[পর্ব – ১] [পর্ব – ২] [পর্ব – ৩]
১৯৩৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেলেন আইরিন ও ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি। একই বছর নিউট্রন আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন জেম্স চ্যাডউইক। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ স্টকহোমে নোবেল পুরষ্কার নেবার সময় সারাক্ষণই মায়ের কথা মনে পড়ছিল আইরিনের। চব্বিশ বছর আগে মায়ের সাথে এসেছিলেন আইরিন মায়ের নোবেল পুরষ্কার অনুষ্ঠানে। আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন! পুরষ্কার দেবার সময় রাজা পঞ্চম গুস্তাভও মাদামের কথা বললেন আইরিনকে।
নোবেল বক্তৃতা দেবার সময় পদার্থবিজ্ঞানের অংশ বললেন আইরিন, আর রসায়নের অংশ বললেন ফ্রেড। সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের উত্তর মহাউৎসাহে ফ্রেডই দিলেন। ফ্রেড প্রশংসা পেতে পছন্দ করেন, মিডিয়া কভারেজ তাঁর খুবই ভালো লাগে। আইরিন কিছুক্ষণ পরেই উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন।
সংবাদ সম্মেলন শেষে আইরিনকে নোবেল অনুষ্ঠানের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। শেষে ফ্রেড নোবেল ফাউন্ডেশানের লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলেন আইরিন এক কোণায় বসে নিবিষ্টমনে বই পড়ছেন।
নোবেল পুরষ্কারের টাকা দিয়ে আইরিন স্সোতে তাঁর বাবার বাড়িটা নতুন করে তৈরি করালেন। বাড়িতে ফুলের বাগান, ছেলে-মেয়েদের খেলার মাঠ সবকিছুর ব্যবস্থা করলেন। নোবেল পুরষ্কার পাবার পর স্বাভাবিকভাবেই আইরিন ও ফ্রেডেরিকের সামাজিক মর্যাদা আরো বেড়ে গেলো। তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘কলেজ দ্য ফ্রেঞ্চ’-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিলেন। ফ্রান্সের প্রথম সাইক্লোট্রন তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করলেন ফ্রেডেরিক।
এদিকে ফ্রান্সে তখন প্রগতিশীল পপুলার ফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছে। সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট লিওন ব্লাম মেয়েদের ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করেন। কিন্তু ফ্রান্সে তখনো মেয়েদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। [ফ্রান্সে মহিলারা ভোট দেয়ার অধিকার পায় ১৯৪৬ সালে।] প্রেসিডেন্ট ব্লাম শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করলেন, শ্রমজীবীদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ালেন।
ফ্রান্সের বিজ্ঞান-গবেষণা বাড়ানোর জন্য প্রফেসর জাঁ পেরির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অব সায়েন্টিফিক রিসার্চ’। জাঁ পেরি আইরিনের বাবা-মা’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। জাঁ পেরির পরামর্শে প্রেসিডেন্ট ব্লাম ফ্রেডেরিককে ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অব সায়েন্টিফিক রিসার্চ’র ডিরেক্টর নিযুক্ত করলেন।
ফ্রান্সের বিজ্ঞান গবেষণা আরো গতিশীল করার লক্ষ্যে ব্লাম সরকার কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সে ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য একদিন প্রেসিডেন্টের পিএস এসে ফ্রেডেরিককে ডেকে নিয়ে গেলেন প্রেসিডেন্টের অফিসে। সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরলে আইরিন জিজ্ঞেস করলেন, “প্রেসিডেন্ট নিশ্চয় তোমাকে বড় কোন দায়িত্ব দিয়েছেন?”
“না, আমাকে দেননি, তোমাকে দিয়েছেন।”
“তার মানে?”
“মানে তোমাকে মন্ত্রী হতে হবে। বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে হবে তোমাকে।”
“তুমি সিরিয়াস?”
“ইয়েস মাদাম। তুমি আবারো আমার বস হয়ে গেলে।”
“কীভাবে?”
“আমার ব্যুরো তোমার মন্ত্রণালয়ের অধীনে।”
“আমার কি এ দায়িত্ব নেয়া উচিত?”
“ইয়েস বস্। দেশের কাজে যোগ্য ব্যক্তিরা এগিয়ে না এলে চলবে কীভাবে? ফ্রান্সের ইতিহাসে তুমিই হবে প্রথম মহিলা মন্ত্রী।”
পরদিন প্রেসিডেন্টের অফিসে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন আইরিন জুলিও-কুরি। তিনি সহ মোট তিন জন মহিলা মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন। আইরিনকে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের গবেষণা থেকে ছুটি নিতে হলো। সম্পূর্ণ নতুন এই প্রশাসনিক কাজে এসে সবকিছু একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করতে হলো আইরিনকে। দায়িত্ব নিয়ে তা ঠিকমত পালন না করার মানুষ আইরিন নন।
প্রতিদিন সকালে অফিসে এসে দেখেন তাঁর টেবিলে শত শত চিঠি ফাইল করে রাখা। চিঠিগুলোর বেশির ভাগই বিভিন্ন বিষয়ের জন্য ‘আবেদন’। আইরিন দেখলেন সবগুলো চিঠির উত্তর দিতে গেলে তাঁর আর কিছু করার সময় থাকবে না। বেশির ভাগ চিঠিরই লেখক উল্লেখ করছেন যে মেরি কুরির মেয়ে মন্ত্রী হয়েছে, সুতরাং তাঁদের সব আবেদনই পূর্ণ হবে। মেরি কুরির মেয়ের প্রতি এতটাই বিশ্বাস সবার!
