সাত

একান্নবর্তী পরিবার আলমদের। বাবা-মা, দুই চাচা ও চাচী, দাদা-দাদী মিলিয়ে পরিবার-তার সদস্য সংখ্যা ইতোমধ্যে আরো বেড়েছে। আলমের বাবার ঘরে যোগ হয়েছে আরো দ্ইু ভাই এক বোন-সব মিলিয়ে তারা চার ভাই, দুই বোন। এর বাইরে শিশুকালে মারা গেছে দু’বোন । তার নব-বিবাহিত দু’চাচার ঘরে দুই জন-সর্বসাকুল্যে ষোল জনের যৌথ পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আলমের বাবা। একটি টিকাধারী প্রতিষ্ঠানে কেরানী। তার মেঝো চাচা তার বাবাকে কিছুটা জোগান দিলেও তার ছোট চাচা তখনো অনেকটা বাউণ্ডুলে জীবন কাটায়-গ্রামে গ্রামে, হাটে বাজারে গ্রাম্য গায়কদলের সাথে বেঞ্জু বাজিয়ে দিন কাটায়। তারপরও তাদের পরিবার ছিল মোটমুঠি স্বচ্ছল। দাদা-দাদী, চাচা-চাচীদের অকৃত্রিম স্নেহ-মমতা-ভালবাসায় টইটম্বুর ছিল তাদের শান্তির নীড় । অত্যন্ত রাজনীতি-সচেতন ছিল আলমের বাবা। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যেতে তিনি আলমকে উৎসাহিত করতেন। একবার আলমের বাবা আলমকে লালদিঘীর মাঠে নিয়ে গিয়েছিলেন মৌলানা ভাসানীর সভা শোনার জন্য। লাল রঙের গোল টুপি পড়া মৌলানা ভাসানীকে আলম প্রথম স্বচক্ষে দেখল এবং তার বক্তৃতা শুনল।
ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক পরীক্ষা আলমের। কাছাকাছি সময়ে জুনিয়র স্কলারশীপ পরীক্ষা। আলম, তার সহপাটি তাহের, শেখ আহমদ, দেলোয়ার, রফিক, যারা স্কলারশীপ পরীক্ষা দেবে তাদের বার্ষিক পরীক্ষা দিতে হবে না। পরীক্ষার পড়ায় মনোযোগী হয় আলম। স্কুল পিরিয়ড শেষে আবার সহকারী শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমানের নিকট প্রাইভেট পড়ার জন্য থেকে যায় । বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে তাদেরকে অটো প্রমোশন দিয়ে নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করে দেওয়া হল। ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ স্কলারশীপ পরীক্ষাও শেষ হলো। দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা স্থিমিত। চতুর্দিকে কেবল আনন্দ অভিনন্দন। দেশের বড় ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপন দিয়ে আওয়ামী লীগকে অভিনন্দন জানাতে লাগল। নির্বাচনের বিজয়-উত্তর সভাসমাবেশ হতে লাগলো। এসব সভাসমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতারা জনগণ অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি ঐক্য বজায় রাখার আহবান জানাতে লাগল। পতেঙ্গার পুরানো কন্ট্রোলের মোড়ে এরকম এক সভায় এম এ আজিজ আসলেন। তিনি এ এলাকা থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আঞ্চলিক ভাষায় বক্তব্য রাখেন। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, “এখনো ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি। বাঙ্গালীদের ক্ষমতা না দেওয়ার চক্রান্ত ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। আপনাদের সর্তক থাকতে হবে।” এসব কথা আলমের বোধগম্য হয় না। নির্বাচনে জেতার পর আবার কী ষড়যন্ত্র হতে পারে, ক্ষমতা কি ভাবে না দিয়ে পারবে-এসব রাজনৈতিক ঘোরপ্যাঁচ আলমের মাথায় ঢুকে না।
দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েক মাস। দেশে আবারো রাজনৈতিক উত্তেজনা। সামরিক জান্তা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে নানা তালবাহানা করছে। আন্দোলনে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশ। স্কুলে লেখা পড়াও শিকেয় উঠেছে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হল। সে জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন অসহযোগ আন্দোলনের। সরকারের কোন নির্দেশ মানবে না জনগণ। ট্যাক্স দেবে না, কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকবে অথচ শ্রমিকদের বেতন দিতে হবে। ব্যাংক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে কোন টাকা যেতে পারবে না। প্রতিদিন দেশ কিভাবে চলবে নির্দেশ জারি হতে লাগল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেন হয়ে উঠলেন দেশের মুকুটহীন সম্রাট। রেডিও টেলিভিশনে সংগ্রামের গান আর আন্দোলনের খবর প্রচারিত হতে লাগল। কেটে গেল কিছু দিন। ১৫ ই মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকায় আসলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সহ আওয়ামী নেতাদের সাথে আলোচনা চালাতে লাগলেন। দেশে টান টান উত্তেজনা। আলোচনায় অগ্রগতির কথা ও শুণা যাচ্ছে, আবার আন্দোলনের কথাও বলা হচ্ছে। কি হবে কিছু বুঝা যাচ্ছে না। ২৩শে মার্চ, ৭১, দ্রুত খবর রটে গেল-পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র নিয়ে সোয়াত নামক একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ৫ নং জেটিতে নোঙর করেছে এবং পাকিস্তানী সৈন্যরা সে জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করার চেষ্টা করছে; কিন্তু ডক-বন্দর শ্রমিকেরা বাঁধা দিয়ে যাচ্ছে । মানুষের স্রোত ধাবিত হতে লাগল বন্দরের ৫ নং জেটির দিকে। পতেঙ্গা থেকেও দলে দলে মানুষ লাঠি-সোটা, চিটাগাং ষ্টিল মিলের শ্রমিকেরা লোহার রড নিয়ে প্রতিরোধের জন্য এগিয়ে যেতে লাগল। আলমও এ জনতার মিছিলে শরিক হল। ৫নং জেটির কর্ণফুলীর তীর মিছিলে মিছিলে সয়লাব। জনতার যেন ঢল নেমেছে । কয়েকটি মাঝারি আকৃতির সাবমেরিন (যুদ্ধ জাহাজ) নদীর তীর ঘেঁষে সমবেত মানূষের দিকে কামান তাক করে ডানে-বামে ঘুরাচ্ছে। বন্দরের সীমানা-ঘেরার ভিতরেও পাকিস্তানী সৈন্যরা জনতার দিকে রাইফেল-মেশিনগান তাক করে আছে-যে কোন মুহুর্তে যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। পাক-সেনাদের এ উস্কানীমূলক মহড়া জনতার ঊত্তেজনায় যেন ঘৃতাহুতি দিচ্ছে। যুদ্ধ জাহাজের কামান আর স্থল সেনাদের রাইফেল-মেশিন গানের বিপরীতে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত, বাঁশের লাঠি ও লোহার রড শূণ্যে তুলে মুহুর্মুহু গর্জন-শ্লোগানে জনতাও যেন বলছে আমরাও প্রস্তুত। সূর্যাস্ত পর্যন্ত পাকিস্তানী স্থল ও নৌ সেনাদের সাথে জনতার মুখোমুখী এ মহড়া চলল। এক সময়ে আওয়ামী লীগের জেলা নেতারা সমবেত জনতাকে ৩ নং জেটির দিকে নিয়ে গেল। সেখানে পাকিস্তানী জুন্তার যুদ্ধপ্রস্তুতির বিরুদ্ধে উত্তেজিত জনতাকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানিয়ে বিদায় করে দেওয়া হল। আবেগ-উত্তেজনা মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে আলমও বাড়ি ফিরে আসল। রাত্রে খবর পেল সন্ধ্যার দিকে জনতাকে লক্ষ্য করে পাকিস্তানী সৈন্যরা গুলি ছুঁড়েছে। একটি অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ তাকে বিচলিত করল-তার দূর সম্পর্কের এক চাচা, পাশের মাতব্বর বাড়ির মোঃ ইউনুছ মিঞা ৫নং জেটি সংলগ্ন এলাকায় পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহীয়া তখনো ঢাকায়। ঢাকায় কী হচ্ছে জানে না কেউ। টান টান উত্তেজনায় কাটল ২৪ ও ২৫ শে মার্চ । তবে মানুষের মুখে মুখে নানা গুজব ঢাল পালা বিস্তার করে চলেছে সমানে ।
