২২ দিন ধরে জণ্ডিসের কারনে বিছানায় বন্দী; একটু আম খাওয়ার ইচ্ছা জাগে এই অসুস্থ শরীরের। কিন্তু হায়!!! আজকাল তো বাজারে শুধু আম কিনতে পাওয়া যায়না; আমের সাথে বাধ্যতামূলক ভাবে ফরমালিন কিনতে হয়। অসুস্থ আর আক্রান্ত লিভারে ফরমালিন রুচবে না। তাই ভয়ে আর আম কিনিনা; আমের টাকায় ডাব খাই 🙁
ডাবেও যদি ভেজাল দেয়া শুরু করে তবে তো আমার মতন জণ্ডিসের রুগীরা বিনা চিকিৎসায় মড়বে (জণ্ডিসের অন্য কোন ওষুধ নাই; খালি ডাব আর বিশ্রাম) :-X
ডাবে ওষুধ দেয়া শুরু না হলেই হয় এখন।
আম পাইনা তো কি; ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে জাম খাই।
স্বাদে মিল না থাকলেও নামে কিন্তু মিল আছে; সেটাই সান্ত্বনা।
মুক্তমনায় স্বাগতম 🙂
@এম এস নিলয়,
ক্ষতি কি, ভাই? ডাবের সঙ্গে ঔষুধও ফ্রি পাইলেন! :))
🙂
ধন্যবাদ, আপনার মন্তব্যের জন্য!
শুধু আম নয়, দুধ, চাল, কলা, লিচু ইত্যাদি বেশির ভাগ খাদ্য ও পানীয়তেই ফরমালিন দেয়া থাকে। জেনেশুনে বিষপান ও ভক্ষণ ছাড়া উপায় কি আম-জনতার?
স্বাগতম মুক্তমনায়। (F) (F)
@তামান্না ঝুমু,
রাজা হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ফরমালিন সমূলে বিনাশ করার ঘোষণা দেন, সাধারণ প্রজাদের স্বার্থে! কিন্তু রাজার এই ”গোড়ায় না কেটে আগা ছাটা” সিদ্ধান্ত পোয়াবারো হয়ে যায় সাধারণ প্রজাদের জন্য, বিনে পয়সায় এত এত আম খাওয়ার কি এক সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে তারা!!!
অনেক ধন্যবাদ পাঠ ও মন্তব্যের জন্য!
@গুবরে ফড়িং,
খাদ্য সংরক্ষণাগার ও উপযুক্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাব বাংলাদেশে। এটাই যথাতথা ফরমালিন মেশানোর কারণ। তাই গ্রামের সরল দুধ বিক্রেতাও দুধে ফরমালিন মেশায়।