আবার প্রচুর চিঠি আসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে যাবার জন্য, বিভিন্ন কিছুর উদ্বোধন করার জন্য। আইরিন কিছু কিছু চিঠির উত্তর লিখতে গিয়ে দেখেন যে মন্ত্রী হিসেবে নিজেকে লিখতে হচ্ছে না কিছুই। তিনি শুধু নির্দেশ দেবেন, নির্দেশ অনুযায়ী লিখে দেবার লোক আছে। আইরিন লিখতে নির্দেশ দেন, “আপনাদের সভায় গিয়ে প্রধান অতিথি হবার এবং বক্তৃতা দেবার মত সময় এবং ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই।”
প্রবীণ অভিজ্ঞ পি-এস বিনীতভাবে বলেন, “মাদাম, এভাবে সরাসরি তো কেউ বলেন না। শুরুতে তাদের আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে পরে যেতে না পারার জন্য দুঃখপ্রকাশ করতে হয়”।
“কেন? তারা তো ধন্যবাদ পাবার মতো কোন কাজ করেননি। আর আমি তো দুঃখ পাচ্ছি না যে দুঃখ প্রকাশ করবো। আমার তো আসলে বলা উচিত এভাবে আমার সময় নষ্ট করার জন্য আমি বিরক্ত।”
আইরিন দেখেন মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকরা সারাদিন বসে থাকে খবর সংগ্রহের জন্য। আইরিন যা করেন সবকিছুই তাদের জন্য খবর। আইরিনের দাপ্তরিক চিঠির ভাষা নিয়েও বড় বড় বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিন। সাংবাদিকদের ওপর তাঁর ক্ষোভ ছোটবেলা থেকেই। এখন এসব অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারে এত সময় ও শ্রম নষ্ট হচ্ছে দেখে ক্ষুব্ধ হন তিনি।
কিন্তু দেশের উপকার হবে এমন কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এবং ব্যবস্থা নিতে দেরি করেন না আইরিন। একদিন একটা চিঠি পেলেন সিভ্রের ‘স্কুল অব ফিজিক্স ফর গার্লস’র ডিরেক্টরের কাছ থেকে। ডিরেক্টর জানাচ্ছেন তাঁর স্কুলের মেয়েরা পড়ালেখায় খুবই পরিশ্রমী। সবাই পড়াশোনা করছে ভবিষ্যতে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হবার জন্য। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের সাথে সংগতি রেখে তাদের গবেষণাগারের কোন উন্নয়ন করা হয়নি গত চল্লিশ বছর। বিজ্ঞানমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেন কিনা।
চিঠির পুরোটা পড়ার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন আইরিন। এই স্কুলে তাঁর মা শিক্ষকতা করেছেন অনেক বছর। সেই সময়ও ভালো কোন গবেষণাগার ছিল না এই স্কুলে। তাঁর মা স্কুলের শেড ব্যবহার করেছিলেন গবেষণার কাজে। গত চল্লিশ বছরেও কোন ব্যবস্থা হয়নি! আইরিনের মন্ত্রণালয় অবশ্যই এই স্কুল শুধু নয়, এরকম সব স্কুলেই বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণাগারের ব্যবস্থা করবে। চিঠির শেষে ডিরেক্টরের নাম দেখে চমকে উঠলেন আইরিন। ইউজিনি কটন!
আইরিনের মনে পড়ে – তাঁর মায়ের ছাত্রী ছিলেন ইউজিনি। প্রায়ই তাদের বাসায় যেতেন ইউজিনি। ভীষণ আদর করতেন আইরিনকে। একেবারে ছোটবেলায় আইরিন যখন সবে সাইকেল চালানো শিখতে শুরু করেছে – ইউজিনি আইরিনের সাইকেল ধরে ধরে আইরিনের সাথে হাঁটতেন। কত গল্প করতেন তখন। আইরিনের স্পষ্ট মনে আছে ইউজিনি বলছেন – “অনেক বছর আগে বিশাল বিশাল ডাইনোসর ছিল এই পৃথিবীতে।”
“তুমি ডাইনোসর দেখেছো?”