২৬শে মার্চ সকালে ঘুম থেকে উঠেই আলম শুণতে পেল রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে একের পর এক সামরিক ফরমান জারি করা হচ্ছে। ২৫ শে মার্চ সামরিক শাসন জারী করে ইয়াহীয়া পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন গভীর রাতে। কিন্তু ঢাকার কোন ঘোষণা রেডিওর চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার করা হচ্ছে না। বরং সকাল থেকে তা নিশ্চুপ হয়ে আছে। চতুর্র্দিকে নানা গুজব আর রটনা, পাশাপাশি পাকিস্তানী সৈন্যরা গত রাত্রে ঢাকার ছাত্রাবাসগুলিতে হামলা করে প্রচুর ছাত্র ছাত্রীকে খুন করেছে, রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়িতেও হামলা করে বাঙ্গালী পুলিশদের হত্যা করেছে, বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে হামলা করে বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করেছে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন; ইত্যাদি খবরও দাবানলের মত ছড়িযে পড়েছে চতুর্দিকে। আকাশবাণী রেডিও থেকে প্রচার করা হচ্ছে-“ঢাকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য, ইপিআর, পুলিশ এর সাথে পাকিস্তানী সৈন্যদের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় খণ্ড যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস, পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প ও রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পে হামলা করেছে। প্রচুর নিরীহ ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা, বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ করেছে ইত্যাদি।” শহর থেকে আসা মানুষেরা বলছে, শহরে নাকি মাইক দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে- শেখ মুজিব দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আলমের বাবার একটি দুই ব্যান্ড ট্রানজিসটার ছিল। সে বার বার তার নব ঘুরাতে লাগল। সেদিন ছিল শুক্রবার। দুপুর দেড়টার দিকে জুম্মার নামাজ থেকে সবে ফিরেছে আলম। আলমের বাড়ির সামনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ নির্মিত বেশ-চওড়া পাকারাস্তা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, মুদির দোকানের সামনে মানুষের জঠলা। উত্তর দিক থেকে যেই আসছে তাকেই মানুষ ঘিরে ধরছে-শহর থেকে কোন নতুন খবরের আশায়। আলম বাসায় এসে আবারো রেডিও খোলার চেষ্টা করল। হঠাৎ ’সাইনিং অন’ শব্দ শুণতে পেল সে। প্রচণ্ড কৌতুহল আর আবেগে উৎকর্ণ হয়ে রইল। হঠাৎ যেন তার হাতের রেডিওটি গর্জে উঠল-“স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র”। জয়বাংলা বলে আলম এমন সজোরে চিৎকার দিল, বাড়ির সবাই তাদের ঘরে এসে জড়ো হল। রেডিও থেকে ঘোষণা আসতে লাগল-“ আমি এম এ হান্নান বলছি। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তিনি আমাদের সাথে আছেন। লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। আপনাদের যার যা আছে, তা নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। রাম দা, মরিচের গুড়া ইত্যাদি নিয়ে আপনারা মা বোনেরা সহ গ্রাম মহল্লা পাহারা দেন, যাতে পাক সেনারা মহল্লায় ঢুকতে না পারে।” তার পর নজরুলের সে রক্তকাঁপানো গান, ”বজ্র আঘাত হানো এবার, বজ্র আঘাত হানো-শোষক দলের গলার হার হেচ্কা জোরে টানো।” সেকি উত্তেজনা, সেকি আবেগ ! দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা! স্বাধীনতার যুদ্ধ! রক্ত যেন টগবগ্ করে ফুটছে। এ বেতার থেকেই বলা হল, আপনার বেলা দু’টায় আকাশবাণীর এবং সন্ধ্যায় বিবিসি’র সংবাদ শুণবেন। দু’টায় আকাশ বাণীর সংবাদ শুরু হলো এভাবে-“আকাশবাণী, খবর পড়ছি নীলিমা সান্যাল। পূর্ব পাকিস্তানে গৃহ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় বাঙ্গালী ইপিআর, পুলিশ ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের সাথে অবাঙ্গালী পাকিস্তানী সৈন্যদের খণ্ড যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে হামলা করে অনেক ছাত্র ছাত্রীদের খুন করেছে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব বাংলা দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বলে অসমর্থিত সংবাদে জানা গেছে,” ইত্যাদি। শহরের দিক থেকে কারা যেন জীপ নিয়ে আসল যোদ্ধাদের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে। তারা বলল চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র তাদের দখলে আছে। মানুষ যে যা পারল তাদের হাতে তুলে দিতে লাগল। এভাবে সারা দিন গুজব আর স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র শুণে কাটিয়ে দিল আলম। রাত্রে বিবিসি রেডিও শুণতে বসল সে- দু’তিন বাড়ির সবাই দল বেঁধে । এই প্রথম তারা বিবিসি নামক রেডিও এর খবর শুণছে। ঢাকায় পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণের কথা বিবিসি রেডিও সবিস্তারে বলল। গণহত্যার খবরও তারা প্রচার করল। বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানীদের প্রতিরোধের খবর ও প্রচার করা হল। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধের খবর ও প্রচার করতে লাগল এবং স্বাধীনতা ঘোষণাসহ বিশ্ব বাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানের বক্তব্যও প্রচার করা হল। চট্টগ্রাম বেতার থেকে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে তারা একটি অজ্ঞাত বেতার থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে মর্মে সংবাদ প্রচার করল। ২৬সে মার্চ সারা রাত গ্রামের যুবা-বৃদ্ধা-বণিতা সকলেই নির্ঘুম রাত কাটাল। ২৭শে মার্চ সকালে প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র টিউন করল আলম। সংবাদ বুলেটিনে বলা হলো-সামরিক গভর্ণর টিক্কা খান মারা গেছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার কথা প্রচার করা হল। মেজর জিয়া নামে এক বাঙালি সেনাপতি ভাষন দিবেন। ২৭শে মার্চ বিকালে এক গুরুগম্ভীর কণ্ঠে ভেসে আসতে লাগল, I, major Zia, on behalf of our great leader Bangabandhu Sheik Mujibur Rahman, do hereby declare the independence of Bangladesh-আবেগ উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হয়ে চিৎকার করে উঠল সবাই। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে বাঙালি জোয়ানরা জনগণের সাথে আছেন এবং যুদ্ধ করছেন। আলমদের বাড়ি পতেঙ্গা বিমান বন্দরের ঠিক পশ্চিম প্রান্তে। সারা রাত আলম তার বাবা, চাচা, মা, চাচীসহ বাড়ির সবাই এবং একইভাবে পুরা গ্রামের নারী-পুরুষ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের আহবান মোতাবেক মরিচের গুড়া, রাম দা, ও বটকি নিয়ে সারারাত পাহারা দিতে লাগল। পুরুষেরা লুঙ্গি মালকোচা মেরে, মহিলারা কোমরে শক্তভাবে শাড়ী পেছিয়ে সারা রাত গ্রামের অলিতে গলিতে ঘুরল, পরস্পরের সাথে দেখা হলেই ফিস্ ফিস্ আলাপ, ভাবখানা এই, পাক সেনারা আসল বলে এবং আসলেই প্রথমে মরিচের গুরা ছিটিয়ে দিয়ে তাদের অন্ধ করে দেবে, অতঃপর রাম দা দিয়ে কুপিয়ে কুপোকাৎ। যুদ্ধাস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে বস্তুতঃ তাদের তখনো কোন ধারণাই ছিল না। অবশ্য সে বোকামী ভাঙ্গতে বেশী দেরী হয়নি। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পাক সেনারা যখন ১ মাইল দূর থেকে গুলি ছোড়ে আলমদের গ্রামের সাবেক সেনা সদস্য হাবিলদার আলী হোসেন মাস্টারের বাড়ি জ্বালিয়ে দিল, বিমান বন্দরের উপকন্ঠে ও সমুদ্র সৈকতে পাখির মত মানুষ হত্যা করা শুরু করল, তখন তাদের বুঝতে দেরী হল না, মরিচের গুড়া আর রাম দা দিয়ে পাক সেনাদের মোকাবেলা করার চিন্তা কত হাস্যকর। মোকাবেলা করতে চাই অস্ত্র, প্রশিক্ষণ,অতঃপর যুদ্ধ।
