বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, ফরমালিন ফলে ফুলে উঠেচে দেশটা। সুরম্য রাজপ্রসাদের অন্দরে তাই বসিয়াছে জরুরি এক সভা। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়া এমনকি কাঁচা ঘুম থেকে ডাকিয়া তোলা হইয়াছে মহামান্য রাজা!

চোখ কচলাইতে কচলাইতে রাজা মন্ত্রীকে শুধোন, “কি হে, বসিয়া বসিয়া তুমি কাট শুধু ঘাস, এইদিকে বিষালো আম খাইয়া প্রজা মোর হয় লাশ!”

কাঁপিতে কাঁপিতে কহেন মন্ত্রীমশাইঃ “মার্জনা করিবেন, জাঁহাপনা! দুষ্ট বনিক-গনে করিয়াছিলাম সাবধান, তবু তারা চোখে দিতে ধূলা, রাজকোষে করিয়া গেলে অকাতরে দান! কিন্তু ভাবিবেন না, ধর্মাবতার! এইবার আমার খেলায় হবে ওদের সর্বনাশ! ফরমালিন বিক্রয় হয় যেথা, নিমিষেই হানা দিব সেথা, ধসাইয়া দিব সব শয়তানের চেলা, যাহারা আম্র-কুঞ্জে পাকায় ফল পুরিয়া বিষের ঢেলা …..”

শুনিয়া চিৎকার করিয়া উঠেন রাজা: “খামোশ! চোপরাও! শুনিয়া রাখ মন দিয়া, এক মাসের মধ্যে যদি না কর ফরমালিন ধ্বংস, তুমারে আমি করিবই করবি নির্বংশ!”

এদ্রুপ কহিয়া শ্রান্ত রাজা আবার পড়িলেন ঘুমাইয়া!

কালাম আম-ওয়ালা হাত-পা ছাড়িয়ে মড়ার মত পড়ে থাকে আড়তের খালি মেঝের উপর! শূন্য ঝাঁকার পানে ক্ষণিক পর পর তাকায়, আর নিঃশব্দে নয়ন জলে ভাসে! বাঙালি আমও ছাড়ল? হায় রে, বাঙালি!

পাশেই শুয়ে থাকা সালাম আম-ওয়ালার মুখ থেকে কিছু সান্তনাবানী নির্গত হয়: “কান্দিস না, কাইন্দা কুনো ফায়দা নাই! একটা ব্যবস্থা হইবই! আল্লাহ্‌র দুনিয়ায় ব্যবসা কোম আছে?”

বিমর্ষ কালাম আম-ওয়ালা হঠাৎ জ্বলে উঠল:” আর মনে লয়, আল্লাহ্‌র দুনিয়ায় খালি আমই আছে? কেন, হারামির বাচ্চারা মাচুয়াগো ধরতে পারে না? অহন বাঙালি বাঁচবো কেমনে? টিকব কেমনে এই ধরাধামে ?”

সালাম দুঃখের ভিতরও হেসে উঠিল: “আম না থাকলে কি হইছে? আমের জুস তো নিষিদ্ধ হয় নাই! তাছাড়া ফার্মেসিগুলাও তো বন্ধ হয় নাই! ঐখানে হুনছি বেবাক ফলের ভিটামিনই পাওন যায়! আম খালি গাছেই ধরে না, বুঝলি কালাম! দোকান, রেস্টুরেন্ট, ফার্মেসি – সব জায়গাতেই আম পাওয়া যায়!”

ব্রিজের মোড়ে নতুন একটা ট্রাকের শব্দে সেপাইয়ের চোখ সজাগ হয়ে উঠে, অনেকক্ষণ পর একটা পাওয়া গেছে! জানোয়ারের বাচ্চারা ভয়ে আর শহরেই ঢুকে না!

অতি উৎসাহী হেল্পার আগ বাড়িয়ে বলে উঠে, “একদম ফ্রেছ আম, ছার, এক্টুও ঔষধ নাই কা, ছার, বিসছাস করেন!”

অনেকক্ষণ যাবত হাতখানা নিশপিশ করছিল, তাই দেরি করে না সেপাই, প্রবল চপেটাঘাতে মুহুর্তের মধ্যেই হেল্পারের ডিহাইড্রেশন দেখা দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে ড্রাইভার বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করে ফরমালডিহাইডের কাছে, অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্দুকের বাটের আঘাত একটাও মাটিতে পড়ে না ড্রাইভারকে ছেড়ে, অন্যদিকে বুলডোজারে প্রায় পিষে ফেলা হয় বস্তার পর বস্তা রসালো আম!

মুহুর্তেই এক অভাবনীয় জটলা তৈরি হয় জায়গাটিতে! পড়িমরি করে ছুটে আসতে থাকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা! টোপর-ভর্তি করে আম জনতা তুলে নেয় ডাঁসা ডাঁসা, রসালো, গোপাল গোপাল সব আম! অনেক অনেকদিন তারা দেখেনি এত এত আম, বিনে পয়সায় আম-সুখ করার এমন মহা-সুযোগ করে দেয়ার জন্য লোকগুলো মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রাজবাহাদুরের নিকট!

এরপর থেকে ট্রাকগুলি আর শহরেই ঢোকে না। গ্রামের হাড়-হাভাতের দল অবশেষে পানির চেয়েও কম দামে আম খেতে শুরু করে এবং আম-দরদি রাজার জন্য দুহাত তুলে দোয়া করতে থাকে!

একদিন এভাবে জয় হয় দেশের আমজনতার! ধনীদের একটি একচ্ছত্র অধিকার ছিনিয়ে এনে এক নতুন ইতিহাস গড়ে দেশের আম-জনতা!