“না আইরিন। আমি অত বুড়ো নই।”
“তাহলে গ্র্যানপি ডাইনোসর দেখেছে। গ্র্যানপি অনেক বুড়ো।”
আইরিন ইউজিনির সাথে দেখা করলেন।
মন্ত্রীসভায় আইরিনের সততা আর স্পষ্টবাদিতা অনেকেরই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালো। ছয় মাস ধরে কাজ করার পরও ডিপ্লোম্যাটিক ভাষা ও আচরণ আয়ত্ত্ব করতে পারলেন না আইরিন। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর একার পক্ষে পুরো সিস্টেম বদলানো সম্ভব নয়। তাঁর মনে হচ্ছে তিনি ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন, তাঁর বদলে ফ্রেড মন্ত্রী হলেই ভালো করতেন। কারণ ফ্রেড ক্ষমতার স্বাদ বোঝেন।
আইরিনের ইচ্ছে করছে বাবা-মা’র মতো সরবোনের প্রফেসর হতে। প্রফেসর হবার সব যোগ্যতা তাঁর আছে। নোবেল পুরষ্কার পাবার পর পৃথিবীর যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হতে পারেন তিনি। কিন্তু সরবোনের প্রফেসরশিপ পেতে হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে। আইরিন ভাবলেন তিনি যদি এখন দরখাস্ত করেন তাহলে তাঁর সহকর্মী শিক্ষামন্ত্রী কোন কিছু না দেখেই তাঁকে অনুমোদন দিয়ে দেবেন। এটা অনুচিত হবে ভেবে তিনি মন্ত্রীত্বে ইস্তফা দিলেন। মন্ত্রীপরিষদের সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
আইরিন রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের পুরনো পদে ফিরে গেলেন। সেখান থেকে সরবোনে প্রফেসর পদের জন্য দরখাস্ত করলেন এবং সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সরবোনের প্রফেসর পদে যোগ দিলেন। রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের পদটিও তাঁর থাকলো। অধ্যাপনা ও গবেষণার জগতে ফিরে এলেন আইরিন। কিন্তু ফ্রেডের সাথে যৌথ গবেষণা আর সম্ভব হলো না। ফ্রেড ‘কলেজ দ্য ফ্রেঞ্চ’ ও ‘ব্যুরো অব সায়েন্টিফিক রিসার্চ’ নিয়ে ব্যস্ত। ফ্রেড ‘ল্যাবরেটরি অব অ্যাটমিক সিন্থেসিস’ নামে নতুন একটা গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করেছেন। অ্যাটমিক নিউক্লিয়াস সংক্রান্ত নতুন নতুন গবেষণা চলছে সেখানে। ফ্রান্সের নিউক্লিয়ার গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে আইরিন ও ফ্রেডেরিকের হাত দিয়ে।
১৯৩৮ সালে আইরিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। যক্ষা তাঁকে ছাড়ছে না। যেদিন সুস্থ থাকেন সেদিন ল্যাবে যান, পরের দিন আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু এর মধ্যেও তিনি ইউরেনিয়াম নিয়ে নতুন পরীক্ষা চালাচ্ছেন। এনরিকো ফার্মি জুলিও-কুরির কৃত্রিম তেজষ্ক্রিয়তা সৃষ্টির প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে ইউরেনিয়ামের মধ্যে নিউট্রন প্রবেশ করিয়ে তেজষ্ক্রিয় ইউরেনিয়াম আইসোটোপ তৈরি করতে পেরেছেন এবং দেখেছেন সেখান থেকে প্রচুর তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ ঘটছে।
আইরিনও একই রকমের পরীক্ষা করলেন তাঁর ল্যাবে। তাঁরাও একই রেজাল্ট পেলেন। কিন্তু তাঁরা ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলেন না কী হচ্ছে আসলে। তাঁদের গবেষণাপত্র পড়ে একই পরীক্ষা চালালেন জার্মান বিজ্ঞানী লিসা মেইটনার, অটো হান ও ফ্রিট্জ স্ট্রসম্যান। তাঁরাও একই রেজাল্ট পেলেন। লিসা মাইটনার তাঁর ভাইপো অটো ফ্রিসের সাথে আলোচনা করে বুঝতে পারলেন যে ভারী ইউরেনিয়াম আইসোটোপ ভেঙে অপেক্ষাকৃত হাল্কা তেজষ্ক্রিয় নিউক্লিয়াসে পরিণত হচ্ছে – যা ক্রমাগত চলতে থাকবে – যা ‘নিউক্লিয়ার ফিশান প্রসেস’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
এই নিউক্লিয়ার ফিশান প্রসেস নিয়ে ভীষণ উৎসাহিত হয়ে উঠলেন ফ্রেডেরিক। ফিশান পদ্ধতিতে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়। পারমাণবিক নিউক্লিয়াস হতে পারে বিপুল পরিমাণ শক্তির উৎস। ফ্রেড জানেন ফ্রান্স সমস্ত জ্বালানি তেল আর এক তৃতীয়াংশ কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করে। সেক্ষেত্রে পারমাণবিক নিউক্লিয়াস থেকে ভবিষ্যতের জ্বালানি শক্তির জোগান দেয়ার লক্ষ্যে ফ্রেডেরিক ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করতে শুরু করলেন। ১৯৩৯ সালের মধ্যে তিনি প্রায় নয় টন খনিজ ইউরেনিয়াম কেনার ব্যবস্থা করেন বেলজিয়ামের খনি থেকে। কিন্তু সেগুলো দিয়ে কিছু করার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো।
১৯৪০ সালের জুন মাসে ফ্রান্সে জার্মান সৈন্য মার্চ করতে শুরু করেছে। আইরিন নিজে অসুস্থ, বাচ্চাদের নিয়ে ভীষণ আতঙ্কে আছেন। মনে পড়ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল সতেরো। মা তাকে নিয়ে যুদ্ধের মধ্যেই যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখন আইরিন তাঁর তেরো বছরের মেয়ে হেলেন আর আট বছরের ছেলে পিয়েরের জন্য দুশ্চিন্তা করছেন। আইরিন বুঝতে পারছেন তাঁর সাহস তাঁর মায়ের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু আইরিনের বড় চিন্তা হচ্ছে জার্মানদের হাত থেকে রেডিয়াম ইনস্টিটিউট রক্ষা করবেন কীভাবে।
ইভ যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য রণক্ষেত্রে চলে গেছেন। দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। ভারতে গিয়ে মহাত্মা-গান্ধী, নেহেরু আর জিন্নাহ্র সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইভ।
যুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথে ফ্রেড যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত। মিলিটারি আর্টিলারির ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব নিতে গেলেন। কিন্তু তাঁকে আরো বড় দায়িত্ব দেয়া হলো। তাঁকে ‘ডিরেক্টর অব ওয়ার রিসার্চ স্টাফ’-এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু ফ্রান্স তেমন কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই প্যারিস জার্মানদের দখলে চলে গেলো। ফ্রেডের ল্যাবে জার্মান সৈন্য এসে ইউরেনিয়াম আর হেভি ওয়াটারের খোঁজ করতে লাগলো। তাদের কাছে তথ্য আছে যে ফ্রেড অ্যাটমিক রিঅ্যাক্টর তৈরির জন্য তেজষ্ক্রিয় পদার্থ সংগ্রহ করেছেন। জার্মানি সেগুলো দখল করতে চায়। ফ্রেড আগেই ওসব লুকিয়ে রেখেছিলেন নিরাপদ জায়গায়। জার্মান সৈন্যরা তাঁর ল্যাবে তালা লাগিয়ে দিলো।
ফরাসি সরকার নাৎসিদের নির্দেশে চলছে। স্বাধীনতাকামীদের জীবন দুঃসহ হয়ে উঠছে। ফ্রেড ও লাঁজেভির মত মানুষেরা গোপন প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন তাঁরা। যে কোন মুহূর্তে জার্মান সৈন্যরা তাঁদের তুলে নিয়ে যেতে পারে। শীতকাল চলে আসছে। নাৎসিরা ফ্রান্সের সমস্ত কয়লা জার্মানিতে নিয়ে যাচ্ছে। শীতকালে ফায়ার-প্লেসে আগুন জ্বলবে না কোন ফরাসির বাড়িতে। ছেলে-মেয়েদের নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দেয়ার চিন্তা করছেন আইরিন ও ফ্রেড। পিয়ের এখনো ছোট – তাই হেলেনকেই তাঁরা সুইজারল্যান্ডে এক বন্ধুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।
নাৎসিদের সমালোচনা করার অপরাধে পল লাঁজেভিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। তারপর তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো জার্মান ক্যাম্পে। ফ্রেডের অনেক বন্ধুকে জার্মানরা হত্যা করেছে – যাদের মধ্যে লাঁজেভির মেয়ের স্বামীও ছিলেন। ফ্রেডের গতিবিধির ওপর জার্মানরা নজর রাখছে। ১৯৪১ সালের জুন মাসে জার্মানরা রাশিয়ায় ঢুকতে শুরু করেছে।
একদিন খুব সকালে ফ্রেড ও আইরিনের বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠলো। সাদা পোশাকে ফরাসি পুলিশ। নাৎসিরা ফরাসিদের ওপর অত্যাচার করার জন্য ফরাসিদেরই ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
“আপনাকে আমাদের সাথে একটু পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে মঁসিয়ে।”
“আইরিন, আমার জন্য অপেক্ষা করো না। পিয়েরকে কিছু বলার দরকার নেই।”
আইরিন দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলেন তাঁর স্বামীকে নিয়ে চলে গেলো পুলিশের জিপ। কখন ফিরবে ফ্রেড, কিংবা আদৌ ফিরবে কিনা কিছুই জানেন না আইরিন। কিন্তু চিন্তা করে কী হবে। আইরিন সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করলেন। পিয়েরকে বাবার ব্যাপারে কিছুই বললেন না। কিন্তু মনে মনে সারাক্ষণ আশা করছেন ফ্রেড ফিরবেন, আবার আশংকাও করছেন যদি না ফেরে?
গভীর রাতে ফ্রেড ফিরে এলেন। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাঁকে। নাৎসিরা তাঁকে সারাদিন ধরে মানসিক অত্যাচার করেছে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। একটা প্রশ্ন একশ’ বার করে করা। মেজাজ ঠিক রাখা দায় হয়ে পড়ে। ভবিষ্যতে অবস্থা আরো কত খারাপ হতে পারে ভেবে আতঙ্কিত ফ্রেড ও আইরিন।
আইরিনের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ফ্রেড। তিনি আইরিন আর পিয়েরকে সুইজারল্যান্ডে পাঠিয়ে দিতে চান। কিন্তু আইরিন ফ্রেডকে ছেড়ে কিছুতেই যাবেন না। ফ্রেড জানেন আইরিনের সিদ্ধান্ত বদলানো যায় না। হেলেনও মা-বাবা-ভাইকে ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে বেশিদিন থাকতে না পেরে ফিরে এসেছে বাড়িতে।
ছদ্ম-জার্মান শাসনে ফ্রান্স চলছে। এমনভাবে চলছে যেন কিছুই হয়নি। স্কুল কলেজ অফিস আদালত চলছে। সবকিছু স্বাভাবিক আছে প্রমাণ করার জন্য ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্স ফ্রেডকে একাডেমির সদস্যপদ দিয়েছে। আইরিনও দরখাস্ত করেছিলেন, কিন্তু যে কারণে তেত্রিশ বছর আগে মাদাম কুরিকে সদস্যপদ দেয়নি এবং আইন পাস করিয়ে রেখেছে যে একাডেমিতে কোনদিনই কোন মহিলাকে একাডেমির সদস্যপদ দেয়া হবে না, সেই কারণ দেখিয়ে আইরিনের দরখাস্ত বাতিল করা হলো। [আইরিন তারপর থেকে প্রতিবছরই নিয়মিত দরখাস্ত করে গেছেন একই রেজাল্ট দেখার জন্য।]
হেলেনের স্কুলের পরীক্ষা হয়ে গেলো। এবার তার সরবোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার কথা। মা-বাবার মতোই বিজ্ঞানী হবার ইচ্ছে হেলেনের। ১৯৪৪ সালে প্যারিসে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছে। পল লাঁজেভির কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। একদিন ভোরে আবার পুলিশ এলো বাড়িতে। ফ্রেডকে আবার তুলে নিয়ে গেল নাৎসি ক্যাম্পে। সন্ধ্যার পর বিধ্বস্ত হয়ে ফিরে এসে আইরিনকে জানালেন, “আমাকে আমার সব পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।”
রাতে হেলেন আর পিয়ের ঘুমিয়ে পড়লে ফ্রেড আইরিনকে বললেন, “ব্যাকপ্যাকগুলো গুছিয়ে নাও। আমরা কাল সকালেই বেরিয়ে পড়বো।”
“কোথায় যাবো আমরা?”