২৭ শে মার্চ থেকেই পতেঙ্গা বিমান বন্দরে দু’টি ডাউস সাইজের সামরিক পরিবহন বিমান সারা দিন ধরে ওঠানামা করল। লোকের মুখে খবর রটে গেল, পাক সেনাদের আনা হচ্ছে সে বিমানে করে। এ সংবাদ নিশ্চিত করল আমাদের গ্রামের যারা বিমান বন্দরে কর্মরত ছিল তারা। তাদের মুখে শুণা গেল বিমান থামার সাথে সাথে পাকসেনারা নাকি বিমানের দরজা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে পজিশন নিয়ে দুই কনুই এ ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছে, যেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছত্রী সেনার অবতরন। যুদ্ধ ক্ষেত্রই বটে। এ ক’দিনত চট্টগ্রাম জনগণের দখলে ছিল। বিমান বন্দর থেকে তারা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। বিমান বন্দরে স্থায়ী ঘাঁটি করল পাক সেনারা। পতেঙ্গার মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে লাগল ক্রমে। এ আতঙ্ক ভয়াল রূপ নিল যখন পাক সেনারা গ্রামে আসা শুরু করল। কয়েক দিনের মধ্যেই গ্রামে প্রবেশ করে তারা সর্বপ্রথম হাবিলদার আলী হোসেন মাষ্টারের বাড়ি জ্বালিয়ে দিল। বড় রাস্তা থেকে ফায়ার করে তার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করল। গুলির সুতীব্র শব্দের সাথে সাথে দাউ দাউ করে আগুনের লেলিহান শিখা যখন আকাশকে গ্রাস করল, তখন মাইজ পাড়ার মানুষ দিগ্বিদিগ্ ছুটাছুটি শুরু করল। আলী হোসেন মাষ্টার এক সময় সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন । এবার তারা বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে মানুষের হাঁস, মুরগী, গরু খাসি ইত্যাদি নিয়ে যেতে লাগল। রাস্তা-ঘাটে যেখানে যাকে পাচ্ছে বেদম মারধর করতে লাগল । বাড়িতে বাড়িতে এসে তারা ইপিআর (ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস) এর সদস্যদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বলতে লাগল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নারী নির্যাতনের লোমহর্ষক সংবাদও ভেসে আসতে লাগল। জানমালের ভয়ে শহরের মানুষ গ্রামে, গ্রামের মানুষ অধিকতর নিরাপদ স্থানে সরে পড়ার প্রাণান্তকর চেষ্টায় মেতে উঠল। আলমদের গ্রামের পরিবারগুলো একে একে কর্ণফুলীর পূর্ব পাড়ে সরে পড়তে লাগল। যারা তখনো গ্রামে কোন দিকে সরতে পারে নি তারা অনুক্ষণ জান মালের আশঙ্কা নিয়ে কালাতিপাত করতে লাগল। পাঞ্জাবী সৈন্যরা প্রায়শঃ বাড়ি বাড়ি হানা দেওয়া শুরু করল। সর্বাপেক্ষা বিপদগ্রস্থ হলো সে পরিবারগুলো, যাদের ঘরে সোমত্ত মেয়ে আছে।
২৭শে এপ্রিল, মঙ্গলবার । রাত তখনো গভীর হয়নি। এক সাথে কটাকট কটাকট অনেক বুটের আওয়াজ শুণে আলমদের বাড়ির সকলে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে বাড়ির সীমানা বেড়ার উপর দিয়ে দুরু দুরু বুকে প্রত্যক্ষ করল। চাঁদের আলোতে পরিস্কার দেখতে পেল তারা-এক দল পাক সেনা মার্চ করে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কোথায় হানা দেবে তারা? সবার চোখে মুখে এ জিজ্ঞাসা। কিছুক্ষণের মধ্যে সেশব্দ মিলিয়ে গেলেও সবাই নির্বাক হয়ে বসে রইল। আলমদের বাড়ির সামান্য দক্ষিণে গিয়ে চাটি হালদা রোড ধরে কিছু পশ্চিমে গিয়েই নাপিত পাড়া ঘেরাও করল পাকিস্তানী সৈন্যরা। পাড়ার সকল পুরুষকে নিরাপদে চলাচলের জন্য পাশ দিবে বলে ঘর থেকে ডেকে বের করে জড়ো করল। অতঃপর তাদের সবাইকে নিয়ে গেল বিমান বন্দরে। বুটের শব্দে আবারো হতচকিত হল আলমদের বাড়ির সবাই। সামনে-পেছনে গার্ড দিয়ে পাক সেনারা যখন তাদের নিয়ে যাচ্ছিল, তখন বেড়ার উপর দিয়ে আলমদের বাড়ির সবাই সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল। সবিস্ময়ে তারা দেখল, সেনাদের মধ্যে অনেক সাদা পোশাকের লোক। তারা যে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিশ্বাস করেছিল তা নয়। কিন্তু