“সুইজারল্যান্ডে। গোপনে চলে যেতে হবে আমাদের। অবস্থা কিন্তু আরো খারাপ হবে।”
“পালিয়ে যাবো?”
“উপায় নেই। ছেলে-মেয়েদের কথা তো ভাবতে হবে। জার্মানরা পরাজয় আঁচ করতে পারছে। ওরা এখন ফরাসি বিজ্ঞানীদের সবাইকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে। ফ্রান্সকে মেধাশূন্য করে দেয়ার পরিকল্পনা করছে তারা। কিন্তু আমাদের তো দায়িত্ব আছে – দেশের জন্য নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা। ভেবে দেখো আইরিন। আমাদের কী করা উচিত?”
আইরিন বুঝতে পারলেন। চারজনের দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাকপ্যাক রেডি করে রাখলেন। খুব ভোরে উঠে ছেলে-মেয়ে আর স্বামীর হাত ধরে বেরিয়ে পড়লেন সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
ফ্রান্স আর সুইজারল্যান্ডের সীমান্তে গিয়ে ফ্রেড আইরিনের হাত ধরে বললেন, “এবার আমি তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেবো আইরিন।”
“তুমি যাবে না আমাদের সঙ্গে?”
“না। আমি এখান থেকে ফ্রন্টে চলে যাবো। আমি একজন সৈনিক। আমাদের রেজিস্ট্যান্স ফোর্স সীমান্তে অপেক্ষা করছে। আমেরিকান সৈন্যরা আসতে শুরু করেছে। আমরা তাদের সাথে যোগ দেবো। তোমরা অন্য সবার সাথে নিরাপদেই সুইজারল্যান্ডে চলে যাবে। আশা করি যুদ্ধের পর দেখা হবে আমাদের।”
আইরিন জানেন ফ্রেডকে বাধা দেয়া যাবে না। হেলেন আর পিয়েরকে আদর করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ফ্রেড।
ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আইরিনের সুইজারল্যান্ডে পৌঁছানোর খবর কীভাবে যেন প্রচারিত হয়ে গেছে বহির্বিশ্বে। আমেরিকার ‘মেরি কুরি ট্রাস্ট ফান্ড’ তাঁদের জন্য বেশ কিছু ডলার পাঠিয়ে দিয়েছে। ১৯২১ সালে মেরি কুরিকে রেডিয়াম উপহার দেয়ার জন্য ফান্ড গঠন করেছিলেন মেসি মেলোনি। সেখানে যা কিছু অবশিষ্ট ছিল সব আইরিনকে পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। মায়ের মৃত্যুর পরেও এই দুঃসময়ে মায়ের দান এসে গেছে আইরিনের হাতে।
১৯৪৪-এর ডিসেম্বরে জার্মান সৈন্যরা ফ্রান্স ছেড়ে চলে গেলো। আইরিনরা সবাই প্যারিসে ফিরে এলেন। ১৯৪৫-এ আমেরিকা পারমাণবিক বোমা বানালো। হিরোশিমা-নাগাসাকি ধ্বংস হয়ে গেলো পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে। নিউক্লিয়ার ফিশান প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে এই বোমাগুলো বানানো হয়েছে। আইরিন নিজেও ফিশান প্রক্রিয়া আবিষ্কারের সাথে জড়িত ছিলেন। নিজেকে এ কারণে অপরাধী মনে করতে শুরু করেছেন তিনি।
যুদ্ধের পর ফ্রেড ফ্রান্সের হিরো হয়ে গেলেন। ‘কমান্ডার অব দি লিজিয়ন অব অনার’ নিযুক্ত হলেন তিনি। ১৯৪৬ সালে পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন’ গঠিত হলো। ফ্রেড কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হলেন, আইরিন কমিশনের সদস্য মনোনীত হলেন। ফ্রেড কমিশনের প্রশাসনিক কাজে তাঁর দক্ষতার ছাপ রাখতে শুরু করেছেন, আইরিন বৈজ্ঞানিক দিক দেখাশোনা করেন।
পারমাণবিক শক্তি প্রকল্পের কাজ চলছে। ফ্রান্স ইউরোপের প্রথম অ্যাটমিক রিঅ্যাক্টর স্থাপনের কাজ হাতে নিয়েছে। প্রথম প্ল্যান্টের নাম দেয়া হয়েছে জোয়ি (ZOE)। হেভি ওয়াটার আর ইউরেনিয়াম ১৯৩৯ সালেই সংগ্রহ করে রেখেছিলেন ফ্রেড। এখন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে পুরোদমে।
বিশ্ব-শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জড়িত হচ্ছেন ফ্রেডেরিক ও আইরিন। তেজষ্ক্রিয়তার শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের প্রতি জোর দিচ্ছেন তাঁরা। আমেরিকার ‘অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট রিফিউজি কমিটি’র আমন্ত্রণে স্প্যানিশ রিফিউজিদের সাহায্যের জন্য ১৯৪৮ সালের মার্চে আমেরিকা গেলেন আইরিন।
আগে মায়ের সাথে যখন গিয়েছিলেন বিপুল সম্বর্ধনা পেয়েছিলেন আমেরিকায়। কিন্তু এবার অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো তাঁর। প্যারিস থেকে বিমানে নিউইয়র্কের লা গোয়ার্ডিয়া এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন অফিসারেরা আইরিনকে আটক করে এলিস আইল্যান্ডের হাজতে নিয়ে গেলেন। আইরিন তাঁর স্বভাব মতই শান্ত। হাজতে রাত কাটাতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন সেখানকার ব্যবস্থা খুব একটা ভালো নয়।
পরদিন ফরাসি দূতাবাসের কর্মকর্তারা ছুটে এলেন। ফরাসি সরকার তীব্র নিন্দা জানালেন এই ঘটনার। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী, ফ্রান্সের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সদস্য, কমিশনের চেয়ারম্যানের স্ত্রী, রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর আইরিন কুরিকে আটকে রাখায় আমেরিকান সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠলো। উপর মহলের আদেশে আইরিনকে ছেড়ে দেয়া হলো। কী কারণে তাঁকে আটক করা হয়েছিল তা কর্তৃপক্ষ না জানালেও সবাই অনুমান করলেন যে কমিউনিস্ট সন্দেহে আইরিনকে আটক করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা কমিউনিস্ট আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেছে।
এলিস আইল্যান্ডের হাজত থেকে বেরিয়ে আইরিন একটা টেক্সি নিয়ে চলে গেলেন রিফিউজি কমিটির অফিসে। তাঁরা তো ভীষণ অবাক। আগের দিন তাঁরা এয়ারপোর্টে গিয়ে ফিরে এসেছেন।
“মাদাম আপনি নিজেই চলে এসেছেন! আমাদের ফোন করলে তো আমরা গিয়ে নিয়ে আসতাম আপনাকে।”
“নিয়ে আসতে হবে কেন? আমার কাছে তো ঠিকানা আছে আপনাদের।”
আইরিন রিফিউজিদের সমর্থনে বেশ কিছু সমাবেশে বক্তৃতা করলেন। তারপর প্রিন্সটনে আইনস্টাইনের সাথে দেখা করলেন। আইনস্টাইনও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার একজন জোরালো সমর্থক।
১৯৪৮ সালে আইরিন ও ফ্রেডের মেয়ে হেলেন একুশ বছরের তরুণী। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি পাস করেছে। রূপে গুণে অদ্বিতীয়া হেলেন ভালোবাসে সহপাঠী মাইকেলকে। মাইকেল পল লাঁজেভির নাতি (ছেলের ছেলে)। মাদাম কুরির নাতনির সাথে মঁসিয়ে লাঁজেভির নাতির বিয়ে – এর চেয়ে ভালো সম্পর্ক আর কী হতে পারে?
১৯৪৮ সালের ৪ঠা নভেম্বর হেলেন আর মাইকেলের বিয়ে হয়ে গেলো। আইরিন তখন ভীষণ অসুস্থ। ম্যাস্টয়ডাইটিসে ভুগছিলেন। অপারেশন দরকার। কিন্তু মেয়ের বিয়ের জন্য অপারেশন পিছিয়ে দিয়েছিলেন। হেলেনের বিয়ের পরেই অপারেশন হলো আইরিনের। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েই বাড়িতে চলে এলেন তিনি।
ফ্রেড পারমাণবিক প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছেন। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে চালু হলো পাঁচ কিলোওয়াট শক্তি সম্পন্ন ‘জোয়ি’। এই প্রাথমিক প্রকল্পের সাফল্য বড় মাপের প্রকল্প হাতে নিতে সহায়তা করলো। ক্রমে ক্রমে ফ্রান্সের বিদ্যুৎ শক্তির সিংহভাগ পারমাণবিক শক্তি থেকেই উৎপাদিত হয় যার সূচনা করেছিলেন ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি।
প্রত্যেক গ্রীষ্মকালেই লা’কোয়েস্টে ছুটি কাটাতে যান ফ্রেড ও আইরিন। সেখানে তাঁরা একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে ‘কুরি হাউজ’ নাম দিয়েছেন। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে, মাছ ধরে আনন্দে কাটে কয়েক দিন। ১৯৪৯ সালের এমনি এক দিনে আড্ডায় আলোচনা হচ্ছিলো প্রেম-ভালোবাসা বিষয়ে। ফ্রেড ভালোবাসা সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথা বলছিলেন। তিনি যে আইরিনকে কত ভালোবাসেন তার সরস বর্ণনা দিচ্ছিলেন। আইরিন সাধারণত এসব আলোচনায় শ্রোতা হিসেবেই থাকেন – কখনো কোন মন্তব্য করেন না। কিন্তু সেদিন ফ্রেডের কথা শুনে হঠাৎ আইরিন বললেন, “আচ্ছা, তোমাদেরকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। বিবাহিত পুরুষ তাদের ওয়ালেটে কার ছবি রাখে?”
“স্ত্রীর”
“ফ্রেড আমাকে এত ভালোবাসে বললো – তার ওয়ালেটে কার ছবি আছে?”