অস্ত্রের মুখে যাওয়া ছাড়া তাদের কোন গত্যন্তর ছিল না। সারা রাত গ্রামের মানুষরা আর ঘুমাতে গেল না। তারা যখন নানা জল্পনা কল্পনা নিয়ে বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছিল, তখন মধ্য রাতে এক ঝাক গুলির শব্দে গ্রামবাসি আবার হতচকিত হলো। ঐদিন মধ্য রাতে জিরো পয়েন্ট নামক রানওয়ের মাথায় তাদের হাতে কবর খুঁড়িয়ে সে কবরের পাড়ে দাঁড় করিয়ে তাদের হত্যা করা হল। মধ্য রাতে প্রচণ্ড গুলির শব্দে গ্রামের সবাই বুঝতে পারল তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে। এক সাথে এভাবে ৩৫/৪০ জন মানুষকে হত্যা করে তাদের খোঁড়া কবরে তাদের মাটি চাপা দেওয়া হল। এ নির্মম গণহত্যার পর গ্রামের মানুষ প্রচণ্ড ভাবে বিচলিত ও ভীত সন্ত্রস্থ হোয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাতে লাগল। বিমান বন্দর এর রানওয়েতে প্রচুর মানুষকে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়েছে বলে কিছু কিছু প্রত্যক্ষ দর্শীর বিবরণ ও পাওয়া যেতে লাগল। আলমদের পরিবারও গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবতে লাগল। আলমের বাবা আবার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। তাই তার পরিবারের অবস্থা ছিল আরো বিপদজনক। পোটলাপুটলি বেঁধে একদিন তাদের পুরো পরিবার গৃহত্যাগ করল।
সাম্পানে করে তারা যখন নদী পার হচ্ছিল, তখন বিষন্ন নীরবতায় পরিবারের সবার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অবিরল অশ্র“ ধারা। নৌকা একসময়ে তীরে ভিড়ল। একে একে সবাই নৌকা থেকে নামল। সঙ্গে নেওয়া পুটলাপুটলি কেউ হাতে কেউ মাথায় নিয়ে যাত্রা শুরু করল। কর্ণফুলীর তীর ঘেষে জুলধা নামক গ্রাম। সেগ্রামের এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিল আলমদের পরিবার। প্রতিদিন সকাল-সন্ধায় নদী তীরের বেড়ি বাঁধে এসে বসে থেকে আলম অপলক নেত্রে চেয়ে থাকত তার সে গ্রামের দিকে, যেখানে তার সূতিকাগার, যার কাঁদা মাটিতে গড়াগড়ি করে শিশুকাল পার করে কৈশোরে উত্তীর্ণ হয়েছে আলম। মাঝে মাঝে পাক-নৌ-সেনাদের গান বোট সশব্দে এগিয়ে যেতে দেখে কায়মানো বাক্যে প্রার্থনা করত, হায়! আল্লাহ, গানবোটটা ডুবে যাক। অত্যাচারী পাক-নৌ সেনারা ডুবে মরুক। অবশ্য আলমের সে প্রার্থণা কোনদিন কবুল হয় নি। নিজের সূতিকাগারের টান মানুষ বেশী দিন এড়াতে পারে না। তাই তুলনামূলক নিরাপদ হলেও আলমের পরিবার বেশী দিন থাকতে পারল না ডাঙ্গার চরে। মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে তারা ফিরে আসল স্ব-ভূমি পতেঙ্গাতে। তত দিনে পতেঙ্গার বিমান বন্দর সংলগ্ন মাইজ পাড়া প্রায় জনশূণ্য বিরানভূমি হোয়ে গেছে। ইতোমধ্যে “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেনদ্র” চালু হয়ে গেছে । মানুষ লুকিয়ে লুকিয়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র শুণছে। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের খবর প্রচার করছে । পরম উৎসাহে সে সমস্ত সংবাদ শুণছে মানুষ। আলমের মনে নানা প্রশ্ন কারা এ মুক্তিযোদ্ধা ? কিভাবে তারা অস্ত্র চালনা শিখল? কোথায় তারা অস্ত্র পেল? আলমের বাবা এবং চাচার কাছে প্রচুর লোক আসত। তারা ফিস ফিস করে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলত। আলম আড়ি পেতে সে সমস্ত কথা শুণত । সে বুঝতে পারে তার বাবা-চাচা মুক্তিযুদ্ধে লোক পাঠানোর কাজে জড়িত আছে। ইস মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পথ তার যেন কত কাছে। সে আঁড়ি পেতে পেতে কোন কোন পথে মুক্তিযোদ্ধারা ওপারে যাচ্ছে তা শুণে শুণে মুখস্থ করে নিল । অতঃপর কাউকে কিছু না বলে একদিন পাড়ি জমাল শত্রু“ হননের জিঘাংসা বুকে নিয়ে।