“অবশ্যই তোমার” – বন্ধুদের একবাক্যে উত্তর।
“ফ্রেড, তোমার ওয়ালেটটা খুলে এদের দেখাও।”
ফ্রেড কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ওয়ালেট খুলে দেখান – সেখানে আইরিনের বদলে বিশাল একটা মাছের ছবি। অপ্রস্তুতের হাসি হেসে ফ্রেড বললেন, “লা’কোয়েস্টে এত বড় মাছ আর কেউ ধরেনি।”
ফরাসি সরকারের ওপর আমেরিকান সরকারের প্রভাব ও চাপ বাড়তে শুরু করেছে। আমেরিকান সরকার কমিউনিস্ট ফোবিয়ায় ভুগছে। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৫০ সালের ২৮শে এপ্রিল ফ্রেঞ্চ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন থেকে ফ্রেডকে বরখাস্ত করা হলো। ফ্রেডের অপরাধ – তিনি ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। মানসিকভাবে খুব হতাশ হয়ে পড়লেন ফ্রেড। তাঁর শরীরেও তেজষ্ক্রিয়তার প্রভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন ফ্রেড।
এর কিছুদিন পর ২১শে মে হেলেন ও মাইকেলের প্রথম সন্তান ফ্রাঁসোয়ার জন্ম হয়। নাতনির মুখ দেখে হতাশা কিছুটা কাটিয়ে উঠলেন ফ্রেড।
অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন থেকে আইরিনকে বরখাস্ত করা না হলেও ১৯৫১ সালের ১০ই জানুয়ারি তাঁর মেয়াদ শেষ হবার পর তাঁকে কমিশন থেকে বাদ দেয়া হয়। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় এবং রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টরের পদ এখনো আছে তাঁর। কিন্তু শরীর তাঁরও খুব খারাপ। এক সময়ের এত ভালো অ্যাথলিট আইরিন নানারকম রোগে ভুগছেন।
১৯৫১ সালের ২৫শে জুলাই হেলেনের ছেলে ইভিসের জন্ম হয়। আইরিন ও ফ্রেড তাঁদের নাতি-নাতনির সাথে সময় কাটান যতটুকু পারেন। ফ্রাঁসোয়ার বয়স দু’বছর হতে না হতেই তাকে সাঁতার শেখানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন আইরিন।
১৯৫৫ সালে লিউকেমিয়া ধরা পড়ে আইরিনের। সারাজীবন এক্স-রে আর রেডিয়াম পোলোনিয়ামের তেজষ্ক্রিয়তার সাথে থাকতে থাকতে ব্লাড-ক্যান্সার হয়ে গেছে তাঁর। হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো তাঁকে। ফ্রেড প্রায় সারাক্ষণই আইরিনের বেডের কাছে চুপচাপ বসে থাকেন। আইরিন জানেন তাঁর সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। যতক্ষণ জেগে থাকেন ফ্রেডের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ফ্রেড তাঁর হাত ধরে জিজ্ঞেস করেন, “খুব কষ্ট হচ্ছে?”
“আমার নিজের জন্য কোন কষ্ট নেই ফ্রেড। আমি তো জীবনে যা যা চেয়েছি সবই পেয়েছি। কষ্ট হচ্ছে তোমার জন্য।”
“আমার জন্য কেন?”
“আমি মরে গেলে তুমি একা হয়ে যাবে। অবশ্য একা নাও হতে পারো – লা’কোয়েস্টের সাগরে বড় বড় মাছ আছে। সেগুলো ধরবে আর ছবি তুলে ওয়ালেটে রাখবে। দেখি তোমার ওয়ালেটটা।”
ফ্রেড চুপচাপ ওয়ালেট বের করে আইরিনের হাতে দেন। আইরিন কাঁপা কাঁপা হাতে ওয়ালেট খুলে মাছের ছবিটা দেখেন। ফ্রেড বলেন, “তোমার কি ধারণা আমি শুধু মাছই দেখি?”
“না, তুমি এটাও দেখো” – মাছের ছবির নিচ থেকে আরেকটি ছবি বের করেছেন আইরিন। তিরিশ বছর আগের আইরিনের গ্র্যাজুয়েশানের ছবি। সরবোনের কালো গাউন পরে এক হাতে ফুল আর অন্যহাতে সার্টিফিকেট নিয়ে উজ্জ্বল চোখে দাঁড়িয়ে আছে তরুণী আইরিন।
“ছবিটা যে ওখানে থাকে তুমি জানতে?”
“হ্যাঁ”
“তবে সেদিন সবার সামনে মাছের ছবি নিয়ে ওরকম করলে কেন?”
আইরিন চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলেন, “শুধু গুনগুন করলে হয় না, মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে গাইতে হয়।”
১৯৫৬ সালের ১৭ই মার্চ মারা যান আইরিন জুলিও-কুরি। ২১শে মার্চ সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রীয় শোকসভা অনুষ্ঠিত হয় তাঁর স্মরণে।
আইরিনের মৃত্যুর পর ফ্রেড ছেলে পিয়েরের সাথে তাঁদের স্সোর বাড়িতেই দিন কাটাতে থাকেন। ফ্রেডের লিভারের তিন চতুর্থাংশই নষ্ট হয়ে গেছে অত্যধিক তেজষ্ক্রিয়তায়। এ অবস্থাতেও আইরিনের শূন্যপদে যোগ দিলেন তিনি। সরবোনের প্রফেসর পদ এবং রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর পদে নিযুক্ত হলেন ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি। রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের সম্প্রসারণ ঘটছে। নিউক্লিয়ার ইনস্টিটিউট চালু করলেন ফ্রেড।
১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মকালে পাকস্থলীর সমস্যাও দেখা দেয় ফ্রেডের। হেপাটাইটিসের অপারেশান হয় ১০ই আগস্ট। অস্ত্রোপচারের চারদিন পর ১৪ই আগস্ট মারা যান ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি।
পরিশিষ্ট
আইরিন ও ফ্রেডের ছেলে-মেয়ে দু’জনই পরবর্তীতে বিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়েছেন – হেলেন নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী এবং পিয়ের জীব-পদার্থবিজ্ঞানী।
১৯৫৭ সালে হেলেন তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে যোগ দেন। ফ্রান্সের পার্লামেন্টে সায়েন্টিফিক এডভাইজরি কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি অনেক বছর।
হেলেনের ছেলে ইভিসও একজন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
আইরিন ও ফ্রেড জুলিও-কুরির ছেলে পিয়ের জুলিও কলেজ দ্য ফ্রান্সের প্রফেসর এবং সেলুলার বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের হেড। ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্যপদ লাভ করতে কোন অসুবিধাই হয়নি তাঁর। তিনি আমেরিকান একাডেমি অব সায়েন্সেরও সদস্য।
ইভ কুরি সারাজীবন একা থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও বিয়ে করেছিলেন ১৯৫৪ সালে ৫০ বছর বয়সে। তাঁর স্বামী হেনরি ল্যাবোইসি ইউনিসেফের পরিচালক ছিলেন এবং ১৯৬৫ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেয়েছেন। ইভ ১০২ বছর বেঁচেছিলেন। ২০০৭ সালের ২২শে অক্টোবর ইভ কুরি মারা যান তাঁর নিউ ইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টে।
১৯৯৪ সালে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের কুরি মিউজিয়ামের নতুন নাম হয় – ‘দি মিউজিয়াম এন্ড আর্কাইভস ফর দি রেডিয়াম ইনস্টিটিউট, পিয়ের এন্ড মেরি কুরি, এন্ড ফ্রেডেরিক এন্ড আইরিন জুলিও-কুরি’।
তথ্যসূত্রঃ
১। Marie Curie, Pierre Curie, Dover Publications, New York, 1963.
২। Susan Quinn, Marie Curie a life, Simon & Chuster, New York, 1995.
৩। Denis Brian, The Curies a biography of the most controversial family in science, John Wiley & Sons, New Jersey, 2005.
৪। Shelley Emling, The private lives of science’s first family Marie Curie and her daughters, Palgrave Macmillan, New York, 2012.
৫। Robert Reid, Marie Curie, Collins, London 1974.
৬। Eve Curie, Madame Curie, William Heinemann Ltd, London 1944.
৭। Francoise Giroud, Marie Curie a life, Holmes & Meier, New York, 1986.
৮। Rosalynd Pflaum, Grand Obsession Madame Curie and her world, Doubleday, New York, 1989.
৯। Maurice Goldsmith, Frederic Joliot-Curie a biography, Lawrence and Wishart, London, 1976.
১০। Robin McKown, She lived for science Irene Joliot-Curie, Macmillan & Co Ltd, London, 1962.
১১। Olga S. Opfell, The lady laureates women who have won the Nobel prize, 2nd Edition, The Scarecrow Press Inc., New Jersey, 1986.
১২। Sharon Bertsch McGrayne, Nobel Prize Women in Science their lives, struggles, and momentous discoveries, 2nd edition, Joseph Henry Press, Washington D. C., 2001.
‘রেডিয়াম ভালবাসা’ বইটি কোন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে? ৪ পর্বের এই সিরিজটি কি বইটির অংশবিশেষ নাকি সম্পূর্ণ বই ই এখানে দেয়া হয়েছে?
লেখাটা পড়ে দারুণ লাগলো । পড়তে পড়তে ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়ার অনুভুতি হয়।তবে একটা তথ্যগত ত্রুটি ছখে পড়লো ঃ মাদাম কুরি ফ্রান্স-এর প্রথম মহিলা ডক্টরেট, ইউরোপ-এর নন ।
আর ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি সম্বন্ধে লেখকের মতামত যুক্তিহীন । তিনি অক্লেশে বলে দিলেন যে ফ্রেড ক্ষমতার স্বাদ বোঝেন । সেটার কোন তথ্যভিত্তিক প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন লেখন মনে করেননি । এই লেখাটি পড়লেই স্পষ্ট বোঝা যায়, ফ্রেড বিজ্ঞানের গবেষণার সাথে সাথে তার সামাজিক অবদান এবং সঠিক প্রয়োগ নিয়েও চিন্তা করতেন , যা কিনা অবশ্যই ফ্রেডের রাজনৈতিক আদর্শ – যেটার সাথে লেখক অসহমত হতেই পারেন । কিন্তু কোনভাবেই সেটা ফ্রেডকে ক্ষমতালোলুপ প্রতিপন্ন করে না ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনেক তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের কোন না কোন রাজনৈতিক আদর্শের দিকে জেতে বাধ্য করেছিল । তার সাথে বিজ্ঞানের সঠিক প্রয়োগ সমাজের সঙ্খ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্যাণে হওয়া উচিত বলেও ভাবতে শিখিয়েছিল । বারট্রান্ড রাসেল, আইন্সটাইন, জে ডি বারনাল, জে বি এস হ্যাল্ডেন ইত্যাদির মত ব্যক্তিত্বরাও রাজনৈতিক মতামত দিয়েছিলেন সর্বনাশা যুদ্ধের বিরুদ্ধে । সেইসব বিজ্ঞানীদেরও কি লেখক ক্ষমতালোলুপ বলে মনে করেন ?
অসাধারণ । পুরাই নোবেলময় পরিবার ! (Y) (Y) :guru:
(Y) (B)